বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। দেশ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। অতঃপর আসে পৈশাচিক ২৫ মার্চ। ২৫ মার্চ রাত একটা নাগাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যা শুরু হয়। ওই রাতের হত্যাযজ্ঞ, দমন-পীড়ন সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ে। পশুশক্তির তাণ্ডব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য চলে যাই ভারতে। ভারতে যাওয়ার আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল, যদি কোনোভাবে দেশমাতৃকার মুক্তির লড়াইয়ে নিজেকে শামিল করতে পারি। সেখানে গিয়ে জানতে পারি, শিল্পী কামরুল হাসান, শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার, শিল্পী নিতুন কুন্ডু, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, শিল্পী নাসির বিশ্বাস, শিল্পী প্রাণেশ মণ্ডলসহ অনেকেই এসেছেন। আরও এসেছেন অনেক সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ। যে যেভাবে পারছেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করছেন।

শিল্পী কামরুল হাসান কলকাতায় পৌঁছেছেন, এই সংবাদ পেয়ে তাজউদ্দীন আহমদ তাঁকে ডেকে পাঠান। তিনি তাঁকে বলেন, ‘কিছুদিনের মধ্যেই প্রবাসী সরকার গঠিত হচ্ছে। আপনাকে একটা দায়িত্ব পালন করতে হবে। ৮ থিয়েটার রোডে আমাদের প্রধান কার্যালয়। প্রবাসী সরকার গঠিত হলে তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের অধীনে আর্ট ও ডিজাইন সেন্টার গড়ে তোলা হবে। আপনি এই বিভাগের পরিচালকের দায়িত্বে থাকবেন।’

সরকার গঠিত হওয়ার পর যথারীতি আর্ট ও ডিজাইন সেন্টারের কাজ শুরু হলো। কামরুল হাসানের অধীনে শিল্পী নিতুন কুন্ডু, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, শিল্পী নাসির বিশ্বাস, শিল্পী প্রাণেশ মণ্ডল ও আমি ডিজাইনার হিসেবে যোগদান করলাম। নিয়মিত কাজ শুরু হলো। অফিস-সময় যথারীতি সকাল ১০টা থেকে বিকেল পাঁচটা।

শিল্পী কামরুল ভাই আমাদের সবাইকে নিয়ে আলোচনায় বসলেন। তিনি বললেন, ‘সারা দেশ এখন মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। আমরা শিল্পীসমাজ এ যুদ্ধ থেকে বিচ্ছিন্ন নই। আমাদের রংতুলিই এখন আমাদের হাতিয়ার। মুক্তিযোদ্ধাদের মনে দেশমাতৃকার জন্য যুদ্ধের উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি করাই এখন আমাদের কর্তব্য।’ তিনি আরও বলেন, ‘মনোগ্রাম, পোস্টার, কাটু‌র্ন, লিফলেট, ব্যানার, নকশা ইত্যাদির মাধ্যমে দেশে ও বহির্বিশ্বে জনমত সৃষ্টি করাই এখন আমাদের প্রধান কাজ।’ কামরুল হাসানের নির্দেশনা মোতাবেক আমরা কাজ শুরু করলাম। আমরা সবাই কিছু কিছু পোস্টারের নকশা তৈরি করতে থাকলাম। কামরুল ভাইও কিছু খসড়া তৈরি করতে লাগলেন। একদিন সবাইকে ডেকে তিনি কিছু ছোট ছোট ড্রয়িং দেখালেন। তার ভেতর তিন থেকে চারটি ড্রয়িং ইয়াহিয়ার মুখমণ্ডলের আদলে তৈরি। দেখে মনে হলো, হিংস্র দানবরূপী ইয়াহিয়া খানের একটি মুখাবয়ব।

আমরা সবাই এই কাটু‌র্ন ড্রয়িংটিকে পোস্টার করার জন্য বললাম। কামরুল ভাই বললেন, ‘এটা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আরও কাজ বাকি।’ সেখান থেকে দুটি ড্রয়িং নিয়ে আরও দু-তিনবার এঁকে তিনি পোস্টারটি তৈরি করেন, রংতুলির মাধ্যমে আরও বোল্ড ব্রাশিং করে লাইনের মাধ্যমে দানবমূর্তির রক্তচোষা অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুললেন। কয়েকবার পরিবর্তন-পরিবর্ধনের পর এটি হয়ে ওঠে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিযুদ্ধের পোস্টার। গণহত্যাকারী, ধর্ষক ও লুণ্ঠক চরিত্রের পাকিস্তানিদের প্রতিভূ রূপে ইয়াহিয়ার এই দানবচিত্র সহজেই একটি প্রতীকী অবয়ব অর্জন করেছিল। পোস্টারটি আঁকা শেষ হওয়ার পর এর শিরোনাম কী হবে, তা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা হলো। আমাদের কথাবার্তা থেকে একটি শব্দ বের হয়ে এল, ‘জানোয়ার’। কামরুল ভাই বললেন, ‘পেয়ে গেছি।’ পোস্টারটির নাম হবে ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’। কামরুল ভাই আমাকে দায়িত্ব দিলেন শিরোনাম লেখার জন্য। আমি সেই দায়িত্ব গুরুত্বসহকারে পালন করলাম। পোস্টারটি হয়ে উঠল পৃথিবীর ইতিহাসে নিষ্ঠুরতম গণহত্যার প্রতিবাদে অঙ্কিত এক অনন্য শিল্পকর্ম। পাকিস্তানি হানাদারদের নৃশংস বর্বরতার বিরুদ্ধে এতে মূর্ত হয়ে উঠেছিল পুঞ্জীভূত ঘৃণা আর প্রজ্বলন্ত প্রতিশোধস্পৃহা।

শিল্পী কামরুল হাসান মূলত দুটি পোস্টার করেছিলেন। একটি ছিল রক্তচোষা মুখমণ্ডল, হাঁ-করা মুখে দুই দিকে দুটো দানবিক দাঁতে লাল রক্ত ঝরছে। বড় দুটো চোখ আর খাড়া বড় কান দেখলেই মনে হয় রক্তপায়ী এক দানব।

আরেকটি পোস্টারে ছিল সম্মুখ দিকে তাকানো বড় বড় রক্তচক্ষু, কান দুটো হাতির কানের মতো খাড়া। মুখ কিছুটা বন্ধ। ঠোঁটের দুই দিকে খোলা, দুই দিকে চারটি দাঁত বের করা। দেখেই মনে হয়, দানবরূপী ইয়াহিয়া খানের মুখাবয়ব। পোস্টারটির ভেতর শিল্পীর রূপকল্পনার গভীরতা ছিল, কলম ও তুলির দক্ষ আঁচড় ছিল আর সবচেয়ে মারাত্মকভাবে যা ছিল, তা হলো শত্রুর প্রতি গভীরতম ঘৃণা। এই ঘৃণাই প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার ভেতর সঞ্চারিত হয়ে গিয়েছিল। এযাবৎকাল যুদ্ধের যত পোস্টার আমরা দেখেছি, এতটা ঘৃণা সঞ্চারকারী এবং ক্রোধ উদ্রেককারী দ্বিতীয়টি দেখিনি।

এ পোস্টার দুটোর একটি দুই রঙে ও অন্যটি একরঙে করা হয়। দুটো পোস্টারই ছাপিয়ে মুক্তাঞ্চলে বিতরণ করা হয়। এর মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে যেমন তীব্র ধিক্কার ও প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়, তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের মনে দেশমাতৃকার জন্য যুদ্ধের উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়।

২০‌র্ ‌র্ ×৩০‌র্ ‌র্ সাইজে সাদা কাগজে মুদ্রিত পোস্টারটি মুজিবনগর থেকে ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগের মাধ্যমে পৃথিবীর বহু দেশে পাঠানো হয়েছিল। দেশে-বিদেশে পোস্টার দুটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের এটি যে কত বড় মারণাস্ত্র হয়ে শত্রুকে আঘাত করেছিল, সে কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।

মুক্তিযুদ্ধকালে আরও পোস্টার আমরা করেছিলাম। সেগুলো হলো: ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্িরষ্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি’, ‘সদা জাগ্রত বাংলার মুক্তিবাহিনী’, ‘বাংলার মায়েরা মেয়েরা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা’, ‘একেকটি বাংলা অক্ষর অ আ ক খ একেকটি বাঙালির জীবন’, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’, ‘রক্ত যখন দিয়েছি আরও রক্ত দেব’—এ রকম অসংখ্য পোস্টার ও লিফলেট প্রবাসী সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। শিল্পীদের আঁকা পোস্টার দেখে দর্শক ও মুক্তিযোদ্ধাদের মন আবেগে আপ্লুত হয়েছে। প্রতিরোধ-চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়েছে। যুদ্ধতাড়িত ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ওই সৃজনশিল্পীদের কাজে বাংলাদেশের অগ্নিগর্ভ সময়ের অভিজ্ঞতা ও চিন্তাধারা দুয়েরই প্রতিফলন ঘটেছিল।

বীরেন সোম: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ সরকারের আর্ট ও ডিজাইন সেন্টারের শিল্পী

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১২ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত