বিজ্ঞাপন
default-image

তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকা ছাড়লেন। এরপর সীমান্ত পেরোনো, প্রবাসে রাজনৈতিক নেতাদের সমন্বয়, ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ, মুজিবনগর সরকার। ইতিহাস পাল্টানো সেসব দিনে তাজউদ্দীন আহমদের নিত্যসঙ্গী আমীর-উল ইসলামের স্মৃতিচারণ

১৯৭০ সালের নির্বাচনে উভয় পরিষদে (পাকিস্তান গণপরিষদ ও পাকিস্তান আইন পরিষদ) নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করার পর ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে লাখো মানুষের সমাবেশে বঙ্গবন্ধু জনপ্রতিনিধিদের ছয় দফাভিত্তিক সংবিধান প্রণয়নে অনুগত থাকার জন্য শপথ পাঠ করান।

১৫ ফেব্রুয়ারিতে সংসদীয় দলের সভায় বঙ্গবন্ধুকে গণপরিষদের নেতা ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপনেতা নির্বাচিত করা হয়। একই সভায় অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে চিফ হুইপ এবং আবদুল মান্নান ও আমাকে হুইপ নির্বাচিত করা হয়।

ইয়াহিয়া খান ঢাকায় ৩ মার্চ গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন।

ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু ড. কামাল হোসেন ও আমাকে ছয় দফাভিত্তিক সংবিধান রচনা করার দায়িত্ব দেন। ছয় দফার অর্থনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য দুটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও তাদের সমন্বয় এবং বৈদেশিক মুদ্রা ও বৈদেশিক বাণিজ্যে উভয় পাকিস্তানের ক্ষমতার সমন্বয় সাধনকল্পে পরামর্শ গ্রহণের জন্য ড. নূরুল ইসলাম, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, অধ্যাপক মুশারফ হোসেন, ড. স্বদেশ বোস ও আনিসুর রহমানের পরামর্শ নেওয়া হতো।

বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদ প্রায়ই আওয়ামী লীগ অফিস থেকে বেরিয়ে আমাদের সঙ্গে সময় দিতেন। আমরা সে সময় মতবিনিময় ও বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের পরামর্শ নেওয়ার সুযোগ পেতাম।

এভাবে কাজ করার পর ছয় দফাভিত্তিক খসড়া সংবিধান যখন চূড়ান্ত হয়েছে, সে সময় ইয়াহিয়া খানের ডাকা ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় গণপরিষদের বৈঠকে পেশ করার আগে পুরানা পল্টনের অফিসে আমাদের খসড়া সংবিধান অনুমোদনের কাজ তখন প্রায় শেষ। পূর্বাণী হোটেলে গণপরিষদের পার্লামেন্টারি পার্টিতে ডাকা উভয় পরিষদের সদস্যদের সমাবেশে যাওয়ার জন্য যখন প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখনই রেডিওতে ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা শোনা গেল। তিনি ৩ মার্চ গণপরিষদের সভা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছেন।

১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর গাড়িতে করে আমরা পূর্বাণী হোটেলে রওনা হলাম। সামনে বঙ্গবন্ধু। পাশে হাজি গোলাম মোরশেদ গাড়ি চালাচ্ছেন। পেছনে ড. কামাল হোসেন ও আমি। আমার কাছে একটি বাঁধানো খাতা। আরেকটি খাতা পূর্বাণী হোটেলে জনপ্রতিনিধিদের উপস্থিতির জন্য।

এরই মধ্যে ঢাকার রাস্তা আর অলিগলি লোকে লোকারণ্য। সরকারি-বেসরকারি অফিসের কেরানি, পিয়ন, কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, দোকানদার, ছাত্র, যুবক থেকে শুরু করে স্টেডিয়ামে পাকিস্তান ক্রিকেট টেস্ট ম্যাচ বন্ধ হয়ে যাওয়া দর্শক-খেলোয়াড় সবাই পল্টন ময়দানে। প্রায় লাখো মানুষের সমাবেশ।

এমন অবস্থায় আমি দ্রুত দুটি প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করে বঙ্গবন্ধুকে দেখালাম। তাতে ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা ছাড়াই সর্বোচ্চ পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করায় নিন্দা প্রস্তাব। পরিবর্তিত অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একক সিদ্ধান্ত দেওয়ার সমস্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়। প্রস্তাবে বলা হয়, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের সকল নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে সর্বময় ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি যে সিদ্ধান্ত দেবেন, তা-ই বাংলাদেশ গণপরিষদের সিদ্ধান্ত বলে গণ্য হবে।’ তিনি যে সিদ্ধান্ত নেবেন, তা-ই এই পরিষদের সিদ্ধান্ত বলে গণ্য করা হবে। মুহুর্মুহু করতালির মাধ্যমে সর্বসম্মতিতে সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়। এরই ভিত্তিতে নির্বাচিত ওই দুটি পরিষদের সদস্যরা গণপরিষদে পরিণত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই পরিষদই বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করে।

পূর্বাণী হোটেল থেকে স্টেডিয়াম পর্যন্ত উপচে পড়া ভিড়। দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের ভিড়ে পূর্বাণী হোটেলের লবি থেকে হোটেল-প্রাঙ্গণ পর্যন্ত উপচে পড়েছে।

স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত নগর।

ছয় দফা না এক দফা/ এক দফা, এক দফা

পিন্ডি না ঢাকা/ ঢাকা, ঢাকা

তোমার আমার ঠিকানা/ পদ্মা মেঘনা যমুনা

তুমি কে আমি কে/ বাঙালি বাঙালি

বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো/ বাংলাদেশ স্বাধীন করো।

এর পর শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু ৩ মার্চে ছাত্র-জনতার সমাবেশে বক্তব্য দেন। ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে তিন লক্ষাধিক মানুষের সভায় তিনি দিলেন তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ। জনগণকে সার্বিক আন্দোলন, অসহযোগ এবং যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানালেন। বললেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’

১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত এই ভূখণ্ডে পাকিস্তান সরকারের কোনো আদেশ কার্যকর ছিল না। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই সবকিছু চলেছে। তখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি হাইকমান্ড তৈরি করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তিনজন সহসভাপতি (সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও খোন্দকার মোশতাক আহমদ), ঢাকায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এবং পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামানকে নিয়ে গঠিত হয় সেই হাইকমান্ড। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সার্বক্ষণিক কাজ করার জন্য তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে কামাল হোসেন ও আমি টাস্কফোর্স হিসেবে কাজ করি। বঙ্গবন্ধুর লাইব্রেরি রুমটিতে টেলিফোন ও একটি লেখার টেবিলে বসে আমি সার্বক্ষণিক কাজ করতাম। ৩ থেকে ২৫ মার্চ এই টাস্কফোর্স থেকেই সব নির্দেশনা তৈরি হতো এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ডি ফ্যাক্টো সরকার তখন থেকেই কাজ করছিল।

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ থেকে ৩০ মার্চের মধ্যে পায়ে হেঁটে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আমার ভারতে প্রবেশ, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সফল বৈঠক এবং ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন ও স্বাধীনতার অপরিহার্যতা বর্ণনা করে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রণয়ন—এসব ঘটনা আমাকে আজও রোমাঞ্চিত করে।

মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নামে এবং বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারণ করে। একাত্তরে মুক্ত মুজিবের চেয়েও বন্দী মুজিব আরও অনেক বড় অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছিলেন। মুজিবনগর সরকারের বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা, সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত, ভারতের সরকার ও জনগণ এবং বিশ্বের প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষের অকুণ্ঠ সাহায্য ও সমর্থনে মাত্র নয় মাসে স্বাধীন হলো বাংলাদেশ। বীর মুক্তিযোদ্ধারা একের পর এক সাহসী ও বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মুক্ত করেছেন বাংলার প্রতিটি প্রান্তর। স্বাধীনতার জন্য, এ যুদ্ধে জেতার জন্য জনগণ এক অতুলনীয় ত্যাগ ও তিতিক্ষার উদাহরণ রেখেছে। ৩০ লাখ লোক শহীদ হয়েছেন। দুই লাখ মা-বোন হয়েছেন ইতিহাসের নজিরবিহীন ঘৃণ্য ও পাশবিক নির্যাতনের শিকার। এর বিনিময়ে আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা।

এক অজানা পথে

২৫ মার্চ ১৯৭১। একটি ভয়াল রাত। বাঙালির ঐক্যবদ্ধভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর একটি চরম মুহূর্ত। পাকিস্তানি বাহিনীর ছোড়া কামান ও বোমার আঘাতে ঢাকার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠছিল। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতায় ছিল সেই নির্দেশনা, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়—তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’ ওই রাতেই আমি ও তাজউদ্দীন সাহেব লালমাটিয়ায় পূর্ব বাংলা রেলওয়ের সাবেক চিফ ইঞ্জিনিয়ার গফুর সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় নিই।

২৭ মার্চ আমরা ঢাকার সীমানা পার হয়ে যাই। মুক্তাঞ্চলে তাজউদ্দীন আহমদ ও আমি হেঁটে চলেছি বিরতিহীন। দেখেছি, মানুষের চোখে-মুখে ক্ষোভ, তবে অন্তরে প্রতিরোধের দৃঢ় মনোবল। এ যুদ্ধ যেন মানুষের দৃষ্টিকে বদলে দিয়েছিল এক অলৌকিক ছোঁয়ায়—আমরা সবাই এক স্থির গন্তব্যের দিকে ধাবমান। আমরা সম্বলহীন ছিলাম, কিন্তু অসহায়ত্বের কোনো বেদনা আমাদের সেদিন স্পর্শ করতে পারেনি। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সবার মধ্যে ছিল সম্মিলিত ও সুতীব্র এক ঘৃণা এবং প্রত্যেকের চোখে-মুখে ছিল সুদৃঢ় প্রত্যয় ও বিশ্বাস—সব বাধা অতিক্রম করে সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দাঁড়ানোর হিমালয়সম অটল সংকল্প।

মার্চ মাসের শুরু থেকেই অফিস-আদালত, হাট-বাজার, পুলিশ, প্রশাসন—সবকিছু আমাদের সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে চলছে। সংগ্রাম পরিষদ অস্ত্র, গোলাবারুদসহ সবকিছু তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। ১ মার্চ ১৯৭১ থেকে কার্যত যে সরকার সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার নির্দেশেই সবকিছু চলেছে। বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতি আন্তরিক আনুগত্য ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রশ্নের অতীত। ইতিমধ্যে আর্মড ফোর্সেস, পুলিশ, ইপিআর, আনসার বাহিনী বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে গঠিত সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে সব শ্রেণির মানুষ তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে যে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়েছিল, তাদের নেতৃত্বে স্থানীয়ভাবে কাজ করার অভ্যাসটি ৭ মার্চের পর থেকেই সংঘবদ্ধ প্রতিরোধে রূপ নিয়েছে। আমাদের যাত্রাপথে ঢাকা থেকে জিগাতলা, কেরানীগঞ্জ, দোহার হয়ে পদ্মার চরে, ফরিদপুর, কামারখালী, মাগুরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা—সর্বত্র সবারই দাবি, বাংলাদেশ সরকার গঠন করো। পথে চলতে গ্রামগঞ্জে, হাটে-লোকালয়ে আমাদের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যেও একই মনোভাব। কোথাও এর কোনো ব্যত্যয় লক্ষ করিনি। সবার সঙ্গে আলোচনা করে আমরা এ উপলব্ধি ও সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম যে এই মুহূর্তে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম একটি কার্যকর ও বৈধ সরকার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

ওই মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর একটা কথা বারবার মনে পড়ছিল। তিনি বলেছিলেন, আমি সব তৈরি করে রেখে যাব। ২৫ মার্চ পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি অফিসারসহ সেনাবাহিনী, ইপিআর পুলিশ বিদ্রোহ করে। সঙ্গে যোগ দেয় আনসার, স্বেচ্ছাসেবক, যুবক, তরুণ রাজনৈতিক নেতা-কর্মী। ফলে ২৫ মার্চের রাতেই মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। দৃশ্যত মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আর ঢাকার মানুষের চলাচল গণমিছিলের মতো গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে, ছড়িয়ে পড়ছে নিজ নিজ এলাকায়। নিজ দেশের মাটিতে, নিজ শহর ও রাজধানী থেকে বিতাড়িত হয়ে প্রতিটি মানুষ একেকটি বিস্ফোরণোন্মুখ আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হচ্ছে। দেশের মাটিকে খাঁটি জেনে প্রাণপণ লড়াইয়ের মানসিক প্রস্তুতি তাদের চোখে-মুখে দৃপ্ত। কান্না নেই, হাহাকার নেই। প্রতিবাদ আর প্রত্যয়ে সুদৃঢ় মুখাবয়ব, প্রতিটি মানুষই একেকটি বিপ্লবের প্রতিচ্ছবি। বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুর নানা কথার, ৭ মার্চের ভাষণে প্রদত্ত স্বাধীনতার বার্তারই যেন প্রতিফলন দেখছি চারপাশে। নয় মাসের যুদ্ধের পুরো সময়েও আমরা সেটাই দেখেছি।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা

বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের বক্তৃতায় স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক গ্রাম প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এর মাধ্যমে যা কিছু বলার সবই বলা হয়েছিল। বাংলাদেশের আবালবৃদ্ধবনিতা জানত, বাঙালির ওপর আক্রমণ করলে কী করতে হবে।

অসহযোগ আন্দোলনের সময় দেশের সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ বঙ্গবন্ধু ও হাইকমান্ডের নির্দেশে পরিচালিত হতো। তখন আমরা বিভিন্ন সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতাম। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে ব্যাংক লেনদেন থেকে শুরু করে সব যোগাযোগ ও আদান-প্রদান বন্ধ করে দেওয়া হয়। শুধু নির্দিষ্ট সময়ে সাংবাদিকদের খবর পাঠানোর জন্য টেলিযোগাযোগ চালু করা হতো। ব্যাংক, বিমা, চেম্বার, রেল, ব্যবসায়ী নেতারা, শ্রমিক সংগঠন থেকে সব স্তরের সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছি। তাদের সঙ্গে কিছু বৈঠক হতো মতিঝিলে, কিছু ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে আর কোনো কোনো বিশেষ বৈঠক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের পাশে বেগম বদরুন্নেসা আহমেদের বাসায়। বেতার ও টেলিযোগাযোগের বিষয়গুলো নিয়ে ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হকের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হতো বেগম বদরুন্নেসার বাসায়।

সম্ভবত ১৮ বা ১৯ মার্চ, ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হক (খোকা ভাই) আমাকে বললেন, বঙ্গবন্ধু তাঁকে একটা ট্রান্সমিটার জোগাড় করতে বলেছিলেন। সেটা তিনি নিয়ে এনেছেন। এখন এটা কোথায় পৌঁছে দিতে হবে? তিনি আরও বললেন, ‘এ ট্রান্সমিটারটি পুরোনো। অনেক দিন থেকে খুলনাতে পড়ে ছিল। সবাই এটার কথা ভুলেই গেছে।’ অফিস রেজিস্ট্রিতেও এর হদিস ছিল না। তবে সেটি তিনি সারিয়ে সচল করে তুলেছেন।

নূরুল হক সে সময় ইস্টার্ন ওয়্যারলেস ডিভিশন অ্যান্ড ট্রান্সমিটিং স্টেশনের প্রধান। ২৫ মার্চ বেলা দুইটার দিকে আমি দুপুরের খাবার খেতে বাসায় গিয়েছি। গিয়ে দেখি, নূরুল হক সাহেব বাসায় ঢুকছেন। তিনি বললেন, আজকেই একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। আমাকে তিনি খুব সাবধানে থাকতে বললেন। আরও বললেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না, আমার এখন করণীয় কী। এটা নিয়ে আমি এখন কী করব।’ তিনি আরও বললেন, ‘আজকের দিনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মনে হচ্ছে, একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে।’

আমি খোকা ভাইকে বললাম, ‘বঙ্গবন্ধু বলে দিয়েছেন তোমাদের যার যা আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করবে।’ আমার কাছে কলম আছে, সংগঠন আছে। আমি এগুলো দিয়ে মোকাবিলা করব। আপনার কাছে ট্রান্সমিটার আছে, ইঞ্জিনিয়ারিং বুদ্ধি আছে, আপনি ওটা দিয়েই মোকাবিলা করবেন। আমি কি আপনাকে লিখে দেব ট্রান্সমিটারে কী বলতে হবে? উনি বললেন, তার প্রয়োজন হবে না। আমি জানি, কী বলতে হবে। একধরনের আত্মবিশ্বাসের ভঙ্গিতে অথচ নির্লিপ্তভাবে তিনি যেন নিজেকে নিজে শুনিয়ে বললেন, ‘আই নো হোয়াট ইজ টু বি ডান। ইট মে কস্ট মাই লাইফ, বাট ইট মে বি ওয়ার্থ ডুইং অ্যান্ড আই উইল ডু ইট।’

২৫ মার্চ মধ্যরাতে এক ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর বাসায় ফোন করেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ওই ব্যক্তি ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হক। হাজি গোলাম মোরশেদের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। হাজি গোলাম মোরশেদ বললেন, আপনি কে? উনি পরিচয় না দিয়ে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে জানান যে আমি বলধা গার্ডেন থেকে বলছি। আমি মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন মেশিন কী করব?’

বঙ্গবন্ধু তখন পাশেই ছিলেন। তিনি হাজি গোলাম মোরশেদকে বললেন, ‘তাঁকে বলো, কাজ শেষ করে মেশিন ভেঙে পালিয়ে যেতে।’ আমার বিশ্বাস, নূরুল হক খুলনা থেকে আনা ট্রান্সমিটারে এই রাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার বার্তা পাঠিয়েছিলেন। ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হক ব্রিটিশ আমলের ওয়্যারলেস ইঞ্জিনিয়ার। তিনি শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর যত ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক—সবই তাঁর নিজের তৈরি। রানি এলিজাবেথ ১৯৬০-এর দশকে যখন ঢাকা আসেন, তাঁর জন্য তৈরি করা রমনা পার্কের সামনের বাড়িটি ছিল ১৯৭২ সালের প্রথম গণভবন। ওই ভবনে তিনি রানি এলিজাবেথের জন্য স্থাপন করে দেন একটি ওয়্যারলেস যোগাযোগ ব্যবস্থা। তার মাধ্যমে তিনি বাকিংহাম প্যালেসের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতেন।

পাকিস্তান সরকার নেপালকে ওয়্যারলেস সিস্টেম স্থাপনে সহায়তা করার জন্য ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হককে সেখানে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে নেপালের আধুনিক ওয়্যারলেস ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিভা, দক্ষতা ও যোগ্যতার জন্য সে সময়ে সরকার তাঁকে ‘তমঘা-ই-পাকিস্তান’ উপাধিতে ভূষিত করে। মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের সময় তিনি সে খেতাব প্রত্যাখ্যান করেন। খবরের কাগজে এ খবর তখন ছাপা হয়েছিল। ২৫ মার্চের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ট্রান্সমিটার খঁুজতে নূরুল হকের ওয়্যারলেস কলোনির বাসা ঘেরাও করে। ২৬ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত পাকসেনারা তাঁকে নানা জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং নজরদারিতে রাখে। তাঁর বাড়িতে তল্লাশি চালায়। ২৯ মার্চ সকালে নূরুল হককে পাকসেনারা তাঁর বাসা থেকে নিয়ে যায়। তিনি আর ফিরে আসেননি।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ওয়্যারলেসে ইংরেজিতে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়। এ বিষয়ে লন্ডনের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক ও দক্ষিণ এশিয়া করেসপন্ডেন্ট ডেভিড লোশাক লিখেছেন, ঘোষণাকারীর গলার আওয়াজ খুব ক্ষীণ ছিল। খুব সম্ভবত ঘোষণাটি আগেই রেকর্ড করা ছিল। উল্লেখ্য, ডেভিড লোশাক প্রথম বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন। উইটনেস টু সারেন্ডার বইয়ে কর্নেল সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, এই ঘোষণাটি তাঁর ট্রান্সমিটারে ধরা পড়েছিল।

২৫ মার্চ রাতে জীবনের সব ঝুঁকি অবজ্ঞা করে হাজি গোলাম মোরশেদ ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে থেকে যান। বঙ্গবন্ধু আমাকে ও কামাল হোসেনকে যখন বিদায় দেন, হাজি গোলাম মোরশেদ তখনো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে আছেন। সেই রাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তিনিও গ্রেপ্তার হন। সেখানে তাঁর ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। নির্যাতনের সময় তাঁকে ‘মুজিব কা সেক্রেটারি, মুজিব কা ড্রাইভার’ বলে পেটানো হতো। দীর্ঘদিনের অমানবিক নির্যাতনের পর মুমূর্ষু অবস্থায় তিনি ২৫ নভেম্বর মুক্তিলাভ করেন।

২৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার খবর সব জেলা ও মহকুমা প্রশাসকদের কাছে পৌঁছে যায়। লিফলেট আকারে সেসব প্রচার করা হয়। আমি যখন তাজউদ্দীন ভাইকে নিয়ে চুয়াডাঙ্গা পৌঁছেছি, দেখি, সেখানে হাজার হাজার মানুষ যোদ্ধায় পরিণত হয়েছে। বুঝতে পারলাম, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা এখানেও পৌঁছে গেছে। তাজউদ্দীন আহমদসহ আমি যখন ভারতে প্রবেশ করি, তখন বিএসএফের কাছ থেকে আমরা জানতে পারি, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা তাদের ওয়্যারলেসেও ধরা পড়েছে। তার একটা কপি আমাকেও দেওয়া হলো। দিল্লিতে যখন চট্টগ্রামের এম আর সিদ্দিকের সঙ্গে দেখা হয়, তাঁকে ওই কপিটা দেখাই। তিনি বললেন, চট্টগ্রামে তাঁরা এ ঘোষণাটাই পেয়েছেন। প্রত্যেক সীমান্তে এই বার্তাটি পাঠানো হয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হক সাহেব এ কাজটি করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা ওয়্যারলেস ট্রান্সমিটারসহ নানাভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ভিত্তিতেই পরে আমরা প্রস্তুত করেছিলাম স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। তাতে বলা হয়, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন...।’ বাঙালি জাতির পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করার একমাত্র অধিকার ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। তিনিই ছিলেন বাঙালি জাতির বৈধ প্রতিনিধিদের দেওয়া অর্পিত ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর পক্ষে জনগণের নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট ছিল। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ওই ঘোষণাটিই প্রথম পাঠ করেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হান্নান এবং পরবর্তীকালে মেজর জিয়াউর রহমান।

২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় এ সরকার শপথ নেয়। অথচ কেউ কেউ বলেন, আওয়ামী লীগের কোনো যুদ্ধপ্রস্তুতি ছিল না। ৪ এপ্রিল সিলেটের তেলিয়াপাড়ায় কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানীর নেতৃত্বে বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর জিয়াউর রহমানসহ মুক্তিকামী বহু সেনা কর্মকর্তা। সে সভা থেকে একটি সরকার গঠনের জন্য আমাদের কাছে খবর পাঠানো হয়। ১০ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর প্রথম বেতার ভাষণে বলেন, ‘পাহাড়প্রমাণ লাশের নিচে পাকিস্তানের কবর রচিত হয়েছে। জেগে উঠেছে একটি নতুন জাতি।’

ভারতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিনিধি

৩০ মার্চ বেলা তিনটার দিকে চুয়াডাঙ্গা থেকে আমি ও তাজউদ্দীন ভাই সীমান্তের পথে রওনা হই। প্রথমে আমরা ভারতীয় সীমান্তের বর্ডার আউটপোস্টের (বিওপি) দিকে যাই। সীমান্ত অতিক্রম করার সময় সহকারী হিসেবে আমাদের সঙ্গে ছিলেন মেহেরপুরের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ও ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন। তাঁদের বললাম, আপনারা চেকপোস্টে গিয়ে এ কথাগুলো বলবেন, প্রয়োজনে বারবার বলবেন: ‘স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ের দুজন নেতা ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনার জন্য ভারতে প্রবেশ করতে চান। ভারত সরকার রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আমন্ত্রণ জানালে তারা ভারতে প্রবেশ করতে রাজি আছেন।’

তৌফিক-ই-এলাহী ও মাহবুব বার্তাটি নিয়ে চলে গেলেন ভারতীয় সীমান্ত ফাঁড়িতে। বার্তাটি ছিল খুবই সুচিন্তিত। আমরা জানতাম, ভারতীয় চেকপোস্টে কর্তব্যরত কর্মকর্তা এ বার্তার উত্তর দিতে পারবেন না। কলকাতায় অবস্থিত বিএসএফের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান, এমনকি দিল্লির কমান্ডার ইন চিফও এ বার্তার উত্তর দিতে পারবেন না। এ বার্তার উত্তর দিতে পারবেন একমাত্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উত্তর পেলেই আমরা যাব।

কিছু দূরে একটি জঙ্গলের মধ্যে ছোট্ট খালের ওপর ব্রিটিশ আমলের তৈরি একটি কালভার্ট। কালভার্টের ওপর তাজউদ্দীন ভাই ও আমি বসে আছি। তাজউদ্দীন ভাইকে ক্লান্ত ও বিষণ্ন মনে হলো। তাঁকে বিষণ্নতার কারণ জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, ‘আমি হেরে যাচ্ছি।’

আমি বললাম, ‘আমরা এখন বিজয়ের পথে এগোচ্ছি। নতুন একটি রাষ্ট্রের জন্ম হতে চলেছে। এ মুহূর্তে হেরে যাওয়ার কথা তো খুবই বেমানান। যে সূর্যটি অস্ত যাচ্ছে, এ অস্তগামী সূর্যের সঙ্গে আমাদের পরাধীন যুগেরও সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে। শিগগিরই স্বাধীনতার নতুন সূর্য উঠবে। এমন একটি প্রত্যাশার দুর্লভ মুহূর্তে আপনি বলছেন আপনি হেরে যাচ্ছেন? আমি এ কথার অর্থ বুঝতে পারছি না।’

তিনি বললেন, ‘ছোটবেলায় স্কুলের হিন্দু সহপাঠীরা বলত, তোদের পাকিস্তান টিকবে না। আমি পাল্টা যুক্তি ও নানা উদাহরণ দিয়ে বলতাম, পাকিস্তান অবশ্যই টিকবে। নানা তথ্য ও যুক্তি তুলে ধরে প্রমাণ করতাম যে পাকিস্তান একটা টেকসই রাষ্ট্র হবে। সেসব যুক্তি-তর্কে আমি জিতে যেতাম। সেই আমি আজ হেরে যাচ্ছি।’ ছোটবেলার সহপাঠীদের কথা তাঁর মনে পড়ছে। বাংলাদেশের আকাশে সূর্য ডুবুডুবু। আবার কখন নতুন সূর্যের উদয় হবে, তা ভাবতে ভাবতে আমরা দুজনেই মৌন। ক্লান্তিতে কালভার্টের ওপর শরীর এলিয়ে দিলাম। জঙ্গলের ভেতরে অন্ধকার গাঢ় হয়ে এসেছে। চারদিকে কোনো জনবসতি নেই বললেই চলে।

বেশ অনেকটা সময় পরে আবছা অন্ধকারে মানুষের পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। তাজউদ্দীন ভাইকে ডেকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। শব্দটা ক্রমে আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। আগন্তুকেরা কাছে এসেই হাতের অস্ত্র উঁচু করে সামরিক কায়দায় আমাদের অভিবাদন জানালেন। কর্মকর্তাটি বললেন, ‘স্যার, ইউ আর কর্ডিয়ালি ইনভাইটেড টু ভিজিট আওয়ার ক্যাম্প।’ বিদেশি রাষ্ট্রের সম্মানিত অতিথিদের যেভাবে গার্ড অব অনার দিয়ে নিয়ে যায়, আমাদেরও ঠিক সেভাবে আমন্ত্রণ জানানো হলো। পরে জেনেছি, বিএসএফের বিওপি থেকে তৎক্ষণাৎ বার্তা পাঠানো হয়েছিল বিএসএফের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান গোলক মজুমদারের কাছে। তিনি বিএসএফের সর্বভারতীয় প্রধান দিল্লিতে অবস্থিত কে এফ রুস্তমজির সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

বিএসএফের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান আমাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য রওনা হয়ে গেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিএসএফের আঞ্চলিক প্রধান গোলক মজুমদার ছাউনিতে এসে পৌঁছালেন। তিনি জানালেন, হাইকমান্ডের নির্দেশেই তিনি এখানে এসেছেন। মজুমদার বললেন, ‘আপনাদের প্রশ্নের জবাব শুধু একজনই দিতে পারেন; তিনি প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী।’ আমাদের আশ্বস্ত করে তিনি বললেন, তাঁরা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করে দেবেন। তিনি তাঁর সঙ্গে আমাদের কলকাতা যেতে অনুরোধ করলেন। বললেন, তাঁর পক্ষে এখন কিছু ছোট অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া সম্ভব। প্রতীকী অর্থে সহায়তার জন্য কিছু অস্ত্রও তিনি দিলেন। মাহবুব ও তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীকে সেসব দেওয়া হলো। তিনি বললেন, ‘এখানে আসার আগে আমি দিল্লিতে যোগাযোগ করেছিলাম। আজ রাতেই আপনাদের অভ্যর্থনা জানাতে সেখান থেকে একজন আসছেন।’ তৌফিক-ই-এলাহী ও মাহবুবকে বিদায় জানিয়ে মজুমদারের জিপে করে তাজউদ্দীন ভাই ও আমি কলকাতার উদ্দেশে যাত্রা করলাম।

জিপটা এসে দমদম এয়ারপোর্টের টারমাকে থামল। মজুমদার জানালেন, আমাদের সঙ্গে আলোচনার উদ্দেশ্যে এই ফ্লাইটে দিল্লি থেকে একজন কর্মকর্তা আসবেন। দমদম এয়ারপোর্টে জিপ থেকে নামিয়ে আমাদের অপেক্ষাকৃত বড় কালো রঙের একটি গাড়িতে তোলা হলো। বিমান থেকে ছয় ফুট লম্বা একজন লোক নেমে সোজা আমাদের গাড়িতে এসে উঠলেন। তিনি বিএসএফের সর্বভারতীয় প্রধান কে এফ রুস্তমজি। একসময় ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নেহরুর নিরাপত্তাপ্রধান ছিলেন। সে কারণে নেহরু পরিবার ও ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা। প্রধানমন্ত্রীর তিনি খুবই আস্থাভাজন। পরে জেনেছি, রুস্তমজি গোলক মজুমদারের বার্তা পাওয়ার পর কোনো প্রোটোকল না মেনে সরাসরি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে বলেছিলেন, ‘আপনি নিজে গিয়ে তাঁদের অভ্যর্থনা জানাবেন। তাঁদের দেখে আপনার কাছে খুব “ইমপ্রেসিভ” মনে নাও হতে পারে। বাঙালিরা অত্যন্ত আত্মসচেতন ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ। তাঁদের সঙ্গে আমাদের ব্যবহার যেন উপযোগী হয়।’

গাড়িতেই শুরু হলো আলোচনা। রুস্তমজির প্রথম প্রশ্ন, বঙ্গবন্ধু কোথায়? এটা গোলক মজুমদারেরও প্রথম প্রশ্ন ছিল। এরপর আরও অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে। সবারই প্রথম প্রশ্নই ছিল, বঙ্গবন্ধু কেমন আছেন? এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমরা তৈরি ছিলাম। মুক্তিযোদ্ধাসহ দলীয় নেতারা সবার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর অবস্থানের ব্যাপারে একটি উত্তরই আমরা দিয়েছি। আমরা বলতে চেয়েছি, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী যুদ্ধ পরিচালনা করা হচ্ছে। তিনি জানেন, আমরা কোথায় আছি। তিনি আমাদের দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছেন।

রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথিশালা ‘অসম ভবনে’ আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হলো। একটি ঘরে আমি আর তাজউদ্দীন ভাই, অন্য ঘরে রুস্তমজি। আমরা খুবই ক্লান্ত। আমাদের কাপড়চোপড়ের অবস্থাও একেবারে শোচনীয়। গোসল করা প্রয়োজন। সঙ্গে অতিরিক্ত কোনো কাপড় নেই। রুস্তমজি আমার পরিধেয় বস্ত্রের অভাবের কথা জেনে তাঁর ইস্তিরি করা পায়জামা আর কোর্তা দিলেন। ছয় ফুট লম্বা একজন মানুষের কোর্তা সামাল দেওয়া আমার পক্ষে কষ্টকর হয়ে দাঁড়াল। দেখলাম, পায়জামার দরকার নেই, শুধু কোর্তা হলেই চলে। কে এফ রুস্তমজি তাঁর লেখা দ্য ব্রিটিশ, দ্য ব্যান্ডিটস অ্যান্ড দ্য বর্ডারম্যান বইয়ে এসবের চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন।

তখন প্রায় মধ্যরাত। গোসল সেরে নিলাম। এত রাতে খাবার পাওয়া কষ্টকর। রুস্তমজি ফৌজি প্রশিক্ষণের অভ্যাস হিসেবে সব সময় নিজের সঙ্গে ভাঁজ করা একটা স্টোভ রাখতেন। ইচ্ছে করলেই সেটা দিয়ে রুটি টোস্ট বা ডিম সেদ্ধ করা যায়। তিনি কয়েকটা রুটি টোস্ট ও ডিম সেদ্ধ করে দিলেন। সঙ্গে গরম চা। সারাটা দিনের পর অত্যন্ত তৃপ্তির সঙ্গে আমাদের আহার হলো। খাওয়ার পর টেবিলের ওপর রাখা একটি মানচিত্রের দিকে আমরা চোখ রাখলাম। কোনো দিন যুদ্ধ করিনি বা যুদ্ধের কথা ভাবিনি। অথচ আজ যুদ্ধের পরিকল্পনায় অংশ নিতে হচ্ছে। রুস্তমজি রণকৌশলী। আমাদের মূল উদ্দেশ্য তাঁকে সংক্ষেপে জানালাম। আজ রাতেই আমাদের অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেই রাতেই পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ প্রধান ও বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের সেখানে আনা হলো। তাঁদের সঙ্গে বৈঠক হলো আমাদের। তাজউদ্দীন আহমদ বিস্তারিতভাবে আমাদের আন্দোলন থেকে শুরু করে সব পরিস্থিতির বর্ণনা দিলেন। সেনানিবাস ছাড়া সবই আমাদের মুক্ত এলাকা। আমরা কী পরিস্থিতিতে এখানে এসেছি, তা-ও সবাইকে বুঝিয়ে বললেন। আমাদের প্রথম কাজ হলো দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা রাজনৈতিক নেতা ও নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের একত্র করে পরামর্শের জন্য তাদের সীমান্তের কাছে নিয়ে আসা। সামরিক বাহিনী, রাইফেলস, আর্মড পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনের সদস্যদের সঙ্গেও যোগাযোগ ও সহযোগিতা গড়ে তোলা দরকার। বিএসএফের বিভিন্ন বিভাগের প্রধানদের এই গভীর রাতে ডেকে আনা হলো। কলকাতা থেকে চুয়াডাঙ্গা টেলিযোগাযোগ এবং দর্শনা পর্যন্ত রেল যোগাযোগ স্থাপন করার আদেশ হলো। চুয়াডাঙ্গায় ডা. আসহাবুল হক তৌফিক ও নূরুল কাদেরের সঙ্গে আলোচনা হলো পরদিন সকালেই। নূরুল কাদের খান পাবনা থেকে কুমারখালী হয়ে সেখান থেকে চুয়াডাঙ্গা এসে পৌঁছেছেন। উভয়েরই দাবি অস্ত্র ও গোলাবারুদের। ট্যাংক নিয়ে এলে যশোর ক্যান্টনমেন্ট আমরা দখল করে নিতে পারি ইত্যাদি। আমরা অবশ্য জানি, যুদ্ধ আন্তর্জাতিকীকরণ হলে স্বাধীনতার সম্ভাবনা সুদূর পরাহত হবে।

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সম্পাদক, এমএনএ, এমপিএসহ নেতাদের একটি তালিকা তৈরি করে তাঁদের সম্ভাব্য অবস্থানের কথা লিপিবদ্ধ করা হলো। এসব নেতার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তালিকাটি পাঠানো হলো বিভিন্ন সীমান্ত ফাঁড়িতে। যশোর সেনানিবাস অবরুদ্ধ। কুষ্টিয়ায় আমরা জয়লাভ করেছি। চুয়াডাঙ্গাও আমাদের শক্ত ঘাঁটি হয়ে উঠেছে। শত্রুর মোকাবিলায় অতি দ্রুত আমাদের সশস্ত্র ও সুসংবদ্ধ হয়ে উঠতে হবে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আমাদের এসব খবর পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন। বিএসএফের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাসহ আমাদের নেতৃবৃন্দের কাছে আমরা নির্দেশ পৌঁছে দিতে শুরু করলাম।

যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের যথাসম্ভব সাহায্য দিতে বিএসএফ রাজি হলো। পরামর্শ করতে করতে রাত প্রায় শেষ হয়ে গেল। আমরা ভোরের দিকে কিছুক্ষণের জন্য বিছানায় গেলাম। ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে গিয়ে শুনলাম রেডিওর শব্দ। বিএসএফের সরোজেন্দু চট্টোপাধ্যায় একটি রেডিও দিয়েছিলেন। রেডিওতে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে আমাদের মা-বোনদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর অত্যাচারের কথা শুনে অজান্তেই চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে এল। সকালে বাথরুমে ঝরনার পানিতে গোসল করার সময়ই সদ্যরচিত একটি গান প্রথম শুনতে পেলাম। গানটি ছিল গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা, অংশুমান রায়ের সুর দেওয়া ও গাওয়া: ‘শোন, একটি মুজিবরের থেকে/ লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি/ আকাশে বাতাসে ওঠে রণি।/ বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।’ বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো দুই চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে ঝরনার পানির সঙ্গে ধুয়েমুছে একাকার হয়ে গেল।

১ এপ্রিল আমাদের দিল্লি যাওয়ার কথা। আমাদের অবস্থান গোপন রাখার জন্য বিএসএফ ও অন্যরা খুবই সাবধানতা অবলম্বন করল। আমাদের কাজ পরিচালনার জন্য প্রয়োজন একটি উপযুক্ত বাড়ি, যেখান থেকে প্রবাসী সরকার কাজ করতে পারবে। এমন একটি অগ্রিম চিন্তা থেকে রুস্তমজি আমাদের নিয়ে গিয়ে দুয়েকটি বাড়ি দেখালেন। প্রথমে যে বাড়িটা দেখালেন, সেটাই পছন্দ হয়ে গেল। বাড়িটি ছিল ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে। সেটিই হয়ে গেল যুদ্ধকালীন সরকারের দপ্তর এবং প্রধানমন্ত্রীসহ আমাদের জন্য নয় মাসের অবস্থান ও মুজিবনগর সরকারের সদর দপ্তর।

সকালে সীমান্তের দিকে গেলাম। খবর অনুযায়ী চুয়াডাঙ্গায় ইপিআরের মেজর ওসমানী অস্ত্রশস্ত্রের একটা তালিকা তৈরি করে নিয়ে এসেছেন। তাঁকে কিছু অস্ত্র দেওয়া হলো। তার মধ্যে এলএমজিও ছিল। ইতিমধ্যে খবর এল, পাকিস্তানি সৈন্যরা যশোর সেনানিবাস থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে। তাঁকে এক্ষুনি যেতে হবে। তিনি সদ্য পাওয়া এলএমজি কাঁধে নিয়ে দ্রুত রওনা দিলেন।

১ এপ্রিল রাতে আমরা গোলক মজুমদারসহ বিএসএফের একটি মালবাহী পুরোনো রুশ বিমানে দিল্লি রওনা দিলাম। দিল্লিতে পৌঁছালাম ২ এপ্রিল সকালে। এরপর আরও দুটো দিন কেটে গেল। রুস্তমজি ও গোলক মজুমদার ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেছেন।

ইন্দিরা গান্ধী-তাজউদ্দীন আহমদ বৈঠক

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনার জন্য তাজউদ্দীন ভাই ও আমি বিষয়বস্তু চূড়ান্ত করলাম। পাঁচটি বিষয়কে আমরা গুরুত্ব দিয়ে দিলাম। ৪ এপ্রিল তাজউদ্দীন ভাই ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। সাক্ষাৎকালে তাঁদের কোনো সহযোগী ছিল না।

পরদিন ৫ এপ্রিল তাজউদ্দীন ভাই দ্বিতীয়বারের মতো ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করলেন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে জানালেন, বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তখনো অবশ্য এ খবর পাকিস্তান সরকার সরকারিভাবে প্রকাশ করেনি। এ কথা শুনে তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য যা কিছু করণীয়, তা করতে শ্রীমতী গান্ধীকে অনুরোধ করলেন। ইন্দিরা গান্ধী আশ্বাস দিলেন, তিনি সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাজউদ্দীন ভাই বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় করলেন। সিদ্ধান্ত হলো, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের সরকার ভারতের মাটিতে অবস্থান নিয়ে তাদের কাজ পরিচালনা করতে পারবে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সংগ্রহ এবং শরণার্থীদের আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর প্রচারের জন্য একটি বেতারব্যবস্থা নিয়েও আলোচনা হলো।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের দুদিনের আলোচনায় চারটি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়:

১. মুক্তিযুদ্ধে আমরা ভারতের সর্বাত্মক সহযোগিতা চাই। আমাদের রিট্রিট, রিগ্রুপিং ও ট্রেনিং দরকার। এ জন্য আমাদের সাপোর্ট ও স্যাঙ্কচুয়্যারি প্রয়োজন। বাঙালি সেনা কর্মকর্তা, জওয়ান, পুলিশ, ইপিআর, আনসার—সবাই আমাদের সঙ্গে আছে। এ ছাড়া আমাদের যুবকদের প্রশিক্ষণ দরকার।

২. প্রচারণা যুদ্ধের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই আমাদের প্রচারের জন্য বেতারের প্রয়োজন।

৩. পাকিস্তানের কারাগারে আটক আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের নিরাপত্তা ও তাঁর মুক্তির জন্য এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বে জনমত গঠনের জন্য ভারত সরকারের সার্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন।

৪. বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা শরণার্থীদের আশ্রয়, খাদ্য ও নিরাপত্তার জন্য ভারতের সার্বিক সহায়তা প্রয়োজন। তাদের সংখ্যা যে প্রায় এক কোটিতে পরিণত হতে পারে—এমন একটি আনুমানিক সংখ্যার কথাও আমরা জানিয়েছিলাম।

তাজউদ্দীন আহমদ শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছিলেন, সেনানিবাস ছাড়া সমগ্র বাংলাদেশ মুক্ত। এ যুদ্ধ আমাদের যুদ্ধ। এটি যেন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পরিণত না হয়। পাকিস্তান এ যুদ্ধকে আন্তর্জাতিকীকরণের পথ বেছে নিতে পারে। এ ব্যাপারে আমাদের অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের যুদ্ধ আমাদের করতে দেওয়ার জন্য সাহায্য ও সহযোগিতা প্রয়োজন। তাজউদ্দীন ভাইয়ের কথা শুনে ইন্দিরা গান্ধী খুবই মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি এসব বিষয়ে যথাযথ সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। এসব বিষয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের একটা মতৈক্য হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যেসব সহযোগিতা আমরা ভারতের কাছ থেকে পেয়েছি, বলা যায়, এই আলোচনা ছিল তার ভিত্তি।

দিল্লিতে ভারত সরকারের একটি অতিথি ভবনে তাজউদ্দীন ভাই আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘সরকার গঠন করার কথা বলছেন, কাদের নিয়ে সরকার গঠন করবেন।’ উত্তরে বললাম, সরকার তো বঙ্গবন্ধু তৈরি করেই রেখে গেছেন। ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ যে সরকার দেশ পরিচালনায় নির্দেশনা দিয়ে আসছিল, সেটিই ছিল কার্যকর সরকার। অবৈধ ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারের দেশে বাংলা সরকারই একমাত্র বৈধ সরকার। তফাত শুধু এই যে বঙ্গবন্ধু শত্রুর হাতে বন্দী। তাঁর জীবন রক্ষা, মুক্তি ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য আনুষ্ঠানিক সরকার গঠন করা খুবই জরুরি। সশস্ত্র সংগ্রাম তো শুরু হয়েই গেছে। এর সুপরিকল্পিত নেতৃত্ব দেওয়া হবে এ সরকারের মূল কাজ।

দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, বঙ্গবন্ধু শত্রুশিবিরে বন্দী। তাঁকে রাষ্ট্রপতি রাখলে তাঁর জীবনের ঝঁুকি কমবে, না বাড়বে? আমার উত্তর ছিল যে, তাঁকে রাষ্ট্রপতি রাখলে তাঁর জীবনের ঝঁুকি অনেক কম হবে। কারণ, তাঁর জীবনের নিরাপত্তার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ স্বাভাবিকভাবেই আরও বাড়বে। তিনি মুক্ত বা বন্দী—যেভাবে যেখানেই থাকুন না কেন, তিনিই হবেন এ যুদ্ধের মূল নায়ক। তাজউদ্দীন আহমদ আমার কথায় সায় দিয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, ‘আমি আমার নেতাকে যেভাবে জানি বা চিনি, আমাদের এই ঘোষণা বা তাঁকে রাষ্ট্রপতি করে সরকার গঠনের পদক্ষেপ জীবন গেলেও তিনি অস্বীকার করবেন না।’

তৃতীয় প্রশ্ন হলো, আমাদের প্রধানমন্ত্রী কে হবেন? আমি উত্তর দিলাম, বঙ্গবন্ধু বন্দী হওয়ার পর থেকে যিনি এ মুক্তিসংগ্রামে প্রধান ভূমিকা পালন করছেন, তিনিই প্রধানমন্ত্রী হবেন।

এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে (৮ এপ্রিল) আমাদের তরুণ ছাত্র ও যুবনেতাদের প্রস্তাব ছিল, সরকার গঠন না করে একটি বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করা হোক। তখন আমি বঙ্গবন্ধুর এই যুক্তিটি ব্যবহার করেছিলাম যে, নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়লাভের ফলে বঙ্গবন্ধু আমাদের অবিসংবাদিত নেতা। তাঁর নেতৃত্বে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সরকার গঠনের সাংবিধানিক ও আইনগত অধিকার রয়েছে। সারা বিশ্বে তার যৌক্তিকতা ও স্বীকৃতি লাভে আইনগত কোনো বাধা নেই। সেটা গ্রহণ করে সরকার গঠন করাই হবে আমাদের যুক্তিসংগত পদক্ষেপ।

সেই সভায় তরুণ বন্ধুরা সরকার গঠনের বিরোধিতা করে অনেক জোরালো যুক্তি দিয়েছিলেন। প্রাথমিকভাবে তাঁরা এ বিষয়ে অনেককে তাঁদের পক্ষে নিতেও সক্ষম হন। তাঁদের যুক্তি ছিল, এখন যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধক্ষেত্র ও লড়াইয়ের ময়দানেই নতুন নেতৃত্ব গড়ে উঠবে। সেখানেই ঠিক হবে কারা নেতৃত্ব দেবে। মন্ত্রী-মন্ত্রী খেলার সময় এটি নয়। এখন প্রয়োজন বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করার। শেখ ফজলুল হক মনির আবেগঘন তেজস্বী বক্তৃতায় হাউস তাঁর দিকে চলে যায়। তা ছাড়া সবাই জানতেন যে বঙ্গবন্ধু কোথায় যাবেন, থাকবেন, কোথা থেকে অস্ত্র পাবেন কিংবা কী করতে হবে, তার সব নির্দেশনা তিনি শেখ মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখনদেরই দিয়ে গেছেন। এই পরিস্থিতিতে তাজউদ্দীন ভাই খুবই বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে গেলেন।

আমাকে সে সময় উঠে দাঁড়াতে হলো। আমি একটি একটি করে তাঁদের সব যুক্তি খণ্ডন করতে সক্ষম হলাম। আমার প্রথম ও প্রধান যুক্তি ছিল, এটি ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে বাংলাদেশ বারো ভূঁইয়ার দেশ। এখানে একটি বিপ্লবী কাউন্সিল গঠিত হলে যে আরও এগারোটি কাউন্সিল গঠিত হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়?

তা ছাড়া:

১. সামরিক বাহিনী, ইপিআর, পুলিশ বাহিনী, আনসার, সরকারি, আধা সরকারি সংস্থার কর্মকর্তারা কার কাছে আনুগত্য প্রকাশ করবে?

২. ভারত সরকার ও তাদের সামরিক, আধা-সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা কাদের সঙ্গে সহযোগিতা করবে?

৩. সে ক্ষেত্রে এটি একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগ্রামরূপে আখ্যায়িত হবে এবং পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রই এটিকে সমর্থন দেবে না। উল্টো তারা রাষ্ট্রীয় সংহতির পক্ষে অবস্থান নেবে। আমি নাইজেরিয়ার বায়াফ্রার উদাহরণ দিলাম। বিপ্লবী কাউন্সিল সম্পর্কে বলতে গিয়ে উদাহরণ দিলাম চে গুয়েভারার। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তামিল টাইগারদের কথাও উল্লেখ করলাম। কাশ্মীরের মুজাহিদদের কথা বললাম এবং উদাহরণ দিলাম তিব্বতের দালাই লামার নেতৃত্বে ভারতে শরণার্থী শিবিরের। সেই সঙ্গে বললাম, জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে বিজয়ের একটি বড় দৃষ্টান্ত যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাযুদ্ধ।

আমি আরও বললাম যে ইয়াহিয়ার সরকার যেখানে একটি অবৈধ ও অসাংবিধানিক সরকার, সেখানে আমরাই একমাত্র বৈধ ও সাংবিধানিক সরকার। আমাদের সরকার গঠনের অধিকার আন্তর্জাতিক আইনেও স্বীকৃত। ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক সনদ ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্টস অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা সরকার গঠনের অধিকার মানবাধিকারে পরিণত হয়েছে।

আমার জীবনের সবচেয়ে সফল ওকালতি ছিল ৮ এপ্রিলের সেই বক্তৃতা। যুক্তিগুলো অসাধারণ সাফল্য বয়ে আনল। কামরুজ্জামান সাহেব আমার কাছে এসে একান্তে সমর্থন জানালেন। কিন্তু প্রশ্ন করলেন, মিজানুর রহমান চৌধুরীকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া যায় কি না? আমি বললাম, আমরা তো নতুনভাবে কাউকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়ার কথা বলিনি। অসহযোগ আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যাঁরা হাইকমান্ডে ছিলেন, এখানে মন্ত্রিসভা হিসেবে তাঁদেরই আত্মপ্রকাশ ঘটছে।

সমস্ত হাউস সরকার গঠনের যৌক্তিকতা মেনে নিল। দিল্লি বৈঠকের আলোচনাসহ সবাই সরকার গঠনের প্রস্তাব অনুমোদন করল।

পরবর্তী সময়ে তিস্তা নদীর উৎসমুখে জঙ্গলের মধ্যে একটি পাহাড়ি ঝরনার তীরে তাঁবু ফেলে জনপ্রতিনিধিদের একটা অধিবেশন বসে। সেখানে সরকার গঠন এবং তার সব কার্যক্রম অনুমোদন পায়।

কলকাতার লর্ড সিনহা রোডের অতিথিশালায় ৮ এপ্রিলের সান্ধ্যকালীন সভায় উপস্থিত নেতাদের কাছে সরকার গঠনের ব্যাখ্যা করতে পেরেছিলাম বলে আমাদের সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নেন। এতে তাজউদ্দীন সাহেবের সিদ্ধান্ত গ্রহণের যৌক্তিকতা ও যথার্থতা সম্পর্কে আমার আরও সুদৃঢ় অবস্থান সৃষ্টি হলো। আমার মনে হলো, ইতিমধ্যেই আমরা যে সরকার গঠন করেছি, তার সমর্থনে একটা সাংবিধানিক দলিল তৈরি করা আবশ্যক এবং আইনানুগভাবে সরকার পরিচালনা ও দেশবাসীর জন্য একটি চলমান আইনের ধারাবাহিকতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন।

তাই সভা শেষে খাওয়ার পর সবাই যখন ঘুমিয়ে, আমি তখন ঘরের কোনার একটি টেবিল ল্যাম্পের আলোয় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি রচনা করি। ওই দলিল তৈরি করতে গিয়ে তাই প্রাধান্য পেয়েছিল জনগণের সার্বভৌমত্ব, তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এবং তাদের পক্ষে বৈধ উৎস ও প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকার পরিচালনার বৈধ আইনানুগ ক্ষমতা ও দিকনির্দেশনা।

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ১৯৭০ সালের নির্বাচন থেকে শুরু করে ঐতিহাসিক ঘটনাক্রমের ধারাবাহিক বর্ণনা দেওয়া হয় এবং এতে স্বাধীনতা ঘোষণার পৌনঃপুনিক যৌক্তিকতা, অপরিহার্যতা ও অবশ্যম্ভাবিতার পাশাপাশি রাষ্ট্র গঠনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে স্থান করে দেওয়া হয়:

১. সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করা।

২. বাংলাদেশের জনগণকে একটি নিয়মতান্ত্রিক ও ন্যায়ানুগ সরকার প্রদানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অন্য সব কার্য পরিচালনা করার ক্ষমতা, একই সঙ্গে তৈরি করা হয় লস কন্টিনিউয়েন্স অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট অর্ডার। এই দুটি দলিলই ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর করা হয়।

সকালে নাশতার টেবিলেই তাজউদ্দীন সাহেবকে দেখালাম, তাঁর রেকর্ড করা বক্তৃতাটির পক্ষে সাংবিধানিক দলিল ও লস কন্টিনিউয়েন্স অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট অর্ডারটি রাতে তৈরি করেছি। তিনি মনোযোগ দিয়ে সেটি পড়ে খুবই সন্তুষ্টচিত্তে তা অনুমোদন করলেন। আমি বললাম, এর পরও কোনো অভিজ্ঞ আইনজীবীকে দিয়ে এটি দেখিয়ে নিতে পারলে ভালো হয়। তিনি বললেন, পারলে পরে কাউকে দিয়ে দেখিয়ে নিতে। ১৫-১৬ তারিখের দিকে এগুলো মৈত্রেয়ী দেবীর ছোট একটি প্রেসের সাইক্লোস্টাইল মেশিনে কপি করতে নিয়ে যাওয়ার আগে এটি ব্যারিস্টার সুব্রত রায়চৌধুরীকে দেখাই। তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, পারফেক্ট। তিনি জানতে চাইলেন, এটি আমিই করেছি কি না? বললেন, এর কমা বা সেমিকোলন কিছুই বদলানোর প্রয়োজন নেই। পরে মৈত্রেয়ী দেবীর সাইক্লোস্টাইল মেশিনে তা ছাপানো হয়।

পরদিন ৯ এপ্রিল আমাদের যাত্রা শুরু হবে শিলিগুড়ি ও আগরতলায়। তার আগে জনাব কামরুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর সঙ্গে আমার দেখা করতে হবে। তাঁদেরও আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে।

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মূল সাংবিধানিক দলিল। এটি ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানের মূল ভিত্তি। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত, বাস্তবতা, অপরিহার্যতা এবং তার আইনগত ও সাংবিধানিক যৌক্তিকতা ঘোষণাপত্রের প্রথম অংশে স্থান পেয়েছে।

২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, শত্রুর মোকাবিলা করতে জনগণের প্রতি মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনার আহ্বান ইত্যাদির ধারাবাহিক পরিণতিই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। জাতিসংঘ সনদ, সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারসংবলিত অঙ্গীকারনামার মূল ভাবধারার সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও সংবিধানের মূলনীতিগুলোর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে বাংলাদেশের মর্যাদা রক্ষার্থে নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে একটি গণপরিষদ গঠন এবং গণপরিষদের পক্ষ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি নিয়োগ করা হয়। অধ্যাপক ইউসুফ আলী ছিলেন নির্বাচিত চিফ হুইপ। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথ পরিচালনার দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশের জনগণকে একটি নিয়মতান্ত্রিক ও ন্যায়ানুগ সরকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হয়। দেওয়া হয় জাতিসংঘের সনদ মেনে চলার সব প্রতিশ্রুতি।

এক রক্তক্ষয়ী ঐতিহাসিক সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের আলোকে পরে আমাদের সংবিধান প্রণীত হয় এবং তা কার্যকর হয় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাকে এতে দৃঢ়ভাবে অনুমোদন ও সমর্থন করা হয়। এ ঘোষণাপত্রে দেওয়া ক্ষমতাবলে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারি করেন। সেই আদেশেও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের স্বীকৃতি রয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সমর্থন ও স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রথম বাক্যে, সংবিধানের ১৫০(২) অনুচ্ছেদে এবং সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ৪(৩) নম্বর অনুচ্ছেদে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এতদ্বারা অনুমোদিত ও সমর্থিত হইল এবং তাহা আইন অনুযায়ী যথার্থভাবে প্রণীত, প্রযুক্ত ও কৃত হইয়াছে বলিয়া ঘোষিত হইল।’

স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ

বাংলাদেশ সরকারের আত্মপ্রকাশ ও শপথ অনুষ্ঠানের কথা ছিল প্রথমে চুয়াডাঙ্গায়। কিন্তু পাকিস্তান বিমানবাহিনীর বোমা হামলার পর আমাদের পরিকল্পনা বদলাতে হয়। দিল্লি থেকে ফিরে প্রথমে যাই আগরতলা, পরে পথে শিলিগুড়িতে যাত্রাবিরতি। ১০ তারিখে একই দিনে ঘোষণাপত্র অনুমোদন ও অনেক বাধা অতিক্রম করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন ভাইয়ের বক্তৃতার রেকর্ডটি বাজানো হয়। কলকাতা থেকে ফিরে গোলক মজুমদার ও সরোজেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনায় বসি। প্রথমে চুয়াডাঙ্গায় আমাদের শপথগ্রহণের সিদ্ধান্ত থাকলেও পাকিস্তানের বিমান হামলার কারণে স্থান পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আমি মেহেরপুরের আমবাগানের কথা উল্লেখ করি। আমার জানা মতে, এর কাছেই ভবেরপাড়ায় মিশনারিদের একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার আওয়ামী লীগের সংগঠক ও পরে সভাপতি হিসেবে এসব অঞ্চল আমার খুবই চেনা। মনে মনে জায়গাটির কথা আমি ভেবে রেখেছিলাম। জায়গাটি ছিল ভারত সীমান্তের খুব কাছে। তিন দিকেই ভারতের ভূখণ্ড। সরোজেন্দু চট্টোপাধ্যায় একটি মানচিত্র নিয়ে এলেন। জায়গাটি চিহ্নিত করা হলো। গোলক মজুমদার বললেন, এখানে ভারত-সীমান্তে অ্যান্টি-এয়ারক্র্যাফট গান রাখা যাবে। জায়গাটিকে সম্পূর্ণ নিরাপদ করা হবে। শপথ গ্রহণের স্থানটি আমরা এভাবেই চিহ্নিত করি।

১৭ এপ্রিল শপথ অনুষ্ঠানে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের হাজির করার ভার ছিল আমার ও আবদুল মান্নানের ওপর। ১৬ এপ্রিল আমরা দুজনে মিলে কলকাতা প্রেসক্লাবে যাই। এই প্রথম বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দুজন প্রতিনিধি বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে মিলিত হলো। পুরো প্রেসক্লাব লোকে লোকারণ্য। তিল ধারণের ঠাঁই নেই। সার্চলাইটের মতো অসংখ্য চোখ আমাদের দিকে নিবদ্ধ। ক্লাবের সেক্রেটারি উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রথমে তাঁদের অনুরোধ জানিয়ে বললাম যে, আমাদের উপস্থিতির কথা গোপন রাখতে হবে। এরপর বললাম, আমি বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আপনাদের জন্য একটি বার্তা নিয়ে এসেছি। সমবেত সাংবাদিকদের পরদিন ১৭ এপ্রিল কাকডাকা ভোরে প্রেসক্লাবে হাজির হতে অনুরোধ জানানো হলো। বললাম, আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একটি বিশেষ বার্তা তখন তাঁদের জানানো হবে। তাঁদের কেউ কেউ আরও কিছু প্রশ্ন করতে চাইলেন। আমরা কোনো উত্তর দিতে অপারগতা প্রকাশ করলাম। পরদিন সাংবাদিকদের নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের গাড়ি তৈরি রাখার প্রস্তুতি নিলাম।

শপথ অনুষ্ঠানের নির্ধারিত স্থানে, অর্থাৎ বৃহত্তর কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা ১১টা বেজে গেল। ইতিমধ্যে অনুষ্ঠানের আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে। মাহবুব ও তৌফিক-ই-এলাহী অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার দেন। আগেই ঠিক করা হয়েছিল, চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করবেন। অনুষ্ঠানের জন্য ছোট্ট একটি মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। মঞ্চে ছিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্যরা, এম এ জি ওসমানী, আবদুল মান্নান ও আমি। আবদুল মান্নান অনুষ্ঠান পরিচালনা করলেন। ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম পরিচালনা করলেন শপথ অনুষ্ঠান। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিলেন। এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জায়গাটিকে ‘মুজিবনগর’ নামকরণ করলেন।

আমবাগানের অনুষ্ঠানে ভরদুপুরে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ছাড়াও পার্শ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার লোক জমায়েত হয়। হাজারো কণ্ঠে তখন উচ্চারিত হচ্ছিল ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। আমার কাজ ছিল দ্রুত অনুষ্ঠান শেষ করে সাংবাদিকদের কলকাতা ফেরত পাঠানো। দুপুরের মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল। সাংবাদিকদের গাড়িতে করে ফেরত পাঠানো হলো। মন্ত্রিসভার সদস্যরা ফিরলেন সন্ধ্যায়। কলকাতায় ফিরে গিয়ে সাংবাদিকেরা বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে সরকার গঠন সম্পর্কে সংবাদ পাঠাতে শুরু করলেন।

রাত ১২টা থেকে আমি নেতাদের গাড়িতে তুলে দিতে শুরু করি। তাঁদের বলে দেওয়া হলো, তাঁরা কোথায় যাচ্ছেন তা জিজ্ঞাসা করতে পারবেন না। সকালবেলায় আমরা একত্র হব।

১৭ এপ্রিল আমাদের জাতীয় ইতিহাসের একটি অবিস্মরণীয় দিন। স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের দিন এটি। ভোরের দিকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ, এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান এবং এম এ জি ওসমানী আগেই গাড়িতে রওনা হয়ে গেলেন।

আমি ও আবদুল মান্নান ভোরের দিকে কর্মসূচি অনুযায়ী কলকাতা প্রেসক্লাবে গেলাম। সেই ভোরেও ক্লাবে আর লোক ধারণের জায়গা নেই। ক্লাবের বাইরেও অনেকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি সাংবাদিকদের লক্ষ করে বিনীতভাবে বললাম, ‘আমি বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আপনাদের জন্য একটা বার্তা নিয়ে এসেছি। স্বাধীন বাংলার মাটিতে আপনাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।’

এ সময় কেউ কেউ জানতে চাইলেন, আপনারা কোথায় যাবেন, কীভাবে যাবেন? আমি আবার বললাম, ‘আমরা আপনাদের সঙ্গে রয়েছি। পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব।’ আমাদের গাড়িগুলো তখন প্রেসক্লাবের সামনে। উৎসাহী সাংবাদিকেরা গাড়িতে উঠলেন। অনেকের কাঁধে ক্যামেরা। ৫০-৬০টি গাড়ি নিয়ে আমরা রওনা দিলাম গন্তব্যস্থলে। আমি ও আবদুল মান্নান দুজন দুই গাড়িতে। আমার গাড়িতে কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিক। পথে তাঁদের সঙ্গে অনেক কথা হলো। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বহু সাংবাদিক জীবনের ঝঁুকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ পরিবেশন করেছেন।

এবার আমাদের প্রধান দায়িত্ব নির্ধারিত হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতির আবেদন জানিয়ে সে সময়কার ১০৭টি দেশের কাছে চিঠি পাঠানো। এ জন্য চিঠি লিখতে হবে। তারপর ১০৭টি চিঠি টাইপ করানোর কাজ। ভাগ্য ভালো, আমাদের কলকাতা হাইকমিশনের লাইব্রেরিতে ফর্মস অ্যান্ড প্রিসিডেন্স অব ডিপ্লোম্যাটিক করেসপনডেন্স নামে একটি বই ছিল। সে বই থেকে একটি নমুনা বাছাই করে সেই ধাঁচে একটি চিঠি তৈরি করা হলো। চিঠির সঙ্গে তিনটি করে সংযুক্তি পাঠানো হয়: বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং লস কন্টিনিউয়েন্স অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট অর্ডার।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধুর অভাব আমরা তীব্রভাবে অনুভব করেছি। কিন্তু এখন যখন পেছনে ফিরে তাকাই, তখন মনে হয়, বঙ্গবন্ধু সে দিন সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রপ্রধান ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা তাঁর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। যুত্তরাজ্যের হাউস অব কমন্স ও যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটসহ সর্বত্র তাঁর নিরাপত্তার বিষয়টি আলোচনায় স্থান পায়। বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তা সম্পর্কে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি থেকে শুরু করে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে পৃথিবীর বিভিন্ন রাজধানীতে যে দাবি ও চাপ সৃষ্টি হয়েছিল, সে ছিল এক বিরল দৃষ্টান্ত।

এম আমীর-উল ইসলাম: জে্যষ্ঠ আইনজীবী; বাংল​াদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১৫ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত