বিজ্ঞাপন
default-image

‘শেষ মহানবীর নামে আমি আপনাদের কাছে তওবা করছি।’

১৯৭৪ সালে জুনের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশে সরকারি সফরে এসেছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। ঢাকায় তাঁর প্রথম নাগরিক সভায় ভুট্টো স্বভাবসুলভ নাটকীয়তায় এই তওবার কথা ঘোষণা করেন। ১৯৭১-এ পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যে গণহত্যা সংঘটিত করে, এই তওবা ছিল তার জন্য। ভুট্টো সেদিন আরও বলেছিলেন, ‘আপনাদের এবং আমাদের ওপর যারা শাসন করেছে, দয়া করে তাদের সঙ্গে আমাদের (আমাকে) এক করে দেখবেন না। আমি আপনাদের দুঃখ ও বেদনা বুঝতে পারি, আপনাদের প্রতি আমার সমবেদনা রয়েছে এবং আপনাদের যে ক্ষতি হয়েছে তার জন্য আমি শোক প্রকাশ করছি।’ ‘ভুট্টোর ক্ষমা প্রার্থনা’—এই শিরোনামে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা (৩০ জুন ১৯৭৪) সে ঘটনার কথা উল্লেখ করে লিখেছে, ভুট্টোর এই ভাষণ শুনে উপস্থিত অনেকে অশ্রু সংবরণ করতে পারেনি।

ওপরের এই তথ্যে কোনো ভুল নেই। একাত্তরের গণহত্যার পেছনে যাঁর প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল, যিনি নিজে নানাভাবে সে গণহত্যাকে অস্বীকার করার বা একে খাটো করার চেষ্টা করেছেন, যাঁর নির্দেশে পাকিস্তানের হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট কেটেছেঁটে প্রকাশ করা হয় শুধু গণহত্যার অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়ার জন্য, তিনি তওবা করবেন, এ কথা ভাবা কঠিন। কিন্তু করেছিলেন, যদিও সেই একই যাত্রায় বাংলাদেশকে অপমান করার, তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার কোনো সুযোগই হাতছাড়া করেননি পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট। অবশ্য বাংলাদেশের কাছে ১৯৭১-এর গণহত্যার জন্য ভুট্টো ক্ষমা চান বা দুঃখ প্রকাশ করেন আরও আগে, ক্ষমতা গ্রহণের পরপর, ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। ভুট্টোর আমলেই সরকারিভাবে, খানিকটা নিমরাজি হয়ে এবং শর্তসাপেক্ষে, পাকিস্তান দুঃখ প্রকাশ করে এর দুই বছর পর, ১৯৭৪-এর এপ্রিল মাসে, নয়াদিল্লিতে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ—এই ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরের সময়। সে দুঃখ প্রকাশকে কেউ কেউ পাকিস্তানের সরকারি পর্যায়ে ক্ষমা-প্রার্থনা বলে অভিহিত করেছেন। কেউ কেউ অবশ্য সে কথার সঙ্গে একমত নন। এই আলোচনায় ভুট্টোর তওবা ও পাকিস্তানের সরকারি ‘ক্ষমা প্রার্থনার’ প্রেক্ষিতটি বিবেচনা করা হবে। একই সঙ্গে ‘ক্ষমা প্রার্থনা’ প্রশ্নে বাংলাদেশে যে বিতর্ক এখনো অব্যাহত, তার ঘটনাক্রম তুলে ধরারও চেষ্টা হবে এই আলোচনার লক্ষ্য।

ঢাকায় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, যেদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে, ভুট্টো সেদিন নিউইয়র্কে। এর এক দিন আগে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির এক প্রস্তাব কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলে তিনি বেরিয়ে এসেছেন। আসার আগে, বলিউডি ফিল্মের নায়কের মতো বলে এসেছেন, ‘আমার দেশ আমাকে ডাকছে, আমাকে আমার দেশে ফিরে যেতে হবে। আপনাদের এই মেকি মহতী সভায় কালক্ষেপণের কোনো প্রয়োজন আমার নেই।’

default-image

সে সময় তাঁর চোখ ছলছল করছিল, গলা কাঁপছিল আবেগে, কিন্তু ভুট্টো কথাগুলো বলেছিলেন খুব ভেবেচিন্তে, হিসাব করে। পূর্ব পাকিস্তানে জেনারেলদের খেলা ততদিনে শেষ, সে কথা তিনি খুব ভালো করেই জানতেন। গ্লাস থেকে পড়ে যাওয়া দুধ নিয়ে বিলাপ করার প্রয়োজন তাই আর নেই। তখন তাঁর মাথায় একটাই ভাবনা-কীভাবে পাকিস্তানে ফিরে ক্ষমতা দখল করবেন। জাতিসংঘে তিনি যে নাটক করলেন, তার লক্ষ্য বিদেশি কূটনীতিকেরা নন, মানসিকভাবে পর্যুদস্তু তাঁর দেশবাসী ও সেনাবাহিনীর অবশিষ্ট নেতৃত্ব। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে বিপদ সামাল দেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ভুট্টোকে জাতিসংঘে পাঠিয়েছিলেন সহকারী প্রধানমন্ত্রী—এই পদবি দিয়ে। বাঙালি প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনের সহকারী হিসেবে এই নামমাত্র পদোন্নতিতে খুশি হওয়ার কথা তাঁর নয়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার স্বপ্ন তাঁর দীর্ঘদিনের। ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে বিপর্যয় এবং পাকিস্তান ভেঙে দুই টুকরো হওয়ার ফলে তাঁর সে স্বপ্ন পূরণ হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হলো। এর প্রস্তুতি হিসেবেই এই নাটক।

চার দিন পর দেশে ফিরে এলেন ভুট্টো। এসেই সামরিক কমান্ডের সমর্থনে ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে নিজে ২০ ডিসেম্বর দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিলেন। তাঁর প্রথম ভাষণে ভুট্টো শুধু যে ভাঙা পাকিস্তানকে জোড়া লাগার কথা বললেন, তা-ই নয়, হূত সম্মান পুনরুদ্ধারের জন্য ভারতের সঙ্গে অনন্তকাল যুদ্ধের কথাও ঘোষণা করলেন। ‘আমরা যুদ্ধ করব, আমাদের মর্যাদার স্বার্থে যুদ্ধ করে যাব, যুদ্ধ করব আত্মসম্মানের জন্য এবং আমাদের সংহতির জন্য। আমরা এক (অখণ্ড) পাকিস্তানের জন্য যুদ্ধ করব’—তিনি ঘোষণা করলেন। সেই প্রথম ভাষণেই ভুট্টো বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভিযানের কথা অপ্রত্যক্ষভাবে হলেও উল্লেখ করেছিলেন, এমনকি ক্ষমার কথাও তাতে ছিল। ভুট্টো বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা এ দেশের বৃহদাংশ। আমি নিশ্চিত, তারা আমাদের সঙ্গে একসঙ্গে বাস করতে চায়। আমি তাদের কাছে আবেদন করছি, তারা যেন আমাদের ভুলে না যায়, তবে তারা যদি ক্রুদ্ধ হয়ে থাকে, তাহলে তারা যেন আমাদের ক্ষমা করে। (‘আই অ্যাপিল টু দেম নট টু ফরগেট, বাট টু ফরগিভ আস ইফ দে আর অ্যাংরি উইথ আস’)

‘ফরগেট অ্যান্ড ফরগিভ’-এর এই প্রচ্ছন্ন আবেদনের কয়েক মাসের মধ্যে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাচির সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বললেন ভুট্টো। এপ্রিল ১৯৭২-এ গৃহীত সেই সাক্ষাত্কারে ভুট্টো মুজিবকে আজন্ম মিথ্যাবাদী বললেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনা হামলায় মোট নিহতের সংখ্যা হাজার-পঞ্চাশেক বলে দাবি করলেন এবং সেই সেনা অভিযানকে ‘নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য’ বলে ব্যাখ্যা করলেন (দেখুন: ফালাচি, ইন্টারভিউ উইথ হিস্টোরি, হগটন মিফলিন কোম্পানি, বোস্টন, ১৯৭৬, পৃ. ১৮৮-১৮৯)।

এরপর দুই বছর চলে যাবে, যার অধিকাংশই ভুট্টো ব্যয় করবেন বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে। নিজে স্বীকৃতি দেবেন না, অন্য কেউ যাতে সে স্বীকৃতি না দেয় তার চেষ্টা করবেন, এমনকি জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি ঠেকানোরও কসুর করবেন না। পাকিস্তান বাংলাদেশকে অবশেষে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, ততদিনে অবশ্য বিশ্বের ১০০টির মতো দেশের স্বীকৃতি বাংলাদেশ পেয়ে গেছে। সে সময় বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয়েই ‘ভুলে যাওয়া ও ক্ষমা’র কথা বলবে, যদিও ভুলে যাওয়া বা ক্ষমা করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব হবে না। একাত্তরের ঘটনার জন্য ‘দুঃখ প্রকাশের’ প্রশ্ন ফের উঠবে সে বছর এপ্রিলে, ভারত-পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সেনা ও নাগরিক হস্তান্তর নিয়ে যে চুক্তি হবে, সে সময়। তবে সে ঘটনায় যাওয়ার আগে, এই দুই বছরের ঘটনাক্রম খতিয়ে দেখা যাক।

২.

ভুট্টোর জন্য ক্ষমতা দখল যত সহজ হয়, ক্ষমতায় বসে তিনি দেখলেন ক্ষমতা ধরে রাখা তত সহজ নয়। ১৯৭২ সালে যুদ্ধে হেরে, জাতশত্রু ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং দেশের অধিকাংশ জনসংখ্যা খুইয়ে পাকিস্তানের তখন হাঁটুভাঙা ‘দ’-এর মতো অবস্থা। আজীবন সে দেশের লোক গল্প শুনে এসেছে যে একজন পাকিস্তানি সৈন্য মানে হলো দশ জন ভারতীয় হিন্দু সেনা। ভুট্টো নিজে সে কথা জাতিসংঘে বলে এসেছেন। সেখানে ভারতের সেই হিন্দুদের কাছে তাঁর শুধু হারই হয়নি, ৯০ হাজার সামরিক অফিসার ও সৈন্য ভারতের মাটিতে বন্দী হয়ে রয়েছে। একই সময় নব্য স্বাধীন বাংলাদেশ গোঁ ধরে বসে আছে, তারা পাকিস্তানি সেনাদের যুদ্ধাপরাধের জন্য বিচার করবে। সে উদ্দেশ্যে যুদ্ধাপরাধী অফিসার ও সেনা সদস্যের এক তালিকাও তারা তৈরি করা শুরু করেছে। ভুট্টোর জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল সে বিচার ঠেকানো এবং যুদ্ধাপরাধীসহ সব বন্দীকে দেশে ফিরিয়ে আনা। ক্ষমতা ধরে থাকতে হলে এ ছাড়া অন্য পথ তাঁর সামনে তখন বন্ধ। পাকিস্তানি জেনারেলরা, যাঁরা তাঁকে ক্ষমতার মধ্যমঞ্চে ঠেলে দেন, ভুট্টোর জন্য এই এজেন্ডা তাঁরা প্রথম দিন থেকেই নির্ধারণ করে দেন।

কিন্তু যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই ভারত পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, যুদ্ধাপরাধী বিচারের ব্যাপারটি বাংলাদেশের এখতিয়ারের ভেতর। পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করেছে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের কাছে, ফলে এ নিয়ে তাঁর একা বলার বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের কিছু নেই। যা কিছু বাংলাদেশের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার ভিত্তিতেই করতে হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ঘোষণা করেছে, কূটনৈতিক স্বীকৃতির আগে এবং সম্পর্কের সমতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে এ নিয়ে কোনো কথা বলতে সে প্রস্তুত নয়। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে বাংলাদেশকে স্বীকৃতির প্রশ্ন সে সময় পাকিস্তানের বিবেচনার বাইরে। বরং উল্টো যেসব দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তাদের সঙ্গে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখবে না এই কথাই পাকিস্তান জানিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি তার নিজের সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপ, এই যুক্তিতে ১৯৭২-এর গোড়ার দিকে ছোট ছোট গোটাকয়েক দেশের সঙ্গে পাকিস্তান তার সম্পর্কচ্ছেদও করে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতির প্রশ্নে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে মতভেদের দরুন পাকিস্তান কমনওয়েলথ থেকেও বেরিয়ে আসে।

ভুট্টো ঘাগু লোক। সম্পর্কচ্ছেদের হুমকি দিয়ে বাংলাদেশের স্বীকৃতি ঠেকানো যাবে না, এ কথা বোঝা তাঁর পক্ষে কঠিন হলো না। ভারত থেকে সৈন্য ফিরিয়ে আনতে হলে, বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধী সৈন্যদের বাঁচাতে হলে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে মুখোমুখি আলোচনায় বসতে হবে, সে কথা তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের কাছ থেকে পুরো ছাড় আদায় না করা পর্যন্ত, বিশেষত যুদ্ধাপরাধীদের নিঃশর্ত হস্তান্তর ছাড়া, তিনি এগোতে প্রস্তুত ছিলেন না। তা ছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে ভাঙা সম্পর্ক ফের জোড়া লাগানোর এক গোপন বাসনাও তাঁর ছিল। সে উদ্দেশ্যে পাকিস্তানে আটক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে খানিকটা তড়িঘড়ি করেই মুক্তির ব্যবস্থা করেন তিনি। তিনি ভেবেছিলেন, এর ফলে বাঙালিদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। ভুট্টোর জীবনীকার স্ট্যানলি ওয়ালপার্ট তাঁর জুলফি ভুট্টো অব পাকিস্তান গ্রন্থে (ওয়ালপার্ট, জুলফি ভুট্টো অব পাকিস্তান, অক্সফোর্ড ইউ. প্রেস, ১৯৯৩) জানিয়েছেন, পিন্ডির সামরিক ছাউনির পাশে এক বন্দিশিবিরে, যেখানে শেখ মুজিবকে তড়িঘড়ি করে নিয়ে আসা হয় জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে, সেখানে আকস্মিকভাবে উপস্থিত হন ভুট্টো। মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তির কথা বলতে এসেছিলেন তিনি কিন্তু এর আগে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে যেকোনো উপায়ে, যেকোনো ফর্মুলায় সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা সম্ভব কি না, তা বিবেচনার জন্য বঙ্গবন্ধুর কাছে আবেদন করেন তিনি। বঙ্গবন্ধু তাঁর সে আবেদন সরাসরি প্রত্যাখ্যানের বদলে সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার আগে কোনো সিদ্ধান্ত জানানো সম্ভব নয় বলে জানান। ১০ জানুয়ারি ঢাকায় ফিরে তাঁর প্রথম ভাষণে বঙ্গবন্ধু অবশ্য স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্তি আর সম্ভব নয়। সেই একই ভাষণে তিনি যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানিদের বিচারের দাবিও তোলেন।

ভুট্টো অবশ্য হাল ছাড়েননি। ১৯৭২ সালের পুরোটাই তিনি বাংলাদেশকে ভারতের দখলীকৃত পাকিস্তানি এলাকা বলে দাবি করে গেছেন। এ সময় পাকিস্তানের দুই অংশের সংযুক্তি নিয়ে ‘কাল্পনিক’ দেনদরবার করাও বন্ধ করেননি। ১৯৭৩-এ চিকিত্সার জন্য বঙ্গবন্ধু লন্ডনে এলে ভুট্টো সেখানেও ফোন করে আবদার করেছিলেন—আসো, দুই দেশকে ফের জোড়া লাগাই। বঙ্গবন্ধু তাঁকে কী জবাব দিয়েছিলেন তা বোঝা অবশ্য খুব কঠিন নয়। তিনি দুই দেশ জোড়া লাগানোর বদলে পাকিস্তানি স্বীকৃতির কথা তোলেন এবং একাত্তর-পূর্ব যৌথ পাকিস্তানি সম্পদের ন্যায্য ভাগাভাগির দাবি করেন।

স্বীকৃতির প্রশ্ন ছাড়াও পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের ফেরত আনার ব্যাপারে বাংলাদেশের গভীর উদ্বেগ ছিল। আটকে পড়া বাঙালিদের ফেরত আনার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের ওপর তখন দেশের ভেতর চাপ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে ভারতের মাধ্যমে জাতিসংঘ মহাসচিবের সাহায্য কামনা করে আবেদন জানায়। আটকে পড়া বাঙালি প্রশ্নে মুজিব সরকার যে চাপের মুখে রয়েছে, ভুট্টো সে কথা জানতেন বলেই তাদের তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করলেন। এই চাপ আরও বাড়ানোর লক্ষ্যেই এ সময় সেনাসদস্য ও পাকিস্তানে কর্মরত কয়েক শ বাঙালিকে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মুক্তি দেওয়ার দাবিও ভুট্টো প্রত্যাখ্যান করলেন।

বাংলাদেশে আটকে পড়া কয়েক লাখ পাকিস্তানি/বিহারি নাগরিকের প্রশ্নটিও বাংলাদেশের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। পাকিস্তান তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে খুব ব্যগ্র না হলেও তাদের স্বার্থ যাতে রক্ষিত হয়, সে ব্যাপারে নানা রকম হাঁকডাক করা শুরু করলেন ভুট্টো। সিন্ধু প্রদেশের বিপুলসংখ্যক মোহাজিরকে হাতে রাখার জন্য এ ব্যাপারে লোক দেখানো হলেও রাজনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া তার জন্য জরুরি হয়ে পড়ে। ঠিক সে উদ্দেশ্যেই ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ ভুট্টো ‘বিহারি বাঁচাও’ বলে এক আন্তর্জাতিক আবেদনের সূচনা করেন।

আটকে পড়া পাকিস্তানি সৈন্যরা ভারতের জন্যও সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যুদ্ধ শেষ হয়েছে, যুদ্ধ বিরতি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে, এরপর তাদের আটকে রাখার কোনো যুক্তি ভারতের ছিল না। এই বিপুলসংখ্যক সেনাসদস্যের খাওয়া-পরার ঝামেলা তো ছিলই। প্রতিমাসে তাদের জন্য খরচ হচ্ছিল এক লাখ ডলারের সমপরিমাণ অর্থ। তার ওপর যুদ্ধবন্দী নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপও ক্রমাগত বাড়ছিল। খোদ জাতিসংঘ মহাসচিব কুর্ট ভালডহাইম ১৯৭৩-এর গোড়ার দিকে ভারত সফরে এসে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে এ ব্যাপারে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়ার তাগাদা দিয়ে গেলেন। কিন্তু বাংলাদেশের মতামত অগ্রাহ্য করে একতরফাভাবে কিছু করার ইচ্ছা ভারতের ছিল না। ভারত-বাংলাদেশ তখনো খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। যুদ্ধবন্দীদের প্রশ্নটি সামনে রেখে বাংলাদেশ পাকিস্তানের ওপর স্বীকৃতির জন্য চাপ সৃষ্টি করবে—এ কথা ভারত জানত। যুদ্ধাপরাধী বিচারে বাংলাদেশ যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, ভারতের কাছে সে ব্যাপারটাও পরিষ্কার ছিল।

কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, এই ব্যাপারটা বাংলাদেশের কাছে খুব পরিষ্কার ছিল না। নথিপত্র নেই, প্রমাণ নেই, বিচার প্রক্রিয়া শুরুর আইনগত ভিত্তি নেই। শুধু আবেগ দিয়ে এই প্রশ্নে খুব বেশি এগোনো বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব ছিল না। বাংলাদেশ সরকার প্রথমে এই তালিকায় এক হাজার ৫০০ জন অফিসার ও সৈন্যকে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে তা ছাঁটাই করে ১৯৫-এ কমিয়ে আনা হয়। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী তথ্য-প্রমাণ হাজির করা বাংলাদেশের কাছে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যুদ্ধাপরাধী সৈন্যদের তালিকা সে কারণেই কমিয়ে আনতে হয়। ১৯৭২-এর গোড়ার দিকে এই প্রশ্নে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা হলেও বাংলাদেশ সংসদ যুদ্ধবন্দী প্রশ্নে প্রথম আইন পাস করে ১৯৭৩-এর ১৭ জুলাই।

প্রথম এক বছর বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কে কোনো অগ্রগতি না হলেও ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্কে কিছুটা উন্নতি হয় এই দুই দেশের মধ্যে জুলাই ১৯৭২-এ স্বাক্ষরিত সিমলা চুক্তির ফলে। সিমলায় ইন্দিরা ও ভুট্টোর মধ্যে যে চুক্তি হয় তাতে দুই দেশ পশ্চিম সীমান্তে দখল করা জমি ছেড়ে দিতে রাজি হলো, কিন্তু একে অপরের দেশে আটকে পড়া সৈন্য নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো সমঝোতা হলো না। প্রধান কারণ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানাতে পাকিস্তানের বিলম্ব। সমসাময়িক ভারতীয় ভাষ্যকারদের অধিকাংশই বলেছেন, সিমলা চুক্তির পর বাংলাদেশের প্রতি পাকিস্তানের স্বীকৃতি শুধু সময়ের ব্যাপার। কারণ, সৈন্য ফিরিয়ে নিতে যত বিলম্ব হবে, ভুট্টোর শিরঃপীড়া ততই বাড়বে। কিন্তু ভুট্টো এ ব্যাপারে দ্রুত পা বাড়ালেন না। এর একটি সম্ভাব্য কারণের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন অধ্যাপক মোহাম্মদ আইয়ুব। সমসাময়িক রাজনৈতিক আলাপচারিতা উদ্ধৃত করে তিনি লিখেছেন, ভুট্টো জানতেন, তার দেশের আটক যুদ্ধবন্দী ভারতের জন্য বোঝা। আজ হোক বা কাল ভারতকে সব যুদ্ধবন্দী ছেড়ে দিতেই হবে। ফলে এই প্রশ্নে দেন-দরবার করে কোনো বাড়তি ফায়দা আদায় হবে না (দেখুন: আইয়ুব, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, সার্চ ফর নিউ রিলেশনশিপ, ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স, দিল্লি, ১৯৭৫)।

কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্নটি ভুট্টো কেন ঝুলিয়ে রাখছিলেন? এর একটা উত্তর সম্ভবত এই যে, ভুট্টো বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে পুনঃসম্পর্ক স্থাপনের সম্ভাবনা তখনো একদম উড়িয়ে দেননি। পাকিস্তান ভাঙার জন্য দেশের ভেতর তাকে অনেকেই দায়ী করেছে। সে কথা মিথ্যা প্রমাণ করা ভুট্টোর জন্য জরুরি হয়ে ওঠে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা খুঁচিয়ে তুলতে যে কোনো সুযোগ সদ্ব্যবহারের অপেক্ষায়ও ছিলেন তিনি। ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্ক শীতল হলে বাংলাদেশ পাকিস্তানের দিকে হাত বাড়াতে পারে, এ কথা ভুট্টো ধরে নিয়েছিলেন। ইসলামি দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে হলে তাকে পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে যেতে হবে—এমন একটা হিসাবও হয়তো তার মাথায় ছিল। বাংলাদেশের কব্জির জোর কম। যুদ্ধের পরপর তার অর্থনীতি মুখ থুবড়ে আছে। এক ভারত ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর কাছ থেকে পাওয়া সাহায্য নিয়ে সে পা শক্ত করে দাঁড়াতে পারবে না, মধ্যপ্রাচ্যের ধনী আরব ও মুসলমান দেশের কাছে তাকে হাত বাড়াতে হবেই। এই অঙ্ক মাথায় রেখে বাংলাদেশের স্বীকৃতি ঠেকাতে ভুট্টো নিজে বিভিন্ন আরব দেশ সফর করেন। একই কারণে জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিরও তীব্র বিরোধিতা করেন তিনি। এ কাজে পাকিস্তান তার দোসর হিসেবে গণচীনকে পেয়েছিল। তারাই ১৯৭২-এর আগস্টে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রশ্নে তার প্রথম ‘ভেটো’ প্রয়োগ করে।

বাংলাদেশকে স্বীকৃতির বিলম্বের অন্য আরেকটি কারণের কথা বলেছেন অধ্যাপক ডেনিস রাইট তাঁর বাংলাদেশ অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ওশান এরিয়াস (স্টার্লিং, নিউদিল্লি, ১৯৮৯) গ্রন্থে। তাঁর ভাষ্যে, ভুট্টো বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্তিত্ব মেনে নিয়েছিলেন কিন্তু দেশটিকে আন্তর্জাতিকভাবে হেনস্তা করার সুযোগ হাতছাড়া করতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। ঠিক এই উদ্দেশ্যেই বারবার বাংলাদেশকে ভারতের অধিকৃত অঞ্চল বলে অভিহিত করেছেন তিনি। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে ভারত যাতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা না ধরে রাখতে পারে, সেই লক্ষ্যে তিনি স্বীকৃতিসহ সব প্রশ্নে বাংলাদেশের সঙ্গে সরাসরি কথা বলছেন, এমন দাবিও করে যাচ্ছিলেন। সে সময় জাতিসংঘে পাকিস্তানি প্রতিনিধি এমন দাবিও করেন যে, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের লক্ষ্যে ভুট্টো মুজিবের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখছেন। বাংলাদেশ অবশ্য সে দাবি মিথ্যা বলে জানিয়ে দেয়। যুদ্ধবন্দী ও আটকে পড়া নাগরিক বিনিময় প্রশ্নে প্রথম ছাড় কিন্তু বাংলাদেশকেই দিতে হলো। সিমলা চুক্তির সূত্র ধরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের আলোচনার সিদ্ধান্ত হয়। ইসলামাবাদে এই আলোচনা বসার তারিখ ঠিক হয় ২৪—৩১ জুলাই ১৯৭৩। আলোচনার বিষয় আটকে পড়া নাগরিক বিনিময়, কিন্তু বাংলাদেশ তাতে অংশ নিচ্ছে না, সেটা বাংলাদেশের জন্য মোটেই লাভজনক ছিল না। ১৭ এপ্রিল ১৯৭৩ তারিখে বাংলাদেশ ও ভারত এক যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, যুদ্ধবন্দী ও আটক সব নাগরিককে একযোগে নিজ নিজ দেশে পাঠানো হবে। এর আগে তিন দেশই মোট সাত ধরনের নাগরিক তাদের বিবেচ্য বিষয় হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই তালিকায় আটকেপড়া বাঙালি ও বিহারি ছাড়াও পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দী ও পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী অন্তর্ভুক্ত ছিল। অধ্যাপক রাইট তাঁর গ্রন্থে ঠিকই বলেছেন যে, যুদ্ধাপরাধীদের আলোচনার বিষয় হিসেবে নির্ধারণ করে বাংলাদেশ কার্যত এ কথা মেনে নেয় যে তাদের বিচার নিয়ে কোনো পূর্বশর্ত তারা আরোপ করবে না। অন্য কথায়, যুদ্ধাপরাধী নিয়ে বিচারের প্রশ্নে বাংলাদেশ অনড় রয়েছে, এই ঘোষণার পর সে কথা আর বিশ্বাসযোগ্য থাকল না।

ভারত-পাকিস্তান আলোচনার প্রথম পর্যায়ে ১ জুলাই ঠিক হলো যে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী ছাড়া সব পাকিস্তানি সেনা দেশে ফিরে যাবে। পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিরাও দেশে ফিরে যাবে। সীমিতসংখ্যক বিহারিকে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারেও পাকিস্তান সম্মত হলো। যে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী বাকি থাকল ঠিক হলো তাদের ব্যাপারে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান নিজেরা আলোচনায় বসবে। চতুর ভুট্টো ঠিক এই সময় ২০৩ জন বাঙালিকে ‘গুপ্তচর’ উল্লেখ করে জানালেন তাদের তিনি দেশে ফেরত পাঠাবেন না। বরং নিজ দেশের আইন অনুযায়ী তাদের বিচার করবেন। সন্দেহ নেই, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আটকানোর জন্যই ভুট্টো এই তথাকথিত ‘গুপ্তচরদের’ বিচারের কথা তুলেছিলেন। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিপদে পড়ল মুজিব সরকার। সব বাঙালিকে নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনা তখন মুজিব সরকারের আশু সমস্যা। দুই মাস পর ২৮ আগস্ট ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে ‘দিল্লি চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়, সেখানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে ছাড় দিতে বাধ্য হলো বাংলাদেশ। সে চুক্তিতে বলা হলো, পাকিস্তান বাঙালি ‘গুপ্তচরদের’ বিচার করবে না। যে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী বাংলাদেশ চিহ্নিত করেছে তাদের বিচার হবে, বাংলাদেশেই হবে, তবে এ ব্যাপারে যদি পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে শুধু তাহলেই। মুজিব ও তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে তাঁদের দৃঢ়তার কথা এর পরও বলেছেন, কিন্তু এই চুক্তির ফলে একতরফাভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ তাঁদের যে আর থাকল না, সেটাও দিনের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। সোজা কথায়, দিল্লি চুক্তির ফলে স্পষ্ট হয়ে গেল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে না। কারণ পাকিস্তান সে প্রশ্নে কখনোই একমত হবে না।

দিল্লি চুক্তিকে পাকিস্তানি পত্রপত্রিকা ‘উপমহাদেশে নতুন সম্পর্কের সূচনা’ বলে অভিহিত করে। এমনকি নিউইয়র্ক টাইমস ২ সেপ্টেম্বর এক সচিত্র প্রতিবেদনে মন্তব্য করে, নতুন সম্পর্ক হয়তো এখনি শুরু হচ্ছে না, কিন্তু এ কথায় কোনো ভুল নেই যে এই তিন দেশের মধ্যে সম্পর্কে নতুন মোড় নিচ্ছে। টাইমস, বিশেষ করে পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী (মিনিস্ট্রি অব স্টেট) আজিজ আহমদের মন্তব্য উদ্ধৃত করে বলল, তিনি চুক্তি স্বাক্ষর করে স্পষ্টত উচ্ছ্বসিত। এক অস্বাভাবিক মূল্যায়নে তিনি ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের তিন নেতাকে (ইন্দিরা, মুজিব ও ভুট্টো) মহান বলে উল্লেখ করেন। অল্প কিছুদিন আগে হলেও তাঁর মুখ থেকে ইন্দিরা বা মুজিবকে ‘মহান’ বলার কথা স্বপ্নেও ভাবা যেত না। দিল্লি চুক্তি স্বাক্ষরের ছয় মাসের মাথায় ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪, লাহোরে ইসলামি সম্মেলন শুরুর প্রাক্কালে, ভুট্টো বাংলাদেশের প্রতি তাঁর দেশের স্বীকৃতির কথা ঘোষণা করেন। অধিকাংশ পর্যবেক্ষকেরই ধারণা, সে স্বীকৃতি ঘোষণার আগে তিনি বাংলাদেশের কাছ থেকে এই মর্মে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছিলেন যে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবে না। সম্মেলনের প্রাক্কালে ইসলামিক কনফারেন্সের কুয়েতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নেতৃত্বে ইসলামি নেতাদের এক প্রতিনিধিদল ঢাকা সফর করে মুজিবের কাছ থেকে সে সম্মতি আদায় করে ফেরেন। ওয়ালপার্ট লিখেছেন, সম্মেলনকেন্দ্র শালিমারবাগে যেভাবে মুহুর্মুহু ‘ভুট্টো-মুজিব ভাই ভাই’ স্লোগান উঠছিল, তাতে কারও সন্দেহই ছিল না যুদ্ধাপরাধীরা শিগগিরই দেশে ফিরবে।

বাংলাদেশকে স্বীকৃতির বিলম্বের অন্য আরেকটি কারণের কথা বলেছেন অধ্যাপক ডেনিস রাইট তাঁর বাংলাদেশ অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ওশান এরিয়াস (স্টার্লিং, নিউদিল্লি, ১৯৮৯) গ্রন্থে। তাঁর ভাষ্যে, ভুট্টো বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্তিত্ব মেনে নিয়েছিলেন কিন্তু দেশটিকে আন্তর্জাতিকভাবে হেনস্তা করার সুযোগ হাতছাড়া করতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। ঠিক এই উদ্দেশ্যেই বারবার বাংলাদেশকে ভারতের অধিকৃত অঞ্চল বলে অভিহিত করেছেন তিনি। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে ভারত যাতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা না ধরে রাখতে পারে, সেই লক্ষ্যে তিনি স্বীকৃতিসহ সব প্রশ্নে বাংলাদেশের সঙ্গে সরাসরি কথা বলছেন, এমন দাবিও করে যাচ্ছিলেন। সে সময় জাতিসংঘে পাকিস্তানি প্রতিনিধি এমন দাবিও করেন যে, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের লক্ষ্যে ভুট্টো মুজিবের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখছেন। বাংলাদেশ অবশ্য সে দাবি মিথ্যা বলে জানিয়ে দেয়। যুদ্ধবন্দী ও আটকে পড়া নাগরিক বিনিময় প্রশ্নে প্রথম ছাড় কিন্তু বাংলাদেশকেই দিতে হলো। সিমলা চুক্তির সূত্র ধরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের আলোচনার সিদ্ধান্ত হয়। ইসলামাবাদে এই আলোচনা বসার তারিখ ঠিক হয় ২৪—৩১ জুলাই ১৯৭৩। আলোচনার বিষয় আটকে পড়া নাগরিক বিনিময়, কিন্তু বাংলাদেশ তাতে অংশ নিচ্ছে না, সেটা বাংলাদেশের জন্য মোটেই লাভজনক ছিল না। ১৭ এপ্রিল ১৯৭৩ তারিখে বাংলাদেশ ও ভারত এক যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, যুদ্ধবন্দী ও আটক সব নাগরিককে একযোগে নিজ নিজ দেশে পাঠানো হবে। এর আগে তিন দেশই মোট সাত ধরনের নাগরিক তাদের বিবেচ্য বিষয় হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই তালিকায় আটকেপড়া বাঙালি ও বিহারি ছাড়াও পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দী ও পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী অন্তর্ভুক্ত ছিল। অধ্যাপক রাইট তাঁর গ্রন্থে ঠিকই বলেছেন যে, যুদ্ধাপরাধীদের আলোচনার বিষয় হিসেবে নির্ধারণ করে বাংলাদেশ কার্যত এ কথা মেনে নেয় যে তাদের বিচার নিয়ে কোনো পূর্বশর্ত তারা আরোপ করবে না। অন্য কথায়, যুদ্ধাপরাধী নিয়ে বিচারের প্রশ্নে বাংলাদেশ অনড় রয়েছে, এই ঘোষণার পর সে কথা আর বিশ্বাসযোগ্য থাকল না।

ভারত-পাকিস্তান আলোচনার প্রথম পর্যায়ে ১ জুলাই ঠিক হলো যে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী ছাড়া সব পাকিস্তানি সেনা দেশে ফিরে যাবে। পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিরাও দেশে ফিরে যাবে। সীমিতসংখ্যক বিহারিকে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারেও পাকিস্তান সম্মত হলো। যে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী বাকি থাকল ঠিক হলো তাদের ব্যাপারে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান নিজেরা আলোচনায় বসবে। চতুর ভুট্টো ঠিক এই সময় ২০৩ জন বাঙালিকে ‘গুপ্তচর’ উল্লেখ করে জানালেন তাদের তিনি দেশে ফেরত পাঠাবেন না। বরং নিজ দেশের আইন অনুযায়ী তাদের বিচার করবেন। সন্দেহ নেই, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আটকানোর জন্যই ভুট্টো এই তথাকথিত ‘গুপ্তচরদের’ বিচারের কথা তুলেছিলেন। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিপদে পড়ল মুজিব সরকার। সব বাঙালিকে নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনা তখন মুজিব সরকারের আশু সমস্যা। দুই মাস পর ২৮ আগস্ট ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে ‘দিল্লি চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়, সেখানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে ছাড় দিতে বাধ্য হলো বাংলাদেশ। সে চুক্তিতে বলা হলো, পাকিস্তান বাঙালি ‘গুপ্তচরদের’ বিচার করবে না। যে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী বাংলাদেশ চিহ্নিত করেছে তাদের বিচার হবে, বাংলাদেশেই হবে, তবে এ ব্যাপারে যদি পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে শুধু তাহলেই। মুজিব ও তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে তাঁদের দৃঢ়তার কথা এর পরও বলেছেন, কিন্তু এই চুক্তির ফলে একতরফাভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ তাঁদের যে আর থাকল না, সেটাও দিনের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। সোজা কথায়, দিল্লি চুক্তির ফলে স্পষ্ট হয়ে গেল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে না। কারণ পাকিস্তান সে প্রশ্নে কখনোই একমত হবে না।

দিল্লি চুক্তিকে পাকিস্তানি পত্রপত্রিকা ‘উপমহাদেশে নতুন সম্পর্কের সূচনা’ বলে অভিহিত করে। এমনকি নিউইয়র্ক টাইমস ২ সেপ্টেম্বর এক সচিত্র প্রতিবেদনে মন্তব্য করে, নতুন সম্পর্ক হয়তো এখনি শুরু হচ্ছে না, কিন্তু এ কথায় কোনো ভুল নেই যে এই তিন দেশের মধ্যে সম্পর্কে নতুন মোড় নিচ্ছে। টাইমস, বিশেষ করে পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী (মিনিস্ট্রি অব স্টেট) আজিজ আহমদের মন্তব্য উদ্ধৃত করে বলল, তিনি চুক্তি স্বাক্ষর করে স্পষ্টত উচ্ছ্বসিত। এক অস্বাভাবিক মূল্যায়নে তিনি ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের তিন নেতাকে (ইন্দিরা, মুজিব ও ভুট্টো) মহান বলে উল্লেখ করেন। অল্প কিছুদিন আগে হলেও তাঁর মুখ থেকে ইন্দিরা বা মুজিবকে ‘মহান’ বলার কথা স্বপ্নেও ভাবা যেত না। দিল্লি চুক্তি স্বাক্ষরের ছয় মাসের মাথায় ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪, লাহোরে ইসলামি সম্মেলন শুরুর প্রাক্কালে, ভুট্টো বাংলাদেশের প্রতি তাঁর দেশের স্বীকৃতির কথা ঘোষণা করেন। অধিকাংশ পর্যবেক্ষকেরই ধারণা, সে স্বীকৃতি ঘোষণার আগে তিনি বাংলাদেশের কাছ থেকে এই মর্মে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছিলেন যে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবে না। সম্মেলনের প্রাক্কালে ইসলামিক কনফারেন্সের কুয়েতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নেতৃত্বে ইসলামি নেতাদের এক প্রতিনিধিদল ঢাকা সফর করে মুজিবের কাছ থেকে সে সম্মতি আদায় করে ফেরেন। ওয়ালপার্ট লিখেছেন, সম্মেলনকেন্দ্র শালিমারবাগে যেভাবে মুহুর্মুহু ‘ভুট্টো-মুজিব ভাই ভাই’ স্লোগান উঠছিল, তাতে কারও সন্দেহই ছিল না যুদ্ধাপরাধীরা শিগগিরই দেশে ফিরবে।

ইসলামিক সম্মেলনে ভুট্টো নিজে একাত্তরের ঘটনার কোনো প্রসঙ্গ তোলেননি, তবে সবকিছু ভুলে গিয়ে পারস্পরিক ক্ষমার ভিত্তিতে ইসলামি দেশগুলোর নিজেদের সমস্যা সমাধানের কথা তিনি বললেন। মুজিব নিজেও সে কথাই বললেন। লাহোরে সম্মেলন থেকে ফেরার পথে তিনি জানালেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তিনি ইতিমধ্যে স্থগিত রেখেছেন, তবে এই প্রশ্নে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ খুব শিগগিরই আলোচনায় বসবে। তিনি আরও বললেন, ‘বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পারস্পরিক স্বীকৃতির ফলে যে নতুন যুগের সূচনা হলো, তার ফলে আমাদের সব সমস্যা সমঝোতার ভিত্তিতে সমাধান সম্ভব হবে’ (ডন, ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪, আইয়ুবের গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ১২৯)।

তিন দেশের মধ্যে সেই আলোচনা বসল দিল্লিতে ৫ এপ্রিল ১৯৭৪। একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের একমাত্র সরকারি ‘দুঃখ’ প্রকাশ, তা রয়েছে এই সম্মেলনের শেষে প্রদত্ত যৌথ বিবৃতিতে অন্তর্ভুক্ত পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্যে। ৯ এপ্রিল তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে চুক্তি স্বাক্ষর করলেন তাতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারটি পুরোপুরি বাদ দেওয়া হলো। খুব সাবধানতার সঙ্গে যে বিবৃতিটি পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজিজ আহমেদ সেখানে যৌথ ঘোষণায় অন্তর্ভুক্ত করেন, তাতে বলা হলো, ‘তার সরকার (অর্থাত্ পাকিস্তান) (একাত্তরে) যে অপরাধ হয়তো সংঘটিত হয়েছে তার প্রতি নিন্দা ও গভীর দুঃখ প্রকাশ করে (হিজ গভর্নমেন্ট কনডেমন্ড অ্যান্ড ডিপলি রিগ্রেটেড এনি ক্রাইম দ্যাট মে হ্যাভ বিন কমিটেড)।’ অর্থাত্ পুরো ব্যাপারটাই পাকিস্তান এক অনিশ্চয়তার আবরণের ভেতর রেখে দিল। যদি যুদ্ধাপরাধ হয়ে থাকে, তাহলে পাকিস্তান দুঃখিত। একই বিবৃতিতে বলা হলো, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী (ভুট্টো) বাংলাদেশের জনগণের কাছে এই বলে আবেদন করেছেন যে সমঝোতার স্বার্থে তারা যেন বিগত ঘটনা ভুলে যায় ও ক্ষমা প্রদর্শন করে। বাংলাদেশ যে ক্ষমা করে দিয়েছে সে কথাও খুব স্পষ্টভাবে জানালেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব। সেই যৌথ বিবৃতিতে বলা হলো, ‘শেখ মুজিব ঘোষণা করেছেন যে, ১৯৭১-এ তার দেশে যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, তিনি চান সে অতীত ভুলে নতুন করে যাত্রা শুরু হোক।’

১১ এপ্রিল ১৯৭৪ নিউইয়র্ক টাইমস ‘পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চেয়েছে’ শিরোনামে তার দিল্লি সংবাদদাতা বার্নাড উইনরবের এক নাতিদীর্ঘ প্রতিবেদন ছাপে। উইনরব তাতে লিখলেন:

‘যদিও পাকিস্তানের ক্ষমা প্রার্থনা সরাসরি ছিল না, যতটা সরাসরি বাংলাদেশ দাবি করেছিল, কিন্তু ভারতীয় ও বাংলাদেশি কর্মকর্তারা মনে করেন পাকিস্তান এ কথা স্বীকার করেছে যে (১৯৭১-এ) তাদের সৈন্যবাহিনীর কেউ কেউ মাত্রাতিরিক্ত কাজ করেছে (‘কমিটেড এক্সেসেস’)। এমনকি পাকিস্তান যে এই চুক্তি স্বাক্ষর করে, তাও একধরনের ক্ষমা প্রার্থনা বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। চুক্তিপত্রে এই মর্মে বাংলাদেশের একটি বিবৃতি অন্তর্ভুক্ত হয় যে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত ১৯৫ জন সৈন্য নানা অপরাধ করেছে, যার অন্তর্গত হলো যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও গণহত্যা।’ মৈত্রীর বৃহত্তর স্বার্থে তাদের প্রতি তার দেশ ক্ষমা প্রদর্শন করেছে বলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন জানালেন।

বাংলাদেশ এই ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে ‘গণহত্যা’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করেই আত্মতৃপ্তি বোধ করল, কিন্তু ভুট্টোর জন্য এই চুক্তি ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বিজয়। তিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন দিল্লিতে, ভুট্টো সে সময় প্যারিসে এক সরকারি সফরে। সেখান থেকে তিনি হুমকি দিয়ে বললেন, এই চুক্তি স্বাক্ষরিত না হলে উপমহাদেশে

সমঝোতার পথ সুদূরপরাহত হবে। পাকিস্তানি কোনো কোনো পত্রিকা এই চুক্তির বিরোধিতা করলেও ভুট্টো দাবি করলেন, তাঁর শক্ত অবস্থানের কারণেই শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি তুলে নিয়েছে। ওয়ালপার্ট লিখেছেন, প্যারিস থেকে ভুট্টো ফিরলেন বিজয়ীর বেশে। তাঁর যত দাবি ছিল, সবই ভারত ও বাংলাদেশ মেনে নিয়েছে। বিনিময়ে তাঁকে শুধু বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হয়েছে।

নিজেকে বিজয়ী ভাবার অবশ্য অন্য আরেক কারণ ছিল ভুট্টোর। ততদিনে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কে উত্তেজনা জমা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ সৃষ্টি তার জনগণের মনে যে আশার সঞ্চার করেছিল, স্বাধীনতার প্রথম তিন বছরের মধ্যেই তা ফিকে হওয়া শুরু করে। দেশে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। পুরোনো সাম্প্রদায়িক চেতনার বশবর্তী হয়ে কেউ কেউ এই সময় পাকিস্তান ভাঙার জন্য ভারত দোষী বলে ভাবাও শুরু করেন। শেখ মুজিব দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেননি, ফলে পাকিস্তানপন্থী রাজনীতিকেরা পেছন দরজা দিয়ে পুনঃপ্রবেশ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁরাই দেশে ভারতবিরোধী মনোভাব চাঙা করে তুললেন। এর সঙ্গে যুক্ত হলো সীমান্তে অবৈধ বাণিজ্য ও ফারাক্কা প্রশ্নে ভারত-বাংলাদেশ মতানৈক্য। খোদ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা ও মুজিবের হস্তক্ষেপের পরেও ফারাক্কা প্রশ্নে দুই দেশের ব্যবধান কমার বদলে বৃদ্ধি পেতে থাকল। মে মাসে দিল্লিতে যে শীর্ষ বৈঠক বসে তা কার্যত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ভুট্টো ঠিক এই সুযোগটিরই অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে দিল্লি ও ঢাকার মধ্যে মতানৈক্য শুধু সময়ের ব্যাপার। ১৯৭২-এর জানুয়ারিতে মুজিবের সঙ্গে পিন্ডির জেলে তাঁর যে কথোপকথন হয়, তা থেকেও তিনি ভেবে থাকতে পারেন যে ভারতীয়দের সঙ্গে খুব বেশিদিন মুজিব হাত মিলিয়ে থাকতে পারবেন না। সে সময় মুজিব মন্তব্য করেছিলেন, বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর আগমন তিনি চাননি। বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের প্রভাব খর্ব করার কথাও মুজিব সে সময় ভুট্টোকে বলেছিলেন। [দেখুন: ওয়ালপার্ট, পৃষ্ঠা ১৭৫]

প্রকৃতপক্ষে, অধিকাংশ পাকিস্তানি পর্যবেক্ষক বাংলাদেশের স্বীকৃতিকে উপমহাদেশে মুসলিম মৈত্রীর জন্য (অর্থাত্ পাকিস্তানের জন্য) লাভজনক বলেই ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন, দৈনিক মুসাওয়াত (২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪) লেখে, ‘পাকিস্তানের শত্রুরা তাকে বিভক্ত করেছে পাকিস্তানকে দুর্বল করতে। তাদের দুরভিসন্ধি ঠেকাতে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জনগণকে নিকটে আনতে, বাংলাদেশকে আগ্রাসনবাদীদের খপ্পর থেকে বাঁচাতে এবং উপমহাদেশে মুসলিমদের অবস্থান দৃঢ় করতে’—বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া সঠিক হয়েছে। আরও স্পষ্ট করে লিখল নওয়া-ই-ওয়াক্ত পত্রিকা। তার ভাষায়, এই চুক্তির ফলে মুজিবের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর পরিবর্তে ভুট্টো যদি বন্ধু হিসেবে জায়গা দখল করে নেয়, তাহলে কাজটা খুব ভালো হয়েছে তা বলতে হবে। (আইয়ুবের গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃষ্ঠা ১৩২)

ঠিক এই রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে ভুট্টো বাংলাদেশ সফরে আসার কথা ঘোষণা করলেন। ওয়ালপার্ট জানিয়েছেন, ভুট্টোর ইচ্ছা ছিল তাঁর ঢাকা সফর বিলম্বিত করার, কিন্তু মে মাসে দিল্লিতে ভারত-বাংলাদেশ শীর্ষ বৈঠক কার্যত ব্যর্থ প্রমাণিত হওয়ায় ‘মুজিবকে তাঁর ও পাকিস্তানের কাছে টানবার’ মোক্ষম সুযোগ এসেছে বলে হিসাব কষলেন তিনি।

১৯৭৪-এর জুন মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকা এলেন ভুট্টো। প্রথম দিনেই একাত্তরের ঘটনার জন্য তওবা চাইলেন তিনি, কিন্তু কোথাও গণহত্যা শব্দটি ব্যবহার করলেন না, এমনকি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে তার ভূমিকার জন্য দোষারোপ পর্যন্ত করলেন না। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ‘পরস্পরকে ক্ষমা ও পূর্বের ঘটনা ভুলে যাবার ভেতর দিয়ে’ সম্পর্কের নতুন দিগন্তের সূচনা করবে, এ কথা ভুট্টো বেশ কয়েকবারই বলেছেন। যেমন, ১৯৭৩-এর জুলাই মাসে জাতীয় আইন পরিষদে মধ্যরাতে এক আবেগময়ী ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি একে অপরের সঙ্গে মিলিত হতে চাই, একে অপরের সঙ্গে আলিঙ্গন করতে চাই, অতীতে যা হয়েছে তা নিয়ে একে অপরে একসঙ্গে অশ্রুপাত করতে চাই।’ (টাইম, ২৩ জুলাই ১৯৭৩)

তাঁর তওবা চাওয়া যতই নাটকীয় মনে হোক, নতুন কোনো কথাই তিনি ঢাকায় এসে বললেন না। সত্যি বলতে কি, তাঁর কোনো প্রয়োজনও তিনি দেখেননি। তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে ঢাকায় যে আবেগের ঢল নামে, তা দেখেই তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়, বাংলাদেশে অনেকেই পাকিস্তান ভাঙা নিয়ে খুশি নয়, ভারতের ব্যাপারেও বাঙালিদের মনোভাব দ্বিধাবিভক্ত। এমনকি একাত্তর নিয়েও বিতর্ক এ দেশে শেষ হয়নি। ঢাকায় অবস্থানকালে ভুট্টো নানাভাবে বাংলাদেশের প্রতি তাঁর অবজ্ঞা প্রকাশ করেন। সাভার স্মৃতিসৌধে নিমরাজি গেলেন, কিন্তু ইচ্ছে করে দুই ঘণ্টা বিলম্ব করলেন। শর্ত দিয়েছিলেন, সেখানে ফুল দেওয়ার সময় কোনো গার্ড অব অনার দেওয়া চলবে না, কোনো বিউগল বাজানো যাবে না, শহীদদের উদ্দেশে কোনো ‘গান স্যালুট’ও হবে না। নিয়মিত পোশাকের বদলে টি-শার্ট ও গলফ টুপি পরে গেলেন তিনি, স্পষ্টতই স্মৃতিসৌধের প্রতি অসম্মান দেখানোর উদ্দেশ্যেই। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশের শহীদ মিনারে যেতে অনুরোধ করেছিল, কিন্তু ভুট্টো এক কথায় তা না করে দিলেন। বলা যায়, তাঁর প্রতিটি কথায়, প্রতিটি কাজে ভুট্টো বুঝিয়ে দিলেন তাঁর ‘তওবা’ শুধু কথার কথা। আসলে একাত্তরের ঘটনার জন্য তিনি বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নন।

ভুট্টোর ঢাকা সফরের একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন ভারতীয় কূটনীতিক জে এন দিক্ষিত। সে সফরের প্রতিবাদে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সুবিমল দত্ত পদত্যাগ করে দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। তাঁর জায়গায় ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পান দিক্ষিত। তাঁর লিবারেশন অ্যান্ড বিয়োন্ড (ইউ. প্রেস, ঢাকা, ১৯৯৯) গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, এয়ারপোর্ট থেকে ভুট্টোর মোটর শোভাযাত্রা শহরে যাওয়ার সময় নাগরিক আগ্রহ ও উত্তেজনা চরমে পৌঁছে। ভুট্টো ও পাকিস্তানের পক্ষে স্লোগানে শহর তখন মুখরিত। লক্ষণীয় যে এসব স্লোগানের অনেকই মুজিব ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ছিল। শোনা গেছে, কেউ কেউ মুজিবের গাড়ি লক্ষ্য করে জুতার মালা ছুড়ে মারে। দিক্ষিতের গাড়িও জনতার আক্রমণের শিকার হয়। দিক্ষিত যখন তাঁর অফিসে পৌঁছান, তখন তাঁর চোখে ক্রোধের অশ্রু। (পৃষ্ঠা ১৯০)

৩.

একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা প্রার্থনার প্রশ্নটি নতুন করে চাঙা হয়ে ওঠে নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনর্বহাল হওয়ার পর। এই সময় দেশে একাত্তরের ঘাতক ও দালালদের বিচারের দাবি নিয়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম দেশজুড়ে এক ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলেন। সে আন্দোলনের ফলে কোনো ঘাতক বা দালালকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি বটে, কিন্তু একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার পক্ষে স্পষ্ট নাগরিক মনোভাব গড়ে ওঠে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামেও বাঙালিরা লবি করা শুরু করে। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ক্ষমতাসীন জাতীয়তাবাদী দল অবশ্য এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। ঘাতক-দালাল আন্দোলন সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হলে নিউইয়র্কে এক সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া উল্টো প্রশ্ন করেন, ‘জাহানারা ইমাম, তিনি আবার কে?’ খালেদা সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক গাঢ় করার ব্যাপারেও বিশেষ উদ্যোগ নেয়। ফলে সামরিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে তার সময় দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়। এর আগে ১৯৭৭ সালে জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়া পাকিস্তান সফর করে এই সম্প্রসারিত সম্পর্কের ভিত্তি পুঁতে আসেন।

১৯৯৬-তে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তানের ক্ষমার প্রশ্নটি আবার রাজনীতির কেন্দ্রে এসে পড়ে। ঘাতক-দালাল আন্দোলনের সাফল্যের কারণেই গণহত্যা ও তাতে পাকিস্তানি ভূমিকা পুনঃপুন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে, বাঙালি মানসেও সে প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ সময় পাকিস্তানি দূতাবাসের সামনে একাধিক জঙ্গি মিছিল করে ক্ষমা প্রার্থনার দাবি জানায়, সে দাবি পূরণ না হলে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের দাবিও তোলেন কেউ কেউ।

ক্ষমার প্রশ্নটি পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক যুদ্ধের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ১৯৯৯ সালে। সে বছর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেসব দেশে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি তোলেন। অনেকেই তাঁর এ দাবিকে পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল মোশাররফের প্রতি নিক্ষিপ্ত বলে ব্যাখ্যা করেছেন। হাসিনার সেই মন্তব্যকে উপলক্ষ করে নিউইয়র্কে মোশাররফ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর এক নির্ধারিত সাক্ষাত্কার বাতিল করে দেন। এর কয়েক মাসের মধ্যেই ঢাকায় পাকিস্তানি সহকারী রাষ্ট্রদূত ইরফান রিজাকে অকূটনৈতিক ব্যবহারের জন্য বহিষ্কার করা হয়। ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে রিজা একাত্তরের গণহত্যার কথা অস্বীকার করেছিলেন এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ভূমিকা অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয় বলে মন্তব্য করেছিলেন। রিজার বহিষ্কারের পর প্রধানমন্ত্রী হাসিনা নিজে একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের কাছ থেকে সরকারিভাবে ক্ষমা প্রার্থনার দাবি তোলেন। অনেকেরই ধারণা, ক্ষমা প্রার্থনা বা ঘাতক-দালালদের বিচারের প্রশ্নে আওয়ামী সরকারের এই ভূমিকা শুধু লোক দেখানো ছিল, এ ব্যাপারে তারা সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণে মোটেই আগ্রহী ছিল না। হাসিনা সরকারের আমলে এই দুই প্রশ্নের কোনোটির যে অগ্রগতি হয়নি, তা থেকেই এ কথা প্রমাণ হয়। আন্তর্জাতিক কোনো ফোরামেও এ নিয়ে কথা তোলেননি তাঁরা। কেউ কেউ বলেছেন, একাত্তরের প্রশ্ন ব্যবহার করে রাজনৈতিক ও নির্বাচনী ফায়দা আদায়ের বাইরে মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে কোনো নীতিগত পদক্ষেপই নেয়নি হাসিনা সরকার।

২০০২ সালের জুলাই মাসে ঢাকা বেড়াতে আসেন পাকিস্তানের সামরিক শাসক মোশাররফ। সে সময় তিনি সাভার স্মৃতিস্তম্ভের মন্তব্য খাতায় যে কথা লেখেন, কেউ কেউ তাকে একাত্তরের গণহত্যার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা বলে অভিহিত করেছেন। অনেকেই অবশ্য সে মূল্যায়নের সঙ্গে একমত নন। মোশাররফ সে সময় লেখেন, ‘আপনাদের পাকিস্তানি ভাই ও বোনেরা একাত্তরের ঘটনাবলির জন্য আপনাদের বেদনার সঙ্গে একাত্মবোধ করে। সেই দুর্ভাগ্যজনক সময়ে যে মাত্রাতিরিক্ত ঘটনা ঘটে, তা দুঃখজনক।’ পরে রাষ্ট্রীয় ভোজে ভাষণ দিতে গিয়ে মোশাররফ তাঁর ‘দুঃখে’র কথা পুনর্ব্যক্ত করে বললেন, ‘পাকিস্তানে আমার ভাই ও বোনেরা একাত্তরের দুর্যোগপূর্ণ ঘটনাবলির জন্য তাদের বাংলাদেশি ভাই ও বোনের সঙ্গে গভীর শোক বোধ করে। এই ট্র্যাজেডি, যা আমাদের দুই দেশের ওপর ক্ষতচিহ্ন রেখে গেছে, তার জন্য আমরা দুঃখিত।’

গণহত্যাকে ‘মাত্রাতিরিক্ত ঘটনা’ হিসেবে অভিহিত করা এবং এক লাইনের মৌখিক দুঃখবোধকে ক্ষমা প্রার্থনা বলে মেনে নেওয়া যায় কি না, তা নিয়ে বাংলাদেশে সে সময় বিস্তর তর্ক-বিতর্ক হয়। সরকারিভাবে তাত্ক্ষণিকই তাকে ক্ষমা প্রার্থনা বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, ‘দুঃখ প্রকাশ’ করে পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশকে যেন অসীম কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করলেন, একই ভোজসভায় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া নিজেই সে কথা জানিয়ে দিলেন। খালেদা বললেন, ‘একাত্তরের ঘটনাবলির জন্য, এমন খোলামেলা বক্তব্যের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। এই বক্তব্য, কোনো সন্দেহ নেই—পুরোনো ক্ষত মেটাতে সাহায্য হবে। আমরা ভবিষ্যতের দিকে তাকে চাই এবং ভাইয়ের মতো একযোগে কাজ করতে চাই।’ শুধু এ কথা বলেই খালেদা থামলেন না। তিনি দাবি করলেন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক এখন পরিণত আকার নিয়েছে। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করতে তাঁর সরকার দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ, আর সে জন্য ‘ভবিষ্যতের দিকে আমরা পূর্ণ আস্থার সঙ্গে তাকাতে পারি।’ গণহত্যার জন্য ক্ষমা প্রার্থনার প্রশ্নটি আলোচিত হবে কি না, এ প্রশ্ন উঠলে খালেদার পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার চেয়ে এক কদম এগিয়ে এসে সংবাদমাধ্যমকে বললেন, আমরা মহামান্য পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতির এই সফরের সময় ক্ষমা প্রার্থনার মতো বিষয় আলোচনা করে তাঁকে বিব্রত করতে চাই না। সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীও জানালেন, মহামান্য অতিথির কথায় প্রকৃত দুঃখবোধ প্রকাশিত হয়েছে, ফলে এ নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই।

বিরোধী আওয়ামী লীগ অবশ্য মোশাররফের বক্তব্য কেবল শুকনো কথা, আসলে এর কোনো অর্থ নেই বলে তা প্রত্যাখ্যান করল। শুধু তা-ই নয়, সফররত রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে আওয়ামী নেতাদের একটি নির্ধারিত সাক্ষাত্কারও তারা বাতিল করে দেয়। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের আহ্বানে ৩০ জুলাই এই প্রশ্নে ঢাকায় এক দিনের হরতালও পালিত হয়।

মোশাররফের ‘দুঃখ প্রকাশ’ নিয়ে পাকিস্তানেও কম তর্ক-বিতর্ক হলো না। পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশন স্পষ্টভাবে বলল, মোশাররফ দুঃখ প্রকাশ করে ঠিক করেছেন, কিন্তু শুধু এই দুঃখ প্রকাশই যথেষ্ট নয়। মোশাররফ দেশে ফিরে আসার পরপর কমিশন পূর্ণ পাতা বিজ্ঞাপন দিয়ে জানায়, পাকিস্তানের সুশীল সমাজ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যে ঘটনা ঘটে, তা কোনোক্রমেই সমর্থন করে না। ৫১টি সুশীল সমাজভুক্ত গোষ্ঠীর স্বাক্ষরিত সে বিবৃতিতে স্পষ্টভাবে বলা হলো, একাত্তরে বাংলাদেশে যা ঘটেছে, তা গণহত্যা। মোশাররফের দুঃখ প্রকাশের ভেতর দিয়ে সেই গণহত্যার জন্য ক্ষমা প্রার্থনার অনুভূতি প্রকাশিত হলেও তা যথেষ্ট নয়। পাকিস্তান এখনো পুরোপুরি ক্ষমা প্রার্থনা করেনি।

৪.

ভুট্টো থেকে মোশাররফ, পাকিস্তানের সরকারি নেতাদের ভেতর কেউই একাত্তরের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের জন্য পাকিস্তানের দায়িত্ব স্বীকার করেননি, অথবা এ জন্য তাঁরা অনুতপ্ত, এ কথা বলেননি। এমনকি ‘গণহত্যা’ এ কথাটি তাঁরা কেউই মুখ দিয়ে উচ্চারণ করেননি অথবা বাংলাদেশের সংগ্রামকে মুক্তিযুদ্ধ বলেও তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করেননি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের লোক দেখানো দুঃখ প্রকাশের পেছনে কূটনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করেছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের ভাবনা মাথায় থেকেছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দূরত্ব সৃষ্টি এবং ভারতের বিরুদ্ধে পাক-বাংলা জোট গঠনের চেষ্টা পাকিস্তান বরাবর অনুসরণ করেছে। দুঃখ প্রকাশ করলে সে কাজে সুবিধা হবে, সেই ভেবেই চতুর কূটনীতিকের ভাষায় হয় ‘আপোলজি’ নয়, ‘রিগ্রেট’ বলে তাঁরা দায়িত্ব শেষ করেছেন।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশের নিজের ব্যর্থতাও কম নয়। যুদ্ধাপরাধী বিচারের প্রশ্নে অনমনীয় থাকার ব্যর্থতার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের প্রথম সরকার তাদের দুর্বলতা প্রকাশ করে। ১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের পর পাকিস্তানের সঙ্গে দোস্তিতে আগ্রহ বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি সরকার নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে প্রকাশ করেছে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয় জেনারেল জিয়াউর রহমানের সময়। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে একঘরে করার লক্ষ্যে সার্ক বা দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা গঠনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এ কাজে তাঁকে জোর সমর্থন দেয় পাকিস্তান। ১৯৭৭ সালে পাকিস্তানে জেনারেল জিয়ার সরকারি সফরের পর দুই দেশের সম্পর্ক জোরদার হয়। সে কথা উল্লেখ করে পাকিস্তানি গবেষক, করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনিস আহমার লিখেছেন, এই সফরের পর স্পষ্ট বোঝা গেল, দুই দেশের মানুষ মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হতে কতটা আগ্রহী। দুই দেশের সম্পর্কে এতদিন যে অসদ্ভাব বজায় ছিল, জিয়া ক্ষমতায় আসার ফলে তার জায়গায় এক নতুন উষ্ণ সম্পর্কের সূচনা হলো (দেখুন: পাকিস্তান অ্যান্ড বাংলাদেশ, বিআইআইএসএস পেপারস, নম্বর-২৯, ঢাকা, ২০০৩)।

উল্লেখ্য, সে সফরের পর শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ পাকিস্তান বাংলাদেশকে একটি বোয়িং-৭০৭ বিমান ও ২৮টি রেলওয়ে বগি উপহার দেয়। জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা ১৯৯০ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর দুই দেশের সম্পর্কে ক্রম-উষ্ণতা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করেন। বিশেষভাবে ২০০১ সালে দ্বিতীয় দফা ক্ষমতা গ্রহণের পর কূটনৈতিক পর্যায়ে এই দুই দেশের মধ্যে ক্রম-নৈকট্য পরিলক্ষিত হয়। ২০০৬ সালের গোড়ার দিকে খালেদা জিয়া নিজে পাঁচ দিনের জন্য পাকিস্তান সফর করে আসেন।

এই আপাত ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়েছে, এ কথা বলা বোধহয় পুরোপুরি যৌক্তিক হবে না। কূটনৈতিক পর্যায়ে যে সদ্ভাব রয়েছে, তা নাগরিক পর্যায়ে সম্প্রসারিত হয়নি। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে তার কণামাত্রও নেই। এর একটা কারণ অবশ্যই একাত্তরের রক্তক্ষরণ। একাত্তরের চেতনা এখন হয়তো অনেক ধূলিমলিন, কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির ইতিহাস বোধকে সজ্ঞানে অথবা তার অজান্তে এখনো উজ্জীবিত করে। মুক্তিযুদ্ধের সাড়ে তিন দশক অতিবাহিত হওয়ার পর নতুন যে প্রজন্ম আজ বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর বৃহদাংশ, তাদের কারোরই পাকিস্তান নিয়ে কোনো স্মৃতি নেই, তাদের পাকিস্তানের প্রতি কোনো আদর্শগত ও আনুভূতিক আনুগত্য থাকারও কথা নয়। বহুলাংশে অনুষ্ঠানসর্বস্ব হলেও ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর বাঙালিকে তার ইতিহাসের দিকে মুখ ফেরাতে বাধ্য করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের ক্ষমা প্রার্থনার প্রশ্নটিও ঘুরেফিরে বিবেচনার কেন্দ্রে প্রায় অনিবার্যভাবে উঠে আসে। পাকিস্তান নিঃশর্তভাবে ও সরকারি পর্যায়ে এই প্রশ্নে ক্ষমা প্রার্থনা না করা পর্যন্ত এই প্রশ্নের সমাধান হবে না। আর সে কারণে এই দুই দেশ তাদের সম্পর্ককেও পুরোপুরি স্বাভাবিক করে আনতে পারবে না।

শুধু পাকিস্তানের ক্ষমা প্রার্থনা নয়, একাত্তরের অনেক প্রশ্নেরই এখনো সম্পূর্ণ সমাধান হয়নি। যেমন স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ঘাতক-দালালদের বিচারের প্রশ্ন। এসব প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত বলেই তা প্রায় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়ে পরিণত হয়। এমনকি পাঠ্যপুস্তকে পর্যন্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যতদিন বাংলাদেশ তার নিজের ইতিহাস তথ্য ও যুক্তির বদলে শুধু আবেগ দিয়ে অনুসরণ করবে, ততদিন বাঙালির নাবালকত্ব ঘুচবে না।

২১ মার্চ ২০০৭, নিউইয়র্ক

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৭ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত