‘লেনিনের তাত্ত্বিক কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো পরাধীন জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের প্রশ্ন। এই নীতির কেন্দ্রে রয়েছে এই ঘোষণা যে প্রতিটি বিপ্লবী সর্বহারা শ্রেণি—প্রতিটি জাতির শ্রমিক শ্রেণি—নিজেদের ইচ্ছামতো রাষ্ট্র গঠন, অন্য কোনো বহুজাতিক রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্তি অথবা তেমন কোনো রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন করার অধিকার রাখে। লেনিন লিখেছিলেন, কোনো জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের অর্থ হলো বিজাতীয় শাসনব্যবস্থা থেকে তার বিযুক্তি ও স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র গঠন।’
১৯৭১ সালে ১২ ডিসেম্বর, বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতাপ্রাপ্তির দ্বারপ্রান্তে, মুক্তিযুদ্ধে মরণপণ লড়াইয়ে লিপ্ত এই দেশের প্রতি তাঁর দেশের সংহতি প্রকাশ করে এ কথা বলেছিলেন জাতিসংঘে (সাবেক) সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থায়ী প্রতিনিধি ইয়াকফ মালিক। সেই প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক ফোরামে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যে একটি জাতীয় মুক্তি আন্দোলন, তার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়।
নিজের অবস্থান বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করে মালিক সেদিন আরও বলেন, ‘আমরা যদি উটপাখির মতো মাথা গুঁজে থাকতে চাই, তাহলে এ নিয়ে ভাবার কিছু নেই। কিন্তু বাস্তব সত্য যদি আমরা জানতে চাই, কেন এই দুই দেশ (ভারত ও পাকিস্তান) যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে, তাহলে এই সংকটের মূল কারণ জানতে হবে। এই ঘটনার কারণ নিরূপণ করতে হবে। তা না করে আমরা অবশ্য ভিন্নপথেও যেতে পারি। আমরা বিদ্রোহ বা বিদ্রোহীদের কথা বলতে পারি। কিন্তু যে যা-ই বলি, (এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই) এই বিদ্রোহ বস্তুত একটি জাতীয় মুক্তি আন্দোলন (ন্যাশনাল লিবারেশন মুভমেন্ট), যার নেতৃত্বে রয়েছে একটি জাতীয় মুক্তি বাহিনী (ন্যাশনাল লিবারেশন ফোর্সেস)।’
সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে এই স্বীকৃতির গভীর রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল। জাতিসংঘের অভ্যন্তরে অধিকাংশ দেশ সেই সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে বিরাজমান যুদ্ধাবস্থাকে পাকিস্তানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে ধরে নিয়েছিল। চীন সে যুদ্ধকে ভারতের সম্প্রসারণবাদ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে একটি অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধ ভিন্ন অন্য কিছু মানতে চায়নি। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল ভারত, যে গোড়া থেকেই এই যুদ্ধকে একটি জাতির মুক্তিসংগ্রাম হিসেবে আখ্যায়িত করে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর গোড়া থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানের সামরিক হামলার তীব্র সমালোচনা করলেও তাকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। সে স্বীকৃতির অর্থ দাঁড়াত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অনিবার্য বলে মেনে নেওয়া ও তার প্রতি সমর্থনের নৈতিক ও রাজনৈতিক যুক্তি গ্রহণ করা। কিন্তু একাত্তরের অধিকাংশ সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানের সরাসরি বিরুদ্ধাচরণের বদলে তার সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ রাজনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক রণকৌশল অনুসরণ করে। পাকিস্তান ছিল মস্কোর জন্য নিকটপ্রাচ্য ও মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের সম্ভাব্য প্রবেশদ্বার। ১৯৭১-এর মার্চ-এপ্রিলে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ২৪তম কংগ্রেসে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতা রাজেশ্বর রাও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বাংলাদেশের পক্ষ সমর্থনের প্রশ্নটি নিয়ে সোভিয়েত কমিউনিস্ট নেতা পানমরিয়েফের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। রুশ নেতা এ ব্যাপারে তাড়াহুড়া না করার ও ইন্দিরা গান্ধী যাতে ‘রাজনৈতিক সমাধানের’ চেষ্টা করেন, তার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
অবস্থা বদলে যায় সে বছর জুলাই মাসে হেনরি কিসিঞ্জারের পিকিং সফর শেষে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নতুন আঁতাত প্রতিষ্ঠার খবর প্রকাশিত হওয়ার পর। নিজের রাজনৈতিক ও কৌশলগত রণনীতির প্রয়োজনেই মস্কোকে দিল্লির সঙ্গে নিকটতর সামরিক ও রাজনৈতিক মৈত্রী সুদৃঢ় করার প্রয়োজন দেখা দেয়। ৯ আগস্ট স্বাক্ষরিত হয় ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি। বাংলাদেশ প্রশ্নে পাকিস্তান, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আঁতাত মোকাবিলা করতেই এই চুক্তি। সে সময় থেকে সোভিয়েত তথ্যমাধ্যমে ও আলোচনা ও বিবৃতিতে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ধারণাটির প্রয়োগ হলেও তার কোনো আনুষ্ঠানিক ব্যবহার ছিল না। কারণ, জাতীয় মুক্তি আন্দোলন হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সব মুক্তিকামী শক্তির অংশগ্রহণে একটি পূর্ণাঙ্গ মুক্তি আন্দোলনে রূপান্তর।
সে কথায় যাওয়ার আগে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ধারণাটি বিবেচনা করা যাক। ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে অধীন জাতিসমূহের সংগ্রামকে একটি আন্তর্জাতিক মুক্তি আন্দোলনের বৃত্তে বিবেচনার প্রথম তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের, এ কথায় কোনো ভুল নেই। তবে তারও আগে, মার্ক্স ও এঙ্গেলস উপনিবেশবাদ ও ধনতন্ত্রের নিকট-সম্পর্ক নির্ণয় করে পদানত জাতিসমূহের মুক্তির পথ হিসেবে কমিউনিস্ট বিপ্লবের প্রস্তাব করেছিলেন। সে রেখাচিত্র অনুসরণ করেই লেনিন উপনিবেশবাদবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সংহতির প্রশ্নটির একটি তাত্ত্বিক প্রস্তাবনা উপস্থিত করেন। লেনিন তাঁর ‘জাতীয় ও উপনিবেশবাদ প্রসঙ্গে’ যে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ১৯২০ সালের দ্বিতীয় কমিন্টার্নে উপস্থিত করেন, তাতে বিশ্ববিপ্লবের সম্ভাবনা বিবেচনার সময় জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতি সমর্থন একটি প্রয়োজনীয় শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেন। উপনিবেশসমূহে যে সশস্ত্র আন্দোলন তত দিনে দানা বাঁধা শুরু করেছে, তা পুরোপুরি সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে বুর্জোয়া বা পাতিবুর্জোয়া শ্রেণির নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে, সে কথা স্বীকার করেও লেনিন বৃহত্তর লক্ষ্য মাথায় রেখে এই আন্দোলনের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থনের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব দেন।
লেনিন দুই ধাপে এই সমর্থন কার্যকর করার পক্ষে মত দেন। প্রথমত, সর্বহারা শ্রেণির প্রতি তাদের উপনিবেশবাদী আন্দোলনে সুস্পষ্ট সমর্থন; এবং দ্বিতীয়ত, এই লড়াইয়ে চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে প্রলেতারীয় গ্রুপগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করা। লেনিনের যুক্তি ছিল, এই আন্দোলন যা মূলত উপনিবেশবাদবিরোধী, তার সফল বিজয়ের মাধ্যমে বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লব অর্জিত হবে। সেহেতু বুর্জোয়া শ্রেণির নেতৃত্বে পরিচালিত হলেও এই আন্দোলনে কমিউনিস্ট জোটের সমর্থন প্রয়োজন। বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতি সমর্থন জানালেও সর্বহারা আন্দোলন তার সঙ্গে একীভূত হবে না, বরং সে নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখবে।
উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াইতে পদানত দেশসমূহকে সমর্থনের এই থিসিসের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করে দ্বিতীয় কমিন্টার্নে একটি পাল্টা তত্ত্ব উপস্থিত করেন মানবেন্দ্রনাথ রায়। ভারতের উদাহরণে তিনি লেখেন, বুর্জোয়া নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনের ফলাফল যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে পরিণত হবে, এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই। ভারতের বুর্জোয়া নেতৃত্ব এখনো সামন্ততান্ত্রিক, সে আন্দোলনের নেতা গান্ধী আদৌ কোনো বিপ্লবী নন। এম এন রায় উপনিবেশসমূহে ‘বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনের’ পরিবর্তে ‘জাতীয় বিপ্লবী’ শক্তিসমূহের সঙ্গে সংহতির প্রস্তাব দেন। লেনিনের ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে এম এন রায়ের এই সম্পূরক তত্ত্বটি সম্মেলনে গৃহীত হয়, তবে টিপ্পনী হিসেবে লেনিন সেখানে এই কথা জুড়ে দেন যে, ‘জাতীয় বিপ্লব’ ও ‘বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব’, এই দুইয়ের মধ্যে বিশেষ কোনো তফাত নেই, কারণ অনুন্নত উপনিবেশসমূহে অধিকাংশ জনগোষ্ঠীই কৃষক শ্রেণিভুক্ত, সেখানে কমিউনিস্ট চেতনাবাহী শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্ব এখনই প্রতিষ্ঠিত হবে, তা ভাবার কোনো কারণ নেই।
১৯২০ সালে যে যুক্তির ভিত্তিতে এম এন রায় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন হিসেবে নির্দেশ করতে অনাগ্রহী ছিলেন, ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ঠিক সে কারণে সোভিয়েত রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। এই যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লিগ, প্রগতিশীল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রশ্নে তার সংহতি সত্ত্বেও এই দলের মোদ্দা চরিত্র ছিল বুর্জোয়া ও আধা বুর্জোয়া এবং বহুলাংশে সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব দ্বারা প্রভাবিত। এই দলের নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন তাঁদের কেউই শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। একই সময় বাংলাদেশে অত্যন্ত সচল শ্রমিক ও কমিউনিস্ট আন্দোলন সক্রিয় ছিল, এমনকি মস্কোপন্থী হিসেবে বিবেচিত একাধিক রাজনৈতিক দল ও উপদল রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিল। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ সত্ত্বেও এই যুদ্ধের রণনীতি বা রাজনৈতিক ও আদর্শগত প্রশ্ন বিবেচনায় তাদের কোনো সরাসরি অংশগ্রহণ ছিল না। অন্য কথায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে তার আদর্শিক বিবেচনা থেকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন হিসেবে সমর্থনের কোনো তাগিদ সোভিয়েত ইউনিয়নের ছিল না।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের গোড়া থেকেই এই লড়াইয়ের সঙ্গে জড়িত ছিল। ভারতের সমর্থনে এই দলভুক্ত রাজনৈতিক কর্মী ও সমর্থকদের সীমিত পরিমাণে হলেও সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়। তবে চীনাপন্থী ভাসানী ন্যাপ ও একাধিক বামপন্থী দল ও গ্রুপ ভারতীয় সমর্থন বলয়ের বাইরে থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা অথবা অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের নীতিনির্ধারণ ব্যবস্থাপনায় তারা কেউই প্রথমাবধি আদৌ কোনো ভূমিকা পালনে সক্ষম হয়নি। বস্তুত, নিজ দলের বাইরে অন্যান্য সমমনা দল ও নেতা নিয়ে কোনো সমন্বিত নেতৃত্ব গঠনের বিবেচনা আওয়ামী লীগের ছিল না। পরে এই অবস্থার সামান্য পরিবর্তন ঘটে, মুখ্যত সোভিয়েত চাপের কারণেই।
বাংলাদেশে সামরিক হামলার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের কঠোর সমালোচনা ও বাংলাদেশের পক্ষে আপাত সোভিয়েত সমর্থন সত্ত্বেও আগস্ট মাসে ভারত-সোভিয়েত চুক্তি স্বাক্ষরের আগ পর্যন্ত মস্কো তার স্ববিরোধী অবস্থান বজায় রাখে। বাংলাদেশের প্রশ্নটি পাকিস্তান বিভক্ত না করেও সমাধান সম্ভব, এমন একটি বিবেচনা মস্কোর রাজনৈতিক সমীকরণে অধিক গুরুত্ব লাভ করে। ভারত ও বাংলাদেশের মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের জন্য মস্কোর এই অবস্থান কঠিন সমস্যার সৃষ্টি করে। এ ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য কমিউনিস্ট নেতৃত্বের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার সুযোগ আসে মে মাসের মাঝামাঝি বুদাপেস্টে বিশ্ব শান্তি পরিষদ আয়োজিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের সমর্থনে সে সম্মেলনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির একটি প্রতিনিধিদল বুদাপেস্টে এসে হাজির হয়।
বন্ধুপ্রতিম কমিউনিস্ট দেশ ও বিশ্বের প্রগতিশীল বামপন্থী দলসমূহের প্রতিনিধিরা বুদাপেস্ট সম্মেলনে যোগ দেওয়ায় বাংলাদেশের পক্ষে আশা করা হয়েছিল তারা স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে সক্ষম হবেন। বাংলাদেশ প্রশ্নটি আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা হয়, কিন্তু তাতে তেমন সমর্থন মেলেনি। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল স্বাধীনতার সপক্ষে একটি ঘোষণাপত্র এনেছিল। তাতে স্বাক্ষরের ব্যাপারে পশ্চিম ইউরোপীয় দেশসমূহ আগ্রহী হলেও সোভিয়েত ব্লকভুক্ত দেশসমূহের কাছ থেকে তেমন সমর্থন মেলেনি। বাংলাদেশ দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির ডা. সারওয়ার আলী। তিনি পরে নিজ স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ব্যাপারটা নিয়ে তাঁরা মস্কোতে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন, কিন্তু সেখানেও খুব ভালো খবর কিছু পাননি। সে সময় মস্কোতে ভারতের রাষ্ট্রদূত ডি পি ধর তাঁদের আশ্বাস দিয়েছিলেন, শিগগিরই ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হতে যাচ্ছে। তারপর পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে যাবে।
৯ আগস্ট ভারত-সোভিয়েত চুক্তি যে একাত্তরের মোড় ফেরানো একটি ঘটনা, তা আমরা জানি। এই চুক্তির একটি অপ্রত্যক্ষ ফল ছিল, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দল ও গ্রুপসমূহের একটি যুক্তফ্রন্ট গঠনের তাগিদ। লেনিন ঔপনিবেশিক অঞ্চলসমূহের জনগণের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে কমিউনিস্ট শিবিরের সমর্থনের পূর্বশর্ত হিসেবে যে ঐক্যের তাগাদা দিয়েছিলেন, এবার অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের ওপর তা বাস্তবায়নের জন্য চাপ শুরু হলো। এ ব্যাপারে ভারত সরকারের পক্ষে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এলেন মস্কোতে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত ডি পি ধর।
কোনো কোনো ভারতীয় লেখক দাবি করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের গোড়া থেকেই ভারত সে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এমন গণতান্ত্রিক ও বামপন্থী দলগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণে উৎসাহ জুগিয়েছিল। কিন্তু গোড়াতেই সমস্যা সৃষ্টি করে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর ব্যবস্থাপনায় শুধু আওয়ামী লীগ সমর্থক ও সদস্যদের নিয়ে ‘মুজিব বাহিনী’ গঠনের সিদ্ধান্ত। বিভিন্ন দল ও নির্দলীয় যুবকদের নিয়ে ইতিমধ্যে যে মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়েছিল, তারা নানাভাবে উপেক্ষিত হয় এবং তাদের প্রতি ভারত সরকারের অনাগ্রহ নিয়ে কিছুটা উত্তেজনারও সৃষ্টি হয়। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই মাওলানা ভাসানীকে কার্যত গৃহবন্দী করার সিদ্ধান্তে ভাসানীপন্থী ন্যাপ ও চীনঘেঁষা বামপন্থী মহলে অসন্তোষ গড়ে ওঠে। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের ভেতরেও নেতৃত্ব নিয়ে মতবিরোধ ছিল, প্রধানত অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কেন্দ্রীয় ভূমিকা নিয়ে। শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বে একদল শীর্ষস্থানীয় নেতা কার্যত তাজউদ্দীনের নেতৃত্বের প্রতি প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন।
এই জটিল অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলার মুখে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি ব্যাপকভিত্তিক ফ্রন্ট গঠনের প্রস্তাব ওঠে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা বলার পর বর্ষীয়ান নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ বিষয়টি নিয়ে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন জুলাইয়ের গোড়ার দিকে। বাংলাদেশ প্রশ্নে তিনি ইতিমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ঘুরে তাঁদের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতির প্রশ্নে ভারতীয় নেতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ। ফলে তাজউদ্দীন ও তাঁর সহকর্মীদের কাছে তাঁর ভিন্ন মর্যাদা ছিল। জয়প্রকাশ বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে সমমনা দলসমূহের অংশগ্রহণে একটি মুক্তিফ্রন্ট গঠনের পরামর্শ দেন। এ কথা শুধু তাঁর একার নয়, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীরও, সে কথা জানাতেও তিনি ভুললেন না।
ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের পর বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের ঘটনা কোনো গৃহযুদ্ধ নয়, তা একটি সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধ, তার প্রমাণ হিসেবে একটি জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠনের তাগিদ সোভিয়েত তরফ থেকে আসে। এই চুক্তি সম্পাদনের ব্যাপারে গুরুত্ব ভূমিকা রাখেন ডি পি ধর। ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে মস্কো থেকে ফিরিয়ে এনে বাংলাদেশ প্রশ্নে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারীর দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর দূত হিসেবে আগস্ট মাসের শেষ তিন দিন তিনি কলকাতায় অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার পর মুক্তিফ্রন্ট গঠনের বিষয়টি চূড়ান্ত করেন।
অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি মঈদুল হাসান জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট প্রশ্নে ডি পি ধরের সঙ্গে মতবিনিময়ের সুযোগ পেয়েছিলেন। মূলধারা ’৭১ গ্রন্থে তিনি স্মরণ করেছেন, বহির্গত, বিশেষত সোভিয়েত সমর্থন পেতে হলে একটি ব্যাপকভিত্তিক জোট গঠন অত্যন্ত জরুরি—ধর এ কথা কোনো রাখঢাক ছাড়াই জানিয়ে দেন। বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার কোনো কোনো সদস্য এ ধরনের ফ্রন্ট গঠনে অনাগ্রহী ছিলেন। তাঁদের ভয় ছিল, আওয়ামী লীগের বাইরে অন্য দল নিয়ে জোট গঠিত হলে তাঁদের গুরুত্ব কমে যাবে। কিন্তু ধর এই প্রশ্নে অনড় ছিলেন। তিনি জানান, বহুদলীয় জোট গঠনের বাইরে এই যুদ্ধে বাংলাদেশকে সমর্থন জোগানো ভারত সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়বে।
ঠিক কাদের নিয়ে এই ব্যাপকভিত্তিক জোট গঠিত হবে, ভারতের সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ছিল। তাদের যুক্তি ছিল, মুক্তিযুদ্ধের পরিচালনায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পরিবর্তন না করেও একটি মুক্তিফ্রন্ট গঠন সম্ভব, যাতে মাওলানা ভাসানী, ন্যাপের মুজাফ্ফর আহমদ ও পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি এবং আরও কিছু কিছু বাম ঘরানার দল, যারা চীনা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে এবং পাকিস্তানি বাহিনীর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিচ্ছে, তাদের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
আওয়ামী নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী সরকারের অনেক সদস্য ধরের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এই যুক্তিতে যে ১৯৭০-এর নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে এমন দল বা ব্যক্তিকে নিয়ে জোট গঠন করলে মুক্তিযুদ্ধ তার লক্ষ্য ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবে। ইয়াহিয়া খান নিজেই সে রকম একটি বহুদলীয় সরকার গঠনের চেষ্টা করছেন। তাহলে তাঁর সঙ্গে আমাদের সংগ্রামের ভিন্নতা কোথায়?
এর আগের মাসে জয়প্রকাশ নারায়ণের সঙ্গে এই প্রশ্নে আলোচনার সময় আওয়ামী নেতারা মোর্চার ব্যাপারে তাঁদের বিরুদ্ধতার কথা তুলেছিলেন। জয়প্রকাশের ব্যক্তিগত নোট থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে ভারতীয় গবেষক শ্রীনাথ রাঘবন জানিয়েছেন, আওয়ামী নেতৃত্ব যুক্তি দেখায়, ভারত যাদের কথা প্রস্তাব দিয়েছে, তাদের সঙ্গে সম্ভাব্য সব রকম সহযোগিতা করা হচ্ছে। তাহলে আবার নতুন জোট কেন? ভাসানী প্রসঙ্গে বলা হয়, তাঁর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত। তা ছাড়া ভাসানীর কার্যত কোনো প্রভাব নেই।
কিন্তু জোট গঠনের ব্যাপারে ভারতের অবস্থান ছিল অনমনীয়। মঈদুল হাসান লিখেছেন, ভারতের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র বামপন্থী দলসমূহকে স্বাধীনতাসংগ্রামের মূল শক্তি আওয়ামী লিগের সঙ্গে এমনভাবে গ্রথিত করা, যাতে এই সংগ্রাম জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের রূপ লাভ করে এবং যার ফলে ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তিকে কেবল নিরাপত্তার বর্ম হিসেবে ব্যবহার না করে বাংলাদেশে পাকিস্তানি দখল বিলুপ্তির অন্যতম প্রধান সহায়ক উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব হয়।
শেষ পর্যন্ত আওয়ামী নেতৃত্ব যে একটি ব্যাপকভিত্তিক মুক্তিজোট গঠনে সম্মত হয়, তার কারণ ডি পি ধরের অনমনীয়তা। তিনি কার্যত জানিয়ে দেন, ভারত সরকারের অব্যাহত সমর্থন পেতে হলে তাদের এই শর্ত মানতে হবে। ভারতের ভূমিকা প্রশ্নে অস্থায়ী সরকারের কেউ কেউ আগে থেকেই অসন্তুষ্ট ছিলেন, এই ঘটনায় সেই অসন্তুষ্টি আরও বিস্তৃত হয়।
চূড়ান্ত দর-কষাকষির পর অবশেষে সিদ্ধান্ত হয় ঠিক কোনো ‘লিবারেশন ফ্রন্ট’ নয়, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি ‘জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি’ গঠিত হবে। উদ্দেশ্য, মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত সব কর্মকাণ্ডের সমন্বয়। ৮ সেপ্টেম্বর এই উপদেষ্টা কমিটি তার প্রথম বৈঠকে মিলিত হয়। আওয়ামী লীগের দুজন প্রতিনিধি—তাজউদ্দীন আহমদ ও খন্দকার মোশতাক আহমদ—ছাড়া এই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হলেন মস্কোপন্থী বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান মণি সিংহ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান মুজাফ্ফর আহমদ, ন্যাপ (ভাসানী) গ্রুপের প্রধান মাওলানা ভাসানী এবং বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেসের মনোরঞ্জন ধর। তাজউদ্দীন হন এই কমিটির আহ্বায়ক।
এই কমিটি গঠনের ফলে ভারতীয় চাপ মোকাবিলা করা গেল বটে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন ও পরিচালনায় তার কোনো ভূমিকাই ছিল না। কমিটির প্রথম বৈঠকের পরপরই কমিটির ভেতর ভাঙন দেখা দেয়। প্রথম অসন্তোষ প্রকাশ করেন মাওলানা ভাসানী। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রায় পুরো সময় তিনি কার্যত ভারত সরকারের নজরদারিতে ছিলেন। ভারত সরকারের সমর্থনে তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা হলে তিনি উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে যোগ দিতে সম্মত হন। কিন্তু সে বৈঠকের তিন দিন পর তিনি প্রকাশ্যে এই কমিটির ব্যাপারে তাঁর অনাস্থা প্রকাশ করেন। এর আগে জুন মাসের মাঝামাঝি কলকাতায় ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’ নামে ভাসানীপন্থী বিভিন্ন দল ও উপদল নিয়ে একটি কাগুজে কমিটি গঠিত হয়েছিল। ভাসানী চেয়েছিলেন এই কমিটি থেকে সদস্য নিয়ে জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি সম্প্রসারিত করা হোক। কিন্তু উপদেষ্টা কমিটিতে তাঁর সে প্রস্তাবে কোনো সমর্থন মেলেনি। ১১ সেপ্টেম্বর ভাসানী ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটির এক বৈঠকে প্রস্তাব রাখা হয়, উপদেষ্টা পরিষদের বদলে একটি সর্বদলীয় ‘জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট’ গঠিত হোক।
আওয়ামী লীগের পূর্ণ সমর্থন না থাকায় মুক্তিযুদ্ধ উপদেষ্টা কমিটি কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে, এমন কোনো প্রত্যাশা কারও ছিল না। এই কমিটির অন্যতম সদস্য মুজাফ্ফর আহমদ কমিটি গঠনের অব্যবহিত পরে নিউইয়র্কভিত্তিক পাকিস্তান ফোরাম সাময়িকীর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে নিজের হতাশার কথা ব্যক্ত করেন। মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য এই কমিটির গঠন, সে কথা উল্লেখ করে মুজাফ্ফর আহমদ বলেন, অস্থায়ী কমিটির সঙ্গে এর সম্পর্ক এখনো পুরোপুরি সংজ্ঞায়িত হয়নি, ভালো হতো যদি এই ফ্রন্ট গঠনের পর অস্থায়ী সরকার গঠিত হতো। ‘এই কমিটির সিদ্ধান্ত মানতে অস্থায়ী সরকার বাধ্য নয়, কিন্তু এই কমিটিতে যাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তাদের গুরুত্বের কারণে তাকে অগ্রাহ্য করাও যাবে না।’
একটি ব্যাপকভিত্তিক মুক্তিফ্রন্ট গঠনের জন্য ভারত যে এত জোরাজুরি করছিল, তার মূল কারণ ছিল সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে ইন্দিরা গান্ধীর মস্কো সফর। এই সফরের প্রচারমূল্য যাতে সর্বাধিক অর্জিত হয়, সে লক্ষ্যে মস্কো ও দিল্লি উভয়েই ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে এই দুই দেশ নিজেদের কৌশলগত আঁতাত প্রতিষ্ঠা করে, কিন্তু সে আঁতাতকে দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টি সামনে নিয়ে আসা হয়। জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হওয়ায় নিদেনপক্ষে কাগজে-কলমে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সমন্বিত চরিত্রের ব্যাপারে লেনিন যে শর্তারোপ করেছিলেন, আপাতভাবে তা পূরণ হলো। এত দিন সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশ প্রশ্নে যে সতর্কতামূলক অবস্থান নিয়েছিল, এই চুক্তির পর তার কার্যকারিতা ফুরিয়ে গিয়েছিল। তারা প্রকাশ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি সমর্থন প্রকাশে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
উপদেষ্টা কমিটি গঠনের বিষয়টি সোভিয়েত তথ্যমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। একই সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সংহতি দেখিয়ে নানা সভা ও প্রতিবাদ জমায়েতের আয়োজন করা হয়। এই সময় থেকেই সোভিয়েত পত্রপত্রিকায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করা শুরু হয়। ২৮-২৯ সেপ্টেম্বর মস্কোতে ইন্দিরা গান্ধীর সফরকালে মুখোমুখি আলোচনায় সোভিয়েত নেতা ব্রেজনেভ প্রথমবারের মতো স্বীকার করেন, বাংলাদেশের ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের উপাদান রয়েছে।’ সে সফরের ওপর এক বিশ্লেষণী নিবন্ধে ইজভেস্তিয়া পত্রিকায় প্রভাবশালী সোভিয়েত ভাষ্যকার ভালেন্তিন কুদ্রিয়াৎসেফ ব্রেজনেভের সে কথার প্রতিধ্বনি করে মন্তব্য করেন, (পূর্ব পাকিস্তানে) যা ঘটছে, তা আসলে এক জাতীয় মুক্তি আন্দোলন।
এ কথায় সন্দেহ নেই, ভারতীয় চাপের মুখে মুক্তিযুদ্ধ সমন্বয় করার লক্ষ্যে যে উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়, আদর্শ ও সম্ভাবনার অর্থে তা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সোভিয়েত তাত্ত্বিক ভাবনায় যে ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ কথা রয়েছে, তা নিকটবর্তী করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কখনোই মুক্তিযুদ্ধের ওপর তাদের দলীয় মালিকানা ত্যাগে প্রস্তুত ছিল না। ভাসানী ন্যাপ বা অন্যান্য ক্ষুদ্র উপদলের রাজনৈতিক লক্ষ্য ও কর্মপন্থা বিষয়ে তাদের যুক্তিপূর্ণ অনাস্থা ছিল। ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় থেকেই তারা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে এসব ক্ষুদ্র দলের কোনো রাজনৈতিক গুরুত্ব নেই, তাদের বিবেচনায় আনারও কোনো প্রয়োজন নেই। তদুপরি মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে তাদের একধরনের ‘মালিকানাবোধ’ ছিল, যার কারণে তার নেতৃত্ব অন্য কারও সঙ্গে ভাগাভাগিতে লীগের কোনো আগ্রহ ছিল না।
তবে মোর্চার বিরুদ্ধে আপত্তির বড় কারণ ছিল, মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের ওপর আওয়ামী লীগের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা। অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের ব্যাপারে শেখ মণির নেতৃত্বাধীন ‘মুজিববাদী’ গ্রুপ আগাগোড়াই অসন্তুষ্ট ছিল। মোর্চা গঠনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের নীতিনির্ধারণী ক্ষমতা তাজউদ্দীন নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করছেন, এমন উদ্বেগ থেকে শেখ মণির সঙ্গে সংযুক্ত প্রায় ৪০ জন পার্লামেন্ট সদস্য শুধু আওয়ামী লীগ সদস্যদের নিয়ে একটি ‘জাতীয় মুক্তি পরিষদ’ গঠনের প্রস্তাব দেয়। মঈদুল হাসান মন্তব্য করেছেন, এই দাবি ছিল মূলত বহুদলীয় মোর্চা গঠনের উদ্যোগকে বন্ধ করা, ‘কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের রণকৌশলগত প্রয়োজন তথা আন্তর্জাতিক শক্তি সমাবেশের ক্ষেত্রে এই প্রস্তাব ছিল সম্পূর্ণ অর্থহীন।’
তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন মুক্তি আন্দোলন বিচ্ছিন্নতা আন্দোলন থেকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে পরিণত হয় মূলত তার বহুদলীয় চরিত্রের জন্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সে আন্দোলনের কেন্দ্রভূমি হিসেবে কোনো একটি দল কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে থাকলেও ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে সে আন্দোলনে যুক্ত হয় একাধিক দল বা রাজনৈতিক প্রবণতা। এর ফলে ঐক্যের যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, তাতে মুক্তি আন্দোলন শুধু বেগবানই হয় না, বহির্গত শক্তির প্রভাবে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বিভক্তির সম্ভাবনাও সীমিত হয়ে আসে। তা ছাড়া মুক্তি আন্দোলন শুধু সামরিক প্রতিরোধ নয়, তার রয়েছে বেসামরিক ও প্রশাসনিক চরিত্র। মুক্তি আন্দোলনের ভেতর দিয়েই এর বিভিন্ন অংশগ্রহণকারী দল ও সংস্থা মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী স্বাধীন রাষ্ট্রসত্তা গঠন ও তার ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা সঞ্চার করে নেওয়ার সুযোগ পায়। ঠিক এই ঘটনাই ঘটেছে দক্ষিণ আফ্রিকায়, জিম্বাবুয়েতে, অ্যাঙ্গোলায় ও নামিবিয়ায়।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ অবশ্যই একটি জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল, কিন্তু সে আন্দোলনের রাজনৈতিক সুফল সর্বাংশে আমরা ভোগ করতে পারিনি। এ কথা বলা হয়তো অযৌক্তিক নয় যে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ তার যাত্রা মুহূর্ত থেকেই যে জটিল রাজনৈতিক সংকটে নিক্ষিপ্ত হয়, তার একটি কারণ ছিল মুক্তিযুদ্ধের মালিকানা নিজ দলের বাইরে যেতে তার তীব্র অনীহা। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় যে উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয়, তা যদি একটি কার্যকর সাংগঠনিক কাঠামোর ওপর স্থাপিত হওয়ার সুযোগ পেত, তাহলে এই কমিটির ভিত্তিতেই একটি পূর্ণাঙ্গ জাতীয় সরকার গঠন সম্ভব ছিল। সে সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হলে আজকের বাংলাদেশে যে অব্যাহত রাজনৈতিক সংকট, তার মোকাবিলা হয়তো অনেক সহজ হতো।
সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১৬ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত