বিজ্ঞাপন
default-image

আবার এসেছে মার্চ মাস। মাসটি আমার কাছে ফিরিয়ে আনে সেই সব জ্বলজ্বলে স্মৃতি, যার অংশীদার আরও অনেকেই।

১৯৭১ সালের মার্চ। আমি তখন ভারতের বিহারে অক্সফাম-ইউকের সহায়তাপুষ্ট গান্ধীবাদী আদর্শের গ্রাম উন্নয়ন প্রকল্পে কর্মরত। মার্চের শুরুর দিকে বিবিসি ও ভারতীয় পত্রপত্রিকার কিছু ভাসাভাসা প্রতিবেদনের মাধ্যমে ঢাকার অস্থিরতার খবর জানতে পারি। কিন্তু ক্রমশ যা উন্মোচিত হলো, তার জন্য কেউ প্রস্ত্তত ছিলেন না। ২৫ মার্চ রাতের পর থেকেই ভারত-পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত থেকে রাঁচিতে অক্সফাম কার্যালয়ে টেলিগ্রামে খবর আসতে শুরু করল যে প্রতিদিন হাজার হাজার শরণার্থী সীমান্ত পার হয়ে ভারতে প্রবেশ করছে। সীমান্ত এলাকাগুলোতে কর্মরত কয়েকটি সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে অক্সফাম এ খবর পায়। ভারতের পূর্বাঞ্চল ও পূর্ব পাকিস্তানে অক্সফামের কার্যক্রম পরিচালিত হতো রাঁচির কার্যালয় থেকেই। তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের কয়েকজন কর্মী সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করলেন। পরিদর্শনের পর অক্সফাম সদর দপ্তরে পাঠানো প্রতিবেদন এতটাই ভয়াবহ ছিল যে সেখানকার কয়েকজন কর্মকর্তা প্রতিবেদন বিশ্বাস করতে অস্বীকৃতি জানালেন। একজন তো মন্তব্য করে বসলেন যে ‘জুলিয়ান তরুণ আর অনভিজ্ঞ। মনে হচ্ছে ভারতের তীব্র গরম ভালোই প্রভাব ফেলেছে তার ওপর।’

ভারতের পূর্বাঞ্চল ও পূর্ব পাকিস্তানে অক্সফামের নবনিযুক্ত মাঠ পরিচালক ফরাসি-কানাডিয়ান রেমন্ড কুরনোইয়ার ১৯৫৮-১৯৬৫ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে কাজ করেছেন। শরণার্থীর ঢল নামার শুরুর দিকেই তিনি বলেন, প্রায় এক কোটি পর্যন্ত উদ্বাস্ত্ত ভারতে আসতে পারে। কিন্তু সংখ্যাটি বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল অক্সফোর্ডে অক্সফাম সদর দপ্তরের কর্মকর্তাদের। রেমন্ড আমাদের কয়েকজনকে কলকাতায় গিয়ে এই পরিস্থিতিতে অক্সফাম কী করতে পারে, সেটা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিলেন আমাদের। অধিকাংশ দাতব্য সংস্থাই দলে দলে বিদেশি সাহাঘ্যকর্মী নিয়ে এলেও আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, এই সংকটে ভারতীয় সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করাটাই সবচেয়ে ভালো হবে। শিগগিরই আমাদের ওই সিদ্ধান্ত বিচক্ষণ বলে প্রমাণিত হলো। কারণ নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের কারণে সীমান্ত এলাকায় বিদেশিদের যাতায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ভারত সরকার।

ভারত সরকারের ওই সিদ্ধান্তের কারণে প্রথমে মাদার তেরেসার চিকিৎসাসেবায় প্রশিক্ষণ পাওয়া সিস্টারদের কর্মকাণ্ডে সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে কাজ শুরু করে অক্সফাম। ওই সিস্টাররা প্রতিদিন কলকাতার আশপাশের শরণার্থীশিবিরগুলো পরিদর্শনে যেতেন। প্রথম দুই থেকে তিন সপ্তাহ প্রতিদিন সকালে নির্দিষ্ট সময়ে মাদার তেরেসা স্বয়ং আমাকে ফোন করে বাজারের একটি তালিকা দিতেন। সিস্টারদের কী কী জিনিসপত্র আর কয়টা ট্যাক্সির প্রয়োজন, তিনি আমাকে সেটা জানাতেন। প্রতিদিন সকালে ফোন করে তিনি ‘গুড মর্নিং’ না বলে বলতেন ‘গড ব্লেস ইউ’। এরপর আমাকে বাজারের তালিকা দিতেন।

default-image

১৯৭১ সালের মে মাসের শেষের দিকে অক্সফামের পূর্ব ভারতীয় অঞ্চলের সহকারী মাঠ পরিচালক অ্যালান লিদার আর আমার সঙ্গে যোগ দিলেন উন্নয়নকর্মী বিকাশ ভাই।

আমাদের কাছে এই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে অধিকাংশ বিদেশি সাহাঘ্য সংস্থাই সল্টলেকের মতো কলকাতার আশপাশের শরণার্থীশিবিরগুলোতে কাজ করছে। সল্টলেকের শরণার্থী শিবিরে ছিল প্রায় আড়াই লাখ লোক। তাই শহর থেকে দূরের শরণার্থীশিবিরগুলোতে কাজ করার জন্য অক্সফামকে সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা। শিবিরগুলোতে ওই সময় কলেরার ভয়াবহ হুমকি ছিল। ভারতের চিকিৎসা দলগুলোকে সংগঠিত করা এবং সেই সঙ্গে যথাযথ চিকিৎসা উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করার বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হয়েছে আমাদের। একদিন বিকাশ ভাই আমাদের জানালেন, গান্ধিবাদী নেতা নারায়ণ দেশাইয়ের মেয়ে সংঘমিত্রা দেশাই (উমা) কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজের (এনআরএস) শেষ বর্ষের ছাত্রী। তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য একদিন সন্ধ্যায় আমরা মেডিকেল কলেজে গেলাম। আজও স্পষ্ট মনে পড়ে, শিক্ষার্থীদের ক্যানটিনে চা খেতে খেতে কথা বলেছিলাম আমরা।

এনআরএস মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা যাতে ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা দলের সদস্য হিসেবে শরণার্থীশিবিরগুলোতে যেতে পারে, উমা ও তাঁর সহপাঠীরা কলেজ কতৃ‌র্পক্ষের কাছ থেকে সেই অনুমতি আদায় করে নিতে পেরেছিলেন। শরণার্থী শিবিরে তাঁদের কার্যক্রমকে এমবিবিএস কোর্সের সামাজিক ও প্রতিষেধক চিকিৎসা শিক্ষার ব্যবহারিক ক্লাসের অংশ হিসেবেও স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছিলেন তাঁরা। উমার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে কলকাতার অন্য মেডিকেল কলেজগুলোও চিকিৎসা দল পাঠাতে শুরু করে। ক্রমে কলকাতার কলেজগুলোর সফলতার গল্প শুনে অন্য মেডিকেল কলেজগুলোও এগিয়ে আসে। বোম্বে মেডিকেল কলেজ ও কটক মেডিকেল কলেজ থেকে মাসিক ভিত্তিতে চিকিৎসা দল আসতে থাকে আমাদের কাছে। পাঞ্জাবের লুধিয়ানা মেডিকেল কলেজ ও ভারতীয় রেডক্রসের গুজরাট শাখা থেকেও চিকিৎসা দল পাঠানো হয়। জুনের শেষ নাগাদ ত্রিপুরা পর্যন্ত বাংলাদেশ সীমান্তের সর্বত্র সক্রিয় ছিল অক্সফাম।

শরণার্থীদের চিকিৎসা-সহায়তার বাইরের অন্য চাহিদাগুলো পূরণের জন্য নিয়মিতভাবে স্বেচ্ছাসেবক দল পাঠায় ওড়িশা ও গুজরাটের বেশ কয়েকটি গান্ধীবাদী সংগঠন। এমনকি রাজস্থানের উদয়পুরের মতো দূর এলাকা থেকেও ছাত্রদের স্বেচ্ছাসেবক দল এসেছিল। শরণার্থীশিবিরগুলোকে চাঙা করে তুলেছিলেন এই স্বেচ্ছাসেবকেরা। শিবিরে বিদ্যালয় চালু, সাপ্তাহিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিশেষ করে গানের আসরের মতো বিভিন্ন আয়োজন করতেন তাঁরা। দক্ষতার সঙ্গে নিত্যকার খাদ্য পরিবেশন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম তো চালিয়েছেনই।

default-image

এসব ভারতীয় তরুণ-তরুণী যেসব কাজ করতেন, তা ছিল খুবই কঠিন আর ক্লান্তিকর। আগাম মৌসুমি বন্যায় অনেকগুলো শিবির প্লাবিত হওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করে। ওই সময় কলকাতাজুড়ে কলেরার প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে নগরে কতৃ‌র্পক্ষ। পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য বিভাগের মহাপরিচালক আমার কাছে জানতে চান, আমরা বিদেশ থেকে জরুরিভাবে বিমানে করে কলেরার টিকা আনার ব্যবস্থা করতে পারব কি না। অক্সফাম ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ১০ লাখেরও বেশি ডোজ টিকা কিনে তা কলকাতায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিল। ওই সময় আরও একটি সমস্যা দেখা দেয়। সেটা হলো, কলেরারোগীদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে স্যালাইনের বোতল ছিল না। কলকাতায় নিরাপদে স্যালাইন তৈরি করা সম্ভব হলেও যথেষ্ট পরিমাণ খালি বোতল পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই আমরা যুক্তরাজ্য থেকে বিমানভর্তি বোতল নিয়ে এলাম। খালি হওয়া বোতলে আবার স্যালাইন ভরে তা ব্যবহারের ব্যবস্থা করা হলো। একেক সময় স্যালাইন না থাকলে ডাবের পানিকে স্যালাইন হিসেবে ব্যবহারের পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চালিয়েছেন চিকিৎসকেরা! ওই সময় শরণার্থীশিবিরগুলোতে ‘চোখ ওঠা’ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের থেকে এটা ছড়িয়েছিল বলে মজা করে একে ডাকা হতো ‘জয়বাংলা রোগ’। এই চোখ ওঠা বা কনজাংটিভাইটিসের চিকিৎসায় যুক্তরাজ্য থেকে আনা হলো ১০ লাখ টিউব মলম।

পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও সীমান্তবর্তী রাজ্য ত্রিপুরা, মেঘালয় ও আসাম মিলিয়ে প্রায় পাঁচ লাখ শরণার্থীকে ত্রাণসহায়তা দিয়েছিল অক্সফাম।

এই সময়ের কত স্মৃতিই যে মনে পড়ে। জলপাইগুড়িতে কলেরায় মৃতদের জন্য কবর খুঁড়েছি। একসঙ্গে এক লাখ শাড়ি, এক লাখ লুঙ্গি-গেঞ্জি আর বাচ্চাদের জন্য বিভিন্ন সাইজের তিন লাখ পোশাক কেনার মতো দুরূহ কাজের কথাও ভুলব না। মনে আছে, আমার অফিসের ৩৬ জন কর্মীর বেশির ভাগই ছিল পালিয়ে আসা শরণার্থী।

কার্যক্রমের পুরো সময়জুড়েই ত্রাণসামগ্রী বিদেশ থেকে সংগ্রহ করার পরিবর্তে ভারতের ভেতর থেকেই জোগাড়ের চেষ্টা করা হয়। বিদেশ থেকে ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করা ছিল ব্যয়সাধ্য। আমরা টনকে টন ব্লিচিং পাউডার ও হাজার হাজার লিটার ‘এসকাবিয়ল’ (খোসপাঁচড়ার ওষুধ) কিনেছিলাম। শরণার্থীশিবিরগুলোর জন্য এ ধরনের পণ্যের চাহিদা ছিল সব সময়, যা কলকাতার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে খুবই ব্যস্ত রেখেছিল।

বায়াফ্রার পরে এবং কাম্পুচিয়ার আগে এটাই ছিল অক্সফামের সবচেয়ে বড় ত্রাণ কার্যক্রম। এ জন্য আমাদের তহবিল গঠন কার্যক্রমও হতে হয়েছিল জোরদার ও দক্ষ। তহবিল সংগ্রহের জন্য বিজ্ঞাপন প্রচার করেছিল অক্সফাম। শীত ঘনিয়ে আসায় শরণার্থীদের জন্য কম্বল ও গরম কাপড়ের প্রয়োজন পড়ে। ‘আপনার বিছানা থেকে একটি কম্বল তুলে নিন’ ও ‘বড়দিনের জন্য একটি নতুন সোয়েটার কিনে পুরোনোটি অক্সফামকে পাঠিয়ে দিন’—এই ভাষায় প্রচারণা চালায় অক্সফাম অক্সফামের ঠিকানায় পাঠানো ত্রাণসাহাঘ্য পার্সেলের জন্য ব্রিটিশ ডাক বিভাগ তখন কোনো ডাকমাশুল নেয়নি।

আমরা যারা ভুলে গেছি বা যারা বেশি নবীন, তাদের জন্য বলছি, ভারতের ৯০০ শরণার্থী শিবিরে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি শরণার্থী ছিল। এত বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর জন্য খাবার ও অন্য জিনিসপত্রের জোগান দেওয়া কত দুরূহ ব্যাপার ছিল, এত দিন পরও সেটা উপলব্ধি করা কঠিন মনে হয় আমার। কীভাবে সম্ভব হয়েছিল এই কর্মযজ্ঞ? অনেক মানুষের বীরত্বপূর্ণ অবদান এই অসাধ্য কাজকে সম্ভব করেছে। ওই সব মানুষ কখনই খ্যাতি কিংবা কৃতিত্ব দাবি করেননি। তাঁদের কথা হচ্ছে, যা করা উচিত ছিল, তাঁরা শুধু সেটাই করেছেন।

বৈশ্বিক সংবাদপত্রগুলোর প্রথম পাতায় এই সংকটের স্থান করে নেওয়া ছিল কঠিন। ২৫ মার্চের গণহত্যার খবর সংবাদপত্রগুলোর প্রথম পাতায়ই ছিল। কলেরার প্রাদুর্ভাবের খবরটিও প্রথম পৃষ্ঠায় ঠাঁই পায়। শরণার্থীশিবিরগুলো যখন বন্যায় প্লাবিত হয়, তখন আরেকবার তা পত্রিকার প্রথম পাতায় উঠে আসে। ’৭১ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ অক্সফাম সিদ্ধান্ত নেয়, বিশ্বনেতাদের ঝাঁকুনি দেওয়ার মতো একটি উপায় বের করতে হবে। খুব কম সময়ের মধ্যেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য সংগ্রহ করা হলো। ‘দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি অন দ্য ক্রাইসিস ইন বেঙ্গল’ শিরোনামে প্রত্যক্ষদর্শীদের ওই ‘সাক্ষ্য’ প্রকাশ করা হয়। সারা বিশ্বের সব সরকারপ্রধানের হাতে ওই জবানবন্দি তুলে দেওয়া হয়। ঘটনাচক্রে জাতিসংঘের বার্ষিক অধিবেশন শুরুর সময়ের সঙ্গে ওই ‘সাক্ষ্য’ প্রকাশের সময়টা মিলে যায়। ২০০৭ সালে বাংলাদেশের ‘মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’ এর একটি ইংরেজি প্রতিরূপ সংস্করণ প্রকাশ করে। কীভাবে এ দেশটি জন্ম নেয় এবং এর পেছনে কত ব্যথা ও দুর্ভোগ ছিল, ওই প্রকাশনার মাধ্যমে মানুষ তা আরও ভালো জানতে পারবে। ২০০৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম আলো এরই একটি বাংলা প্রতিরূপ প্রকাশ করে।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১০ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত