বিজ্ঞাপন
default-image

পৃথিবীর ইতিহাস প্রমাণ করেছে কতৃ‌র্ত্বের জন্য নেতাদের উচ্চাশা সাধারণ মানুষকে প্রায়ই অবর্ণনীয় দুর্যোগের মধ্যে ফেলে থাকে।

পশ্চিম পাকিস্তানি বা পূর্ব পাকিস্তানিদের কেউ-ই তাদের কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ে এতটুকুও সন্তুষ্ট নয়।

রাজনীতি সম্পর্কে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অজ্ঞতা, পশ্চিম পাকিস্তানের আলী ভুট্টোর সঙ্গে তাঁর ষড়যন্ত্র এবং পাঞ্জাবি জেনারেলদের নির্যাতন ও নিপীড়ন পূর্ব পাকিস্তানকে একটি রক্তাক্ত ভূখণ্ডে পরিণত করেছে।

যদিও সে দেশের সংবিধানে পাকিস্তানকে ইসলামিক রাষ্ট্র বলা হয়েছে, কিন্তু নিজ দেশের মানুষের প্রতি তাঁদের যে আচরণ ও মনোভাব তাতে লেশমাত্র ইসলামের ছোঁয়া নেই। ফলে এই নেতারা আমাদের এমন একটা ধারণা দেন, যেন ইসলাম তাঁদের কাছে কেবল একটি অলঙ্কারমাত্র।

যদিও ভবিষ্যতে পূর্ব পাকিস্তান ভূখণ্ডের পরিস্থিতি ভবিষ্যতে স্বাভাবিক হয়ে আসবে, কিন্তু যে ভৌত ও মানসিক ধ্বংসযজ্ঞ এ অঞ্চলে ঘটে গেল, আগামী ১০ বছরের প্রচেষ্টায়ও তা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে না, আর অন্যদিকে অর্থনৈতিক সংকট তো বাড়বেই।

কয়েকটি বড় দেশ যেমন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, পশ্চিম জার্মানি, জাপান স্বতস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছে লাখ লাখ দেশত্যাগী দুর্গত মানুষকে সাহাঘ্য করতে—এ প্রচেষ্টার গুণগান করতেই হয়।

সাহাঘ্যের একান্ত চেষ্টার পরও একা ভারতের পক্ষে ভীতসন্ত্রস্ত ও বিপন্ন যারা নিজ দেশ থেকে পালিয়ে এসেছে, তাদের সবার বোঝা বহন করা সম্ভব নয়।

ভারত বাংলাদেশের জন্য সহানুভূতিপ্রবণ এবং তাদের সাহাঘ্যে এগিয়ে আসতে চায়—কারণ তারা পশ্চিম বঙ্গবাসীর মতো একই ধরনের মানুষ।

default-image

পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে আসা বাস্ত্তত্যাগীদের সমস্যাটি আসলে আন্তর্জাতিক প্যালেস্টাইন শরণার্থীদের মতো একই সমস্যা। সে জন্য জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন স্থাপন করেছে, জাতিসংঘ শরণার্থী জরুরি তহবিল খুলেছে। কাজেই পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের সমস্যাটি জাতিসংঘের হাতে তুলে দেওয়াই যুক্তিসংগত।

আরব অঞ্চলের মুসলিম দেশগুলোর নীরবতা দুঃখজনক—কারণ, দেখা যাচ্ছে ভুক্তভোগীরা এমনকি মুসলমান হলেও তাদের কাছে মানবকল্যাণের চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।

ইন্দোনেশিয়াকে এখনই আরও ধনাত্মক সাড়া দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। মানবিক সমস্যায় সহানুভূতি প্রকাশ আমাদের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। তারচেয়ে বড় কথা, আমাদের ‘পঞ্চশীলা’ নীতি মানবকল্যাণকামীতার বিশেষ স্থান রয়েছে, যা ইসলামের প্রথম সূত্র ‘আল্লাহকে বিশ্বাস’ থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়।

যখন প্যালেস্টাইনি শরণার্থীদের বিষয়টি উচ্চস্বরে আলোচনা হয়, ইন্দোনেশিয়ায় মুসলমান নেতারাও সাহাঘ্য প্রদানের জন্য চিৎকার করতে থাকেন, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের বিপন্ন মুসলিম শরণার্থীর সংখ্যা প্যালেস্টাইনিদের তিনগুণ, তখন আমাদের মুসলিম নেতারা একজন অন্যজনের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলেন—সমস্যাটা ওখানে কী যেন? তাঁদের কাছেও মানুষের সমস্যার চেয়ে রাজনীতির সমস্যাটিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১০ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত