নীল রঙের আলোর মধ্যে চিত হয়ে পড়ে আছে মেয়েটি। ভেজা কপালে লেপ্টে থাকা কিছু চুল পাখার বাতাসের ঝাপ্টায় উড়তে লেগেছে। একেবারে নিথর ওর সাদা স্তনের কালচে একটুখানি বৃত্তের ওপর কিশমিশের মতো লালচে বোঁটা দুটোই বুঝি জেগে আছে এখনো আর ঘন পাপড়ির ফাঁকে ওই আধবোজা চোখ দুটো! বসার ঘরের টেলিভিশনে ধারাবাহিক নাটকের আবহ সংগীত আর কথাবার্তা ছাড়া কোনো শব্দ নেই বাড়িতে। সিথানের দিকে পাশটেবিলটার ওপর পড়ে আছে আধখানা হুইস্কির গেলাস। আর বোধ হয় নিতে পারছিল না সে।
পূব দিকে শোবার এই ঘরের কোনায় মুখোমুখি রাখা ছোট্ট সোফা দুটোর একটায় হেলান দিয়ে মাত্রাতিরিক্ত গিলে নিচ্ছে ফয়সল। খালি গায়েও দরদর করে ঘামছে সে। ভয়ংকর এক-একটা শব্দের মতো ওর বুকে বিরতিহীন আঘাত করে চলেছে চিত হয়ে পড়ে থাকা নগ্ন মেয়েটার নীরবতা।
এবারের শীত সময় হওয়ার আগেই বিদায় নিলেও প্যাচপ্যাচে ঘামের গরম শুরু হয়নি। বিদেশ থেকে ভাই, ভাইয়ের বউ আর বাচ্চারা এসেছে, তার ওপর পরপর তিন দিনের ছুটি, মারজিয়াকে তাই যেতেই হলো কক্সবাজারে বেড়াতে। ব্যাংকের একঘেয়ে ঘানি টানার ক্লান্তির ফাঁকে এক টুকরো ফুরসত তো মিলল।
বউ আর মেয়ে গেল কিন্তু ফয়সল গেল না। বড় কুটুমের পরিবারকে সঙ্গ দেওয়ার ধার না ধেরে গোঁ ধরে থাকল সে, বলছি তো তোমরা যাও, জরুরি কাজ আছে আমার।
কাজ যে আছে মারজিয়া তা জানে না তা নয়, তা ছাড়া হুট করে ওর এমন সুযোগও তো আসে না খুব একটা—তিন দিনের ছুটি, বাড়িতেও কেউ থাকবে না, বইপত্র ঘেঁটে ভেবেচিন্তে প্রজেক্ট প্রোপোজালটা এগিয়ে নেবে। মারজিয়ার মন খুঁতখুঁত করলেও আর ঘাঁটায় না সে ফয়সলকে। ফয়সলও হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। মাত্র সাত দিন হাতে আছে, এর মধ্যে ফাইলটা জমা দিতে হবে তাকে—এনজিওর কাজে সুখ যেমন আছে, অসুখও কিছু কম নয়।
যাওয়ার আগে পইপই করে বুঝিয়ে যায় মারজিয়া, কোথায় কোন বক্সে কী আছে, খাবার আগে যেন খুঁজে নেয়, টেলিভিশন ছেড়ে রেখে যেন না ঘুমায়, সকালে বুয়া এলে যেন জেগে গিয়ে দরজা খুলে দেয়, একা ঘরে মদ সিগারেট যেন বেশি না খায়—এই সব চৌদ্দ ফিকির।
দুই দিন কোথাও বের না হয়ে কি-বোর্ড আর মনিটরে লেপ্টে থাকে ফয়সল। তার মাথা ধরে। সে চা বানিয়ে খায়। টিভি দেখে। বই পড়তে পড়তে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেয়। খাবার গরম করে। আবার ডুবে যায় সে কি-বোর্ড আর মনিটরে। ভিলেজ এডুকেশন সেন্টারে সেক্সুয়াল অ্যান্ড রিপ্রোডাকটিভ হেলথ রাইটস নিয়ে এখন তার কাজ। কিশোরী আর বয়ঃসন্ধিকালীন সচেতনতা, অপ্রাপ্তবয়সে যৌনতা, মাতৃসাস্থ্য, বাল্যবিবাহ, মা হওয়ার আগে-পরের বিষয় থেকে শুরু করে পুরুষেরও সর্বস্তরে সচেতন হয়ে ওঠা নিয়ে যতই লিখছে সে মনমতো হয়ে উঠছে না তার কিছুই। তারপরও দুই দিনের মধ্যে প্রোপোজালটা গুছিয়ে আনে ফয়সল। ডাটা কালেকশন, মাঠপর্যায়ে ভিজিট, জনে জনে সাক্ষাৎকার, অফিসে মিটিংয়ের পর মিটিং সব আগেই সেরে নিয়েছিল সে। লেখার কাজও তো শেষ, এখন ঠান্ডা মাথায় আগাগোড়া একবার দেখে নিলেই হবে।
দুপুর থেকে আকাশ ভারী হয়ে আছে। মারজিয়ার সঙ্গে কথা হলো, ওখানে ঝকঝকে রোদ, ওরা মিস করছে তাকে। হাতের কাজ গুছিয়ে ফয়সলের একা লাগতে থাকে। একে ওকে কয়েকটা ফোন করে।
বন্ধু আজহারের বাসায় একটা মেয়েকে বেশ ভালো লেগেছিল। খালি বাড়িতে খুবই ব্যক্তিগত সেই গোপন আড্ডায় মাত্র ঘণ্টা তিনেকের পরিচয়। ওর নম্বরটাও তো টুকে নিয়েছিল। ফোনবুকে ঢুকে খুঁজে খুঁজে তাকেও কল করে ফয়সল।
ফোন ধরে পরিচয় পাওয়ার পর মেয়েটা বলে, আসতে তো চাই, কখন? আকাশের অবস্থাও তেমন ভালো না। কী করি বলেন তো?
কিচ্ছু হবে না। সন্ধ্যায় আসো, রান্না করব। মন চাইলে থেকে যেতেও পারবে। আর একটা কথা, আজহারকে কিন্তু বলবে না, প্লিজ। এরপর মালিবাগের ঠিকানাটা বুঝিয়ে বলে সে, হ্যাঁ হ্যাঁ, আইডিয়াল স্কুলের পাশে স্বপ্নের গলিটাই। তোমাকে দিচ্ছি, বলে এসএমএস করে ফয়সল।
বিকেল থেকে ছটফট শুরু হয় ওর। কী রাঁধবে না রাঁধবে, তা-ই নিয়ে ভেবেটেবে দোকানে যায়। ব্রয়লার মুরগি গরম মসলার সঙ্গে তেলে পুরিয়ে ধনেপাতার একটা রেসিপি ভালো করে ফয়সল। আর মালয়েশিয়ান পরোটা তো ফ্রিজে আছে, ভেজে নিলেই হবে। বুয়া এসে গুছিয়ে গেছে, তবুও এলোমেলো ভেবে ঘর গোছায়। ডিপ ফ্রিজের আইস কিউবে পানি ভরে রাখে।
সন্ধ্যা পার করে এল মেয়েটি। হলুদের ওপর ছোপ ছোপ লাল রঙের শাড়ি পরেছে সে। কাপড়ের সঙ্গে মিলিয়ে পরেছে মাঝারি আকারের টিপ। ঠোঁটের লিপস্টিকের রং চোখে পড়ার মতো নয় কিন্তু পাপড়িতে হালকা করে মাসকারা লাগানো চোখ দুটো বড় বেশি উজ্জ্বল ওর। ফয়সল একেবারে অস্থির হয়ে উঠল।
চা খাবে, চা বানাই? হারবাল গ্রিন টি আছে, রেয়ার কালেকশন। কেমন রং ছড়ায় দেখবে, মাইল্ড গ্রিন।
চা বানিয়ে এনে মুখোমুখি বসে ফয়সল। কাপে আলতো করে চুমুক দিল মেয়েটি। ওর অভিব্যক্তি থেকেই বুঝতে পেরেছে ফয়সল, এই চায়ে অভ্যস্ত সে নয়। কাজুবাদামের বাটিটা তুলে দিয়ে বলে, আইসক্রিম খেতে পারো, না হয় চকলেট।
আমি ওসব খাই না, বাদাম খুব প্রিয় আমার, বলে দেয়ালে ঝোলানো একটা পোর্ট্রেটের দিকে তাকিয়ে জানতে চায় ও, ওটা কার?
আমার বউয়ের। আর ওই যে ড্রয়ারের ওপর স্ট্যান্ডে ওটা আমার মেয়ের।
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে মেয়েটি, কী যেন ভাবে, একটু কি লজ্জা পেয়েছে সে? বাদামের বাটিটা রেখে উঠে গিয়ে কাচের শেলফে মৃদু আলোর মধ্যে ছোট্ট ছোট্ট ফ্রেমে বাঁধানো গ্রুপ ছবিগুলো থেকে মা-মেয়েকে আলাদা করে নেয়। ছবির মারজিয়া কটমট করে তাকায়, কী বেহায়া মেয়ে রে বাবা, আবার তন্ন তন্ন করে খোঁজা হচ্ছে! মেয়ে রুকাইয়ার তো বাবার ওপর অভিমান, কে না কে একজন এল অমনি আমার চকলেট আর আইসক্রিম সাধছে বাবা! ভাগ্যিস ও খেতে চায়নি।
ফয়সলের ছটফটানিটা কিন্তু গেল না। সে মাংসে মসলা মাখানোর পর কড়াইয়ে তেল গরম করতে দিয়ে আলমারি থেকে স্কচের বোতলটা বার করে আনে। দুটো গ্লাসে ঢেলে ওকে বলে, এই, তোমাকে আইস দিই?
ছবি ফেলে শেলফে সাজানো বিচিত্র মিনিয়েচারগুলোয় চোখ আটকে আছে মেয়েটির। কম দিয়েন, গলা বসা আমার, পেছন ফিরে না তাকিয়েই বলে সে। ফয়সল গ্লাস বানিয়ে গিয়ে কাঁধে হাত রাখে ওর। একটা মিষ্টি গন্ধ আসছে ঘন কালো ঝলমলে চুল থেকে। স্নানের আগে আজ শ্যাম্পু করেছে নিশ্চয়। ওর চুলে নাক ঘষে সে আর বলে, সুন্দর না? জানো, যেখানেই গেছি কিছু না কিছু নিয়ে এসেছি, আমার শখ বলতে পারো।
চুলোর ওপর তেল পুড়ে যাচ্ছে। দৌড়ে যায় ফয়সল, মেয়েটাও যায় পিছু পিছু। এরপর মাংস ভাজার ফাঁকে ফাঁকে এক ছিপ এক ছিপ করে চুমুক দেয় ওরা, চুমু দেয়, নাকে নাক ঘষে। গরম তেলে নাড়তে থাকা কষানো মাংস থেকে একটু একটু করে গন্ধ ছড়াচ্ছে। বসার ঘরের দেয়াল আর ড্রয়ারের ওপর থেকে রান্নাঘরে কী হচ্ছে, মারজিয়া বা রুকাইয়া তা দেখতে পায় না।
মধু আর মসলার বনে ঘুরপাক খেতে খেতে যখন ওরা শোবার ঘরে এল, বাইরে তুমুল বাতাস দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। খাটের পাখায় হেলান দিয়ে আছে ফয়সল। যেটুকু খেয়েছে, তাতেই ঢুলুঢুলু করছে চোখ। অর্ধেক গ্লাস পাশটেবিলে রেখে মেয়েটি ওর গা ঘেঁষে বসে। বলে, বুকটা চিনচিন করতেছে, আর না খাই।
শাড়িটা সরিয়ে ব্লাউজের মধ্যে হাত রাখে ফয়সল, হতে পারে অ্যাসিডিটি, একটা ট্যাবলেট দিই?
না থাক, মাঝে মাঝে এমন হয়, একটু পরেই ঠিক হবে।
ওর কথার রেশ ধরেই হঠাৎ মেয়েটাকে ম্লান আর ক্লান্ত লাগে ফয়সলের। ব্লাউজের ভেতরের কোমলতা থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে একটু গুছিয়ে বসে সে, তুমি না একটা জব করতে?
ছেড়ে দিছি। কৃতিত্বভরা গলা ওর, বস ব্যাটার মাত্রাছাড়া আবদার, বুঝলেন। ফাঁকে ফাঁকে ম্যানেজারের আবদার। যা বেতন! তার চেয়ে স্বাধীন আছি, এই-ই তো ভালো।
তারপরও এটা তো কোনো পথ না, তাই না?
পথ যে না তা মানতেছি, কিন্তু ছোট ভাইটা কলেজে পড়ে, মায়রে টাকা পাঠাইতে হয়, উপায় কী, বলেন?
বসার ঘরে চার্জে দেওয়া ফোনটা বেজে উঠতেই তড়াক করে খাট থেকে নেমে গিয়ে ফোন ধরে ফয়সল,...আরে না, না, এখানে তো জোর বাতাস দিয়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে।...তুমি পাগল নাকি! সব বন্ধ করেছি। বললাম তো ছাদে কিছু দেই নাই।...কথায় তাড়াহুড়া থাকলেও রাগের কণ্ঠস্বর যদ্দুর সম্ভব কোমল করে রাখে ফয়সল। ওঘর থেকে তা অনুভব করতে পারে মেয়েটি। ফিরে এলে সে বলে, এই তো ফোনে কথা বলতে গিয়া রাইগাই তো ছিলেন, রাগ কি দেখাইতে পারলেন? সব সময় সব কাজের উপায় থাকে না, ফয়সল ভাই।
একা ঘরে একটা মেয়েকে ডেকে রান্না করছে, মদ খাচ্ছে, চুমু খাচ্ছে, বাকি কাজ তো পড়েই আছে এখনো; বউকে এর ছিটেফোঁটাও বুঝতে না দিয়ে ফোনে যে শুধু নিজের রাগটাই চেপে ধরেছে সে—অনুভব এড়ায়নি তেইশ-চব্বিশ বছরের এই মেয়েটার। আর বুদ্ধি করে ও যেভাবে বলল, তা ভেবে ফরসা মুখখানার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ফয়সল। বলে, একটু চেষ্টা করলে কীই-না হতে পারত তোমার, বলো?
বুকের ভেতর দলা পাকানো শ্বাস ছেড়ে একটা একটা করে ওর শার্টের বোতাম খুলে দিতে দিতে বলে মেয়েটি, সবাইরে দিয়া কি সব হয়, ভাই? বাবা মারা যাবার পর মামা-চাচা কেউই তো কোনো দায়িত্ব নেয় নাই। পথের পাতার মতন দ্বারে দ্বারে উইড়া আইজ এইখানে খাড়াইছি। এমনও দিন গেছে, দূর সম্পর্কের এক খালার আশ্রয়ে থাকি তখন, মা-ভাই থাকে কুমিল্লায়—কলেজ থেকে আইসা কেবল ভাত মাখছি, খালায় জানে খাইতে আমার দেরি হয়, কয়, মানুষ আইছে রুমে যা, তার সোময় নাই। মাখা ভাত পইড়া রইছে, হাত ধুইয়া হাসিমুখে শুইতে গেছি। কোনো কোনো দিন পাঁচবার শুইছি, ছয়বার শুইছি। মাইয়া লোকের শোয়াশুইর কি শেষ আছে!
কথায় কথায় কখন যে তৎপর হয়ে পড়েছে মেয়েটি—বাতি নিভিয়ে নীল আলো জ্বেলে দিয়েছে, ধবধবে উজ্জ্বল নগ্ন শরীরে গেঁথে নিয়েছে ফয়সলের নগ্নতা। আর ফয়সলও নেশার ঘোরে সব ভুলে সবটুকু বিসর্জনের চেষ্টায় একেবারে বুঁদ হয়ে জিজ্ঞেস করে, খারাপ লাগছে, এত ঘামছ যে?
বুঝতে পারতেছি না, বলে প্রাণপণে ওকে আঁকড়ে ধরে মেয়েটি।
এদিকে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। জানালায় বাতাসের ঝাপ্টা আর বাজ পড়ার শব্দের মাঝে ওর গোঙানি একটু বুঝি কানে বাজল ফয়সলের। কিন্তু যেভাবে খামচে ধরেছে, বুকের নিচে তড়পাচ্ছে ওর সঙ্গে পেরে উঠবে কি উঠবে না, তেমন একটা ভাবনাও বুঝি মুহূর্তের জন্য উঁকি দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর এই দুর্ভাবনাকে ধুলো দিয়ে একেবারে নিস্তেজ হয়ে গেল মেয়েটি। পিঠ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল খামচে থাকা হাত দুটি। এমনকি ওর নিশ্বাসের শব্দও আর টের পায় না ফয়সল। তবুও কানের কাছে মুখ লাগিয়ে ফিসফিস করে বলে, কী, হলো তো?
কোনো ভাষা মেলে না। না শরীরের না কণ্ঠস্বরের। দুই হাতে ভর রেখে ওর তলপেটের ওপর বসে ফয়সল। থুতনি নাড়িয়ে জাগাতে চায়। ও-মা, ও কি জ্ঞান হারিয়েছে?
তা কী করে হয়! লাফ দিয়ে নেমে পড়ে সে খাট থেকে। পানি এনে বার কয়েক ওর মুখে ঝাপ্টা দেয়। হাতের তালু ঘষে, পায়ের পাতা ঘষে। হৃৎপিণ্ডের শব্দ শুনতে নিবিষ্ট হয়ে উদোম বুকে কান পাতে, নাড়ি টিপে টিপে স্পন্দন পেতে চায় ওর। কিছুই মেলে না। তুমুল বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে সব। বাতাস পড়ে গেলেও আকাশ কাঁপাতে থাকে ঘন ঘন বিদ্যুচ্চমক। আধবোজা চোখ মেলে কিছুতেই আর জাগে না মেয়েটি।
পাঁজর ভেঙে দেবে নাকি? নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তেমন করেই হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে ফয়সলের। কপালের দুই পাশে শিরা দাপাচ্ছে। কিছুই চিন্তায় আসছে না তার গুছিয়ে। ধপ করে সোফায় বসে গেলাসের তরলটুকু এক ঢোঁকে গিলে নেয় সে। ছটফটানিটা বেড়ে গেলে তুমুল একটা আলোড়ন মাথায় নিয়ে কিছুক্ষণ এঘর-ওঘর করে, চুল ধরে টানে। বলা নেই, কওয়া নেই, দুম করে তার বুকের তলায় তড়পাতে তড়পাতে একটা মেয়ে মরে গেল, আর সে কিনা বুঝল উল্টো! এখন উপায় কী করে সে? নীল আলোর নিচে চিত হয়ে শোয়া মেয়েটার আধবোজা চোখের দিকে তাকাতে গিয়ে বারবার আঁতকে উঠছে ফয়সল। পাঁজর যে খান খান হতে চাইছে।
দেয়ালঘড়ির দশটা আটান্নয় ভ্যানিটিতে ফোনটা বেজেই চলে মেয়েটার। একবার ভাবে ফয়সল, ব্যাগটা খুলে দেখে কিন্তু মনের ইশারা পায় না সে। খেতে খেতে বোতলটাও শেষ হয়ে এসেছে প্রায়। সোফায় শরীর এলিয়ে পড়েছে। এখন কী করবে? কিছু তো একটা করবে, নাকি? আজহারকে ফোন দেবে? চিন্তায় জট পাকিয়ে গেছে, চেতনা নেতিয়ে গেছে, পৃথিবীর সব পথ ফুরিয়ে গেছে বলে মনে হয় তার। জীবন থেকে জীবন খসে গিয়ে ঘুমে চোখের পাতা লেগে আসছে এখন...
কাঠের গোল গুঁড়িটা মেঝেতে গড়িয়ে গড়িয়ে এনে চামড়ার ফোল্ডারটা যখন খুলল ফয়সল ছোট বড় মাঝারি ছুরিগুলো চকচক করে উঠল। কোরবানিতে কসাইয়ের সঙ্গে রক্তে মাখামাখি হয়ে মাংস কাটার আনন্দ তার বহুদিনের। থাইল্যান্ড থেকেই তো সে শখ করে কিনেছিল এই সেটটা। রাত এখন কত কে জানে!
প্রাণের মধ্যে একটা তাড়াহুড়ো লেগে গেছে, কী এক উন্মাদনা এসে ভর করেছে—আর বুঝি সময় নেই, নক্ষত্রেরাও বুঝি চোখ বুজল এবার।
মেয়েটার শরীর থেকে মাথাটা আলাদা করে রক্তের ধারা বইয়ে দিল সে রান্নাঘরের নালা-বরাবর। বেসিনের নিচের কলটা ছেড়ে রাখল। জল আর রক্তের সে ধারায় তাকানোর ফুরসত নেই ফয়সলের। মাঝারি আকারের একটা ছুরি দিয়ে কবজি থেকে হাত দুটো, গোড়ালি থেকে পায়ের পাতা দুটো কেটে নিয়ে আরও ছোট একটা দিয়ে ধবধবে ঊরু থেকে, জঙ্ঘা থেকে, ডানা থেকে, পাঁজরের সবগুলো হাড় থেকে নিপুণ করে মাংস চেঁছে নিয়ে কুচি কুচি করতে থাকে ফয়সল। শব্দ এড়ানোর জন্য ভারী অস্ত্র না নিয়ে মারজিয়ার নিষেধ উপেক্ষা করে সে ছোট ছুরি দিয়েই কিমা বানাতে লেগে যায়। কোরবানিতে প্রতিবারই এ রকম চ্যাঁচায় মারজিয়া, টাকা দিয়ে কসাই এনেছি তোমার এই কাণ্ড দেখতে? ওঠো বলছি।
কে শোনে কার কথা। মাংস কাটাও বুঝি এক নেশা! আহ্, সেই নেশার ঘোরেই কি প্রাণপণে কেটে চলে ফয়সল? নাকি আলো ফোটার ভয় বেড়েছে তার মনে?
তিনটি টয়লেটের কমোডে ফ্লাশ করে দেওয়া হয়েছে কিমা হওয়া সবটুকু শরীর। পলিথিনে পেঁচিয়ে হাড়গোড়, মাথা, হাতের পাঞ্জা, পায়ের পাতা একটা লাল টুকটুকে ট্রলি ব্যাগে ভরা হয়ে গেছে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচা গেছে!
কলের সঙ্গে পাইপ লাগিয়ে এবার সে ধুয়ে নিতে চাইছে লেগে থাকা রক্ত-চর্বি-মল-মূত্র- পাপ-গ্লানি-কান্না-হাহাকার, সব—জলে ভিজে ভিজে জীবন দিয়ে ঘষে ঘষে তুলতে চাইছে ফয়সল, চিরতরে মুছে দিতে চাইছে...।
পর্দার ফাঁক গলে ভোরের একছটা রোদ নীল আলোর মেয়েটাকে ডেকে ডেকে কখন যে সরে গেছে!
সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১৬ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত