বিজ্ঞাপন
default-image

মধুসূদন দে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীর সবার প্রিয় মধুদা। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে সবার কাছে ছিলেন অতিপরিচিত। সবার প্রিয় ছিলেন ‘মধুদা’। এই মধুদা ২৬ মার্চ নিহত হন বর্বর পাকিস্তানি সেনাদের হাতে।

২৫ মার্চের ভয়াল বীভৎস রাতের পরদিন সকাল। সন্ত্রস্ত প্রতিটি মুহূর্ত। বর্বর পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণ করে জগন্নাথ হলের পার্শ্ববর্তী শিববাড়িতে। মধুবাবু তাঁর পরিবার–পরিজন নিয়ে থাকতেন শিববাড়ি কোয়ার্টারে। সেনারা মধুবাবুর বাড়ির দরজায় সজোরে করাঘাত করলে দ্বিধাসংকোচচিত্তে তিনি দরজার কপাট খুলে দেন। সঙ্গে সঙ্গে একজন ভেতরে ঢুকে পড়ে। মধুবাবুকে টেনে বাইরে নিয়ে যায়। পাশের বাড়ির আঙিনায় সেনারা তাঁকে আটকে রাখে।

এঘর–ওঘর করে ছোটাছুটি করতে থাকেন মধুবাবুর পুত্রবধূ রানী। বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা। অসহায় গৃহবধূর আর্তি প্রমত্ত হায়েনাকে এতটুকু বিচলিত করল না। স্বামী রণজিত দে ছুটে এলেন অসহায় স্ত্রীকে রক্ষা করতে। ক্রুদ্ধ বর্বরের উদ্যত রাইফেলের আঘাতে তাঁরা লুটিয়ে পড়লেন। দাদা-বউদির কাছে ছুটে এল ছোট বোন রানু। সব ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষ সাক্ষী পরিবারের এই মেয়ে। আর সবাই ছোট ছোট। ওরাও দেখেছিল তাদের আপনজনকে বর্বর নরপিশাচদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হতে। নরপিশাচদের ভয়ে ওরাও প্রকম্পিত। অসহায় অবুঝ শিশু ওরা। সেদিনের ঘটনাগুলোর প্রত্যক্ষ সাক্ষী ওরা। রানুই ছিল তাদের মধ্যে বড়। সে জানে সে দেখেছে নিজেও বর্বরদের শিকার হয়েছে। দাদা-বউদিকে রক্ষা করতে অবুঝ মেয়ে রানু ছুটে গিয়েছিল পাশের ঘরে। সঙ্গে সঙ্গে বর্বরদের উদ্যত রাইফেলের গুলি তার চোয়ালে আঘাত করে।

রানু সেদিন প্রাণে বেঁচে গেলেও রণজিত বাবু আর তার স্ত্রীকে হত্যা করে বর্বরেরা মধুবাবুকে আঙিনায় এনে দাঁড় করায়। একজন সেনা উঁচিয়ে ধরে রাইফেল। স্ত্রী শঙ্কিত হয়ে উঠলেন। দৌড়ে গিয়ে স্বামীকে জড়িয়ে ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গে উদ্যত রাইফেলের গুলি ছুটে এল। লুটিয়ে পড়লেন তিনি। গুলির আঘাতে হাত দুটো তার ঝাঁঝরা হয়ে গেল। স্বামীকে বাঁচাতে গিয়ে তিনি নিজে প্রাণ দিলেন। গুলির আঘাতে মধুবাবুর দেহও জর্জরিত হয়ে গেল। স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে তিনি লুটিয়ে পড়লেন।

বর্বরদের গুলি রানুকে আহত করেছিল। ‘তবু আমি বেঁচে গেলাম। কিন্তু সেদিকে আমার ভ্রুক্ষেপ নেই। ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরছিল অবিরল। গুলি পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গেল। তবু আমি মরলাম না। সবাই যখন মরে গেছে, আমার বেঁচে আর লাভ কী।’ প্রিয়জন হারানোর বেদনায় ব্যথিত রানু কান্নাভেজা কণ্ঠে বলছিলেন কথাগুলো।

গুলির আঘাতে জর্জরিত মধুবাবু বর্বরেরা চলে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ বেঁচে ছিলেন। ঘণ্টাখানেক পর আবার ওরা এসেছিল। ওরা মধুবাবুকে নিয়ে যায়। অন্যদিকে ঘটনার ১৪ দিন পর্যন্ত শিববাড়িতে পড়েছিল মধুবাবুর ছেলে, পুত্রবধূ আর স্ত্রীর লাশ। (সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত)

সূত্র: ‘বাংলাদেশে গণহত্যা’ বাংলার বাণী, বিশেষ সংখ্যা, ১৯৭২ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনের মধুদা)

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, অষ্টম খণ্ড (তথ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার) থেকে