বিজ্ঞাপন
default-image

হাঁটি হাঁটি পা পা করে বেশ কয়েক বছর তো পেরিয়ে গেল। সন্ত্রাস-মারামারি-হানাহানি আর নেতা-নেত্রীদের গালমন্দের বোধ হয় এই বুম-টাইমে হতাশা-নিরাশাটাই আমাদের মুখ্য আবেগ। হবেই হয়তো। তাই একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্প ঠুকে দিই। সংক্ষেপে। হস্তী সমের্ক সর্বোত্কৃষ্ট লেখার জন্য মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। শুনেই এক ইংরেজ তেড়ে-মেড়ে ছুটল টমাস কুকের ট্রাভেল অফিসে। জোগাড়যন্ত্র, ব্যবস্থাদি শেষে ১০ দিনের মাথায় আসাম-জঙ্গলে হাজির, তিন মাস পর দেশে ফিরে গিয়ে প্রকাশ করল বই-আসামের পার্বত্যাঞ্চলে হাতি শিকার। ফ্রেঞ্চ বাবাজি কলম-নোটবই আর শ্যামেেনর বোতল নিয়ে গেলেন চিড়িয়াখানায়। হাতির খাঁচার সামনে কাটালেন দিনের পর দিন। হাতির চাল-চলন দেখেন আর নোট করেন। কিছুকাল পর ছাপা হলো তার চটি বই-হাতির প্রেমরহস্য। জার্মান না গেল জঙ্গলে, না ছুটল চিড়িয়াখানায়, লাইব্রেরিতে গিয়ে গাদা দাগা বই জোগাড় করে দিন-রাত ডুবে থাকল। সাত বছর অশেষ পড়াশোনা আর পরিশ্রম করেয়া সাত খণ্ডের বিশাল কিতাব ঝাড়ল-হস্তিবিদ্যার সংক্ষিপ্ত আবতারণিকা। আর মার্কিন? হস্তি কিনিল। হস্তি পুষিল। বই লিখিল বিগার অ্যান্ড বেটার এলিফেন্ট-হাউ টু গ্রো দেম।

মুজতবা আলী হস্তীপর্ব এখানেই শেষ। বাঙালি যদি মিলিয়ন ডলারের জন্য রচনা শুরু করত, তাহলে কী হতো? আমার ধারণা, একজনের বই হতো-পোষা হাতির উপকারিতা। আর অন্য আরেকজন-হাতির আক্রমণ থেকে রক্ষার উপায়। একই জিনিস সমঙ্ূর্ণ ভিন্নভাবে এবং বিপরীতার্থে দেখা এবং বোঝা নিশ্চয় আমাদের অন্যতম প্রধান গুণ, বিশেষত লেখকদ্বয় যদি রাজনৈতিকভাবে ‘সচেতন’ হয়ে থাকেন।

রাজনৈতিক সচেতনতা যে আমাদের কত সহজে সামান্য বিষয়ে একেবারে বিপরীত মেরুতে ঠেলে দেয়, তা তো আমরা পলে পলে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি; আর যে বলব ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ তারও বোধ হয় উপায় নাই। কী করা!

২.

বিভিন্ন ডামাডোলের ভেতর আমরা ধরেই নিই যে আমরা সবাই গণতন্ত্রী-অর্থাত্ গণতন্ত্র বুঝি, মানি, জানি; তবে জেনেশুনেও অগণতান্ত্রিক আচার-ব্যবহার করি, মারধর করি, লাঠিপেটা করি, ইত্যাদি। কিন্তু ব্যাপারটা কি অত সোজা? বোধ হয় না। খোলাশা করার চেষ্টা করি।

আমরা কেউ গণতান্ত্রিক হয়ে জন্মাই না। গণতন্ত্র আমাদের জন্মগত, মজ্জাগত আচার-ব্যবহারের পরিপন্থী, অন্তরায়। ধরুন ছোটবেলার কথা। খেলা নিয়ে দু বন্ধুতে ঝগড়া, সঙ্গে সঙ্গে কিল-ঘুষি, কান্নাকাটি, আর অনেক সময় বাবা-মা পর্যন্ত গড়ানো; অপছন্দ হলে ছোটরা কান্নাকাটি, জেদাজেদি, বেশি দুষ্ট হলে দুধের বোতলটা ছুড়ে, খেলনা ছুড়ে মারবে, চেঁচামেচি করে পাড়া মাতাবে। তারপর আস্তে আস্তে বড় হওয়া মানে বন্ধুর সঙ্গে মনের অমিল হলেও সঙ্গে সঙ্গে তাকে কিল-ঘুষি না মারা, খাওয়া পছন্দ না হলেও বাবা-মার কথা শুনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও খাওয়ার চেষ্টা করা, কিছু চেয়ে না পেলে সেটা মেনে নেওয়া, তা মনে মনে যত দুঃখই হোক না।

দেড়-দু বছরের বাচ্চাকে এটা ধরো না, ওটা করো না আর সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চার তারস্বরে চিত্কারের অভিজ্ঞতা কম-বেশি সব প্রাপ্তবয়স্কেরই আছে। চার-পাঁচ বছরে সে বাচ্চা স্কুলে যাবে-সকালে টেনে-হিঁচড়ে নেওয়া যায় না, স্কুলে গিয়ে কান্নাকাটি ইত্যাদি। কিন্তু আস্তে আস্তে মানিয়ে নেয়।

এসব কিছুই এক অর্থে শিক্ষা আর বড় হতে হতে নিয়মকানুন মেনে চলতে অভ্যস্ত হওয়া। একই সঙ্গে এগুলো আবার আমাদের স্বভাবজাত অসহিষ্ণুতা কাটিয়ে ওঠা-সহিষ্ণু হওয়া, গণতান্ত্রিক হওয়ার সঙ্গেও জড়িত। প্রশ্ন উঠতে পারে-বেড়ে ওঠা, বড় হওয়ার সঙ্গে গণতন্ত্রের কী সমর্ঙ্ক? সমর্ঙ্ক আছে বৈকি!

আমাকে কেউ গালমন্দ দিলে, কটু কথা বললে, আমার সমালোচনা করলে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠাই আমাদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। ছোটবেলায় আমরা সবাই বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে কমবেশি ঝগড়া করেছি, গালমন্দ দিয়েছি-খেয়েছি এবং স্বভাব-চরিত্র বিশেষে হাড্ডাহাড্ডি কিল-ঘুষি, নিদেনপক্ষে কাট্টি-অভিমান, আর অনেকের ক্ষেত্রে লাঠিসোঁটা নিয়ে মাথা ফাটাফাটি করেছি। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় আমাদের সবাইকে গালমন্দ হজম করার বিদ্যা হাসিল করতে হয়। বস বকা দিল আর অমনি ঘুষি মেরে যদি তার দাঁত ফেলে দিই, তাহলে তো সারা জীবন বেকারের খাতায় নাম লেখাতে হবে। আর পেশাগত জীবনে আমাদের আইনজীবীদের অবস্থা তো সবচেয়ে করুণ। বিচারকদের কাছ থেকে অহরহ না হলেও দেদার বকাঝকা খেতে হয়। অন্য পেশাজীবীরা হয়তো আঁচই করতে পারেন না যে, সামরিক বাহিনীর বাইরে পোশাক-আশাকের জন্য মধ্যবয়সী আইনজীবীরাও বকা খান-যেমন কালো কোটের বোতাম খোলা থাকলে। হাটে হাঁড়ি ভাঙলাম না তো আবার।

যা বলছিলাম। সহিষ্ণুতার ব্যাপার। কেউ যদি একটু পাবলিক ফিগার হয়ে পড়েন, তাহলে তো পত্রপত্রিকার গালমন্দ শুনতে হয়। আর মাঠে-ঘাটে প্রতিপক্ষের কথা বাদই দিলাম। এসব সহিষ্ণুতার প্রতিফলন হলো বাক্স্বাধীনতা। অন্যকে মোটামুটি আপনার বিরুদ্ধে যা বলতে চাইবে, তা-ই বলতে দিতে হবে-তা আঁতে যতই ঘা লাগুক না কেন। আর আঁতে-পাতে ঘা লাগবে আর তা চুপ করে হজম করবেন, এমন সহিষ্ণু হতে তো সময় লাগে। প্রায়শই এক জনমে হয় না। আর তাই প্রায়ই দেখি, নেতার বয়স তো ষাট হয়ে গেছে অথচ তাকে কটু কথা বলছেন-মারো বোমা, ছোড়ো গুলি, আর নিজে পাতি নেতা হলে প্রতিপক্ষকে অন্তত লাঠিপেটা করো।

ছোটবেলার স্কুল-এই তুমি আমার পেন্সিল নিয়েছ কেন? যে নিয়েছে সে আকৃতি-প্রকৃতিতে ছোট হলে আর যার পেন্সিল নিয়েছে সে হূষ্টপুষ্ট এবং একই সঙ্গে ন্যায়পরায়ণতা সমের্ক খুবই আদর্শবাদী হয়ে সহপাঠির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া, দু-চারটা কিল-ঘুষি লাগানো। পেন্সিল না হলেও ঘুড়ি, লাটিম, বল আর আজকাল বোধ হয় সিডি, রক বা ফিল্ম স্টারদের ছবি অথবা নিনটেনডোর রবোট ইত্যাদি নিয়ে তাত্ক্ষণিক চার্জশিট, বিচার এবং শাস্তি অহরহ হচ্ছে। তাত্ক্ষণিক বিচার শাস্তি অর্থাত্ কিল-ঘুষি মারা অথবা গণপিটুনিতে পাঁচ ডাকাত নিহত থেকে কোর্ট-কাচারি করে শাস্তি, সেটা ভীষণ রকমের একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া।

আইন না বুঝে ‘আত্মস্বীকৃত খুনিদের ফাঁসি কার্যকর করো’ ্পোগান থেকে বিচারের জন্য কোনো ্পোগান লাগবে না, হরতাল লাগবে না, সভা-মিছিল লাগবে না-এমন পর্যায়ে যেতে বেশির ভাগ সমাজের অন্তত ১০০ বছর লেগেছে।

৩.

হলে গিয়ে বাংলা সিনেমা দেখা হয় না অনেক বছর। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে মনে মনে একটা ‘প্রজেক্ট’ আছে। কোর্ট-কাচারি, বিচার-পুলিশসংক্রান্ত কিছু ঘটনা-সিন আছে, এমন গোটা বিশেক বাংলা সিনেমা দেখব। উদ্দেশ্য-সিনেমাগুলো আমাদের বিচার ব্যবস্থার কী ট্রিটমেন্ট হচ্ছে সেটা দেখা ও বোঝা। সিনেমায়, না দেখেই বলছি নিশ্চয় বিচারে নির্দোষ ব্যক্তির শাস্তি হয় আর ভিলেন ছাড়া পেয়ে যায়। পরে নায়ক নিজের শৌর্যবীর্যে জীবন বাজি ধরে ভিলেনের শাস্তি নিশ্চিত করে-বেশির ভাগই বিচার ব্যবস্থার বাইরে। যেমন পালাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মরে অথবা পানিতে ডোবে। প্লাস আইনজীবীদের খলচরিত্র-সত্যকে মিথ্যা বানানো বা মিথ্যাকে সত্য। এ অবস্থা থেকে বিচার ব্যবস্থায় আসল দোষীর বিচার হবে-এমন সিনেমা অন্তত অর্ধশতাব্দীর লম্বা পথ।

প্রথমদিকের চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমার অনেকটা জুড়েই গরিব নির্ভাগার বিচার না পাওয়ার, নিপীড়িত হওয়ার সিন-ঘটনা; নায়িকাকে ভিলেনের কালো থাবা থেকে উদ্ধার করার আর বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদার সিনেমা।

একইভাবে বন্দুুক হাতে ঘোড়সওয়া-ওয়েস্টার্ন সিনেমা। নিখুঁত নিশানার হিরো। ডজন ডজন ভিলেনের মুখোমুখি হয়ে সবাইকে ঘায়েল করে, উচিত শিক্ষা দেয়। আর যখনই বিচার-আচারের ঘটনা-সিন আসে, তাতে পুরোটাই অন্যায়-অবিচার-ঘুষ।

আর এখনকার পশ্চিমা সিনেমায়? দোষীর শাস্তি হয় আইনমাফিক গণতান্ত্রিক বিচার ব্যবস্থায়। ইতিমধ্যে অবশ্য পেরিয়ে গেছে কম-বেশি একশত বছর।

ঘোঁত করে নাইন্টি ডিগ্রি ঘুরিয়ে সিনেমা ছেড়ে মিল-ফ্যাক্টরিতে গেলে কি চিত্র ভিন্ন? আমার জমি, আমার ফ্যাক্টরি, আমার মূলধন, আমার কাঁচামাল-ব্যাটারা তোদের কাজ করতে দিচ্ছি তার পরিবর্তে বেতন দিচ্ছি। এর চেয়ে আবার বেশি কী চাস! দাবিদাওয়ার কথা মুখে আনলেই চৌদ্দ-পুরুষের পিঠের ছাল তুলে নেব। শিল্প-বিপ্লবের প্রথম যুগ থেকে বলতে গেলে তিন-চার দশক আগ পর্যন্ত এই ব্যবস্থাই কম-বেশি ছিল সারা দুনিয়ায়।

মালিকও হব আবার শ্রমিকদের প্রতি সহিষ্ণুও হব! এই মামাবাড়ির আবদার মানার বয়স নিতান্তই হাঁটি-হাঁটি পা পা। তারপর সভা-সমিতির অধিকার, সংগঠন করার অধিকার হতে, মেনে নিতে, গ্রহণ করতে সময় লাগে, শিক্ষা লাগে। এই লাগালাগিতেও কয়েক দশক পেরিয়ে যায়।

৪.

ঐতিহাসিকভাবে যেখানে রাজা-বাদশা কম ছিলেন সেখানে রাজা-বাদশার প্রতি আকর্ষণ আর সে সুবাদে বংশ পরমঙ্রার ব্যাপার রাজনীতিতে আসে একটু সহজেই (যেমন-রাজা-বাদশাহীন উত্তর আমেরিকায় বড় বুশের পর ছোট একাধিক বুশ, দাদা কেনেডির পর বাবা কেনেডি, ভাই কেনেডি আর এখন তো বোধ হয় আধা ডজন কেনেডি কংগ্রেসম্যান, সিনেটর, পাতি-গভর্নর ইত্যাদি যখন পরিবারের জামাই পর্যন্ত অর্থাত্ লেটেস্ট কালিফোর্নিয়ার গভর্নর আরন্যাল্ড সোয়ার্জনেগার)। একইভাবে জমিদার কম অথবা নিতান্ত শুধু পাতি জমিদার থাকলে রাজনীতিতে জমিদারি ভাবটার খোলতাই হয় একটু বেশি। এটা শুধু আমার সিটে আমার ছেলেমেয়ে আসবে, তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, আমার কোটি টাকার গাড়ি চড়ার মধ্যেও এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বাপ-দাদা জমিদার ছিল না বলে আমি যে রাজনীতির সুবাদে জমিদারি চালে চলব না, তার দিব্যি তো কেউ দেয়নি। আর জমিদারি চালে চলতে হলে তো আমার কোটি টাকার গাড়ির আগে-পিছে আরো দু-চারটা গাড়ি দরকার-অবশ্য আমারটার থেকে কম টাকার গাড়ি। আর যে দেশে এক-তৃতীয়াংশ লোক তিন বেলা পেট পুরে খেতে পায় না, অর্ধেক বাচ্চার জন্মই হয় পুষ্টিহীনভাবে, সে দেশে আমার ঐশ্বর্য যত বেশি দেখানো যাবে তত বেশি বড় নেতা তো আমিই হব। মঙ্গার খবরের সঙ্গে সোয়া কোটি দেড়-কোটি টাকা দামের নতুন গাড়ির খবর, মন্ত্রীর সেসব গাড়ির দোকান উদ্বোধনের খবর-এটাই স্বাভাবিক।

যা বলতে চাচ্ছি-এতসব কিছুতেও হতাশ হওয়ার কারণ-বুঝে পাই না। গণতন্ত্রটা সবাইকে শিখতে হয়, শিখতে হবে। আর সব সমাজেই এই শেখার প্রক্রিয়াটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

আমাদের ভোটাভুটির শুরু তো ১৯৩৭ সালের নির্বাচন থেকে, যদিও সে নির্বাচনে ভোটদাতা ছিলেন প্রাপ্তবয়স্কদের মাত্র এক সপ্তমাংশ। সে নির্বাচনের কিছু আগ থেকে ১৯৪৭ পেরিয়ে ১৯৫৪-৫৫ তো ছিল রায়টের সময়। ব্যাটা আমার বিরুদ্ধাচরণ করছিস-শ্যালাকে জবাই কর। আর জবাই করতে গিয়ে শ্যালার সঙ্গে জামাই-বৌ, দাদী-নানী, ভাতিজা-ভাগ্নে কাউকেও রেহাই নাই, আত্মীয় না হলেও রেহাই নাই। পঞ্চাশের মাঝামাঝি তিন-চার বছর রাজনীতি-রাজনীতি, ভোটাভুটি খেলা চলল, অনেকটা সিনেমার ইন্টারভ্যালের সময়ের মতো। তারপর জোর যার মুল্লুক তার। ‘সহিষ্ণু’ শব্দটাই আউট। গণতন্ত্র তো মেলা দুরস্ত। তারপর যুদ্ধ-স্বাধীনতা। ১৯৭২ সালে ভোট হলো, পার্লামেন্ট হলো, কিছুটা গণতন্ত্রের লেবাস হলো। বছর দুয়েক টিকল। হলো এক দল, অর্থাত্ তোমার আবার মতামত কী? আমার মতই সব মত। মানো, না হলে ভাগো। তারপর আবার জোর যার মুল্লুক তার। চলল নব্বই পর্যন্ত। মোদ্দা কথা, গণতন্ত্র শেখার সময় পেলাম কই?

সবারই সময় লাগে। আশপাশেই তাকাই না কেন। মিয়ানমার-জোর যার মুল্লুক তার। শ্রীলঙ্কা-কখন যুদ্ধ, কখন গণতন্ত্র বোঝা মুশকিল। মালদ্বীপ ভদ্রলোক প্রেসিডেন্ট হয়েছেন সেই কবে, বছরের হিসাবও তো হারিয়ে যাচ্ছে। সার্কের প্রথম থেকে এ পর্যন্ত তো আছেনই। পাকিস্তান-ভোটাভুটির চেয়ে অ্যারোপ্লেনে ওড়াউড়ির সঙ্গেই রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন বেশি, যেন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নেপাল-রাজা বাদশা আর মাওবাদীরা মিলে সবাইকে রেখেছে তটস্থ করে বছরের পর বছর। সাদামাটা চোখে দেখতে গিয়ে প্রতিবেশী বন্ধু দেশের গিবত করাটা আমার উদ্দেশ্য না।

কিন্তু এটাই তো বাস্তবতা। ওরাও এখনো বেশি সময় পায় নাই। ভারতের অবস্থাটা একটু ভিন্ন। পরীক্ষার তিন দিন আগে আমার-আপনার (অবশ্য সবাইকে বলছি না) বই খোঁজাখুজির চেয়ে ওরা বইয়ের খোঁজ করছে সপ্তাহ ১০ দিন আগে থেকে। ওদের গণতন্ত্র চর্চার ইতিহাসটা বেশ দীর্ঘ। মারামারি না করে হাত-পা গুঁজে বসে থাকব; খাব না দাব না করে অনশন করব; পথযাত্রা করে শ শ মাইল যাব-সহিষ্ণুতার এত সব নতুন কিছুর শুরুর যেখানে হয়েছে, সেখানে চর্চা তো অনেক বেশি। আমাদের কিছু পূর্বসূরি এতে যোগ দিয়েছিলেন। তবে হয়তো নামেমাত্র।

গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক আচরণ, সহিষ্ণুতা, অপরকে শ্রদ্ধা, আর সর্বোপরি লাঠিসোঁটা পেটা না করে যুক্তি-তর্কে সীমিত রাখা-এসব শেখা অত সহজও না। নিচের ক্লাসের কবিতা মুখস্থ করার চেয়ে উপরের ক্লাসের সাহিত্য-সমালোচনা করতে পারাটা অনেক অনেক কঠিন। এক অর্থে আমরা বোধ হয় এখনো শিশু ক্লাসের কবিতা মুখস্থের পর্যায়ে রয়েছি। গণতন্ত্র আর উন্নয়নের কথা গড়গড় করে বলবেন না অথচ রাজনৈতিক বক্তৃতা করবেন, এটা কি হয়। চোখ বন্ধ করে মুখস্থ কবিতা বলার মতো।

আমি বিপ্লবী না, বিদ্রোহীও না। যদিও বিদ্রোহী কবির দুটো শব্দ ধার করেছি এ লেখার শিরোনাম হিসেবে। আশা করছি এতে কেউ বেজার হবেন না, রাগও করবেন না, বরং দয়া-পরবশ হয়ে সহিষ্ণু হবেন। গণতন্ত্র শেখা আর চর্চার ফল পাওয়ার শুভদিন আসছে। আপেক্ষিকভাবে সময় কম পেলেও আমাদের শেখা আর চর্চাটা বেশ গণ্ডিশীল। আর এ চেষ্টার অগ্রভাগে নিঃসন্দেহে জনগণ-ভোটার।

শাসনভার অর্পিত হলেই কেন জানি শাসকরা দিব্যি দিয়ে বসেন যে তারা গণতান্ত্রিক আচরণ শেখা পাঁচ বছরের জন্য বন্ধ রাখবেন। কিন্তু এ পাঁচ বছর জনগণ তো চোখে ঠুলি দিয়ে বসে থাকেন না-দেখব না, শুনব না, জানব না বলে প্রতিজ্ঞা করেন না। দল, পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের বদল। আমাদের এ পর্যন্ত আটটি সংসদীয় নির্বাচন হয়েছে। ঠিকমতো (অর্থাত্ কারচুপি, সন্ত্রাস, ভোটচুরি ইত্যাদি ইত্যাদি বাদে) নির্বাচন হয়েছে আর ক্ষমতাসীন দল পুনর্নির্বাচিত হয়েছে, এটা এখনো হয় নাই এবং আমি নিশ্চিত অদূর ভবিষ্যতেও হবে না।

জোর-জবরদস্তি করে লোক দেখানো নির্বাচনে জেতা যায়-যেমন হয়েছিল ১৯৮৬, ১৯৮৮ আর ১৯৯৬-এর ফেব্রুয়ারিতে-কিন্তু ক্ষমতায় টেকা যায় না। শুধু আমাদের দেশেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার গত ৫০ বছরে গোটা পঁয়ত্রিশেক নির্বাচনের মধ্যে নেহেরু আমলের কংগ্রেস ছাড়া কোনো দলই পরপর দুবার নির্বাচনে জয়লাভ করেনি বললেই চলে। অবশ্য কোনো নেতা যদি এখন ভেবে বসেন যে আমি মতিলাল নেহেরুর চেয়ে কম কিসে, তাহলে অবশ্য বলার কিছুই নেই। আমার সঙ্গে এতদিন একমত ছিলে আর এখন মত পাল্টেছ। দাঁড়া ব্যাটা, মজা দেখাচ্ছি। আর এই মজা দেখানোর খেলা তো আমরা এখন মাসদুয়েক ধরে দেখছি। তুমি ভিন্ন পথে যাবে, আমার বিরোধিতা করবে-আর আমি তোমাকে লাঠিপেটা করব না-এ গোছের সহিষ্ণুতা আর এ সহিষ্ণুতা শিখতে সময় লাগবে। তবে যা বলাছিলাম, জনগণ শিখে ফেলছে অতি তাড়াতাড়ি। আর জনগণের চাপে নেতাদেরও শিখতে হবে খুব তাড়াতাড়িই। অবশ্য তাদের দিব্যিটা অনেক দূর-ক্ষমতাসীন আর বিরোধী এই দুই গোছের নেতাদেরই-তবুও আমি আশাবাদী, কেননা যাঁতায় পড়লে বাঘে-মোষেও এক ঘাটে জল খায়।

আর যেসব রাজনৈতিক দল জনগণের সঙ্গে তালে তাল রেখে গণতান্ত্রিক আচার-ব্যবহার রীতিনীতি সাত তাড়াতাড়ি শিখছে না, শত অসম্ভবের মধ্যেও জনগণ যদি গণতন্ত্রের মধ্যে থেকে তাদের অল্প কিছুদিনের মধ্যে বিদায় দেয়, তাহলে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই থাকবে না। এদিকে লাঠিপেটা করবেন, দুর্নীতিতে পাহাড়-প্রমাণ সমঙ্দ গড়বেন, কালো আইনের পর খেয়াল-খুশিমতো সংবিধানের টানাহেঁচড়া করবেন, আর অন্যদিকে মুখে যা আসবে তা-ই বলবেন এবং কথায় কথায় হরতাল ডাকবেন, এমন জমিদারির দিন শেষ করতে জনগণের খুব একটা বেশি বেগ পেতে হবে না। অথবা দলগুলো তাড়াতাড়িই সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক হয়ে উঠবে। স্বাধীনতার এ বার্ষিকীতে তাই আমি আশাবাদী। আসিতেছে শুভ দিন।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৪ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত