বিজ্ঞাপন
default-image

করাচি, পাকিস্তান: বহু বছর আগে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখে গেছেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি...ওমা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে...।’ এই বসন্তে পূর্ব পাকিস্তান/বাংলাদেশের আমের বনে কেবল লাশের গন্ধ—হত্যাযজ্ঞে আজ অনেক হৃদয় দিশেহারা।

গণহত্যায় নিহতের প্রকৃত সংখ্যা পৃথিবীর অন্যান্য জায়গার মতো পূর্ব পাকিস্তানেও যাচাই করা খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কেউ বলে হাজার হাজার, কেউ বলে দুই লাখ। রক্ষণশীল হিসেবে সংখ্যাটি হতে পারে ৫০ হাজার। শরণার্থীর সংখ্যা জানা যাচ্ছে। ১ মে-র হিসাবে ভারতের চারটি রাজ্যে ছয় লাখ ৫০ হাজার।

পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীরা জানাচ্ছে, গণহত্যার যারা শিকার, তারা পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্িরষ্টান; ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর তাদের পদ্ধতিগতভাবে নিশ্চিহ্ন করার জন্য এই হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা বলছে, পূর্বাঞ্চলে যারা নিহত হয়েছে, তারা ভারতের বিহার ও অন্যান্য রাজ্য থেকে আগত বিহারি মুসলমান—দেশ বিভাগের পর তারা অভিবাসী হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে এসেছে, কিন্তু বাঙালি সংস্কৃতিতে আত্মীকৃত হয়নি।

করাচি সফরকারী একজন পর্যটক জানিয়েছেন, পাকিস্তানের অর্থনীতি তলিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক আইন বলবৎ করা হয়েছে আর সরকার মরিয়া হয়ে সবাইকে দেখাতে চাইছে যে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে সাত কোটি মানুষের জীবনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে। করাচিতে সবাই পূর্ব পাকিস্তানে বিহারি হত্যা নিয়ে বিপর্যস্ত, কিন্তু সেনাবাহিনী যে বাঙালিকে হত্যা করেছে, এটা প্রায় সবাই অস্বীকার করেছে।

পশ্চিম পাকিস্তানিরা মনে করছে, সমস্ত ঘটনাই ভারতীয় পরিকল্পনা— ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী (সাদা পোশাকে ভারতীয় সৈন্য), ভারতীয় অস্ত্রশস্ত্র এমনকি শরণার্থী যারা, তারাও ভারতীয় (পাকিস্তানি নয়)। আর তাদের সহায়তা করছে রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি।

দিল্লি সফরকারী অপর একজনের মতে, সাম্প্রতিককালের ইতিহাসে ভারত কদাচিত এতটা একতাবদ্ধ হতে পেরেছে—দলমতনির্বিশেষে সব নাগরিক বাংলাদেশকে (স্বাধীন পূর্ব বাংলা) স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে চাপ দিচ্ছে। ভারতীয় প্রেস বাংলাদেশের গণহত্যাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করছে। এ পর্যন্ত ভারত অত্যন্ত সংযমের পরিচয় দিলেও উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক সুবিধা আদায় করছে।

কলকাতায়, বিশেষ করে সীমান্ত অঞ্চলে যে কারও চোখে পড়বে হাজার হাজার শরণার্থী আসছে; ক্যাম্পে ঠাঁই পেয়েছে কেবল এক-চতুর্থাংশ। বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের আশাবাদী সদস্যরা দেশের জন্য স্বীকৃতি ও যুদ্ধের জন্য অস্ত্র চাচ্ছেন। পশ্চিম পাকিস্তান যে পূর্ব পাকিস্তানকে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হিসেবে এতবছর ধরে বিবেচনা করে আসছে, শরণার্থীরাই এর প্রমাণ। তাঁরা মনে করেন, ২৫ মার্চ যা ঘটেছে, তারপর তাঁদের দেশ কখনো পাকিস্তানের দুই অংশের এক অংশ হিসেবে পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত থাকতে পারে না।

১৯৪৭-এর স্বাধীনতার পর এই প্রথম অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের মোট আসনের ৯৮ শতাংশেই শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। শেখ মুজিব যে ছয় দফাভিত্তিক প্রচারণা চালিয়েছেন, তাতে স্বায়ত্তশাসনের দাবি ছিল। বিচ্ছিনতার নয়। প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে, ক্ষমতাশালী আমলা ও কিছু শিল্পপতির সহায়তায় পাকিস্তানের সেনাশাসকেরা ক্ষমতা হস্তান্তরের এই বড় দাবিটির কাছে মাথা নোয়াতে রাজি হয়নি। ২৫ মার্চ তারা সামরিক আইন জারি করল, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করল, শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করল এবং শুরু করল হত্যাযজ্ঞ। এই সেনা অভিযানের আগে ও পরে পূর্ব পাকিস্তানে কেউ কেউ কদাচিৎ অহিংস এই উপমহাদেশে নিজস্ব স্বার্থে হত্যাকাণ্ডের প্রশ্রয় দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ এবং বিশ্ব পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে নিরুদ্বেগ কেন? আমেরিকানদের নিরুদ্বেগ হওয়ার কারণ কি এটাই যে মুসলমানরা মুসলমানদের হত্যা করছে, তা ছাড়া এতে তো আর সাদা আমেরিকান জড়িয়ে নেই? নাকি আদর্শগত কোনো বিষয় নেই—এর সঙ্গে অন্তত কমিউনিজম তো নেই-ই? নাকি তারা নিরুদ্বেগ এ কারণে যে খুব সহজেই পূর্ব পাকিস্তানকে দ্বিতীয় ভিয়েতনামে পরিণত করা যাবে।

জাতিসংঘ কেন নিরুদ্বেগ? যে যুগের বিধিবিধান নরহত্যার বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলী কি কেবলই অভ্যন্তরীণ ব্যাপার? এসব কি মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়? পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতি এখনো কি অভ্যন্তরীণ এমনকি যখন তা বিশ্বশান্তিকে বিপন্ন করে তুলছে, যখন সশস্ত্র ভারত ও পাকিস্তান মুখোমুখি—বৃহৎ শক্তির হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার কথা বাদই থাক।

জোটনিরপেক্ষ দেশগুলো কেন নিরুদ্বেগ? প্রতিটি দেশের পেটের ভেতর কি এমন নিজস্ব একটি বাংলাদেশ রয়েছে? আন্তর্জাতিক সস্প্রদায় কি এই ১৯৭০-এর দশকে এমন একটা প্রক্রিয়া বের করতে পারে না, যাতে যেসব রাষ্ট্রের অংশ স্বায়ত্তশাসনের চেয়ে বেশি কিছু চায় যেমন—পূর্ব বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতি ভিন্ন, এমনকি ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা হাজার মাইলের—যদি সত্যিই চায়, স্বাধীন হয়ে যেতে পারবে?

জন্মগ্রহণের জন্য বাংলাদেশ সংগ্রাম করছে। সবুজ ও লাল পতাকার ভেতরে সোনালি মানচিত্রে সীমান্ত রেখা কলকাতায় পাকিস্তানে পুরোনো ডেপুটি হাইকমিশনের ওপর পতপত করে উড়ছে। আর মুক্তিযোদ্ধারা ঠাকুরের গানকে বেছে নিয়েছে জাতীয় সংগীত হিসেবে—আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।

যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ এবং বিশ্ব কিছুই কি করবে না?

২০ মে ১৯৭১ নিউইয়র্ক টাইমস -এ হোমার জ্যাকের লেখাটি প্রকাশিত হয়

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১০ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত