বিজ্ঞাপন
default-image

যখন তাদের কাপড়ের নিচের বেয়নেট চার্জের গর্তগুলি বাদ দিয়ে গায়ের ছোট ছোট দাগ সব বসে গেছে, পানি কমে কমে নদীনালাও মরে যাচ্ছে দেশের, তখন ঢাকা থেকে ডাক এলো সংবর্ধনা দেওয়ার। সেটি আবার সরকার হতে নয়, বেসরকারী এক সংস্থার উদ্যোগে। উদ্যোগে। বয়সকালে আমিরজান বিবি মিলিটারির আঁচড়-কামড় আর সিগারেটের ছ্যাঁকার দাগগুলো দেখিয়ে দর্শনার্থীদের বলতো, ‘তোমরা যা ভাবিছ তা নয়, ইগুলি সব পক্সের দাগ।’ মানুষের কৌতুহল কমে যাওয়ার সাথে সাথে সেসবও মজে যেতে লাগলো। আজ আমলকির ব্রিজ ও বড় ব্রিজের কোনো নিশানা নেই। নিমতলির বিজ্রের নিচে শীতের মৌসুমে মানুষ চাষবাস করে, রবিশস্য ফলায়, গাঁয়ের ছোট ছোট ছেলেরা ঘরকেটে হাডুডু, মার্বেল খেলে। তাদের হাতে বাতাসা কি কাঠি লজেন্স দিয়ে বুঝিয়ে বললেও বিশ্বাস করে না যে, একদিন পাকসেনার গতিরোধ করার জন্য রাতের অন্ধকারে এই ব্রিজগুলি ধ্বংস করা হয়েছিল।

এরকম সাক্ষ্যসহায়হীন অবস্থায় আমিরজান বিবি ঢাকার উদ্দেশ্যে মাইক্রোবাসে উঠে বসে। তার সাথে সিনিয়র সাংবাদিক সুজন সিকদার আর তার সহকারী সোহরাব হোসেন। গাড়িতে তাদের আজ রাত কেটে যাবে। পরদিন বেলা দশটায় মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি পাঠাগার মিলনায়তনে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান। যুদ্ধের ৩০ বছর পর তিন জন মুক্তিযোদ্ধা-বীরাঙ্গনার সংবর্ধনা দেয়া হবে। সন্মাননাপত্রের সাথে নগদ ১০ হাজার টাকা করে জনপ্রতি পুরস্কার। কার্ড-সুভ্যেনির ছাপা হয়ে গেছে। অথচ তিন জনের ভেতর দুই জনই গরহাজির। সুজন সিকদার থেকে থেকে আঙুল ঘষে কপালের চামড়া তুলে ফেলছে আর পকেট থেকে রুমাল বের করে শীতের রাতে ঘাড়-মাথার অদৃশ্য ঘাম মুচছে। সোহরাব ব্যতিব্যস্ত, ‘এতো ভাবিয়েন না তো সুজন ভাই। আপনি কি ওদের মিথ্যা বলিছেন? বলেন নি। বাকি দুজনের ছবি, বায়োডাটাও পাঠাই দেছেন। আর আমিরজান বিবি তো সাথে যাচ্ছেই।’

আমিরজানের জায়গায় মোহনা বেগম হলে সুজন সিকদারের ভাবনা ছিল না। মহিলা বলতে পারে বেশ। চেঁচিয়ে মঞ্চ তোলপাড় করে। তার কথা শুনলে লোকজনের পিলে চমকায়। গত বছর শেখ হাসিনা টাউনহল ময়দানে জনসভা করতে এসেছিলেন। সুজন সিকদার সাক্ষী, মোহনা বেগম নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙ্গে তাতে ঢুকে পড়লো। এদিকে সাংবাদিকরা বাহবা দিচ্ছে, ‘একে যাতি দেন, যাতি দেন। না ঢুকতে দিলি পর আমরা সরকার বিরোধী রির্পোট করবো। সামনে নির্বাচন।’ সিকিউরিটি পুলিশ সঙিন উঁচিয়ে বলছে, ‘সরেন, সরেন। তা না হলে গুলি করবো।’ মোহনা বেগম পুলিশ-গার্ড কচুরিপানার মতো হাত দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে সোজা চলে যায় শেখ হাসিনার মাইকের সামনে। ‘ম্যাডাম, মৃত্যুর আগে আপনাকে একটা কথা বলে মরতি চাই। আপনি আমার একটা কথা শুনি যাবেন, একটা সেকেন্ড।’ শেখ হাসিনা বলছেন, ‘ওনাকে বসতে দেও, ওনাকে বসাই দেও।’ পুলিশ পেছন থেকে বলছে, ‘না বইসলে গুলি করবো।’ মোহনাকে বসায় কার সাধ্যি। সে বলে, ‘ম্যাডাম ১৯৭১ সালে আমি আপনার বাবার নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছি। আপনার বাবার নেতৃত্বে যুদ্ধ করতে গিয়ে জীবনটা আমার শেষ হয়্যা গেছে। আপনার কাছে আমার সর্নিবন্ধ আবেদন, একটা পাকা রাস্তা আমার নামে করি দেন ম্যাডাম। শুধু নতুন একটা লোকাল সড়ক।’

মোহনা বেগমের নজর সবসময় ওপরের দিকে। পঁচিশ বছর পরিবার-পরিকল্পনা অফিসে চাকরি করার পর, ইঁদুরের গর্ত খোঁড়ার মতো তিল তিল সঞ্চয় করে সে একখানা বাড়ি তৈরি করেছে। তা কবরের মতো। একবার ঢুকলে পর বেরুনোর রাস্তা নেই। উত্তরে পুকুর। দক্ষিণে পাঁচিল। পশ্চিম আর পুবে দুই শত্রুভাবাপন্ন পড়শি। তারা জমিনের ওপর কাটা পুঁতে অদূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখে আরব দেশের বেদুঈনদের মতো। কাঁটার আঘাতে জর্জরিত মহাপুরুষ নবী করিম (সঃ) পথ চলতে চলতে হাসতেন। কিন্তু মোহনা বেগমের হাসি পায় না। সে মনের ক্ষোভ গোপন করে যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে তাদের কাছে একটা পাকা সড়ক দাবি করে। যার নাম হবে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোসাম্মত্ মোহনা সড়ক। ফলকের গায়ে বীরাঙ্গনা লেখা চলবে না।

মোহনা বেগমের কোনো সন্তান-সন্ততি নেই। দু-দুটি বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু স্বামীরা বিয়ের রাতেই পাকবাহিনীর নির্যাতনের কাহিনী শুনে পালিয়ে যায়। বাচ্চা-কাচ্চা পয়দা করার সময়টাও হাতে পায় না মোহনা বেগম। এখন জীবন দরিয়ার ঠিক মাঝখানে তার বয়স। গভীরভাবে নিরিখ করলে চোখের ওপর কুয়াশাময় অপর কূল ভেসে ওঠে। এ অবস্থায় ঢাকা শহরের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান থেকে টাকা আনতে গেলে কাগজে ছবি উঠবে। তার বীরত্বের কথা না ছাপিয়ে কাগজগুলি কাটতি বাড়ানোর জন্য সত্য-মিথ্যায় রচনা করবে পাকবাহিনীর হাতে এক অজানা বীরাঙ্গনার নির্যাতনের বীভত্স কাহিনী। তাতে করে বহু বছরের পুরোনো কথা পুকুরের পানিতে মরা মাছের মতো ভেসে উঠবে। সমস্ত পাড়ায় থেকে থেকে দুর্গন্ধ ছড়াবে। অথচ এসবের বিনিময়ে যে টাকাটা সে হাতে পাবে, তা দিয়ে বালু ফেলে রাস্তা ভরাট করাও সম্ভব হবে না। ইট-সুড়কি-আলকাতরা ঢালাই তো পরের কথা। সাত-পাঁচ ভেবে মুক্তিযোদ্ধা মোহনা বেগম এখন আর বীরাঙ্গনার সংবর্ধনা চায় না।

দ্বিতীয়জন রাজিয়া বেগম। মুখচোরা স্বভাবের। লম্বা ঘোমটা টেনে সর্বক্ষণ মুখ ঢেকে রাখে। এমন মাইয়্যামানুষ যে কি করে যুদ্ধ করতে গেল, সে এক বিস্ময়। ধরা পড়ার পর দীর্ঘ ৫ মাসই-বা পাকসেনার নির্যাতন সহ্য করলো কীভাবে। নাতির বয়সী বাচ্চারা এখন ছড়া কাটে রাজিয়া বেগমকে নিয়ে, ‘ঘোমটার নিচে খেমটা নাচে/ পাকসেনারা ধইর্যে নেছে।’ সে ঢাকা গেলে বীরাঙ্গনারা মাথায় বাড়তো। মঞ্চের শ্রীবৃদ্ধি হতো না।

কয়েক দিন আগের কথা। সংবর্ধনার খবর পেয়ে রাজিয়া বেগমের পঙ্গুস্বামী বদর আলী হ্যাঁ-না কিছু বলে না। আগাগোড়া গালে হাত দিয়ে বসে থাকে। সুজন সিকদার দাওয়ায় বসে হুলোর মতো রাগে গড়গড় করে। হাতের কাগজপত্র ঘন ঘন মাটিতে আছড়ায়। ল্যাংড়াটা মানুষ না অমানুষ-গা পিটোলে মন খানেক ধুলো উড়বে, দার্শনিকের পোজ দিয়েছে। সে বাড়ির সীমানা ছাড়তে না ছাড়তে বসাবস্থা থেকে বেড়ার গায়ের ঝুলন্ত লাঠিটা টুক করে পেড়ে নেয় বদর আলী। রাজিয়া বেগম ঘোমটার ফাঁক দিয়ে দেখে, তার পঙ্গুস্বামী নৌকার বৈঠার মতো মাটির সড়কের ওপর দিয়ে লাঠি বেয়ে বেয়ে গাঁয়ের মুরুব্বিদের বাড়ির দিকে যাচ্ছে।

এ দৃশ্যটি রাজিয়া বেগমের জন্য অশেষ পীড়াদায়ক। মুক্তিযুদ্ধ করে, পাকবাহিনীর নির্যাতন সয়ে সারাজীবনের জন্য সে একজন পঙ্গু স্বামী পেলো। আজ এতো বছর বাদে ঢাকার লোকেরা সংবর্ধনা দিয়ে তার জীবনটা বদলাতে পারবে? তারা সেদিন কোথায় ছিল, যেদিন রাজিয়া বেগম গাঁয়ের ময়লা খোলায় ঠাঁয় দাঁড়ানো! কোলে পাকবাহিনীর ছয়দিনের জারজ ছেলে। গাঁয়ের জ্ঞাতিগোষ্টি সব একদিকে, পঙ্গু বদর আলী আরেক দিকে। সে হাতের লাঠি ডানা বানিয়ে ফেরেশতার মতো অকুস্থলে উড়ে এলো, ‘তোমরা এই অভাগীরে তাড়াইয়্যো না। খোদার কিরে, আমি ওরে শাদি করবো, কথা দেচ্ছি।’

ময়লাখোলার কিনার ঘেঁষে ছনের ছাপড়া উঠলো, বর্ষার ভিজে মাটির মেঝেতে খড়ের বিছানা পড়লো। একঘরে হয়ে পঙ্গু মানুষটা চটের ব্যাগ লাঠির আগায় গেঁথে চললো ভিনগাঁয়ে ভিক্ষা করতে। আজও বদর আলীর পেশা ভিক্ষাবৃত্তি। আর মুক্তিযোদ্ধা-বীরাঙ্গনা রাজিয়া বেগম হচ্ছে ভিক্ষুকের ঘরণী। রামকৃষ্ণপুরের লোকেরা দশ বছর হয় তাদের ওপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ তুলে নিয়েছে। সামাজিকভাবে একঘরে তো ভিক্ষুক, বেশ্যা, চোর-গাঁয়ের এ গোত্রের সবাই। এ নিয়ে আর কথা কি। এখন বদর আলীর কাছে হাতখোলা দরাজদিলের মানুষমাত্রই সজ্জন। সে রাজাকার, আলবদর কি মুক্তিযোদ্ধা যাই হোক। সেটিও বছরে দুইবার ধানতোলার মৌসুমে কে কতোটা খাঞ্চাভরে যাকাতের ধান দিতে পারলো, তার ওপর নির্ভর করে। ছয়মাস অন্তর অন্তর বদর আলীর সজ্জনদের তাই বদল হয়। রাস্তায় বৈঠা বাইতে বাইতে সে মনস্থ করে দুই মৌসুমের উভয় প্রকার সজ্জনের কাছেই এখন তার যাওয়া উচিত। কারণ সমস্যাটা ঘোরতর। ফের একঘরে করলে বুড়ো বডি নিয়ে দূরের গাঁয়ে সে ভিক্ষা মাঙ্গতে যেতে পারবে না। ছয় মাস হলো পাঞ্জাবির বাচ্চাটা গাঁ-ছাড়া, শহরে ঘর ভাড়া করে বউ-বাচ্চা নিয়ে থাকছে। এ অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর ছোট মেয়েটাকে নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে। সব শোনার পর সজ্জনেরা যে যা বলে, তা থেকে যাচাই-বাছাই করে বদর আলী একটা সিদ্ধান্ত নেবে।

এক মুরুব্বি সব শুনে বললেন, ‘বউ ঢাকা গেলি পর তোর সংসারের উন্নতি হবে।’ আরেকজনের লম্বাচওড়া উপদেশ, ‘এইরে বউ বেচে খাবি? খোদাতালার কাছে জবাব দিবি কী শেষ বিচারের দিন? ভিক্ষে করে খাচ্ছিস, এই করে খেয়ে যা। আমরা তো আছিই।’ অনেক ভেবেচিন্তে পরের জন একটা ফাঁকা কথা বললেন, ‘আমি তোর বউকে যাতিও বলবো না, না-যাতিও বলবো না।’ তারপর দুটি চকচকে আধুলি দিয়ে তিনি তাকে বিদায় করে দিলেন। কৃতজ্ঞতাবশতই হয়তো তৃতীয় মুরুব্বির কথাটা বদর আলীর পছন্দ হয়। সে লাঠিতে ভর দিয়ে নাচতে নাচতে নতুন আধুলি জোড়া ভেঙে বিড়ি কিনতে ঢোকে বাজারের শক্কুর আলীর দোকানে। সেখানে তার দেখা মাতাল কেরামতের সাথে। লোকটা পাকিস্তান আমলের বিএ। মুক্তিযুদ্ধও করেছিল। এখন দিনচুক্তি আড্ডা দেয় শুক্কুর আলীর চায়ের দোকানে আর রাত নামলে পর মেথরপট্টির চোলাই আকণ্ঠ গিলে তাদের পোষা শুয়োরদের জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে। এমন যে বদর আলী, যে পেশায় ভিক্ষুক, তার কাছ থেকে টাকা নিয়েও কেরামত মিয়া মদ খায়।

বদর আলী চায়ের দোকানে ঢুকতেই কেরামত তার লাঠি ধরে টানাটানি শুরু করে, ‘কি দোস্ত, সব খবর ভালো তো? আজ কত পেলি, শুক্কুরের গা ছুঁয়ে বল দেখিনে।’ কেরামত মিয়া আজ দিনদুপুরেই মাতাল হয়েছে। গায়েগতরে মদের ভুরভুর গন্ধ। চোখ দুটোয় যেন আঁঠা লাগানো। বদর আলীর তাড়াহুড়োর কারণ জানতে পেরে, নিজে থেকেই লোকটা ঠেকে ঠেকে এমন জ্ঞানগর্ভ কথা বলে যে, যার মাথামুণ্ডু কিছুই সে বুঝতে পারে না। ‘আজ ৩০-৩২ বছর পরে কার মূল্যায়ন হবে? কোন মুক্তিযোদ্ধার সংবর্ধনা দেবে তারা? সেদিন এদিন অনেক পার্থক্য। তখন যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ, মুমূর্ষূ বাঙালি জাতি-দশ টাকার বিনিময়, এক বস্তা সিমেন্টের বিনিময় মানুষ মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট পেয়েছে।’

বদর আলী দোকানের ঝুলন্ত দড়ির আগায় বিড়ি ধরিয়ে তৃতীয় মুরুব্বির কথাটা ভুলে যাওয়ার আগেই বাড়ির দিকে ছোটে। পেছনে কেরামত মিয়া চোখ বুজে তখনো বলে যাচ্ছে, ‘তা বলে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। আমার কোনো আনন্দ নেই, কোনো দুঃখ নেই। আমি কোনো সুখও পাই না, কোনো শান্তিও পাই না। কোনো তৃপ্তি নাই আমার। দেশ স্বাধীন হয়েছে তাদের জন্য, যারা এদেশের বিপক্ষে ছিল।’

বাড়ি ফিরে বদর আলী দেখে ঘরের দাওয়ায় নতুন একজন মানুষ। সে তার কোন মৌসুমের সজ্জন ঠিক ঠাহর হয় না। উপরন্তু তার মন বলে, সে লোকটাকে জীবনে কোনোদিন দেখে নি। ভিনগাঁয়ের কেউ হয়তো। কত জনের কাছ থেকে জীবনে সে ভিক্ষা নিয়েছে, সবার চেহারা-সুরত কি তার মনে আছে? সে ঘরের পেছন দিয়ে ঢুকে বউকে চুপিচুপি বলে, ‘আমি তোরে যাতিও বলবো না, না যাতিও বলবো না।’ রাজিয়া বেগম তো তাজ্জব। এতোগুলি টাকা! ল্যাংড়ার ভিমরতি হলো নাকি? আবার দেখি টাকাকড়ি ভেঙ্গে বিড়ি ফুঁকছে! সে বদর আলীর ওপর রেগে ফেটে পড়ে। ভিনগাঁয়ের লোকটি স্বামী-স্ত্রীর বচসার পুরোটা মনোযোগ সহকারে শোনে। হাসে মিটিমিটি। তারপর ধীরে ধীরে কায়দা করে শেষ বাক্য উচ্চারণ করে সে, ‘বদর আলী আমি তোর বিবিকে কচ্ছি, ওই টাকা তোরা যদি নিস, জীবনে লোন শোধ করে শেষ করতে পারবিনা নে। তুই মরে গেলি পর তোর ছেলের তারপর তার ছেলের এই লোন শোধ করি যেতি হবে। এনজিও থেকে এ টাকা দেওয়া হচ্ছে-নিসনে, মারা পড়বি।’

বাকি থাকে আমিরজান বিবি। একজন অশিক্ষিত মানুষ। তার ওপর মাথার ঠিক নেই। মঞ্চে দাঁড়িয়ে কি বলতে কি বলে দেবে। হয়তো মাইকের সামনে থেকে এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছে ভিক্ষা চেয়ে বসলো। ‘বাবা আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, বাবা আমি একজন বীরাঙ্গনা। আমায় চারটি পয়সা দেন। পিঠে কিনি খাতাম।’ বেজপাড়া গোরস্থানের সামনে দিয়ে পাঁচ বছর আগে ডিসেম্বর মাসের এক পড়ন্ত বেলায় সুজন সিকদার সাইকেলে চড়ে যাচ্ছিল। শাঁ-শাঁ উত্তরে হাওয়ায় সে কথাগুলো চলন্ত অবস্থায় শোনে। কানের ভুল না তো। কেননা কানে-মাথায় তার মাফলার জড়ানো। প্যাডেল ছেড়ে মাটিতে নেমে সাইকেল টেনে টেনে সে অ্যালুমিনিয়ামের তোবড়ানো একটা থালার সামনে দাঁড়ায়। ‘বাবা আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, বাবা আমি একজন বীরাঙ্গনা।’ বিজয়ের মাস। আল্লা যখন দেয় ছপ্পড় ফুঁড়ে দেয়।

এর সাক্ষাত্কার কাগজে ছাপা হলে দিকবিদিক সাড়া পড়ে যাবে। সাংবাদিক সুজন সিকদার অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে পকেটের সিকি-আধুলি সব ছেড়ে দিয়ে সেখানে দাঁড়িয়েই কাগজ-কলম বের করে। পাশেই গুড়-নারকেলের পুর দেয়া গরম গরম ভাপা পিঠা চুলার ওপরের হাড়ি থেকে বাঁশের ঝাঁকায় টপটপ করে পড়ছে। হাতে পয়সা পেয়ে আমিরজানের মনোযোগ চলে যায় সেদিকে। সুমন সিকদার আবার পকেটে হাত দেয়। ভাপা পিঠা অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে ফেলে ফের কথা বলার চেষ্টা করে। এবার রাস্তার উচ্ছৃঙ্খল জনতা সাগরের ঢেউয়ের মতো হুড়মুড় করে ছুটে আসে। এ অবস্থায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করা বৃথা। সে আমিরজানকে সাইকেলসহ হাটিয়ে নিয়ে চলে পত্রিকা অফিসের দিকে। জনতা কিছু দূর এসে ব্যর্থ হয়ে পায়ে পায়ে ফিরে যায়। কিন্তু মফস্বলের কাগজ। যতটা সাড়া পড়ার কথা ততটা পড়ে না। জাতীয় দৈনিকেরও এক কোনায় হূদয় বিদারক বাক্যগুলি মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। তা বলে সুমন সিকদার হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। সে আমিরজান বিবির সঙ্গী আরো তিন জনের নাম সেই সূত্রে উদ্ধার করে। তারা চার জনই মুক্তিযোদ্ধা, একই সাথে বীরাঙ্গনা। একেবারে সোনায় সোহাগা। কাগজে লেখালেখি ও জনে জনে দেনদরবার সমান তালে চলে। একজন তার ভেতর অনাহারে, বীনাচিকিত্সায় মারা যায়। জাতির তাতে টনক নড়ে না সত্য, আন্তর্জাতিক মিডিয়া নড়েচড়ে বসে। ডেনমার্কের একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ভিডিওতে তাদের সাক্ষাত্কার রেকর্ড করে, ছবি তুলে নিয়ে যায়। আমিরজান একাই পায় একমোটে এক হাজার টাকা। একা মানুষ। এক পেট। রাতারাতি সে রাস্তার ভিক্ষুক থেকে মুদি দোকানদার।

‘ভাই আমি সন্মান নিয়ে মরতি চাই। বীরাঙ্গনার খেতাব আমি চাচ্ছিনে ভাইডি।’ বলে কি, দুদিন আগেও যে ভিক্ষা করে ভাপা পিঠা খেতো, তার মুখে এ কেমন কথা! মানুষের এই এক স্বভাব, খাতি দিলে শুতি চায়। এদিকে সুজন সিকদারের জুতোর তলা ক্ষয়ে গেল তাদের জন্য বাড়ি আর ঢাকা করতে করতে! আজ এজন তো কাল আরেকজন। কাগজপত্র আর চিঠির অনুলিপি এর কাছ থেকে ওর হাতে জমা পড়ে। সরকার বদলের সাথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লোকেরও বদল হয়। আজকে যখন একটা কিনারা করা গেছে, তখন আমিরজান বিবির এ কী রকম অবুঝের মতো আব্দার। সুজন সিকদার কাচের জানালা ঠেলে বাইরে একদলা থুথু ছুঁড়ে দিয়ে সাফ সাফ জানিয়ে দেয়, এসব বিষয় তার না ভাবলেও চলবে। মঞ্চে উঠে কি বলতে হবে না-হবে, তা ভাষা দিয়ে রেডি করার দায়িত্ব সোহরাবের। কাল সময় পাওয়া যাবে না। কাজটা ফাইনাল করতে হবে আজ রাতে গাড়িতে বসেই। সুজন সিকদার চোখের পাতা দুটি এক করার সাথে সাথে আমিরজান বিবির পরদিনের অনুষ্ঠানের রিহার্সেল শুরু হয়। সোহরাব বলে, ‘আমার কথাটা আগে মনোযোগ দে শোনেন। আমি যা বলি, টিয়ে পাখির মতো তা বলি যেতি হবে। এক দুই তিন। এভাবে দশ বার, কেমন?’

‘আমি মোসাম্মত্ আমিরজান বিবি। মহান মুক্তিযুদ্ধে ভাইদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরা চার জন নারী যুদ্ধ করেছি। শ্রাবণ মাসের ১২ তারিখ সন্মুখ সমরে আমরা একই সাথে বন্দি হইলাম।’

আহারে কেমন অন্ধকার রাত। আসমানে চাঁন-তারা কিছু নেই। নদীর ঘাটে চোখ বাঁধা চার নারী। গা বেয়ে রক্ত ঝরছে। তাদের আগে-পিছে প্রহরী। সাথে জল্লাদ। নদীর অপর পাড়ে বিন্দুর মতো একজন মানুষ, হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তাকে দেখা যায় না। ফেরেশতার মতো তার দূরাগত কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর এপাড় থেকে শোনা যায়-

: এই এদের মেরে ফেলবি? আহারে ছোট বাচ্চা এরা। কি এরা বোঝে। অশিক্ষিত মূর্খ।

: না-না, এরা সবই বোঝে, সবই জানে, আমরা দেখেছি।

: না, এদের মারতি হবে না। যেখানে দেয়া দরকার, সেখানে এদের দিয়ে দে। মারিস না। এটা রাজনীতির কেস, রাজবন্দির কেস। এদের মারা অপরাধ।

সোহরাব বলে, ‘বাইরের অন্ধকারে তাকায়ে থাকলি পর আমি যা শেখাচ্ছি, সব ভুলে যাবেন। এখন আরেক বার বলেন দেখিনি, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে, তারপর?’

‘তারপর?’ আমিরজান বিবি টিয়া পাখির ভঙ্গিতে বলে, ‘আমরা যুদ্ধ করিলাম শেখ মুজিবের নেতৃত্বে।’

‘না-না, কার নেতৃত্বে, সেটি ইবার বাদ দে বলেন।’

‘কেনে? আমরা তো তা করিলাম। মিথ্যে নয় ভাইডি, সেসময় তুমি মায়ের পেটের থে পড়িছো কি পড়োনি, আমাগের বাপ-চাচারা তখন সব আমুলীগ করতো।’

এই মহিলাকে কি করে সোহরাব বোঝাবে যে, সেসময় আর এসময় এক না। লেখাপড়া জানা থাকলে সে আপনিই রাজনীতির প্যাঁচ ধরতে পারতো। একে তো নিরক্ষর তার ওপর ডান-বামের হিসেব নেই। সে কি করে মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়েছিল সুজন ভাইয়ের মুখ থেকে সোহরাব তা শুনেছে বটে, তবু তার বিশ্বাস হতে চায় না। সুজন সিকদার এখন ঘুমের ঘোরে ঘোঁ-ঘোঁ করে নাক ডাকাচ্ছে। এই সুযোগে সোহরাব রির্হাসেল বাদ দিয়ে আমিরজান বিবির কাছ থেকে পুরোনো গল্পটা শুনে ফের যাচাই করে নিতে চায়।

চৈত্রমাসের এক খাঁ খাঁ দুপুরে বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন সিপাহি আর দুইজন ইপিআর ভুল পথে অ্যাডভান্স করে রামকৃষ্ণপুর গ্রামে হাজির হয়। এসে গাঁয়ের জোয়ানদের বলে, ‘কিডা কিডা দেশের লাগি জান দিতে রাজি আছো তারা উঠোনের বামে অ্যাটেনশান হয়ে খাঁড়াও।’ আমিরজান, মোহনা, বীনা সাহা আগে থেকেই উঠোনের বাঁ পাশে দাঁড়ানো। তাদের পাঠানো হয়েছিল চিড়ে-গুড় দিয়ে মেহমানদের আপ্যায়ন করতে। কিন্তু কিছু বোঝার আগেই দেখা গেলো, দেশের লাগি জান দেওয়ার দলে তারা পড়ে গেছে। তখন সিপাহি তোরাব আলী ছাড়া বাকি দুজনের মেয়েদের দলে নেয়ার ব্যাপারে বেজায় আপত্তি। তারা বললো, ‘ওস্তাদ খাজনার চে বাজনা বেশি হবে। ফেঁসে যাবেন।’ তবে তোরাব আলীর জেদের কাছে কথাটা বেশিক্ষণ টিকলো না। তাদের বাবা-মাকেও বোঝানো হলো, যুদ্ধের দিনে ঘরে এমনিও মেয়ে রাখতে পারবে না, অমনিও পারবে না। মিলিটারি ধরে নিয়ে গিয়ে বেইজ্জত করবে। তারচে এরা হাতে অস্ত্র ধরুক, দেশ স্বাধীন হবে, ইজ্জত বাঁচবে। তারপর সদলবলে আলীনগর থানার অস্ত্র-শস্ত্র তারা লুট করলো। ভাইদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মেয়ে তিনজন রাইফেল ট্রেনিং নিলো। গেরিলা যুদ্ধ শুরু হলো। শাবল-কুড়োল দিয়ে ব্রিজ ভাঙ্গায় শরিক হলো। কিন্তু তারা তো তিনজন, বেজোড়। কথাটা মোহনা বেগমের মাথায় প্রথম আসে। সাথে সাথে রাজিয়া বেগমের কথা তাদের তিনজনেরই মনে পড়ে যায়। তার জন্য তাদের দুঃখ হয়। ভাবে যে, তাদের চারজনের আজ থেকে পনের বছর আগে এই গাঁয়ে একই বছরে জন্ম হয়েছিল। এখন তিনজন যদি দেশের জন্য জান দিতে পারে, বাকি একজন পারবে না কেন। সে কি দোষ করলো। এই যুক্তি নিয়ে একমাত্র লেখাপড়া জানা মোহনা বেগম তোরাব আলীর কাছে যায়, ‘স্যার আমাগের আরেকটা বান্ধবী আছে। নাম মোসাম্মত্ রাজিয়া বেগম। স্যার ও যদি মুক্তিফৌজে শরিক হতি পারে, আমরা তবে বিজোড় থাকি না।’

তোরাব আলী হেসে বললেন, ‘বিজোড় থাকবা ক্যান। আসতে চালি তারে নে আসো।’

এই হলো আমিরজান বিবির ভিক্ষুক হওয়ার, রাজিয়া বেগমের পঙ্গু ভিক্ষুক স্বামী পাওয়ার, বীনা সাহার বিনাচিকিত্সা অনাহারে মারা যাওয়ার, মোহনা বেগমের পায়ে নিরন্তর কাঁটা ফোটার গোড়ার কাহিনী। তারপর তারা ভুলে কখনও উঠোনের বাঁ পাশে দাঁড়াতো না। কিন্তু যা হওয়ার তা ততোদিনে হয়েই গেছে। ‘কপালের লিখন, না-যায় খণ্ডন,’ আমিরজান এই বলে তার বক্তব্য শেষ করলো।

তাদের মাইক্রোবাস তখন ঝমঝম করে কুমার খালির নতুন ব্রিজ পার হচ্ছে। সোহরাব আনমনা। এ কোন দেশ, কোন সময়ের কাহিনী-স্বপ্নের মতো লাগে। বার বার শোনার পরও বিশ্বাস হতে চায় না। স্বাধীনের তিন বছর পর তার জন্ম হওয়ায় সে এসবের কিছুই দেখলো না, বুঝলো না। এদিকে আমিরজান হঠাত্ বলে ওঠে, ‘দৈত্যের মতো বিরিজখানা। শাবল-কুড়োল দিয়ে তা ভাঙা যাবেনা নে। ডিনামাইট দে উড়াতে হবে।’

বলে কি? এ দেখি ব্রিজ ভাঙতে চায়। নাশকতামূলক কাজ। বাংলাদেশ দণ্ডবিধি অনুসারে এর সর্বোচ্চ শাস্তি জরিমানাসহ পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। সোহরাব নড়েচড়ে বসে, ‘আমি যা বলি, তার বাইরে কিছু বইল্যেন না। অযথা সময় নষ্ট হয়।’ কিন্তু আমিরজান বিবিকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান’ শেখাতেই তার রাতের দুই প্রহর শেষ। মাইক্রোবাসটা ফেরি পার হয়ে আরিচা রোডে পড়ে। পথ শেষ হয়ে এলো প্রায়। কিন্তু তার আর আমিরজানের বক্তব্য তো তেল আর জলের মতো, কিছুতেই মিশ খাচ্ছে না। সুজন ভাই বিশ্বাস করে একটা কাজ দিলেন, কাল যে কি অঘটন ঘটবে কে জানে।

পরদিন সোহরাব আর সুজন সিকদারের ধুকপুক করা বুকের ওপর দিয়ে আমিরজান বিবি মঞ্চের দিকে হেটে যায়। ‘আমাদের এবারের বক্তা বীরাঙ্গনা-মুক্তিযোদ্ধা মোসাম্মত্ আমিরজান বিবি’, যে এখন মাইকের সামনে রাজহাঁসের মতো গলা বাড়িয়ে দিয়েছে।

পিরিয় ভায়েরা ও বোনেরা। তখন ছিল বর্ষার সময়। সেইবার বন্যা হইয়্যেছিল খুব। বিরাট বন্যা হইয়্যেছিল আমাদের ওইখানে। যখন শুইনলাম গ্রামঘাটে পাকসেনারা ঢুইকবে, মেয়েদের অত্যাচার কইরবে, মেয়েদের ওপর নির্যাতন চালাবে, এই একটা ষড়যন্ত্রের কথা শুনি আমরা দলভুক্ত হইয়্যে ট্রেনিং নিয়েছিলাম। দেশ জয় করার জন্য বা দেশের শান্তির লাগি আমরা এই কাজে লিপ্ত হলাম।

আমিরজান বিবি ঘাড় বেঁকিয়ে ডাইনে-বাঁয়ে তাকায় দিশেহারা-দলছুট এক হাঁসের মতো। মনের কথা বিস্তর। তবে ভাষা নেই। সোহবার ভাষা দিয়ে যেসব কথা বলে দিয়েছিলো, অঠাঁই জলে ডুব দিয়ে শামুক-গুগলির মতো তন্নতন্ন করে সেসব খোঁজে। পায় না। আবার ডুব দেয়। ভাসে। এদিকে দর্শক-শ্রোতাদের নাকেমুখে পানি ঢুকে পড়েছে। একজন কাশলো তো সদলবলে কাশির ধুম। আমিরজান বিবি মুচকি হেসে বলে-

আমরা নদীতে ঝাঁপাতে পারি। মেলা পানিতে ডুব মেরে সরে যেতিও পারি। আমরা কতদিন পানির ভেতর কাটাই দিছি। আমাদের রাইতও কেটে গেছে পানির ভিতর। এ কষ্টের বিনিময়, এ রক্তের বিনিময় আমাদের দেশখানি স্বাধীন হইয়্যেছে।

আমরা বিরিজ ভাঙ্গিছি তিনখানা-আমলকির পৈল, বড় পৈল, নিমতলির পৈল-

‘সুজন ভাই, এ দেখি খালি নিজের কথা কচ্ছে। রাজনীতি নে বইলবে কখন?’ সুজন সিকদারের কানের কাছে মুখ নিয়ে সোহরাব ফিসফিস করে বলে। তারা বসে আছে একেবারে সামনের সারির দর্শক আসনে। সেখানে কানাকানি অশোভন। পেছনের সারিতেও পিনপতন নিঃশব্দতা। সচরাচর যা হয় না। কারণ সেই আসনগুলি ভরানো হয় এনজিও-র তৃণমূল পর্যায়ের সদস্যদের দিয়ে। আর রাজনীতিক নেতারা আনেন ভাড়া করা শ্রমজীবিদের। উভয়ের উদ্দেশ্য অভিন্ন, খালি চেয়ার ভরাট করা। বিশেষত পেছনের। সুজন সিকদারের মনে হয়, আমিরজান বিবির বক্তৃতা সামনের চেয়ে পেছনের সারির শ্রোতারাই বুঝতে পারছে ভালো। ভাষাটা সহজ। বর্ণনাটা প্রাঞ্জল। গ্রামীণ। সে মাছি তাড়ানোর মতো হালকাভাবে হাত নেড়ে সোহরাবকে নিরস্ত করে নিজে ফের বক্তৃতা শোনায় মনোযোগ দেয়।

আমরা ধরা পড়িলাম যখন, তখন তারা আমাদের পিছমোড়া করি বেঁধে ক্যান্টনমেন নে গিইলো। আর সেদিন থেকে মানুষের ঢাক্কা, মানুষের কথা, মানুষের নান্নত্ খাতি খাতি এ পর্যন্ত দেহ আমাগের বিসর্জন হয়্যা গেছে। এই দেহের আর কোনো মূল্য নাই। এখন কুকুর যে কুকুর, সেও ফিরে তাকাতি চায় না। মানুষ তো দূরের কথা। কলঙ্কিনীর জীবন আমাদের, সমাজের সবাই বলে এই কথা। এই কথা ঢাকার বা মোহর করার কোনো দরদী মানুষ কি আমাদের নাই এই পৃথিবীতে? আপনারা বলেন আছে? (হাত্তালি) থাকলি তো বলতো, কেন তাদের ঘিন্না করো, এরা তো মানুষ। এরা তো ঘিন্নার পাত্র না।

সেই থেকে আইজ পর্যন্ত এখনো যুদ্ধ করে যাচ্ছি।

‘কি শিখালাম আর এ-এ-এ কি বইললো সুজন ভাই?’ সোহরাবের কথা শুনে সুজন সিকদার মুখ টিপে হাসে। বেচারা এখনো ছেলেমানুষ। বেজপাড়া গোরস্থানের সামনে থেকে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি পাঠাগার মিলনায়তন পর্যন্ত উজান ঠেলে ওপরে ওঠা, এই দুর্গম পথের নৌকা যদি হয় আমিরজান তবে মাঝি হচ্ছে স্বয়ং সুজন সিকদার। তার পরিশ্রম আজ অনেকখানিই সার্থক। মন থেকে বিরক্তি আর উত্কণ্ঠা তাই বাষেঙ্র মতো উবে যায়। আমিরজান যে কিছু একটা বলে বক্তৃতা শেষ করতে পেরেছে, তাতেই সে খুশি। সুজন সিকদারের আওয়ামী লীগ, বিএনপি নিয়ে মাথাব্যথা নেই। তার এতোদিনের চিন্তা শুধু, কি করে আমিরজান বিবি আর রাজিয়া বেগমেরা হাতে কটা টাকা পাবে। দেশের জন্য কতো বড় আত্মত্যাগ। অথচ কি কষ্টের জীবন তাদের। চোখে দেখা যায় না। মানুষের কুমন্ত্রণা শুনে রাজিয়া বেগমের তো শেষপর্যন্ত ঢাকা আসাই হলো না। বীনা সাহা মরে বেঁচেছে। মোহনা বেগম টাকা চায় না। নাম চায়। বীর মুক্তিযোদ্ধা মোসাম্মত্ মোহনা সড়ক। বীনা সাহার মৃত্যুর পর হালে মোহনা বেগমের আবার একটা নতুন রোগ হয়েছে। সারাদিন ঘুরে ঘুরে সে কবরের জায়গা খুঁজে বেড়ায়। ‘কাল মুগ্ধাপাড়ায় নতুন একখানা গোরস্থান দেখিলাম সুজন ভাই। অতি উত্তম সেই জায়গা। দক্ষিণে বিল, বারো মাস পানি থাকে, হুহু করে বাতাস বয়, পাখ-পাখালি ডাক ছাড়ে। আর উত্তর পাশে পাকা দ্বিতল মসজিদ। সেখেনে মুসল্লিরা রাতদিন আল্লাবিল্লা করি যাচ্ছে। এমন জায়গায় আমার একখানা কবর চাই। দেশ-জাতির কাছে আমি আর কিছু চাই না ভাইডি।’

কেউ খালি মরার কথা ভাবলে তাকে বাঁচানো মুশকিল। অথচ এখন আমিরজান বিবিকে ঘিরে ঘন ঘন অমরত্বের ফ্ল্যাশ জ্বলছে। গলা বোঝাই ফুলের মালা। সামনের টেবিলে ডাঁই করা উপটৌকন। একজন জীবনে যা পেলো, কি আপশোষ বাকি তিনজন তা পেলো না। কিন্তু কূলে ভিড়ে শেষপর্যন্ত না তরী ডোবে। আমিরজান বিবি ফ্ল্যাশের ঝলকানি চোখ বুজে ঠেকিয়েছে, হাত-পা না ভেঙ্গে মঞ্চ থেকে অবতরণও করেছে, এখন ঝাঁকে ঝাঁকে সাংবাদিকের প্রশ্নের দৌরাত্ব সামলাতে পারলে হয়। পত্রিকার লোক সুজন সিকদার নিজেও। কিন্তু কে কোন ধান্ধায় এসেছে, পাবলিক অনুষ্ঠান, কে জানে। সুজন সিকদার অস্থির হয়ে ওঠে। কিন্তু সরেজমিনে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে অভ্যাসবশত সে নিজেও নোটবুক হাতে একসময় ভিড়ের ভেতর হারিয়ে যায়।

সাংবাদিকের নোটবই

নাম: মোসাম্মত্ আমিরজান বিবি

পিতার নাম: জব্বর আখন্দ

গ্রাম: রামকৃষ্ণপুর

থানা: আলীনগর

: আপনি তো মুক্তিযুদ্ধ করেছেন?

: হে কইরেছি। জাতির পিতার নেতৃত্বে আমরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।

: কার নেতৃত্বে?

: দাঁড়ান কচ্ছি। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে আমরা যুদ্ধ করিলাম।

: আপনি যে যুদ্ধ করেছেন এর প্রমাণ কি? বন্দুক চালাতে পারেন?

: হে পারি। আমরা সিনা টান টান করি থ্রি নট থ্রি রাইফেল ধরিতাম। চেম্বারে গুলি ঢুকাইয়্যে তোরাব আলী যখন ফায়ার করতে বইলবেন, তখন হাতের বাজুতে ঠেকিয়ে নিরিখ করে গুলি মাইরতে হবে। বাম হাত থাইকবে রাইফেলের মধ্যিখানে আর ডান হাত থাইকবে চাবির গোড়ায়।

: তোরাব আলী কে?

: সেপাই তোরাব আলী। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা তোরাব আলী। আরেকজন ছিল মোশাররফ হোসেন। সে এখন খুব রোগা হইয়্যে গেছে। পেট্রলপামেঙ্ পানি বিক্রি করে।

: এবার বলেন দেখি পাকবাহিনী ধরে নিয়ে আপনাদের কোথায় রাখলো, কি করলো?

: খড়ের বাগানে আলাদা আলাদা ঘর আছে না ক্যান্টনমেনের ভিতর? যে সমস্ত জাগায় মানুষ যায় না, সেসমস্ত জাগায় আমাদের রাখিছে লুকোয়ে লুকোয়ে। খাওয়া না, ঘুম না, নাওয়া না-এই কায়দায় ছিলাম। মশার কামড়ে শরীরে দাগ হইয়্যে গেছে। এখন একটা রোগ হইয়্যেছে এলার্জি। চুলকোয়, ঠুলানি ওঠে। এলোপত্তি ওষুধে ইটি চেতে। হোমোপত্তি খালি চেতে না। এক পুরিয়া চার আনা। এখন দাম বেড়ে হইয়্যেছে পাঁচ টাকা ।

: শুধু মশায় কামড়েছে আর্মি কিছু করেনি?

: পাঁচমাস তো ওইখানে বন্দি ছিলাম। কোনোদিন খাতাম, কোনোদিন খাতি পাতাম না। তখন তো জান নিয়ে টানাটানি। কে মেরে ফেইলবে, কে বাঁইচবে-একটা দুশ্চিন্তার ভেতর আমরা বসবাস করতাম।

: আর্মি কিছু করেনি?

: আমার কোনো মানুষের সঙ্গে দেখা না। কারো সঙ্গে মিশা না। আমি আটকা। এমন অন্ধকার জীবনে কারো মুখ কেউ দেখতি পাবো তার কোনো আশা নেই। যেদিন যা পাতাম, আমি তা খাতাম।

: খালি খাওয়ার গল্প করছেন। আর্মি আপনার ইজ্জত লুট করে নি?

: পুরুষছেলে কি করে, এটি আপনারা ভালই জানেন, বোঝেন। কোনোদিন তিন দিনও চইল্যে যেতো খাতি পাতাম না। কেননা ওরা চইল্যে যেতো একেক দিকে। দিনের বেলা ওদের খুব কম পাওয়া যেতো। মচমচ কইর্যে রাইক্ষসের মতো ফিরে আইসতো ও-ই রাতে।

: তারা দেখতে কেমন ছিল?

: আপনাগের মতো, মোটা-কাটা, সোন্দর।

: তাই নাকি! আজকের এই দুর্বস্থার জন্য আপনি কাকে দায়ী করেন?

: দোষ কারো না, সব আমার ভাইগ্য।

: তার মানে আপনি মনে করেন পাকিস্তান আর্মি দোষী না, নির্দোষ?

: তাদের নির্দোষ আমি কোন কায়দায় বানাবো? তারাই তো আমারে নির্যাতন করে থুয়ে গেল। সাথে করে নে গিলে না হয় বুঝতাম। অথবা তারা আইজগে যদি আমারে নির্যাতন না করতো, তাহলে আমি স্বামীর ভাত খাতাম। আনন্দ করতাম। ছেলেমেয়ে নিয়ে শান্তিতে বসবাস করতাম। আইজ তারাই তো আমারে দুশ্চরিত্র বানায়ে থুয়ে গেল।

‘চা না কোক?’ পরিবেশনকারী একজন সাংবাদিকদের চাকের ভেতর থেকে আমিরজান বিবিকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। সমস্যা হলো যারা চা খাচ্ছে, তারা কোক খাচ্ছে না। তেষ্টায় তার বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করছে। কোকের বোতলটা ঠান্ডা, ছুরির মতো ধার। আঙুলগুলি কেটে মাটিতে পড়ে যাবে এমন। আমিরজান বিবি শাড়ির প্যাঁচে বোতল জড়িয়ে, রঙিন ছাতার নিচে বসে, নল দিয়ে কোক টেনে খেতে শুরু করে। শীতল পানিতেও তার বুকের জ্বলুনি যায় না। ক্ষণে ক্ষণে ঢেকুরের সাথে নাকেমুখে গ্যাস উঠছে। চারিধারে কত ছেলেমেয়ে-মোটাকাটা, স্বাস্থ্যবান। তার মণি তিনমাসের মাথায় নষ্ট হয়ে গেল। মাসিক হলে যেমন রক্ত যায়, আঘাতে আঘাতে তা ভেঙে রক্তের দলার মতো চাটাইয়ের ওপর গড়িয়ে পড়ে। মেঝেতে ছিল খানকতক বস্তা। এর একটি তুলে বাচ্চাটা সে পেঁচিয়ে রাখে। তিন দিন পর রাতের লোকগুলি এসে ওটা ধরে বাইরে ফেলে দিয়ে এলো। স্বাধীনের পর বাড়ি ফিরে যখন, তখন সে নিজেই মরা। গরম পানিতে বরই পাতা সিদ্ধ করে যেরকম লাশ গোসল করায়, তাকে সেরকমভাবে গোসল করিয়ে ডাক্তারের দোকানে খবর পাঠালো। ডাক্তার-কমঙ্াউন্ডার আসে। চারদিক থেকে ভাই-বোন এসে মরাবাড়ির মতো হাউমাউ করে কান্নাকাটি করতে লাগলো।

‘আপনার ছেলেমেয়ে কজন?’ আমিরজান বিবির হাতের শাড়ি জড়ানো বোতলটা কেঁপে ওঠে। মুখ থেকে আলগা হয়ে নল পড়ে যায় টেবিলে। কে করলো প্রশ্নটা? কপালে মস্তবড় টিপ আঁকা একজন মহিলা তার দিকে ঝুঁকে পড়ে সকৌতুকে তাকিয়ে আছে। অন্যের কথা গায়ে না তোলা আমিরজান বিবির ভিক্ষা করার সময়কার অভ্যাস। সে মহিলার মাথার ওপর দিয়ে আমগাছের আগার দিকে তাকিয়ে থাকে। এরকম সওয়াল-জবাব সে তো নিজের সাথে নিজে হামেশাই করে। ‘তোর ছেলেপিলে কজন আমিরজান বিবি? তারা কেমন আছে, ভাত বেড়ে দিলে খায় তো? না কাক-চিলেরে বিলোয়ে দেয়?’ ‘না-না, খায় খায়। গরিবের ছেলেপিলে, না খেইয়্যে যাবে কোথা। দুষ্টুমি বলতি করে না।’ আমিরজান মিটিমিটি হাসে। মহিলা ভয় পেয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে চলে যায়। দূর থেকে বন্ধুবান্ধবদের ডেকে ডেকে তাকে দেখায়। অনুষ্ঠানটা আমিরজান বিবিকে নিয়ে হলেও এখন সবাই যার যার মতো সামাজিকতা করছে। হেসে হেসে গল্প-গুজব করছে আর প্লেট থেকে মুঠোমুঠো চানাচুড় তুলে খাচ্ছে। তবে যে কোক খাচ্ছে, সে চা খাচ্ছে না। এ এক জ্বালা। ঠান্ডা কোক খেয়ে তার জিহ্বাটা এখন অসাড়। গরম গরম এককাপ চা হলে ভালো হতো। কিন্তু সুমন ভাই পই পই করে বলে দিয়েছেন, চেয়ে না খেতে। যে যা দেয়, তাই দিয়ে যেন সে খেয়ে ওঠে। রামকৃষ্ণপুর গ্রামে চা খেলে কোক-ফান্টা খাওয়া যাবে না, এমন কোনো নিয়ম নেই। নগদ দশ হাজার টাকা এখন আমিরজান বিবির রেক্সিনের ভ্যানিটি ব্যাগে। তা দিয়ে নিজের দোকানে সে চায়ের চুলো বসাবে। আলীনগরের হাট থেকে আসবে কার্টুন কার্টুন কোক-ফান্টা। তবে সেসব ঠান্ডা না, নর্মাল। খোকা-খুকুরা চা-ফান্টা একসাথে বসে ভাগ করে খাবে। আমিরজান বিবির চোখ গাছের আগা থেকে মাটিতে পড়ে। মহিলা দূরে দাঁড়িয়ে কেমন কটকট করে তার দিকে তাকাচ্ছে। আবার হয়তো ছেলেমেয়ের কথা জানতে চাইবে। বিয়েই হলো না যার, তার আবার নিজের ছেলেমেয়ে!

কত বছর আগের কথা। রামকৃষ্ণপুর গাঁয়ের সীমায় বিয়ের কাজ নিয়ে একজন আসে, পাঁচজন মিলে তা ভেঙে দেয়। ‘এরে কি করতে নিবি, পাঞ্জাবিরা এর কিছু রেখে-থুয়ে গেছে নাকি?’ বাবা টাকা ভেঙে পাত্রপক্ষকে যত্মআত্তি করে খাওয়ান। তারা ভরপেট খেয়ে পান-জর্দা চিবোতে চিবোতে ‘পাটরি আমাডের পটন্ড, টয় পাটরের ডুলা ভাইয়ের বিমারি হইয়েটে, ডুডিন পর খবর ডেবানি’ বলে গাত্রোত্থান করে। দু দিন যায়, তিন দিন যায়। পাত্রের দুলাভাইয়ের বিমারি সারে না। ফিরতি খবরও আসে না। এভাবে খাওয়া-দাওয়া করাতে করাতে বাবা জব্বর আখন্দের দুই বিঘে জমি হাতছাড়া হয়ে গেল। শেষকালে বুড়ো বাপ অন্যের জমিতে জন খাটতে খাটতে মারা গেলেন। আমিরজান বিবির বিয়ে হলো না। অথচ গায়েগতরে স্বাস্থ্যে পাঁচ গাঁয়ে তার জুড়ি ছিল না। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে একমন ধান ভেনে তবে সে সরেছে ঢেঁকির পাড় থেকে। বাপ-মা মারা যাওয়ার পর একবস্ত্রে গ্রাম থেকে সে বিতাড়িত হলো। তাকে তাড়ালো আপন মায়ের পেটের ভাইয়েরা। তারপর থেকে গায়ের চামড়ায় ঠুলানি আর গ্যাস্ট্রিকের ব্যারাম।

এখন গলার মালার ভারে আমিরজান বিবির প্রাণ কেমন আইঢাই করছে। ফুল যে ফুল, তাতেও তার এলার্জি। গলা বেয়ে চুলকোনোটা মাথার তালুতে এক দৌড়ে উঠে যায়, আবার খলবলিয়ে নিচে নেমে আসে। মালাগুলি পাগলের মতো টেনেটুনে খুলতে গিয়ে সে এসবের ফাঁদে আরো বেশি করে জড়ায়। অবস্থা বেগতিক দেখে সুজন সিকদার ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসে। সোহরাব মালা খোলার কাজে হাত লাগায়। তারা যখন ফিরতি পথ ধরে তখন আমিরজান বিবির গলায় শুধু গোলাপ ফুলের লকেটের একটি রজনীগন্ধার মালা। বাকিগুলি সুজন সিকদার আর সোহরাব হোসেন দড়ি গেঁথে বয়ে নিয়ে চলেছে। পথেই এসবের ভাগবাটোয়ারা হবে। সমান সমান তিনভাগ। রাজিয়া আর মোহনা পাবে একদিনের বাসি ফুল আর কিছু উপটৌকন। পরিকল্পনাটা সুজন সিকদারের। এতো বড় যুদ্ধ করে যারা নির্যাতিত হলো, তারা আজ টাকা আর সন্মাননা পেলো না বটে, তবে এগুলি তাদের জন্য যত্সামান্য উপহার।

আমিরজান বিবি মাইক্রোবাস থেকে যখন নামে, তখন ভোর হয় হয়। চারদিকে ঘন কুয়াশা। আসমান ফেঁড়ে হিম পড়ছে। তিরিশ বছর বাদে গলায় মালা, হাতে উপহার-উপটৌকন নিয়ে বীর বেশে তার প্রত্যাবর্তন। কিন্তু এ দৃশ্য দেখার, পথে কোনো লোকজন নেই। সে হাটতে হাটতে চিত্রার ব্রিজের গোড়ায় এসে দাঁড়ায়। ব্রিজের ওপর দিয়েও রাস্তা, নিচে হাটু অব্দি কাপড় তুলেও পারাপার হওয়া যায়। কিন্তু ব্রিজের ওপর দিয়েই হোক আর নিচ দিয়েই হোক, সে এভাবে লোকচক্ষুর আড়ালে চোরের মতো বাড়ি সেঁধোবে, তা হয় না। সে বীর, বীরাঙ্গনা। ঢাকার লোকেরা বই দেখে ব্যাখ্যা করে বলেছে, ‘বীরের ইস্ত্রিলিঙ্গ বীরাঙ্গনা। তাতে লজ্জার কিছু নেই।’

বীরাঙ্গনা সেজে গলায় ফুলের মালা পরে আমিরজান বিবি দর্শকদের অপেক্ষায় ব্রিজের গোড়ায় বসে থাকে। তার মাথার ওপর ঝাঁকড়া একটা বটগাছ। তা থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় হিম ঝরছে। সে আর রাজিয়া বেগম, মোহনা আর বীনা সাহা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ছাড়া পেয়ে সেদিন এই বটগাছের তলায় বসে জিরোচ্ছিল। ব্রিজটা মাঝখান দিয়ে ভেঙে দু’ টুকরা হয়ে নদীর বুকে ঝুলে আছে। নিচে অঠাঁই পানি। পারাপারের নৌকা নেই। তাদের তর সইছিল না। চারটা আহত বস্ত্রহীন শরীর সামান্য ন্যাতাকানি জড়িয়ে একে অন্যকে আড়াল করছে। হিমেল হাওয়ায় কাঁপছে এক সাথে ঠকঠক করে। তাদের গায়ের দুর্গন্ধে পারাপারের ছেলেটা নাক চেপে নৌকা ঘুরিয়ে উল্টো দিকে চলে গেল। পাশ দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় থুথু ছিটালো একজন। আর কোনো আশা নেই। এসময় তাদের বাপ-ভাইয়েরা সংবাদ পেয়ে ছুটতে ছুটতে এলো। সমস্ত গ্রাম ভেঙে পড়েছিল তাদের দেখতে। সবার চোখে আতঙ্ক আর ঘিন্না। সেই ঘিন্নায় ঘিন্নায় আজ তিরিশটা বছর। এখন পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তার সাজসজ্জার দিকে তাকাতে তাকাতে ফজরের নামাজ পড়তে মসজিদের দিকে চলে যায় একজন। খবর পেয়ে সেদিনের মতো বাপ-ভাইয়েরা ছুটতে ছুটতে আর আসে না। তিরিশ বছর আগের ভিড় করা মানুষগুলো আজ কোথায়?

ভোরের কুয়াশা কেটে সকাল, সকাল গড়িয়ে দুপুর। আমিরজান বিবি এক মনে দর্শকদের জন্য অপেক্ষা করছে। অপেক্ষা করতে করতে একসময় তার ঝিমুনি চলে আসে। এর ভেতর ব্রিজের ওপারে শত শত লোক জড়ো হয়। নদীর ভরা বুকে ঝাঁকে ঝাঁকে পানসি নৌকা ভাসে। তাতে বোঝাই হয়ে সওয়ারিরা আসছে আমিরজান বিবিকে বরণ করতে। রামকৃষ্ণপুর গাঁয়ের গৌরব, আলীনগরের কৃতি সন্তান, স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা-বীরাঙ্গনা, মোসাম্মত্ আমিরজান বিবি।

আমিরজান বিবি আমিরজান বিবি/ জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।

মিছিলটা আর একটু হলেই হুড়মুড়িয়ে আমিরজানের গায়ে পড়তো। সে চোখ বুজে অন্ধের মতো কোনো রকমে উপহার সামগ্রী বুকে আগলে ধরে রাস্তা ছেড়ে নদীর পাড় বেয়ে নিচে নেমে দাঁড়ায়। তাড়াহুড়োয় তার গলার মালাটা ছিঁড়ে পড়ে গেছে পথের ঠিক মাঝখানে। এটি পায়ের তলায় পিষে মিছিলটা এগিয়ে যায়। আমিরজান বিবি দেখে, নদীর বুক খাঁ খাঁ। কোনো পানসি নেই। ব্রিজের ওপর দিয়ে সদ্য কারামুক্ত সাত খুন ও দশটি ধর্ষণ মামলার আসামি জার্মান শহীদকে লোকজন কান্ধে করে শ্লোগান দিতে দিতে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। তার গলাভর্তি ফুলের মালা।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৩ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত