বিজ্ঞাপন
default-image

হামদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পর নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। একাত্তর সালের পরাজয়ের ঘটনার জন্য দায়ী সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের সুপারিশের প্রতি ব্যাপক জনসমর্থন দেখা গেছে। আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

পূর্ব পাকিস্তানের সংকটের জন্য যারা দায়ী তাদের শাস্তির পক্ষে যে জনমত রয়েছে সেই দাবির সঙ্গে আমি একমত। বিশেষ করে, যাঁরা সেনাবাহিনীতে ছিলেন এঁদের বিচার হওয়া উচিত। যুদ্ধে পরাজয়ের পর পাকিস্তান ফিরে আমি স্বেচ্ছায় কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু সে সময়ের সেনাপ্রধান টিক্কা খান আমার প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। তিনি আসলে প্যানডোরার বাক্সটি খুলতে চাননি। এ ধরনের কিছু শুরু হলে যুদ্ধ পরিচালনায় সেনা সদর দপ্তরের ব্যর্থতা ও সেনা রিজার্ভ কমান্ডার হিসেবে টিক্কা খানের ভূমিকা প্রকাশ হয়ে পড়ত। কোর্ট মার্শাল না-হওয়ার কারণে হামদুর রহমান কমিশন গঠনের আগে আমরা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাইনি। কোর্ট মার্শাল হলে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতাম না।

পাকিস্তানের সেনা আইন অনুযায়ী আপনি আত্মপক্ষ সমর্থনে কোনোকিছু নতুন করে পর্যালোচনা ও কোনো সাক্ষীকে হাজির করার সুযোগ চাইতে পারেন। এ ধরনের সুযোগ থাকার ফলে সেনা সদর দপ্তরের দুর্বলতা প্রকাশ হওয়ার আশঙ্কা থাকায় আমাদের কখনো কোর্ট মার্শাল হয়নি। এ ধরনের কিছু হলে বরং আমি সহজেই অভিযোগ থেকে মুক্তি পেতাম। কমিশন আমার এই যুক্তি মেনে নিয়েছিল যে আত্মসমর্পণের আদেশ আমাকে পাঠিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান।

আপনি বললেন, কমিশন আপনার এই যুক্তি মেনে নিয়েছে যে আত্মসমর্পণের আদেশ দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। কিন্তু মোশাররফ সরকারের সময় প্রকাশ করা রিপোর্টে যুদ্ধে পরাজয়ের জন্য আপনাকে ও আরও কজন জেনারেলকে দায়ী করা হয়েছে।

আমি যদি এত বড় একটি ট্র্যাজেডির জন্য দায়ী হয়ে থাকি, তবে আমার কোর্ট মার্শাল করা হলো না কেন? ১৯৯১ সালে একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত এক বক্তব্যে টিক্কা খান বলেছেন, ‘আমরা ভারতীয় সেনানায়ক লে. জেনারেল জগজিত্ সিং আরোরার কাছে আত্মসমর্পণকারী লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজির বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর প্রমাণপত্র পাইনি। কারণ তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্য ইয়াহিয়া খানের আদেশ ছিল। কিন্তু আমরা তাঁকে সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে নিইনি এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিয়ে তাঁকে স্বাভাবিক সুযোগ-সুবিধাসহ অবসর দেওয়া হয়।’

তবে কি আপনি বলতে চাচ্ছেন যে ঢাকার পতনের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এককভাবে দায়ী এবং আপনি শুধু তাঁর আদেশ অনুসরণ করেছেন?

না, ইয়াহিয়া খান ছাড়াও আরও কজন সমানভাবে পূর্ব পাকিস্তান সংকটের জন্য দায়ী। কিন্তু রিপোর্টে তাদের দায়ী করা হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানে কেন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠেছিল এবং পরিণতিতে জিন্নাহর ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান ভেঙে গেল তার যথাযথ কারণগুলো ও পেছনে কাদের দায় রয়েছে—সেই সত্য কমিশন বের করতে পারেনি।

রিপোর্টে বলা হয়েছে যে আত্মসমর্পণের কোনো আদেশ ছিল না। তবে আপনার কাছ থেকে সেখানকার পরিস্থিতির বর্ণনা পেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার হিসেবে আপনাকে প্রয়োজনে আত্মসমর্পণের অনুমতি দিয়ে রেখেছিল। রিপোর্টে বলা হয়েছে, আপনি যদি মনে করতেন যে ঢাকাকে রক্ষা করা সম্ভব তবে আপনি সহজেই এ ধরনের আদেশ উপেক্ষা করতে পারতেন।

আমি শপথ নিয়ে বলতে পারি যে ইয়াহিয়া আমাকে আত্মসমর্পণের স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখনো আমি শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে প্রস্তুত ছিলাম। এমনকি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আমার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে আমি বার্তা পাঠিয়েছিলাম। এ ছাড়া জেনারেল আবদুল হামিদ খান ও বিমান বাহিনীপ্রধান মার্শাল রহিম আমাকে ফোন করেছিলেন এবং একাত্তর সালের ১৪ ডিসেম্বর পাঠানো সেনা সদরের বার্তা অনুযায়ী কাজ করার আদেশ দিয়েছিলেন। কারণ পশ্চিম পাকিস্তান বিপদের মুখে রয়েছে। এর আগে আমাকে সৈন্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বলা হয়েছিল।

আমি এখনো বিশ্বাস করি যে দুটি সাঁজোয়া ডিভিশন ও তিনটি পদাতিক ডিভিশনের সমন্বয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রিজার্ভ ফোর্স যদি পাল্টা হামলা চালাত, তবে যুদ্ধের ফলাফল খুবই অন্য রকম হতে পারত।

কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানে আপনার সৈন্যরা লুটপাট, জ্বালাও-পোড়ও, ধর্ষণ ও খুনের সঙ্গে জড়িত ছিল। আপনার মন্তব্য কী?

পূর্ব পাকিস্তান কমান্ডের দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই আমি সৈন্যদের লুটপাট, জ্বালাও-পোড়াও ও নির্বিচারে লোকজন হত্যার বেশকিছু অভিযোগ পেয়েছিলাম। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে পেরে আমি বিষয়গুলো জানিয়ে একাত্তর সালের ১৫ এপ্রিল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলাম। আমি আমার চিঠিতে স্পষ্টভাবেই লিখেছিলাম যে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, এমনকি সৈন্যদের এ ধরনের কার্যকলাপ থেকে সেখানকার পশ্চিম পাকিস্তানিরাও ছাড় পাচ্ছে না। আমি আরও জানিয়েছিলাম যে কর্মকর্তা পর্যায়ে কেউ কেউ এ ধরনের লজ্জাজনক কাজকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন।

বারবার এসব বিষয়ে সতর্ক করে দেওয়ার পরও সংশ্লিষ্ট কমান্ডাররা এই বিপজ্জনক উচ্ছৃঙ্খলতাকে বন্ধ করতে পারেননি। এর ফলে নিশ্চিতভাবেই সৈন্যদের যুদ্ধ করার দক্ষতা কমেছে।

একজন সেনা কমান্ডার হিসেবে আপনার ব্যর্থতাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অপমানকর আত্মসমর্পণের দায়ভার আপনি নেবেন কি?

পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের ৪৫ হাজার সৈন্য লড়াই করছিল প্রায় পাঁচ লাখ ভারতীয় সৈন্য, কয়েক লাখ মুক্তিযোদ্ধা ও আমাদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। শুধু বিদ্রোহ দমনের জন্যই আমার প্রয়োজন ছিল প্রায় তিন লাখ সৈন্যের। সে সময় আমরা আমাদের মূল ঘাঁটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু কোনো বিরতি ছাড়াই আমরা লড়াই চালিয়ে গেছি। হামদুর যদি ভেবে থাকেন যে আমরা সেখানে পিকনিক করতে গিয়েছিলাম, তবে তাঁর উচিত ছিল আমাদের সঙ্গে যোগ দেওয়া। আমি এটা স্পষ্ট করে বলতে চাই যে সেনাবাহিনী আমার কমান্ডের আওতায় পূর্ব পাকিস্তানে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছে। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল একটি ক্ষমতা ধরে রাখার লড়াই, বন্দুকের নল ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা দিয়েছিল এবং শেষ পরিণতি হচ্ছে একাত্তর সালের পরাজয়।

ইয়াহিয়া, মুজিব ও ভুট্টোর মধ্যে ক্ষমতার লড়াই একাত্তর সালের এই তালগোল পাকানো পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ইয়াহিয়া চেয়েছিলেন ক্ষমতা ধরে রাখতে, অন্যদিকে ভুট্টো চেয়েছিলেন তা দখল করতে। আর প্রকৃত সত্যটি হচ্ছে, নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ। সরকারের দায়িত্বটি তাঁর হাতেই তুলে দেওয়া উচিত ছিল। মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলে পাকিস্তান ঐক্যবদ্ধ থাকত। এটা দুঃখজনক যে কমিশন ভুট্টোকে সব ধরনের দায় থেকে মুক্তি দিয়েছে।

কমিশনের রিপোর্টে একাত্তর সালের পরাজয়ের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি জেনারেল চক্রকে প্রকাশ্যে বিচারের সুপারিশ করা হয়েছিল। অথচ জেনারেল টিক্কা, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সাবেক কমান্ডার সাহেবজাদা ইয়াকুব আলী খান ও রাও ফরমান আলীকে (নিয়াজির উপদেষ্টা) অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তাঁরা কি নির্দোষ ছিলেন?

কমিশনের এই তিনজনকে অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়ার বিষয়টির সঙ্গে আমি একমত নই। এটা খুবই বিস্ময়কর যে কমিশন পাকিস্তান ভাঙার কোনো দায়ভার টিক্কা, ইয়াকুব ও ফরমানকে দেয়নি। প্রকৃতপক্ষে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার হিসেবে ইয়াকুবের ব্যর্থতা পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতিকে খারাপের দিকে নিয়ে যায়। সবকিছু গুলিয়ে ফেলার পর ইয়াকুব বিবেক ও নীতি-নৈতিকতার তোয়াক্কা না-করে দায়িত্ব ছেড়ে দেন ও পদত্যাগ করেন। দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলানো উচিত ছিল। ইয়াহিয়া তাঁর পদাবনতি করেছিলেন, কিন্তু ভুট্টো তাঁর পদ ফিরিয়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়েছিলেন। কাজ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার কী অপূর্ব পুরস্কার!

হামদুর কমিশন তাঁকে দায় থেকে মুক্তি দিয়েছে। এর মাধ্যমে আসলে কোনো জটিলতা দেখা দিলে দেশের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিবর্তে সেনা কর্মকর্তাদের পদ ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যাওয়াকে উত্সাহিত করা হয়েছে। একইভাবে রিপোর্টে টিক্কাকে দায়ী করা হয়নি। যদিও ২৫ মার্চের বর্বর হত্যাকাণ্ডের জন্য তিনি কসাই হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করেছেন। কমিশন তাঁর ঘৃণ্য অপরাধকে উপেক্ষা করেছে। আর রাও ফরমান আলীর ক্ষেত্রে এটা বলা যায় যে তিনি ঢাকা অপারেশনের দায়িত্বে ছিলেন।

ভুট্টোর সরকার হামদুর রিপোর্ট প্রকাশ করেনি কেন?

ভুট্টো এই রিপোর্ট প্রকাশে ভীত ছিলেন, কারণ প্রকৃত সত্য হচ্ছে, যে পরিস্থিতি পাকিস্তানকে ভাঙনের দিকে নিয়ে গেছে, তার জন্য তিনি নিজেই দায়ী। ভুট্টোর সহযোগীদের নিয়ে গঠিত সাত সদস্যের একটি উপকমিটিকে এই রিপোর্ট দেখার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কমিটি এই রিপোর্ট প্রকাশ না-করার সুপারিশ করে। ভুট্টো পরে তাঁর ক্ষমতা ব্যবহার করে রিপোর্টটি ৩৪টি পাতায় কিছু সংশোধন করেন।

আপনার মতে হামদুর রিপোর্ট ত্রুটিপূর্ণ, খণ্ডিত ও ভুট্টোর দ্বারা প্রভাবিত। অন্যদিকে ক্ষমতায় যাঁরা রয়েছেন তাঁদের কেউই ঢাকা বিপর্যয়ের জন্য দায়ী জেনারেলদের কোর্ট মার্শাল করতে প্রস্তুত নন। দায়ীদের শাস্তি দিতে কী করা উচিত বলে মনে করেন? আপনার কোনো সুনির্দিষ্ট সুপারিশ আছে কি?

একাত্তরের বিপর্যয়ের প্রকৃত সত্য বের করতে ও দায়ীদের শাস্তি দিতে বিচার্য এবং অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে আরও ব্যাপকতা দিয়ে একটি নতুন কমিশন গঠন জরুরি। সেনাপ্রধানের নেতৃত্বে এই কমিশন হওয়া উচিত। এটা খুবই চমত্কার একটি কাজ হবে এবং অনেক প্রয়োজনীয় শিক্ষা অর্জন করা সম্ভব হবে। চরম প্রতিকূল পরিবেশে ক্ষুদ্র, ক্লান্ত ও খুবই দুর্বল অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পূর্বাঞ্চলীয় গ্যারিসন কীভাবে তাদের ওপর অর্পিত সব দায়িত্ব পালন করতে পারল এবং অন্যদিকে কেন পর্যাপ্ত সৈন্য, অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ থাকার পরও পশ্চিমাঞ্চলীয় গ্যারিসন ব্যর্থ হলো এবং ১০ দিনেরও কম সময়ে পাঁচ হাজার ৫০০ বর্গমাইল এলাকা হারাল—এ ব্যাপারে একটি সামরিক পর্যালোচনা হওয়া উচিত।

ভারতে আটক থাকার পর ১৯৭৪ সালে পাকিস্তান ফিরে আমি যখন পূর্ব পাকিস্তান বিপর্যয়ের ব্যাপারে আমার রিপোর্ট প্রস্তুত করছিলাম তখন আমি সেনা সদরের বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর পাচ্ছিলাম যে একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডকে বলি দেওয়া হয়েছে। এবং পূর্ব পাকিস্তানে পরাজয়ের জন্য এর সিনিয়র কমান্ডারদের বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে। শুরুতে আমার এ ব্যাপারে কিছু সন্দেহ থাকলেও পরে বছরের পর বছর এ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করে আমি নিশ্চিত হয়েছি যে সেনা সদর হাইকমান্ডের ষড়যন্ত্র পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড প্রতারণা, চাতুরী ও বিদ্বেষের শিকার হয়েছে।

এটা এতটাই অবশ্যম্ভাবী ছিল যে ভারতীয় মেজর জেনারেল শাহ বেগ সিং আমাকে বলেছিলেন, ‘স্যার, আপনার সর্বনাশ হয়ে গেছে। তারা সব কিছুর দায় আপনার ও আপনার কমান্ডের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ তারপর আমি এ ব্যাপারে সন্দেহমুক্ত যে পূর্ব পাকিস্তানের পতনের বিষয়টি ছিল পরিকল্পিত।

পূর্ব পাকিস্তানে পরাজয়ের বিষয়টি পরিকল্পিত ছিল—এ অবস্থানের পক্ষে আপনার যুক্তি-প্রমাণ কী?

১৯৭০-এর নির্বাচনে মুজিবের বিজয়ের বিষয়টি ইয়াহিয়া ও ভুট্টো—কারও জন্যই সুখকর ছিল না। কারণ, এর অর্থ হচ্ছে ইয়াহিয়াকে প্রেসিডেন্ট পদ ছেড়ে দিতে হবে এবং ভুট্টোকে বসতে হবে বিরোধী দলের আসনে। ভুট্টো তা কোনোভাবেই চাননি। এ অবস্থায় ভুট্টোর নিজ এলাকা লারকানায় এই দুজন মিলিত হন এবং এক পরিকল্পনা আঁটেন, যা অনেকের কাছেই ‘লারকানা ষড়যন্ত্র’ হিসেবে পরিচিত। তাঁদের পরিকল্পনাটি ছিল অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের সভা স্থগিত করা এবং নানা কূটকৌশল, হুমকি, ভয়-ভীতি ও সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ঠেকানো।

শেষ পর্যন্ত এই লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে।

আপনি কি মনে করেন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে বিরোধ রয়েছে, তা দূর করার সময় এসেছে এবং সাধারণ জনগণের স্বার্থে দেশ দুটির উচিত শান্তির জন্য সংলাপ শুরু করা?

আমাদের কখনোই ভারতকে বিশ্বাস করা উচিত হবে না। ভারতের কোনো সরকারই একটি শক্তিশালী পাকিস্তান রাষ্ট্রের ধারণাকে মেনে নিতে পারেনি এবং তারা সব সময়েই আমাদের দেশটিকে দুর্বল করতে চেয়েছে। অতীতের রেকর্ড দেখলে দেখা যাবে যে ভারত সব সময় পাকিস্তানের ক্ষতি করেছে। ভবিষ্যতেও তারা যখন সুযোগ পাবে কখনো পাকিস্তানকে ছেড়ে দেবে না। এখনো কাশ্মিরে মোতায়েন হাজার হাজার হাজার ভারতীয় সৈন্য জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে নিরপরাধ মুসলমানদের হত্যা করে চলেছে।

জাতিসংঘের প্রস্তাব মেনে কাশ্মির সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি না-দেওয়া পর্যন্ত পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় বসতে পারে না।

কাশ্মির সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য বর্তমানে যে কূটনৈতিক উদ্যোগ চলছে, আপনাকে সুযোগ দেওয়া হলে আপনি কি সেখানে কোনো ভূমিকা পালন করতে আগ্রহী?

না, আমি বরং ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করাকে শ্রেয় মনে করি। যদিও আমি এখন যুদ্ধ করার জন্য খুবই বৃদ্ধ, তবুও আমি জম্মু ও কাশ্মিরে ভারতীয় সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৭ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত