বিজ্ঞাপন
default-image

বিকেলবেলা মাওলা ভাই এসে বললেন, টাউনের অবস্থা খুব খারাপ। আর থাকা ঠিক হবে না।

শুনে আমাদের মুখ শুকিয়ে গেল।

সাবেক শরাফতগঞ্জ লেনের সেই বাড়িতে আমরা দশটি ভাই-বোন আর মা। বাবা মারা গেছেন অক্টোবরের সাত তারিখে। তারপর থেকে আমাদের দুঃখী সংসার আরও দুঃখী হয়ে গেছে। বাবা ছিলেন সংসারের একমাত্র ভরসা। মিউনিসিপ্যালিটিতে হেডক্লার্কের চাকরি করতেন। চাকরির রোজগারে অত বড় সংসার চলত না। চাকরির ফাঁকে ফাঁকে টিউশনি করতেন, গিয়াসউদ্দিন চেয়ারম্যানের অফিসে টুকটাক কাজ করতেন। অর্থাত্ কিছু রোজগার বাড়ানোর চেষ্টা। বড় ভাই জগন্নাথ কলেজে নাইট শিফটে আইকম পড়ে। আমি আর আমার বড় বোন মনি পড়ি ক্লাস টেনে। এ বছরই এসএসসি দেওয়ার কথা। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পরীক্ষা দেওয়ার স্বপ্ন বাতিল হয়ে গেছে। আমি আর বড় ভাই খুব চেষ্টা করছি বাবার পাশে দাঁড়াতে। দুজনেই দশ টাকা পনেরো টাকা মাসিক আয়ের টিউশনি করছি বেশ কয়েকটা করে। কিছুদিন আগে টঙ্গিতে বড় ভাইয়ের একটা চাকরি হয়েছে। বেতন সাড়ে তিনশ টাকা। তাতেও সংসারে সচ্ছলতা ফিরছিল না। সাবেক শরাফতগঞ্জ লেনের সেই পুরনো আমলের দোতলা বাড়ির পেছন দিককার একটি বিশাল আর একটি অতি ছোট্ট রুমে আমাদের এতগুলো মানুষের সংসার। ভাড়া চারশ টাকা। আমাদের সঙ্গে আছেন পুনুআম্মা আর তার একমাত্র মেয়ে রিনা। পুনুআম্মা আমার খালা। রিনার জন্মের পর খালুর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে খালার। তারপর থেকে তারা দুজন আমাদের সংসারে। একজন কাজের বুয়া ছিল, বারেকের মা। তার ছেলে বারেক আমাদের খোকনের বয়সী। বাবাকে নিয়ে ষোলজন মানুষের সংসার। বাবার মৃত্যুতে একজন মানুষ কমেছে কিন্তু সংসারের সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমাদের চোখেমুখে পাকিস্তান আর্মির ভয় আতঙ্কের চেয়ে বেশি আতঙ্ক তিনবেলার খাবার নিয়ে, বাড়ি ভাড়া এবং এতগুলো ভাইবোনের পড়াশোনা নিয়ে। কীভাবে বাঁচব আমরা?

মার মুখে সারাক্ষণ লেগে আছে দুঃখের ছায়া। ছোট ভাইবোনগুলো স্তব্ধ হয়ে গেছে। কারো মুখে কথা নেই, হাসি নেই। দেশজুড়ে আতঙ্ক, আমাদের বয়সী ছেলে দেখলেই তাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে মিলিটারি কিংবা রাজাকাররা। এ অবস্থায় বড় ভাই আর আমি সংসার বাঁচানোর জন্য, তিনবেলার খাবার জোটানোর জন্য এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমাদের আত্মীয়স্বজনরা প্রায় সবাই ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে। পাশে দাঁড়ানোর মতো একজন মানুষ নেই। কী যে অসহায় দিন!

বাবা ছিলেন মিউনিসিপ্যালিটির শুরুর দিককার কর্মচারী। তার আচমকা মৃত্যুতে মোটামুটি একটা আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল লক্ষ্মীবাজারের অফিসটায়। আমাদের সাহায্য করার জন্য কর্মচারী-কর্মকর্তারা চাঁদা তুলেছিলেন। বাবার মৃত্যুর কিছুদিন পর ঈদ ছিল। সেই ঈদের দুতিন দিন আগে বাবার কলিগরা কয়েকজন এসে মার হাতে বারো শ টাকা আর চারটা সুতি শাড়ি দিয়ে গিয়েছিল। ছোট ভাইবোনদের ঈদের জামাকাপড় দিয়েছিলেন আমাদের বাড়িওয়ালা।

কিন্তু মিউনিসিপ্যালিটি অত বড় প্রতিষ্ঠান, অত কর্মচারী আর টাকা উঠেছে মাত্র বারো শ?

পরে জেনেছিলাম, না, টাকা অনেক বেশি উঠেছিল। আমাদের হাতে পৌঁছেছে মাত্র বারো শ নগদ আর আট-নয় শ টাকার শাড়ি। ‘রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি’।

বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রাচুয়িটি এসবের কিছু টাকা আমাদের পাওনা আছে। তত দিনে জেনেছি ওই টাকা পেতে হলে কোর্ট থেকে একটা সাকসেসান সার্টিফিকেট বের করতে হবে। সেটার জন্য উকিল ধরতে হবে। টাকা-পয়সা খরচের ব্যাপার আছে। সময় লাগবে। দেশে চলছে মুক্তিযুদ্ধ। এই অবস্থায় কোন উকিল ধরব আমরা? কোথায় পাব খরচের টাকা? তিনবেলার খাবার জোটানো দায় হচ্ছে যে সংসারে সেখানে ওই সমস্ত খরচের কথা কে ভাববে?

আমরা ছিলাম স্বাধীনতার অপেক্ষায়। দেশ স্বাধীন হলে কোনো না কোনো ব্যবস্থা হবেই। বড় ভাইয়ের টঙ্গীর চাকরিটা তো আছেই। সকালবেলা অফিসে চলে যাবে, বিকেলবেলা চাকরি শেষ করে টঙ্গী থেকে বাসে করে চলে আসবে সদরঘাট, সেখান থেকে কাছেই জগন্নাথ কলেজ, আইকমের ক্লাস করে বাড়ি ফিরবে। আমি আবার টিউশনি নেব। ফাঁকে ফাঁকে এসএসসির প্রিপারেশন। রেজাল্ট বেরুনোর পর মিউনিসিপ্যালিটিতে আমার চাকরি হবে। বাবার কলিগরা কথা দিয়েছেন, এসএসসির রেজাল্ট বেরুনোর সঙ্গে সঙ্গে মিউনিসিপ্যালিটিতে রোড ইন্সপেক্টরের চাকরি হয়ে যাবে আমার। কাজটা কন্ট্রাক্টরদের সঙ্গে। রোড কন্সট্রাকশনের কাজের তদারকি। এই কাজে ভালো রকমের ঘুষ পাওয়া যায়। আমার রোড ইন্সপেক্টরের চাকরি হওয়া মানে সংসারের চেহারা ঘুরে যাওয়া।

সেসব দুঃখের দিনে এই স্বপ্নে বিভোর হয়ে ছিলাম আমি। দিনভর রোড ইন্সপেক্টরের চাকরি করব আর নাইট কলেজে পড়ব। আমি ছিলাম সায়েন্সের ছাত্র। গেণ্ডারিয়া হাইস্কুলে ভালো ছাত্র হিসেবে নাম ডাক ছিল আমার। ফার্স্ট সেকেন্ড হতাম। এই কারণে স্কুলে বেতন দিতে হতো না। ফুল ফ্রি পেতাম প্রায় প্রত্যেক বছর। এ জন্য গেণ্ডারিয়া এলাকায় টিউশনি পেতে অসুবিধা হতো না। স্বপ্ন ছিল ইন্টারমিডিয়েটের পর বুয়েটে ভর্তি হব। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ব। কিন্তু বাবার মৃত্যুতে সেই স্বপ্ন ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। রোড ইন্সপেক্টরের চাকরিতে ঢুকলে নাইট শিফটে পড়তে হবে। নাইট শিফটে সায়েন্স পড়ার ব্যবস্থা নেই।

তবু নিজের স্বপ্নভঙ্গের জন্য আমি তেমন কষ্ট তখন পেতাম না। সংসারের চেহারা বদলাবে, সচ্ছলতা আসবে, মার বিষণ্ন মুখ কিছুটা আলোকিত হবে, ছোট ভাইবোনগুলোর পড়াশোনা, বড় বোনের বিয়ে আস্তে আস্তে সুখের দিন আসবে।

দেশ তখন ক্রমশ এগুচ্ছিল স্বাধীনতার দিকে। চারদিক দিয়ে রাজধানীর দিকে এগুচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধারা। কয়েকদিন হলো ভারত সরাসরি যুদ্ধ শুরু করেছে। ঢাকার আকাশে ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের ফাইটার বিমান ককফাইট করছে। তেজগাঁ এয়ারপোর্টে নাপাম বোমা ফেলেছে ইন্ডিয়া। এয়াপোর্টে আগুন ধরে গিয়েছিল। এ অবস্থায় আমরা জবুথবু হয়ে বসে আছি সাবেক শরাফতগঞ্জ লেনের সেই বাড়ির বড় ঘরটায়। ঘরে একবেলার খাবার আছে তো অন্য বেলার নেই। মিউনিসিপ্যালিটি থেকে সেই যে চাঁদার বারো শ টাকা দিয়ে গিয়েছিল সেই টাকার দু-চার শ হয়তো তখনও আছে মার কাছে। একটি-দুটি করে টাকা বের করেন মা। বারেকের মা গিয়ে বাজার করে আনে। সপ্তাহে একদিন আলাউদ্দিনের রেশনসপে গিয়ে পোকায় খাওয়া মোটা মোটা চাল গম নিয়ে আসি আমি। গম ভাঙিয়ে আটা করে আনি ধোপাবাড়ির গলির কল থেকে। তারপরও দিন কাটে না, রাত কাটে না! কবে দেশ স্বাধীন হবে! কবে শেষ হবে আমাদের দুঃখের কাল। কোর্ট থেকে সাকসেসান সার্টিফিকেট বের হলেই মিউনিসিপ্যালিটি থেকে পাওয়া যাবে বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ড আর গ্রাচুয়িটির কিছু টাকা। তারপর আমার রোড ইন্সপেক্টরের চাকরি। দিন ঘুরে যাবে।

কিন্তু কবে? কবে আসবে সেই দিন।

গোপনে গোপনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনি। স্বাধীনতা আসছে। আশার আলো দেখতে পাই।

আমাদের ভাঙাচোরা, ব্যাটারির জোর কমে যাওয়া রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনতে হতো গোপনে। কারণ আমাদের বাড়িওয়ালা ছিলেন পাকিস্তানের পক্ষের লোক। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতা এসব শব্দ তিনি শুনতে পারতেন না। শুনলে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতেন। একে তার বাড়ির ভাড়াটে আমরা, বাবার মৃত্যুর পর থেকে ভাড়া নিচ্ছেন না, ঈদে আমাদের জামাকাপড় দিয়েছেন, সুতরাং তার মত মতো চলাই ভালো। তিনি রেগে যেতে পারেন কিংবা বিরক্ত হতে পারেন এমন কাজ কেন করব। রেগে গিয়ে যদি বাড়ি থেকে তুলে দেন, আমরা তাহলে যাব কোথায়? টাকা নেই, পয়সা নেই, কে আমাদের বাড়ি ভাড়া দেবে?

তবে তিনি থাকতেন দোতলায়, আমরা নিচতলার পুবদিককার অংশে। তবু সাবধানে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনতাম, স্বাধীনতার আশায় বুক বাঁধতাম।

এ অবস্থায় একদিন বিকেলবেলা মাওলা ভাই এলেন আমাদের বাসায়। শুকনো ভয়ার্ত মুখে বললেন, টাউনের অবস্থা খুব খারাপ। আর থাকা ঠিক হবে না।

মাওলা ভাই আমাদের কোনো আত্মীয় নন। বছর দুয়েক আগে আমরা ছিলাম রজনী চৌধুরী রোডে, নবনূর ভাইদের বাড়ির মাঝখানে পার্টিশান দেওয়া দু কামরার টিনের ঘরে। সামনে অনেকখানি খোলা উঠোন, তারপর গেট। নবনূর ভাইদের সংসারে তিন ভাই দুই বোন। এক বোন থাকতেন মফস্বলে। বাবা ছিলেন না, মা ছিলেন। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন।

এই বাড়ির সামনে হামিদ ভাইদের বাড়ি আর দক্ষিণে আমার সঙ্গে গেণ্ডারিয়া স্কুলে পড়ত আমিনুল, আমিনুলদের বাড়ি। লতায় পাতায় মাওলা ভাই বোধহয় আমিনুলদের কিংবা ওই বাড়ির কোনো ভাড়াটের আত্মীয়। প্রায়ই ওই বাড়িতে আসতেন তিনি। কেমন কেমন করে যেন আমাদের সঙ্গে তার একটা পরিচয় হলো। আমাদের বাসায়ও আসা-যাওয়া শুরু করলেন তিনি। বাবার সঙ্গে বেশ একটা খাতির হয়ে গেল।

মাওলা ভাই ফরিদপুরের মানুষ। বিএ পাস করে জীবন বীমা করপোরেশনের একাউন্টস ডিপার্টমেন্টে চাকরি করছেন। মা-বাবার একমাত্র ছেলে। বাবা কোরানে হাফেজ, গ্রামের মসজিদে ইমামতি করেন। চাকরির খাতিরে জীবন বাজি রেখে মাওলা ভাই তখনও রয়ে গেছেন ঢাকায়। বিজয়নগরের এক মেসে থাকেন। পঁচিশে মার্চের দুদিন পর দুপুরবেলা আমাদের বাসায় এসে ‘এত লাশ! এত লাশ!’ বলতে বলতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও চাকরির মায়ায় শহর ছাড়েননি। ছুটিছাটার দিনে প্রায়ই আমাদের বাসায় আসতেন। মাকে ডাকতেন আম্মা। ছোটখাটো গড়নের প্রাণবন্ত যুবক। অত্যন্ত আন্তরিক ধরনের। আমরা সবাই তাকে খুবই পছন্দ করতাম।

সেই বিকেলে মাওলা ভাইয়ের সঙ্গে একটা রেকসিনের ব্যাগ। শুকনো ভয়ার্ত মুখে তিনি যখন কথা বলছিলেন আমরা সবাই তার চারপাশ ঘিরে ছিলাম। পুরনো ঢাকার অনেক জায়গায়, মোহাম্মদপুর, মিরপুরে পাকিস্তান আর্মির চেয়েও নাকি বেশি অত্যাচার চালাচ্ছে বিহারিরা। নির্বিচারে হত্যা করছে মানুষজন, লুটপাট আর নারীদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে ভয়াবহভাবে।

শুনে মা কেমন দিশেহারা হয়ে গেলেন। মার মতো দিশেহারা হলো আমার বড় বোন মনি আর আমার ছোট পলি। মুখ শুকিয়ে রক্তশূন্য হয়ে গেল তাদের। অতগুলো মানুষ জড়াজড়ি করে আছে একটি মাত্র ঘরে তবু সেই ঘরে কোনো শব্দ নেই, যেন মৃত্যুর স্তব্ধতা নেমে এসেছে ঘরে। সবগুলো মানুষ যেন একসঙ্গে মরে গেছি আমরা।

একসময় মা কোনো রকমে বললেন, তুমি এখন কী করবে?

মাওলা ভাই বললেন, আজকের রাতটা আপনাদের এখানে থাকব। ভোরবেলা, আজানের সঙ্গে সঙ্গে উঠে ফরাশগঞ্জের ওদিক দিয়ে গুদারা পার হব। বুড়িগঙ্গার ওপার গিয়ে দক্ষিণে হাঁটা ধরব। যে কদিন লাগে হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের বাড়িতে চলে যাব। শহর থেকে যাওয়া মানুষদের খুবই হেলপ করছে গ্রামের লোকেরা। রাস্তায় রাস্তায় মুড়ি-চিড়া-গুড়-পানি খাওয়াচ্ছে। খিচুড়ি খাওয়াচ্ছে। রাতের আশ্রয়ও দিচ্ছে। কোনো অসুবিধা নেই।

মাওলা ভাইয়ের কথা শুনে খানিক চুপচাপ কী ভাবলেন মা। তারপর বললেন, তুমি একটা কাজ করবে বাবা?

কী কাজ?

মনি, মিলন আর পলিকে নিয়ে যাবে তোমার সঙ্গে?

কোথায় নিয়ে যাব? আমাদের বাড়িতে?

না। তুমি তো বিক্রমপুরের ওপর দিয়েই যাবে। ওদের পয়শা গ্রামে পৌঁছে দিয়ে যেও। পয়শার বাড়িতে ওদের দুই চাচা আছে, হাপি আর ফজল, আমার শাশুড়ি আছেন। ওই বাড়িতে পৌঁছে দিলে সেখানে ওরা ভালো থাকবে। মেয়েদের নিয়ে আমারও দুশ্চিন্তা কমে।

শুনে মাওলা ভাই খানিক চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে।

মনি, পলি আর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তাহলে কাপড়-চোপড় যা যা খুব জরুরি শুধু সেসব গুছিয়ে ফেল। ছোট এবং হালকা ধরনের ব্যাগ না হলে কিন্তু হাঁটতে পারবে না। বাইশ মাইল পথ হাঁটতে হবে।

ঢাকায় তখন ব্ল্যাক সাইট চলছে। সন্ধের পর অন্ধকারে তলিয়ে যায় শহর। কোথাও কোনো শব্দ নেই, আলো নেই। পুরো নয় মাস জুড়েই গেণ্ডারিয়া ছিল মোটামুটি নিরাপদ এলাকা। বড় ধরনের কোনো ঘটনা গেণ্ডারিয়ায় ঘটেনি। শুধু সাধনা ঔষধালয়ের প্রাণপুরুষ অধ্যাপক যোগেশচন্দ্র ঘোষকে মিলিটারিরা এক দুপুরে এসে গুলি করে মেরেছিল। আমরা যে বাড়িতে আছি এই বাড়িতে ভয়ের কিছু নেই। তবু মা কেন আমাদের তিনজনকে মাওলা ভাইয়ের সঙ্গে চলে যেতে বলছেন? সারারাত কথাটা ভেবেছি আমি। তারপর উত্তর পেয়ে গেছি একসময়। এই ধরনের অভাবী সংসার থেকে তিনটি মুখ যদি কিছুদিন অন্য কোথাও গিয়ে থাকে তাহলে তিনটি মুখ অন্তত কমল। এও তো সংসার যুদ্ধের একটি পন্থা! আমার মা সেই পন্থাটিই ধরেছিলেন।

হারিকেনের ান আলোয় মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা তোলপাড় করছিল আমার। চোখে পানি আসছিল। ইচ্ছে করছিল দু হাতে মাকে জড়িয়ে ধরে, মায়ের বুকে মুখ রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলি-মা, মাগো, তোমার জীবনটা এমন হলো কেন মা? আমাদের জীবন এমন হলো কেন?

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৩ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত