বিজ্ঞাপন
default-image

শতবর্ষের চূড়ায় দাঁড়িয়ে গোড়ার দিকে চোখ ফেরালে বঙ্গবন্ধুর শৈশবকে আর দশটা সম্পন্ন গ্রামীণ গৃহস্থ পরিবারের শিশুর চেয়ে আলাদা করা যায় না।

৪৫ বছর আগে যখন তাঁর জীবনাবসান হয়েছিল মধ্যরাতের নির্মম হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে, তখন ৫৫ বছর বয়সী এই প্রবীণ নেতা বাঙালির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, জাতির পিতা এবং নিজের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তার পরবর্তী দীর্ঘ ৪৫ বছরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক উত্থান-পতনের নাটকীয়তা এবং তাঁর নাম-অবদান মুছে ফেলার, চাপা দেওয়ার ষড়যন্ত্র চললেও তাঁকে ইতিহাসের পাতায় বন্দী করা যায়নি। বরং স্বল্পায়ু জীবনে নানা তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকার গভীরতায় তিনি আজ বাঙালির ইতিহাসে ধ্রুব নক্ষত্রে পরিণত হয়েছেন। আজকের দিনেও রাজনীতিতে, রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনিই দিশারি, পথনির্দেশক। মৃত্যু তাঁকে থামাতে পারেনি, ইতিহাস তাঁকে বন্দী করতে পারেনি।

সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লে বালক মুজিব যখন কলকাতায় চিকিৎসা শেষে প্রায় তিন বছর বাড়িতে কাটান, তখন সেই ১৯৩৪-৩৬ সালে বাংলায় স্বদেশি আন্দোলনের জোয়ার চলছে। আত্মজীবনীতে লিখেছেন পরে, ‘স্বদেশী আন্দোলন তখন মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের ঘরে ঘরে।’ আর বিশ্রামে থাকা বালকের কী কাজ থাকতে পারে?—‘লেখাপড়া নেই, খেলাধুলা নেই, শুধু একটিমাত্র কাজ, বিকেলে সভায় যাওয়া।’ সেই সময় স্বদেশি নেতাদের আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। তবে নেতা হিসেবে বালকের মন জয় করেছিলেন একজন, নেতাজি সুভাষ বসু—‘স্বাধীনতা আনতে হবে, আমিও সুভাষবাবুর ভক্ত হতে শুরু করলাম।’ সুভাষ বসু এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এ দুই নেতার ওপর বড় হয়েও তাঁর আস্থা ও শ্রদ্ধা ছিল গভীর। এর মূল কারণ তাঁদের রাজনৈতিক ভাবনার মধ্যে তরুণ মুজিব হিন্দু সমাজের পাশাপাশি মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য বিবেচনা দেখতে পেয়েছিলেন। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির চেতনা তাঁকে শৈশবেই আকৃষ্ট করেছিল। স্বদেশি অন্য নেতাদের মধ্যে এই ঔদার্যের অভাব তাঁকে পীড়িত করেছিল। আত্মজীবনীতে লিখেছেন—‘এই সকল নিঃস্বার্থ স্বাধীনতা সংগ্রামী ও ত্যাগী পুরুষরা ইংরেজের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সাথে সাথে (যদি) হিন্দু ও মুসলমানের মিলনের চেষ্টা করতেন এবং মুসলমানদের উপর যে অত্যাচার ও জুলুম হিন্দু জমিদার ও বেনিয়ারা করেছিল, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন, তাহলে তিক্ততা এত বাড়ত না।’

মুসলমান প্রজাদের ইংরেজ শাসক ও জমিদার-বেনিয়াদের হাতে দ্বিমুখী অত্যাচারের শিকার হতে দেখে তরুণ মুজিব পাকিস্তানকে একটি সমাধান মনে করেছিলেন। একপর্যায়ে তিনি মনপ্রাণ দিয়েই পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হন এবং মুসলিম লীগের সার্বক্ষণিক কর্মী হয়ে ওঠেন। লিখেছেন তিনি—‘তখন রাজনীতি শুরু করেছি ভীষণভাবে, সভা করি, বক্তৃতা করি।...শুধু মুসলিম লীগ আর ছাত্রলীগ। পাকিস্তান আনতেই হবে, নতুবা মুসলমানদের বাঁচার উপায় নেই।’

বালক বয়সেই তিনি হিন্দু ও মুসলমানের মিলন ও শা‌ন্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা ভেবেছেন। আর যখন পাকিস্তান ছাড়া মুসলমানদের বিকাশের পথ খুঁজে পাননি তখনো কিন্তু এই তরুণ কর্মী অন্ধভাবে নেতাদের অনুসরণ করেননি। অচিরেই তাঁর মনে হলো মুসলিম লীগ দলের প্রতিষ্ঠাতা জমিদার ও খানবাহাদুর নবাবদের পকেটের সংগঠন হয়ে থাকছে।

এদিকে নেতাজি সুভাষ বসু বা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ সম্পর্কে তাঁর ভক্তি ছিল অন্তরের, বাস্তবে পেলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে। অভিজাত পরিবারের বিলেতফেরত এই রাজনীতিক পশ্চিম থেকে গণতন্ত্রের দীক্ষা নিয়ে এসেছেন। তাঁর মধ্যে উদীয়মান রাজনৈতিক নেতা মুজিব এক অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনার সাক্ষাৎ পেলেন। তাই তিনি ও তাঁর বন্ধুরা চাইলেন শহীদ সাহেবের নেতৃত্বে ‘মুসলিম লীগকে জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে।’ মুসলিম লীগের নেতৃত্বে অভিজাতদের একটি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী থাকলেও বাংলায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমকে সামনে রেখে তুলনামূলক প্রগতিপন্থী দলও সক্রিয় ছিল। তবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় শহীদ সাহেবও জিন্নাহ, লিয়াকত আলী ও তাঁদের গোষ্ঠীর প্রাধান্যকে খর্ব করতে পারেননি। এর ফলে, শেখ মুজিবের ভাষায়—‘পাকিস্তান হওয়ার সাথে সাথেই এই খানবাহাদুর ও ব্রিটিশ খেতাবধারীরা তৎপর হয়ে উঠে ক্ষমতা দখল করে ফেলল।’

পাকিস্তানের গোড়াতেই নিবেদিতপ্রাণ কর্মী মুজিবের মনে বড় আঘাত দিয়েছিল দুটি বিষয়—বাংলা ভাগ এবং হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, যার জের ধরে নতুন দেশ তথা মাতৃভূমি ছেড়ে হিন্দুরা দলে দলে দেশত্যাগী হচ্ছিল। তিনি চেয়েছিলেন উপমহাদেশ দুটি রাষ্ট্রে ভাগ হলেও ‘ভারতবর্ষেও মুসলমান থাকবে এবং পাকিস্তানেও হিন্দুরা থাকবে।’ উভয় দেশের সংখ্যালঘুরা সমান অধিকার ভোগ করবেন। কিন্তু বাস্তবে, অন্তত পাকিস্তানে, দিনে দিনে এর বিপরীত ধারাই প্রকট হয়ে উঠেছিল।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুজিব ভেবেছিলেন—‘পাকিস্তান কায়েম হয়েছে, আর চিন্তা কি? এখন ঢাকায় যেয়ে ল’তে ভর্তি হয়ে কিছুদিন মন দিয়ে লেখাপড়া করা যাবে।’ কিন্তু সদ্য স্বাধীন দেশে সমমনা বিভিন্ন দলের কনফারেন্স করতে গিয়ে তাঁরা টের পেলেন কেন্দ্রীয় সরকার এটা সুনজরে দেখছেন না। মুজিবের মনে হলো, ‘ন্যাশনাল গার্ড ও মুসলিম লীগ কর্মীদের মধ্যে যে প্রেরণা ছিল পাকিস্তানকে গড়বার জন্যে তা ব্যবহার করতে নেতারা পারলেন না।’ তারপর রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে তো বোঝাই গেল কেন্দ্রীয় সরকার ও পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের মনোভাব। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে আন্দোলনের প্রথম দিনেই, অর্থাৎ ১১ মার্চ ১৯৪৮ সালে অন্য আরও অনেকের সঙ্গে শেখ মুজিবও গ্রেপ্তার হলেন। সেবারে চার দিন জেল খাটলেন, কিন্তু পাকিস্তানি নেতৃত্বের ওপর আস্থা টলে গেল। সেটা একেবারেই যেন ধ্বংস হয়ে গেল পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহর বক্তব্য ও ভূমিকায়। অন্য সংগঠন না থাকায় তাঁরা ছাত্রলীগের মাধ্যমেই কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর চিন্তা করেছিলেন। তখনো তরুণ মুজিব বাস্তব বুদ্ধিতেই কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের চিন্তাভাবনাকে সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকার কারণে গ্রহণ করতে চাননি। ফলে যুবলীগের প্রস্তুতিতে থেকেও তিনি তাতে যুক্ত হননি। জেল-জুলুম সহ্য করে ভাষা আন্দোলনে যেমন ভূমিকা রেখেছেন, তেমনি জেলে থেকেই যুগ্ম সম্পাদকের পদ গ্রহণ করলেন মুসলিম লীগের পাল্টা সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের। এই সময়ে কারাবন্দী মুজিব মনে করছেন—‘পাকিস্তান হয়ে গেছে, সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা সুষ্ঠু ম্যানিফেস্টো থাকবে।’

অসাম্প্রদায়িকতার উন্মেষ

ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে দেশের শি‌ক্ষিত সমাজের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক বাঙালিত্বের বোধের উন্মেষ ঘটেছিল। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ভাষা আন্দোলনকে ভারতের ষড়যন্ত্র এবং এর সংগঠকদের মধ্যে ভারতের এজেন্ট ঢুকে পড়েছে বলে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার মধ্যে প্রতিবাদী জোশ, পারস্পরিক সংহতি ও ঐক্য, অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনাকে জোরদার করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ছাত্রলীগ ও পরে আওয়ামী লীগ থেকে সাম্প্রদায়িক পরিচয় মুছে ফেলা হয়।

অল্প কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় তরুণ জননেতা উপলব্ধি করেছিলেন, ‘এদেশে রাজনীতি করতে হলে ত্যাগের প্রয়োজন আছে।’ আর সাহস ও পরিশ্রমের, নেতৃত্ব ও সততার পরীক্ষায় তিনি তো আগেই উত্তীর্ণ। এবার আমরা দেখি এক অসাধারণ তরুণ সংগঠক মুজিবকে, যিনি প্রয়োজনে তাঁর রাজনৈতিক শিক্ষক আবুল হাশিম, গুরু শহীদ সোহরাওয়ার্দী বা সংগঠনের প্রথম সভাপতি ও শ্রদ্ধাভাজন নেতা মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশে, প্রয়োজনে স্বতন্ত্র অবস্থান নিতে পিছপা হচ্ছেন না। ভাসানী দল ছাড়লেন, সম্পাদক শামসুল হক অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তখন সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে মুজিব প্রকৃতপ‌ক্ষে প্রদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের প্রধান সংগঠক ও নেতা হয়ে ওঠার পথে পা বাড়ালেন।

তার আগেই আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতেই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলা হয়েছিল। আর ১৯৫০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত গ্র্যান্ড ন্যাশনাল কনফারেন্সে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হয়। তবে তখনো নেতারা পাকিস্তান কাঠামোর মধ্যেই সমাধান চাইছেন। স্বাধীনতার পাঁচ বছরের মধ্যে চারবার জেল খাটার অভিজ্ঞতার পরও তাঁর প্রতিজ্ঞা ‘যে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলাম সেই পাকিস্তানই করতে হবে, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম।’

কিন্তু লিয়াকত আলীর মৃত্যুর পর দুর্বল প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের ওপর চাপ প্রয়োগ করে দ্রুত পাকিস্তানের শাসনভার পাঞ্জাবি আমলাতন্ত্র কু‌ক্ষিগত করে নেয়। তারা ছিল সম্পূর্ণ বাঙালিবিদ্বেষী, যা বিচ্ছিন্ন ও ভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতির দুটি প্রদেশ নিয়ে এক দেশ হিসেবে সমভাবে বিকশিত হওয়ার পরিপন্থী। পরবর্তী সেনাশাসনও তাদের এই প্রবণতা থেকে কেন্দ্রীয় সরকারকে মুক্ত করতে পারেনি। বরং দিনে দিনে তা কেবল জোরদার হয়েছে।

আবার এদিকে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক তৎপরতা চালানো এবং যুক্তফ্রন্ট গঠনের অভিজ্ঞতায় তিনি দেশের প্রবীণ রাজনীতিকদের নৈতিক ও আদর্শিক দৃঢ়তার অভাব দেখতে পেলেন। আর যুক্তফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের নানা ষড়যন্ত্র যখন তুঙ্গে, যখন সরকারের পতন হচ্ছে, তখনো এঁদের ভূমিকায় মুজিব ভীষণ হতাশ এবং ক্ষুব্ধ। হতাশ ও ক্ষুব্ধ মুজিবের তিক্ত উপলব্ধি— ‘অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদের সাথে কোনোদিন একসাথে হয়ে দেশের কোনো কাজে নামতে নেই। তাতে দেশ সেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়।’

এইবার শেখ মুজিব একাই পথ চলার জন্য তৈরি হতে শুরু করলেন। মাওলানা ভাসানী আগেই তাঁকে ছেড়ে নতুন দল গড়েছেন আর আইয়ুবের সামরিক শাসনের মধ্যেই প্রয়াত হয়েছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। শামসুল হক অসুস্থ, অন্ধ আবুল হাশিম তখন নিষ্ক্রিয়। অন্য নেতাদের সম্পর্কে তাঁর অভিমত আমরা তো জেনে গেছি।

শেখ মুজিবের জীবনে ৪৬ থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত, বলা যায়, প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যেও রাজসিক উত্থানের কাল। তাঁর ব্যক্তিচরিত্র ও মানসগঠনের যে পরিচয় আমরা পেলাম, তাতে ১৯৬৬-তে ছয় দফা প্রদান ও ১৯৭০-এর ডিসেম্বরের নির্বাচন পর্যন্ত সময়ের অগ্রযাত্রা বুঝে নিতে কষ্ট হয় না। এই পর্বের সূচনা হয়েছে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিসহ ছয় দফা উপস্থাপনের পর থেকে এবং চলেছে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে পূর্ব বাংলায় ১৬৯টির মধ্যে ১৬৭টি আসনে আওয়ামী লীগের বিজয়ে তাঁর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবিদার হওয়া অবধি। এরপর তাঁর উত্থান একটা পর্যায়ে পৌঁছায় এবং একভাবে তা অব্যাহতও থাকে।

কেন্দ্রীয় সরকার ছয় দফার বিরুদ্ধতা করে গেছে। বরং বিকল্প হিসেবে দুই প্রদেশের রাজনৈতিক জোট পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টে (পিডিএম) আওয়ামী লীগের যোগদান প্রায় নিশ্চিত করেই ফেলেছিল সরকার। কিন্তু বন্দী মুজিব ছয় দফার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আপসে রাজি হননি। দলের কেন্দ্রীয় সভাপতিসহ পূর্ব পাকিস্তানের কিছু নেতা এতে যোগ দিয়েছিলেন। তবে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগে বড় কোনো ভাঙন ঘটেনি। বরং এ সময়ে ছাত্রসমাজের মধ্যে পাকিস্তান সরকারবিরোধী মনোভাব জোরদার হয়েছে। ফলে ছেষট্টির ৭ জুনের হরতাল পুলিশের ব্যাপক অভিযান, গুলিতে ১০-১২ জনের প্রাণহানি এবং আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতা-কর্মীর গ্রেপ্তার সত্ত্বেও সফল হয়েছে এবং পরবর্তী আন্দোলন হয়েছে বেগবান। এ সময় মাওলানা ভাসানী চীনের প্রতি পক্ষপাতবশত আইয়ুবকে বিব্রত না করার পথ ধরেছেন, কমিউনিস্টদের বড় পক্ষÿদ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে ছয় দফার প্রতি সমর্থন দিল। ছয় দফার আন্দোলন দিন দিন বেগবান হয়েছে এবং সমকালীন সব বাঙালি নেতাকে ছাপিয়ে এই সময় বঙ্গবন্ধুই জনগণের নেতায় পরিণত হয়েছেন। মানুষ স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে, এই একজন নেতা, যিনি আপস করেননি, দোলাচলে ভোগেননি কখনো। ফলে তাঁর প্রতি সবার আস্থা ক্রমেই বেড়েছে।

তিনি কারাগারের রোজনামচায় স্পষ্টভাবে লিখেছেন—‘ছয় দফা জনগণের দাবি। পূর্ব পাকিস্তানের বাঁচা মরার দাবি। এটাকে জোর করে দাবান যাবে না।’

১৯৬৮ সালে যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁকে জড়ানো হয়, তখন বোঝা গেছে তাঁর প্রতি গণমানুষের ভালোবাসা ও আস্থা কত তীব্র। ছাত্রসমাজ ক্রমেই স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্রের দাবিতে পরস্পরের কাছাকাছি এসে বিভিন্ন সংগঠন মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১১ দফা দাবি উত্থাপন করে। ৫ জানুয়ারি ১৯৬৯ সালে ৬ দফা ও ১১ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ছাত্ররা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনের ব্যাপকতা ও তীব্রতা এত বেশি ছিল যে সেনাবাহিনী নামিয়ে, কারফিউ দিয়েও তা বন্ধ করা যায়নি। এ সময় সুযোগ বুঝে জুলফিকার আলী ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানেও আইয়ুববিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। দ্বিমুখী চাপের মধ্যে পড়ে শেষ পর্যন্ত সরকারকে ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবসহ সব অভিযুক্তকে মুক্তি দিতে হয়। পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) প্রায় ১০ লাখ ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

বঙ্গবন্ধু একজনই, তিনিই তখন এই বাংলার মুখপাত্র, জনগণের নেতা। আইয়ুবের পদত্যাগ ও জেনারেল ইয়াহিয়ার ক্ষমতা গ্রহণ এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচন বঙ্গবন্ধুর ধারাবাহিক সাফল্যের ইতিহাস। তত দিনে আসলে বাংলাদেশ সময়ের ব্যাপারমাত্র। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীর সভায় বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন—‘জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি আজ হইতে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম “পূর্ব পাকিস্তান”-এর পরিবর্তে শুধুমাত্র “বাংলাদেশ”।’ সেই থেকে মানুষের মুখে মুখে ‘বাংলাদেশ’ নামটি ধ্বনিত হয়েছে। ছাত্র-জনতা স্লোগান দিয়েছে—এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ।

জনগণের নেতা

১৯৭০-এর নির্বাচনে বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তানে) জাতীয় পরিষদের ১৬৯টির মধ্যে ১৬৭টি আসনে এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০-র মধ্যে ২৮৮ আসনে জয়ী হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের সমগ্র জনগণের নির্বাচিত নেতা ও মুখপাত্রে পরিণত হলেন। তিনিই দেশের মানুষকে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, তাদের স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছেন, এক অভূতপূর্ব ঐক্যডোরে তাদের বেঁধেছেন। নির্বাচনের ফলাফল জানার পর থেকেই বাংলার মানুষ অধীর অপেক্ষায় ছিল চূড়ান্ত ডাকের জন্য। সত্তরের শুরু থেকে উৎকণ্ঠা এবং উৎসাহে জনগণ টগবগ করেছে। এমন সময় আগুনে ঘৃতাহুতির মতো হলো ১ মার্চ ইয়াহিয়ার ভাষণ—পার্লামেন্ট বন্ধ ঘোষণা, বঙ্গবন্ধুকে দোষারোপ এবং সৈন্যবাহিনী নামানোর ঘোষণা ছাত্র-জনতাকে দেশের মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছে আরও বেশি, রাজপথেই নেমে এল সবাই। এই সময় হাজারো কণ্ঠে স্লোগান উঠেছে—বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। রাজপথ ছাড়ল না মানুষ, সেনা ব্যারিকেড, সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করেই চলল আন্দোলন, আত্মত্যাগ। এমনকি ছাত্র ও ছাত্রীরা যুদ্ধের প্রশিক্ষণও নিতে শুরু করে। চারদিকে মুক্তিযুদ্ধের সাজ সাজ রব। আর তার মধ্যে নেতার চূড়ান্ত নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকল জাতি। সারা দেশে সব বাড়িতে তত দিনে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উঠে গেছে।

এই প্রেক্ষাপটেই এল সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ঘোষিত হলো মুক্তির বারতা, এল স্বাধীনতার ডাক—এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। তারপর প্রস্তুতির পালা, পাকিস্তানের আঘাতের অপেক্ষায় থাকা।

পাকিস্তানি জান্তা সরকারের দিক থেকে সেটা যে চূড়ান্ত সর্বাত্মক সামরিক অভিযান হবে, তা কেউ ধারণা করতে পারেনি। কিন্তু মানসিকভাবে যে প্রস্তুতি দেশবাসী নিয়েছিল, তাতে পেছানোর প্রশ্ন ছিল না, আপস বা আত্মসমর্পণের চিন্তাও কারও মাথায় আসেনি। নেতা মুক্ত না বন্দী হয়েছেন, সেটা তখন আর প্রশ্ন ছিল না, তাঁর প্রদর্শিত পথে চলা, উচ্চারিত ঘোষণা বাস্তবায়নই মানুষের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে ওঠে। একটি জাতির জন্মে, একটি রাষ্ট্রের আবির্ভাবে তিনিই ধাত্রী, তিনিই এর রূপকার।

২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পাঠিয়ে দিলেন চট্টগ্রামের নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে। পাকিস্তানি বাহিনীর শেলিং ও মর্টারের আঘাতের মধ্যেই ২৬ মার্চ দুপুরে চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সম্পাদক এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করলেন, চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিশন থেকে। ওই সন্ধিক্ষণে পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙালি সৈনিকদের অনেকেই স্বেচ্ছায় আর বাকিরা বাধ্য হয়ে বিদ্রোহ করে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে সত্যিকারের রণাঙ্গনের মুক্তিযুদ্ধে পরিণত করলেন। সশস্ত্র যুদ্ধের সূচনা এবং তাতে বাঙালি সেনাদের অংশগ্রহণের বারতা স্পষ্টভাবে জানিয়ে সবার মনোবল চাঙা রাখার জন্য তৎকালীন মেজর জিয়াকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা আবারও পাঠ করানো হয় কালুরঘাটে স্থাপিত স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে। দলে দলে ছাত্র-জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক সহায়তায় কাজে লেগে পড়লেন।

পরবর্তীকালে বিভিন্ন বাঙালি সেনা কর্মকর্তার লেখায় আমরা দেখছি কেউ ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার অপেক্ষায় প্রস্তুত ছিলেন আর কেউবা ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে পরিস্থিতি বুঝে বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের নিয়ে বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়তে এতটুকু দ্বিধা করেননি। এভাবে সারা দেশে সর্বত্র সিভিল-সামরিক কর্মকর্তা এবং সেনা জওয়ানরা একইভাবে যুদ্ধে যাওয়ার একটি কারণ বঙ্গবন্ধুর অবিসংবাদী অবস্থান এবং তাঁর নেতৃত্বের দৃঢ়তা ও ধারাবাহিকতায় আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠা। বাঙালি প্রথম এমন একটি সশস্ত্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল। তত দিনে বঙ্গবন্ধু বাঙালি মুক্তির প্রতীক, মহান নেতা, ইতিহাসের অনন্য নায়ক। তারা অনেকবার জেলের তালা ভেঙে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে আনার ধ্বনি দিয়েছে। যুদ্ধের সময় তাদের মুখে ছিল জয় বাংলা ধ্বনি আর অন্তরে ধ্বনিত হচ্ছিল নেতার ভাষণের প্রত্যয়—এবারে স্বাধীনতা এবং মুক্তির সংগ্রাম। মুজিব তখন স্বাধীনতা ও মুক্তির আরেক নাম—এমন এক দীপ্যমান প্রতীক বা সংগ্রামী চেতনার শিখা অনির্বাণ, যা বিজয় না হওয়া পর্যন্ত জীবন বাজি রেখে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অফুরন্ত প্রেরণার উৎস। যত দিন এ দেশ, এ মাটির প্রাণ পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বহমান থাকবে, তত দিন বঙ্গবন্ধুর এই কীর্তিও থাকবে অক্ষয় আর নেতাও থাকবেন স্মৃতিতে অমর।

আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক