বিজ্ঞাপন
default-image

ওয়াশিংটন পোস্ট-এ প্রকাশিত লন্ডনের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর সাংবাদিক সাইমন ড্রিংয়ের এই লেখাটি ছিল একাত্তরের গণহত্যা সম্পর্কে বহির্বিশ্বে প্রচারিত প্রথম কোনো প্রতিবেদন

পূর্ব পাকিস্তনের জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সব বড় নেতাকেই গারদে ঢোকানো হয়েছে।

প্রথম সারির রাজনৈতিক কর্মীদেরও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর শেখ মুজিবের আন্দোলনের সমর্থক দুটো পত্রিকার কার্যালয় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার রাস্তার যে ট্যাংক নেমে আসে, সেগুলোর প্রধান লক্ষ্য ছিল ছাত্ররা। অবস্থাদৃষ্টে তা-ই মনে হচ্ছে।

তিন ব্যাটালিয়ন সেনা ঢাকা আক্রমণে অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে একটি ছিল আর্মড, একটি আর্টিলারি ও আরেকটি পদাতিক। তারা রাত ১০টার পরপরই গ্যারিসন ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। রাত ১১টার মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। যাঁরা তখন রাস্তায় অস্থায়ী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছিলেন, তাঁরাই প্রথম হতাহত হন। তাঁরা গাড়ি উল্টে দিয়ে, গাছের গুঁড়ি ফেলে, আসবাব ফেলে ও সিমেন্টের পাইপ ফেলে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিলেন।

শেখ মুজিবুর রহমানকে ফোনে জানানো হয়েছিল যে কিছু একটা ঘটছে, কিন্তু তিনি তাঁর বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। ‘আমি যদি অন্য কোথাও লুকাই, তাহলে ওরা আমার খোঁজে পুরো ঢাকা শহরকে জ্বালিয়ে দেবে,’ তিনি তাঁর এক সহযোগীকে এ কথা বলেন। সহযোগী সেই ব্যক্তি গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হয়েছেন।

ছাত্রদেরও সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু যাঁরা তখনো রাস্তায় ছিলেন, তাঁরা ভেবেছিলেন, তাঁদের হয়তো বড় জোর গ্রেপ্তার করা হবে। মধ্যরাতের পর এক কলাম সেনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহূত মার্কিন এম-২৪ ট্যাংক নিয়ে দ্রুত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পড়ে। তারা ব্রিটিশ কাউন্সিলের লাইব্রেরি দখল করে সেখান থেকে আশপাশের হলগুলোতে শেল নিক্ষেপ করে।

আমি জানতে পারি, ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল ইকবাল হলের প্রায় ২০০ ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে। এই হল ছিল সরকারবিরোধী জঙ্গি ছাত্রদের প্রধান কার্যালয়। দু দিন পর, মৃতদেহগুলো হলের কক্ষে পুড়ছিল, কিছু বাইরে পড়ে ছিল, আর তার চেয়ে বেশি পার্শ্ববর্তী লেকের পানিতে ভাসছিল। চারুকলার এক ছাত্রের মৃতদেহ তাঁর ব্যবহূত ইজেলের ওপর লটকানো ছিল। মনে হচ্ছিল, তিনি যেন হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছেন

সেনারা বহু মৃতদেহ সরিয়ে নেয়। রক্তের যে ধারা হলে করিডরে বেয়ে যাচ্ছিল, তাতে বোঝাই যায় যে ৩০টি মৃতদেহ ওখানে পড়ে আছে তার চেয়ে আরও অনেক বেশি ছাত্র ওখানে মারা পড়েছে।

আরেকটি হলে সেনারা তড়িঘড়ি করে খোঁড়া গণকবরে বহু মৃতদেহ কবর দেয়। এরপর বুলডোজার দিয়ে সেই গণকবর মিলিয়ে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের মানুষের ঘড়বাড়িতে আগুন দেয় পাকিস্তানি সেনারা। তারা রেললাইনের গা ঘেঁষে প্রায় ২০০ গজ লম্বা একটি বস্তিকে গুঁড়িয়ে দেয়।

পার্শ্ববর্তী বিপণিবিতানেও আগুন ধরিয়ে দেয় সেনারা। দু দিন পর যখন এসব জায়গা পরিদর্শন করা সম্ভব হলো, তখন দেখা গেল এসব বিপণিবিতানের অনেক ছোট দোকানদার মেঝেতে এমনভাবে পড়ে আছেন যে মনে হচ্ছিল, তাঁরা ঘুমিয়ে আছেন। তাঁদের কম্বল কাঁধের ওপর উঠে গেছে। এই শহরেই ঢাকা মেডিকেল কলেজে মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়েছিল। একটি মসজিদও খুব মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন হামলা করা হয়, তখন আরেক সারি সেনা শহরের আরেক দিকে পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের সদর দপ্তর রাজারবাগে হামলা করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রথমে ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়। এরপর পুলিশ সদস্যরা যেখানে ঘুমিয়ে ছিলেন সেনারা সেখানে প্রবেশ করে সেই ভবনগুলো মাটির সঙ্গে সমান করে দেয়। যে পরিমাণ গুলি তারা বর্ষণ করে, তাতে আগুন লেগে যায়। রাজারবাগের অপর প্রান্তের মানুষ নির্দিষ্ট করে বলতে পারেনি, কতজন পুলিশ সদস্য সেখানে মারা গেছেন। কিন্তু যে ১১০ পুলিশ সদস্য সেখানে ছিলেন, তার মধ্যে খুব অল্পসংখ্যকই পালিয়ে বাঁচতে পেরেছেন।...

নীরব শহর

ভোরের কিছু সময় আগে গোলাগুলি বন্ধ হয়ে আসে। সূর্য উঠলে শহরে এক ভীতিকর নীরবতা নেমে আসে। এ যেন এক মৃত শহর, পরিত্যক্ত। শুধু কাকেদের কা কা রব ও মাঝেমধ্যে সেনাদের টহলরত একটি বা দুটি ট্যাংকের ইঞ্জিনের একটানা ঘড়ঘড় শব্দ ছাড়া আর কোনো জীবিত কিছু এ শহরে ছিল না।

দুপুরের দিকে সেনারা আবার হঠাত্ করে কোনো সতর্কসংকেত ছাড়াই পুরোনো শহরের ভেতর ঢুকে পড়ে। প্রায় ১০ লাখ মানুষ শহরের এ অংশের ঘিঞ্জি ও আঁকাবাঁকা গলিতে বসবাস করে।

পরবর্তী ১১ ঘণ্টায় এই সেনারা এই ‘পুরোনো শহরে’ তাণ্ডবলীলা চালায়। শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে একনিষ্ঠ কিছু সমর্থক এখানে বসবাস করতেন। ইংলিশ রোড, ফ্রেঞ্চ রোড, নয়াবাজার, সিটি বাজার প্রভৃতি এলাকাকে আগুনে পুড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়।

ফ্রেঞ্চ রোড-নয়াবাজার অঞ্চলের একজন বৃদ্ধ লোকের ভাষ্যমতে, ‘হঠাত্ করে রাস্তার শেষ মাথায় তাদের দেখা গেল। এরপর তারা সব বাড়িতেই গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগোতে থাকে।’

প্রথম সারির ইউনিটটির পেছনে আরেকটি ইউনিট গ্যাসোলিনের ক্যান নিয়ে আসছিল। যারা পালানোর চেষ্টা করে, তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। যারা বাড়ির ভেতরেই ছিল, তাদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। প্রায় ৭০০ নারী, পুরুষ ও শিশুকে সেদিন হত্যা করা হয় বলে আমাকে জানানো হয়েছে।

আধা বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট আরও প্রায় তিনটি এলাকায় এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। পুরোনো শহরের পুলিশ স্টেশনেও হামলা চালানো হয়।

৩০ মার্চ ১৯৭১

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১৪ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত