বিশ্বদরবারে আমাদের সংগ্রাম, স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, সর্বোপরি আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের দৃঢ়প্রত্যয়ের কথা পৌঁছে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ; সেই ভাষণের ইউনেসকোর স্বীকৃতি মাত্র কয়েক দিন আগেই উদ্যাপন করলাম।
এই ঐতিহাসিক ভাষণের মাত্র দুটি শব্দ সব কথা বলে দিয়েছে: ‘মুক্তি’ ও ‘স্বাধীনতা’। আমাদের জনগণের অধিকার নিশ্চিত করতে সক্ষম একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অর্জনের লক্ষ্যে চালিয়ে যাওয়া সংগ্রামের ধারাভাষ্য ছিল এই ভাষণ।
এই গণতন্ত্রের জন্য বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম করেছিলেন, এই গণতন্ত্রের জন্যই আমরা মুক্তিযোদ্ধারা জীবনবাজি রেখেছিলাম। ১৯৭২ সালে রচিত আমাদের প্রথম সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় নীতির বনিয়াদ যে চারটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তারও অন্যতম হলো গণতন্ত্র।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা পাওয়ার পর ৪৭ বছর কেটে গেলেও আমরা এখনো বাংলাদেশে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছি। আমাদের শুরুটা ভালো হওয়া সত্ত্বেও সুদৃঢ় গণতন্ত্র-আকাঙ্ক্ষাসিক্ত একটি নতুন রাষ্ট্রের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধানকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে আমাদের সংবিধানপ্রণেতাগণ অন্যদের সংবিধান থেকে বেছে বেছে সর্বোত্তম উপাদানগুলো নিয়েছেন এবং সেগুলোকে সন্নিবেশিত করেছেন। ১৯৭৩ সালে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক একটি সরকার গঠনের মাধ্যমে আমাদের গণতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষা আরও শক্তিশালী হলো।
১৯৭৫ সালের গোড়ার দিকে একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা ছিল বড় বিচ্যুতি। গণতন্ত্রের সুদীর্ঘ যাত্রায় বঙ্গবন্ধু সারা জীবন যে অবস্থান নিয়েছিলেন, বাকশাল ছিল মৌলিকভাবেই তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এরপর পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ ভুল পথে নিয়ে গেল। সামরিক শাসন এবং জনগণের প্রতিনিধিত্ব ও জবাবদিহিহীন সরকার এল। তার চেয়েও ভয়ানক ব্যাপার হলো, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৪ বছর ধরে চালিয়ে যাওয়া আমাদের সংগ্রামকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে সুকৌশলে নতুন একটি ভাষ্য বোনা শুরু হলো। এই বানানো ভাষ্যই আমাদের সংগ্রামের ইতিহাসের উল্টো ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে।
গণ-আন্দোলনে স্বৈরাচার পতনের মধ্য দিয়ে আমাদের গণতান্ত্রিক যাত্রা দ্বিতীয়বারের মতো সুযোগ পাওয়ার আগে পর্যন্ত একের পর এক সামরিক একনায়ক এসেছে।
তাহলে ১৯৯১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আমাদের গণতন্ত্রের যাত্রাটা কেমন?
আমার দৃষ্টিতে গণতন্ত্রের প্রশ্নে আমরা তুরস্ক, মিসর ও থাইল্যান্ডের চেয়ে অনেক ভালো করছি। এই দেশগুলো কর্তৃত্ববাদ এবং সরাসরি সামরিক শাসনের কর্কশ উত্থান প্রত্যক্ষ করেছে। শেষের দেশ দুটিতে সেনাবাহিনী তথাকথিত ‘গণতন্ত্রের অভিভাবক’ হিসেবে সংসদে স্থায়ী সংরক্ষিত আসন দাবি করেছে। আমরা মিয়ানমার এবং দেশটির সেনাবাহিনীকে চিনি। কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুনসেন আসন্ন নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলকে নিষিদ্ধ করার জন্য বিচার বিভাগকে ব্যবহার করেছেন। নিজের ক্ষমতা সম্প্রসারণের জন্য ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনী সরকারের নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নাড়ে।
অন্যদিকে দুতার্তের শাসনাধীনে থাকা ফিলিপাইনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড দেশটির আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে এতটাই ক্ষমতা দিয়েছে যে সেখানে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার বলে কিছু নেই।
চীনে সি চিন পিংয়ের ক্ষমতাকালের সীমা তুলে দেওয়া চীনের নিজস্ব জনগণের শাসনব্যবস্থার জন্যই আশাবহ বিষয় হতে পারছে না।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, আমরা স্বাধীনতাযুদ্ধ করার এবং সামরিক শাসনের (পাকিস্তান ও বাংলাদেশ—দুই আমলেই) বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার হৃদয়গ্রাহী রেকর্ড থাকার দাবি করতে পারি; কিন্তু দুঃখজনকভাবে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলা, গণতন্ত্রকে দৃঢ় করার সংস্কৃতি চালু এবং তাকে লালন করার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার রেকর্ড আমরা দাবি করতে পারি না।
আমাদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, গণতন্ত্র এখন শুধু নির্বাচনকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। আমরা কেবল ভোটার তালিকা, সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণ, ভোটকেন্দ্র নজরদারি—এসব নিয়েই তর্ক-বিতর্ক করেছি; কিন্তু নির্বাচিত সরকারকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক রাখা যায় কীভাবে, তা নিয়ে কদাচিৎ আলোচনা করেছি।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর রাখার মৌলিক পূর্বশর্ত হলো রাষ্ট্রের তিন প্রধান শাখা—আইন পরিষদ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার সুষ্ঠু বণ্টন করা এবং এই অঙ্গগুলোর একটিও যাতে বিধিবহির্ভূত ক্ষমতা ভোগ করতে না পারে, সে জন্য একটি জোরালো ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ ব্যবস্থা জারি রাখা।
এর উল্টো চিত্র হিসেবে আমরা আইনসভা ও বিচার বিভাগের বিপরীতে নির্বাহী শাখার উত্তরোত্তর শক্তিশালী হয়ে উঠতে দেখেছি। এর ফলে সরকার এতটাই ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছে যে বাস্তবিক অর্থে তাদের হাতে অসীম ক্ষমতা চলে গেছে।
যদিও আমাদের নির্বাচিত সংসদ এবং একটি বিচার বিভাগ ছিল, যা শক্তিশালী অঙ্গ হিসেবে কাজ করতে পারত এবং গণতন্ত্রকে ব্যাপকভাবে জোরালো করতে পারত। পরিতাপের বিষয়, সেটি হয়নি।
নির্বাহী শাখার উত্থান এবং তার আজকের এই পর্যায়ে আসার পেছনে লম্বা ইতিহাস রয়েছে। বঙ্গবন্ধু থেকেই এই উত্থানের শুরু। সমসাময়িক অন্য সবার চেয়ে তাঁর ব্যক্তিত্ব, মর্যাদা, মহিমা, ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার ও জনপ্রিয়তার উচ্চতা এতটাই বেশি ছিল যে তাঁর হিমাদ্রিশিখরতুল্য ব্যক্তিত্বের সামনে প্রতিষ্ঠানগুলো স্তিমিত হয়ে যেত।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতায় বসা সামরিক একনায়ক সরকার তাদের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা আরও বাড়িয়েছে এবং আইনসভা ও বিচার বিভাগের ভূমিকাকে খর্ব করেছে।
১৯৯১ সালে ওই গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং সে বছরই সংসদীয় সরকার পুনরায় চালু হওয়ার পর বাংলাদেশ তার সরকারের তিনটি শাখার সব কটিকে পূর্ণ সাংবিধানিক ক্ষমতা ভোগ করতে দেওয়ার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার সবচেয়ে বড় সুযোগ পেয়েছিল।
গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার বিষয়ে আমাদের সামনে সত্যিকারের সুযোগ এসেছে ১৯৯১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যবর্তী সময়ে। ১৯৯১ সালে জেনারেল এরশাদের পতন দিয়ে এই সুযোগের শুরু এবং এখনো সে সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এই সুযোগ কাজে লাগানো সম্ভব হলো না।
আমার মনে হয়, এটি সম্ভব না হওয়ার পেছনে চারটি কারণ আছে:
প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক পরিবেশের অনুপস্থিতি এবং দলীয় প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া, জেনারেল এরশাদের মতো নেতাদের উত্থান। দল কীভাবে চলবে, সে বিষয়টি তাঁদের সিদ্ধান্তে চলে এবং সে সিদ্ধান্ত নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না। এর ফলে দলের নীতিনির্ধারকসহ অন্য সব নেতা এক নেতার অধীন হয়ে পড়েন এবং দলের মধ্যে মোসাহেবি ও ব্যক্তিপূজার সংস্কৃতি তৈরি হয়। স্বাভাবিকভাবেই তখন সমন্বিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সংস্কৃতি অপসৃত হয়ে শেষ পর্যন্ত সব ক্ষমতা এক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হয়।
দ্বিতীয় কারণটি হলো, প্রতিযোগিতা ও সহযোগিতার রাজনীতির স্থলে সংঘর্ষ ও সহিংসতার রাজনীতির উত্থান। কার্যকর সংসদীয় গণতন্ত্র কিছু বিষয়ে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী—উভয় দলের অংশীদারত্ব দাবি করে এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য এটি থাকা একটি মৌলিক পূর্বশর্ত। তার বদলে আমরা দুটি প্রধান দলের মধ্যে রাজনৈতিক সংঘাত ও অবিশ্বাস্য বিদ্বেষ উগরাতে দেখেছি। এর ফল হিসেবে আমরা আন্দোলন, হরতাল এবং তৃণমূল পর্যায়ে সহিংসতা দেখেছি।
তৃতীয় কারণটি হলো, সংসদে বিরোধী দলের নিষ্ক্রিয়তা। বিরোধী নেতারা বরাবরই আইনপ্রণেতার ভূমিকায় মনোনিবেশ না করে বারবার ওয়াকআউট করেন, অধিবেশন বয়কট করেন এবং পদত্যাগ করে সরকারকে হয়রানি করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এতে আইনপ্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সংসদ ঠিকমতো ভূমিকা পালন করতে পারছে না।
সর্বশেষ কারণ হলো, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ক্রমাবনতি এবং নির্বাহী শাখার উত্থানের রাশ টেনে ধরার চূড়ান্ত নিয়ন্তা হিসেবে তার নিজের অবস্থান ধরে রাখতে না পারা। সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে নিম্ন আদালত আলাদা করার বিষয়ে উচ্চ আদালত যে আদেশ দিয়েছেন, তার বাস্তবায়ন যেভাবে সরকার উপেক্ষা করেছে, তার মধ্যেই বিচার বিভাগের ব্যর্থতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ নিহিত।
উচ্চ আদালতে নিয়োগপ্রক্রিয়ায় সরকারপ্রধানের ভূমিকা প্রায় একচ্ছত্র রয়ে গেছে। এটি বিচার বিভাগের চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের ক্ষমতা একেবারে কমিয়ে দিয়েছে।
উপসংহারে বলতে পারি, বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন ভিন্নমতবিহীন গণতন্ত্র। সরকার যা যা করছে, সেগুলোর বিষয়ে আমাদের সবারই এখন ‘হ্যাঁ’ বলার স্বাধীনতা আছে। কিন্তু ‘না’ বলা ঝুঁকির বিষয় এবং এর জন্য পরে কী ঘটতে পারে, সত্যিই এটা এখন কারও পক্ষে আন্দাজ করা সম্ভব নয়। সংবিধান আন্দোলন ও সমাবেশ করার অধিকার নিশ্চিত করলেও শুধু সে-ই এই অধিকার পাচ্ছে, যাকে ‘অনুমতি’ দেওয়া হচ্ছে। যেগুলো করার ‘অনুমতি’ নেই, তা করলে হয়তো রাষ্ট্রবিরোধী, এমনকি ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবেও গণ্য হচ্ছে।
সুতরাং স্বাধীনতালাভের ৪৭ বছর পর আমরা এমন এক গণতন্ত্রের মধ্যে আছি, যেখানে কেবল ‘অনুমতি’ সাপেক্ষে কেউ তার সাংবিধানিক অধিকার চর্চা করতে পারে।
এখন যখন বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণ শুনি, তখন মনে মনে ভাবি, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে এই ‘গণতন্ত্র’-কে কী বলতেন? গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণই হতে পারে সোনার বাংলা বাস্তবায়নের প্রধান ধাপ। আমার আশা, আমরা সেই পথেই এগোব।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
মাহ্ফুজ আনামদ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক।
সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১৮ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত