বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। একই সঙ্গে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে তাঁর সাংবিধানিক অবস্থানও নিশ্চিত হয়। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ঢাকায় আসন্ন অধিবেশন রেডিও ঘোষণার মাধ্যমে স্থগিত করেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। এরই প্রতিবাদে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে শুরু হয় এক অভূতপূর্ব অসহযোগ আন্দোলন। এই আন্দোলনই খুব অল্প সময়ের মধ্যে স্বাধীনতাসংগ্রামে পর্যবসিত হয়।

অসহযোগ আন্দোলনের শেষ ১০ দিনে ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যে আলোচনা হয়, তাতে মূল প্রতিপক্ষ ছিলেন দুজন—পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো। পরে ১৯৭১-এর সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত দ্য গ্রেট ট্র্যাজেডি নামে আত্মজীবনীতে ওই আলোচনার নানা বিষয়-আশয় পর্যালোচনা করেছেন ভুট্টো। তাঁর ভাষায়, এই বয়ানে তিনি নিজের ব্যক্তিগত ধারণা লিপিবদ্ধ করতে চেয়েছেন। ১৯৭১-এর মে মাসে বসে প্রথমে ভেবেছিলেন কিছু ব্যক্তিগত নথি তৈরি করবেন। পরে সাধারণ পাঠকের জন্য সেটিকে একটি ‘দলিল’ বা বই হিসেবে তৈরি করেন তিনি।

দ্য গ্রেট ট্র্যাজেডিতে বাংলাদেশের অসহযোগ আন্দোলন সম্পর্কে ভুট্টোর বিবরণে অনেক তথ্য রয়েছে, যা আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। তবে মনে রাখতে হবে, এটি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা ভুট্টোর বয়ান। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ‘বিচ্ছিন্নতা’ হিসেবে দেখা তাতে আশ্চর্য কিছু নয়। কিন্তু তার মধ্যেও অনেক সত্যকে ঢেকে রাখা সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের অসহযোগ পর্ব সম্পর্কে জুলফিকার আলী ভুট্টোর বয়ানের উপশিরোনাম ‘আওয়ামী লীগস অ্যাপজি’। ১৯৭১-এর ১ মার্চে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ অধিবেশন মুলতবি করার ঘোষণাকে তিনি দেখেছেন পাকিস্তানের নেতাদের মধ্যে সমঝোতার সুযোগ সৃষ্টির সময়দান হিসেবে। এতে তাঁর নিজের ভূমিকা ঊহ্যই রেখে দিয়েছেন।

ভুট্টোর বর্ণনা অনুসারে, এই ঘোষণায় ক্রুদ্ধ শেখ মুজিবুর রহমান ২ মার্চ যে হরতাল আহ্বান করেন, তাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ রাস্তায় নেমে আসে এবং প্রশাসন স্থবির হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের নেতারা বাংলাদেশের নামে নির্দেশনা জারি শুরু করেন; বেসামরিক প্রশাসনকে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা না করতে বলা হয়; ব্যাংকগুলোকে আওয়ামী লীগের নির্দেশ অনুযায়ী চলতে হয়; হাইকোর্টের বিচারকদের ঘরে অবস্থান করার অনুরোধ করা হয়; এমনকি পুলিশও আওয়ামী লীগের নির্দেশে চলতে থাকে।

ভুট্টোর মতে, এর প্রতিক্রিয়ায় সামরিক বাহিনী কিছু তড়িঘড়ি ব্যবস্থা নেয়। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের প্রতি নমনীয় গভর্নরকে (রিয়ার অ্যাডমিরাল আহসান) সরিয়ে লে. জে. টিক্কা খানকে তাঁর স্থলে নিযুক্ত করা হয়। আওয়ামী লীগের নির্দেশে প্রধান বিচারপতি তাঁকে শপথদানে অস্বীকার করেন। ভুট্টোও স্বীকার করেছেন, এ সময় জনজীবন অচল হয়ে পড়ে; জনগণ কর ও অন্যান্য সরকারি অর্থ দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এবং কয়েক দিনের মধ্যে, ভুট্টোর ভাষায়, শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের ‘শাসক’-এ পরিণত হন। পূর্ব পাকিস্তানে ক্রমেই কেন্দ্রীয় সরকারের শাসন অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং আওয়ামী লীগ প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের পদক্ষেপ নিতে থাকে।

৫ মার্চ রাওয়ালপিন্ডিতে ভুট্টো ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ইয়াহিয়া পুনরায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার কথা তোলেন। ভুট্টো তাতে আপত্তি করেন এই বলে যে জাতীয় পরিষদে একবার ছয় দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র পাস হয়ে গেলে (ভুট্টোর ভাষায় ‘ডিভাইস অব সাকসেশন’) আর কিছুই করার থাকবে না। ৬ মার্চ এক ঘোষণায় ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ পুনরায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন এবং সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার ঘোষণা দেন।

ভুট্টোর বর্ণনায়, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে এই বলে শপথ নেন যে যত দিন পর্যন্ত তাঁর (পূর্ব বাংলার) জনগণ ‘ফ্রি সিটিজেনস অব আ ফ্রি নেশন’ বা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক না হয়, তত দিন সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন। তবে তিনি একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। ১০ মার্চ ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর কাছে এক টেলিগ্রাম-বার্তায় পাকিস্তানকে রক্ষা করার আবেদন জানান এবং ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার প্রস্তাব দেন। দুই দিন পরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ জনসমক্ষে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।

ভুট্টো লক্ষ করেন, এর মধ্যে বাংলাদেশের নামে শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনা দান চলছে, জিন্নাহর ছবি ও পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং ঢাকার জাতীয় বেতার ও টেলিভিশন আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে। লন্ডন, নিউইয়র্কসহ প্রবাসী বাঙালিরাও বাংলাদেশের সমর্থনে আন্দোলন শুরু করেছেন। এর সঙ্গে পাকিস্তানের কিছু নেতাও আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি তুলেছেন।

default-image

১৪ মার্চ করাচিতে ভুট্টো ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে এক বৈঠকে ভুট্টো দাবি করেন, যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে হবে পিপলস পার্টির সম্মতিক্রমে এবং এ জন্য তিনি ঢাকায় যেতে রাজি আছেন। অন্যদিকে ইয়াহিয়া ঢাকায় গেলে তিনি অভ্যর্থনা পাবেন একজন ‘বাংলাদেশের অতিথি’রূপে—শেখ মুজিবুর রহমানের এমন মন্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়েছেন ভুট্টো। এসবের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ১৫ মার্চ ঢাকায় পৌঁছান। শেখ মুজিবুর রহমান ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে আলোচনায় একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কথা হয়েছে, এমন খবর পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন ভুট্টো। পাকিস্তান সরকারের আইন উপদেষ্টাকে ঢাকায় ডেকে পাঠালে তাঁর উদ্বেগ বৃদ্ধি পায়। পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে পিপলস পার্টিকে বাদ দিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না, এই মর্মে সতর্ক করে ভুট্টো ইয়াহিয়াকে একটি বার্তা পাঠান ১৮ মার্চ। এবার প্রেসিডেন্ট আমন্ত্রণ জানালে দলীয় নেতৃবৃন্দ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের একটি দল নিয়ে ২১ মার্চ বিকেলে ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছান তিনি।

ভুট্টোর বর্ণনায় দেখা যায়, তাঁদের বহনকারী বিমানটির দুটি ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেলে ঢাকায় জরুরি অবতরণ করে। সেনাবাহিনীর একটি দল তাঁদের ভিআইপি কক্ষে নিয়ে যায় এবং সেখানে ব্রিগেডিয়ার আরবাব খান তাঁদের অভ্যর্থনা জানান। সেনাবাহিনীর পাহারায় তাঁরা হোটেলে পৌঁছান এবং হোটেল লবিতে বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়েন। এবার ভুট্টো নিশ্চিত হন, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এই ঢাকাতেই পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়ে যাবে।

সেই সন্ধ্যায়ই প্রেসিডেন্ট হাউসে ইয়াহিয়া-ভুট্টো বৈঠক বসে। বৈঠকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে ভুট্টোকে অবহিত করেন। এর মূল অংশ ছিল পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের প্রস্তাবনা। ভুট্টোর করা সারসংক্ষেপ অনুযায়ী প্রস্তাবের মূল কথা—১. অনতিবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার; ২. পাঁচটি প্রদেশে অবিলম্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর; ৩. জাতীয় পরিষদের পূর্ব ও পশ্চিমের সদস্যদের জন্য দুটি পৃথক কমিটি গঠন, পূর্বের কমিটি ঢাকায় ও পশ্চিমের কমিটি ইসলামাবাদে বৈঠক করে রিপোর্ট তৈরি করে জাতীয় পরিষদে উত্থাপন করবে; ৪. ছয় দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে হবে।

হোটেলে ফিরে সহকর্মীদের নিয়ে আলোচনায় বসেন ভুট্টো। তাঁদের ভাষায় এই প্রস্তাব বিপজ্জনকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। তাঁরা বুঝতে পারেন, এতে আসলে পূর্ব ও পশ্চিমে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের বীজ বপন করা হয়েছে।

পরদিন সময়ের আগেই ভুট্টো প্রেসিডেন্ট হাউসে পৌঁছান। শেখ মুজিব পৌঁছান ঠিক ১১টায়। কিছু সৌজন্য বিনিময়ের পর দুজন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কক্ষে যান। তিনজনের মধ্যে কিছু সৌজন্য আলাপের পর শেখ মুজিব সরাসরি প্রেসিডেন্টের দিকে তাকিয়ে জানতে চান, আওয়ামী লীগের প্রস্তাব তিনি চূড়ান্তভাবে মেনে নিয়েছেন কি না? ইয়াহিয়া তাঁকে বলেন, এতে ভুট্টোর সম্মতি প্রয়োজন। শেখ মুজিব বলেন, ভুট্টোকে সম্মত করা প্রেসিডেন্টের কর্তব্য। তিনি আরও বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও ভুট্টো এ প্রস্তাবে সম্মত হলেই পরবর্তী আলোচনা চলবে; নইলে আনুষ্ঠানিক আলোচনা আর নয়। প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে নানাভাবে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু ভুট্টোর ভাষায়, মুজিব ছিলেন অনড়। ভুট্টো লক্ষ করেন, মুজিব অত্যন্ত উদ্বিগ্ন; কিন্তু তাতে ভদ্রতার কোনো কমতি নেই। এরপর দ্রুত কফি পান করে প্রেসিডেন্টের কক্ষ থেকে বিদায় নেন তিনি। ভুট্টো তাঁর পিছু পিছু বেরিয়ে আসেন কক্ষ থেকে।

প্রেসিডেন্টের পাশের কক্ষটি ছিল তাঁর সামরিক সচিবের। সেখানে সামরিক সচিব, নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তা ছাড়াও বসে ছিলেন লে. জে. ওমর ও লে. জে. ইসহাক। শেখ মুজিবুর রহমান তাঁদের ওই কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন এবং ভুট্টোর সঙ্গে আলাপে বসেন। খানিক পরে তিনি ভুট্টোকে নিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে আসেন। ভুট্টোর বয়ান অনুসারে তিনি তাঁকে বলেন, এখন পেছনে ফেরার আর কোনো সুযোগ নেই; এখন পূর্ব পাকিস্তানকে তাঁর হাতে ছেড়ে দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাঁর মাথাব্যথা নেই। ভুট্টো স্বীকার করেছেন, মুজিব তাঁকে সামরিক জান্তা সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। মুজিব বলেছিলেন, সামরিক জান্তা যদি তাঁকে নিঃশেষ করতে পারে, তবে পরে ভুট্টোকেও নিঃশেষ করবে। মুজিব ভুট্টোকে দুই কমিটির প্রস্তাব মেনে নিতে চাপ দেন। ভুট্টো মুজিবকে বলেন, তিনি আওয়ামী লীগের প্রস্তাব নিয়ে চিন্তা করবেন; তবে তা একমাত্র অর্থবহ হবে জাতীয় পরিষদে উত্থাপন ও পাসের মাধ্যমে। ভুট্টো স্বীকার করেছেন, শেখ মুজিব এ পর্যায়ে আর জাতীয় পরিষদের কোনো অধিবেশন সম্পর্কেই আগ্রহী ছিলেন না; বরং জাতীয় পরিষদের বাইরেই সমস্যার পূর্ণ সমাধানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠেছিলেন। এই মনোভাব স্পষ্ট করেই মুজিব প্রেসিডেন্ট হাউস থেকে বেরিয়ে যান এবং ভুট্টো তাঁকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেন। সেবার তাঁদের আর সাক্ষাৎ হয়নি।

আত্মজীবনীতে ভুট্টোর স্পষ্ট কথা, ২৫ মার্চ যদি সরকার ব্যবস্থা না নিত; পরদিনই আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করত। তাঁর মতে, বাঙালিদের সশস্ত্র প্রস্তুতি, বিশেষত পুলিশ ব্যারাকে ১৬ হাজার রাইফেল জমা করা; তাদের শক্তির সমন্বয়, রাস্তায় ব্যারিকেড স্থাপন, হাজার হাজার পতাকা বানানো ইত্যাদির মধ্যে স্বাধীনতা ঘোষণার লক্ষণ প্রত্যক্ষ। ভুট্টো আরও পরিষ্কার করে বলেছেন, আওয়ামী লীগের ইচ্ছা ছিল ২৬ মার্চ দুপুরের নামাজের পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা।

এরপর ভুট্টো আবার ফিরে যান প্রেসিডেন্টের কক্ষে। ইয়াহিয়া খান আসলে তাঁর কক্ষের জানালা দিয়ে তাঁদের দুজনের আলাপে উঁকি দিচ্ছিলেন। তিনি এ আলাপকে দুজনের ‘মধুচন্দ্রিমা’ বলে ঠাট্টা করেন। উত্তরে ভুট্টো তাঁকে বলেন, এ ধরনের সংলাপ রাজনীতির অঙ্গ। এবার তাঁদের দুজনের মধ্যে গুরুতর আলোচনা শুরু হয়। ভুট্টো প্রেসিডেন্টকে বলেন, আওয়ামী লীগের প্রস্তাবে তিনি সংশ্লিষ্ট হবেন না; কেননা এটি প্রকৃতপক্ষে দুটি ‘পাকিস্তান’ সৃষ্টি করবে। এ ছাড়া অনতিবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করলে শাসনশূন্যতার সৃষ্টি হবে, দেশে কার্যত কোনো বৈধ সরকার থাকবে না। অন্যদিকে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার আগেই পাঁচটি প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে প্রকৃতপক্ষে পূর্ব পাকিস্তানসহ পাঁচটি সার্বভৌম দেশের সৃষ্টি হবে। ভুট্টো মনে করেন, শেখ মুজিব এভাবে প্রকৃতপক্ষে আইনগতভাবে (ইন ফ্যাক্ট অ্যান্ড ইন ল) পূর্ব পাকিস্তানের কর্তৃত্ব গ্রহণ করতে চাইছেন। এরপর তাঁর পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানকে পৃথক করা সহজ হবে; সঙ্গে পশ্চিমের প্রদেশগুলোরও স্বাধীনতা ঘোষণার সুযোগ আসবে। আর জাতীয় পরিষদের দ্বিভাজিত রূপ এর সহায়ক হবে।

ভুট্টো ইয়াহিয়াকে এর বিপরীতে বিকল্প কিছু পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, দুটি পৃথক কমিটি গঠনের আগে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকা হোক, যাতে কমিটি দুটির কার্যপ্রণালি (টার্মস অব রেফারেন্স) নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে। ফলে কমিটির ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে এবং বিচ্ছিন্ন হওয়ার মতো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হবে না। এর মধ্যে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন, তা প্রেসিডেন্টের ঘোষণার মাধ্যমে সম্পন্ন করা যাবে। ভুট্টো প্রেসিডেন্টকে বোঝান, তাঁর উচিত হবে এ ধরনের একটি প্রস্তাবে শেখ মুজিবকে রাজি করানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা। ভুট্টো মনে করেন, অন্তত কয়েক দিনের জন্য হলেও জাতীয় পরিষদের একটি সংক্ষিপ্ত অধিবেশন বসাতে পারলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে। ভুট্টোর সঙ্গে আসা প্রতিনিধিদল ইয়াহিয়ার সহযোগীদের সঙ্গেও এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন। পক্ষান্তরে ইয়াহিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন, যাতে ভুট্টোর প্রস্তাব সম্পর্কে জানানো হয়।

২৩ ও ২৪ মার্চ আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের কয়েকটি বৈঠক হয়। ভুট্টোর বয়ান অনুসারে, এসব বৈঠকে আওয়ামী লীগ আরও কঠোর অবস্থান নেয়। এবার আওয়ামী লীগ দুই কমিটির পরিবর্তে দুটি শাসনতন্ত্র কনভেনশন গঠনের দাবি করে, যারা দুই অংশের জন্য দুটো শাসনতন্ত্র বা সংবিধানের খসড়া তৈরি করবে। পরে সংবিধান দুটি জাতীয় পরিষদে উত্থাপিত হবে এবং তার ভিত্তিতে গঠিত হবে একটি শিথিল কনফেডারেশন। এই প্রস্তাবে স্পষ্ট করে দেওয়া হয় যে প্রদেশের ওপর কেন্দ্রের কোনো কর্তৃত্ব থাকবে না; এমনকি কেন্দ্র কার্যত জরুরি অবস্থাও জারি করতে পারবে না। ভুট্টো মনে করেন, প্রকৃতপক্ষে এটি পূর্বাঞ্চলে একটি পৃথক দেশ গঠনের প্রস্তাব। ২৪ মার্চ সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়ে দেন, আওয়ামী লীগ তার চূড়ান্ত বক্তব্য বলে দিয়েছে এবং সংলাপের আর কিছু অবশিষ্ট নেই।

default-image

২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস। ঢাকায় ১৯৭১-এর এই দিনে যা ঘটে, তা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে স্বভাবতই মর্মাহত করে। তিনি খেয়াল করেন, পাকিস্তানের স্বপ্ন বিপর্যস্ত করে দেশের বিরাট জনসংখ্যার মধ্যে পাকিস্তানিদের প্রতি ঘৃণা উপচে পড়ছে। পাকিস্তানি পতাকার বদলে বিভিন্ন দালানের শীর্ষে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা; তাতে সরকারি ভবনও বাদ যায়নি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বদলে ঢাকায় স্থানীয় তরুণেরা প্যারেড করছে প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে। ভুট্টোর ভাষায়, তাঁরা ‘সোলজারস অব বাংলাদেশ’। ভুট্টো এ-ও উল্লেখ করেছেন, শেখ মুজিব তাঁর নিজের বাসভবনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছেন।

২৪ মার্চ ভুট্টো ইয়াহিয়া খান ও তাঁর মুখ্য স্টাফ অফিসার লে. জে. পীরজাদার সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তাঁদের সতর্ক করে বলেন, সময় বয়ে যাচ্ছে, দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। তিনি আরও জানান, পিপলস পার্টির নেতাদের এখন আর ঢাকায় থাকা অর্থহীন; কেননা শেখ মুজিবুর রহমানের যে অনড় ও অনমনীয় মনোভাব, তাতে এর কার্যকারিতা সামান্য। সে রাতেই ভুট্টোর প্রতিনিধি গোলাম মুস্তাফা খার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। খারের বিবরণ অনুসারে বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে যে প্রস্তাব মেনে নিতে বলেন, তা তাঁদের মতে পাকিস্তান বিভাজনের সমতুল্য।

২৫ মার্চ সকালে পিপলস পার্টির সম্পাদক জে এ রহীম ও মুস্তাফা খারকে নিয়ে ভুট্টো ইয়াহিয়া খান ও লে. জে. পীরজাদার সঙ্গে দেখা করেন। সর্বশেষ পরিস্থিতি, বিশেষত তাজউদ্দীনের ‘আলটিমেটাম’ নিয়ে তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়। ওই দিনই সন্ধ্যা সাতটায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। মুস্তাফা খারকে এ খবর দেন আওয়ামী লীগের একজন দূত এবং খার তা ভুট্টোকে জানান। ভুট্টো এর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য কয়েকবার প্রেসিডেন্ট হাউসে ফোন করেন। কিন্তু ওপাশ থেকে ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগ সম্পর্কে নিশ্চিত করা হয়নি।

ভোজন শেষ করে রাত সাড়ে ১০টার দিকে জুলফিকার আলী ভুট্টো ও তাঁর সহযোগীরা হোটেলের কক্ষে ফিরে যান। ভুট্টোর বয়ান অনুসারে, এর ঘণ্টাখানেক পরে গোলাগুলির শব্দে তাঁদের ঘুম ভেঙে যায়। তাঁর কয়েকজন সহযোগী ভুট্টোর কক্ষে জমায়েত হন। তাঁরা হোটেলের জানালা দিয়ে সামরিক বাহিনীর ‘অ্যাকশন’ প্রত্যক্ষ করেন। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে তাঁরা দেখতে পান বেশ কয়েকটি স্থানে আগুন জ্বলছে, সংবাদপত্র দ্য পিপলস ভবন ধ্বংসের দৃশ্যও তাঁরা দেখতে পান। দিগন্তে প্রজ্বলিত অগ্নিশিখার দিকে তাকিয়ে ভুট্টোর মনে দুটি প্রশ্ন জাগে: আমরা কি আমাদের জনগণের মৃত্যু ও ধ্বংস দেখছি? আমাদের কি আর ফেরার পথ নেই?

২৬ মার্চ সকাল আটটায় কর্নেল সাঈদ জুলফিকার আলী ভুট্টো ও তাঁর সহযোগীদের নিয়ে ঢাকা বিমানবন্দরের দিকে রওনা হন। হোটেল লবিতে একদল বিদেশি সাংবাদিক ভুট্টোকে ঘিরে ধরে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। তিনি তাঁদের প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে রওনা হন বিমানবন্দরের দিকে। এ সময় কর্নেল সাঈদ তাঁকে জানান, গত রাত দেড়টায় শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং বর্তমানে তিনি সেনানিবাসের একটি স্কুলে বন্দী রয়েছেন। পথের ব্যারিকেড তখনো আছে এবং কিছু বাড়ি থেকে বাংলাদেশের পতাকা নামানো হচ্ছে—এমন দৃশ্যও নজরে আসে ভুট্টোর।

ভুট্টো করাচি পৌঁছান সন্ধ্যায়। বিমানবন্দরের সমবেত সমর্থকদের তিনি শুধু বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে।’ এরপর ভুট্টো লিখেছেন, তিনি মনে মনে আশা করছিলেন তাঁর কথা যাতে সত্য হয়। আত্মজীবনীতে ভুট্টোর স্পষ্ট কথা, ২৫ মার্চ যদি সরকার ব্যবস্থা না নিত; পরদিনই আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করত। তাঁর মতে, বাঙালিদের সশস্ত্র প্রস্তুতি, বিশেষত পুলিশ ব্যারাকে ১৬ হাজার রাইফেল জমা করা; তাদের শক্তির সমন্বয়, রাস্তায় ব্যারিকেড স্থাপন, হাজার হাজার পতাকা বানানো ইত্যাদির মধ্যে স্বাধীনতা ঘোষণার লক্ষণ প্রত্যক্ষ। ভুট্টো আরও পরিষ্কার করে বলেছেন, আওয়ামী লীগের ইচ্ছা ছিল ২৬ মার্চ দুপুরের নামাজের পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা। পরে ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যে বেতার ভাষণ দেন, তাতেও শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। প্রেসিডেন্ট বলেন, আওয়ামী লীগের নেতা ও তাঁর দল পূর্বাঞ্চলকে পাকিস্তান থেকে পৃথক করে ফেলতে চেয়েছিলেন।

বাংলাদেশকে ঘিরে শেখ মুজিবুর রহমানের পরিকল্পনা সম্পর্কেও বইতে আলোকপাত করেছেন ভুট্টো। তাঁর মতে, বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা ছিল সাংবিধানিক পথে দুই পর্বে দেশের দুই অংশকে পৃথক করা। এর প্রথম পর্বে তিনি জাতীয় পরিষদে ছয় দফার ভিত্তিতে একটি সংবিধান প্রণয়ন করতেন। ভুট্টোর বিশ্লেষণে ছয় দফা গৃহীত হলে কেন্দ্রীয়ভাবে পাকিস্তান বলে প্রকৃতপক্ষে কিছুই থাকত না। কেননা এতে কেন্দ্রের হাতে দেশের রক্ষা বিভাগ থাকলেও পূর্ব বাংলায় প্রাদেশিক মিলিশিয়ার উপস্থিতিতে স্বল্প সংখ্যার সামরিক বাহিনী কিছুই করতে পারত না, অন্যদিকে বৈদেশিক বাণিজ্য প্রদেশের হাতে থাকলে কেন্দ্রের পররাষ্ট্রবিষয়ক কার্যক্রমও মুখ থুবড়ে পড়ত। আবার একবার সংবিধানের অংশে পরিণত হয়ে গেলে ছয় দফাকে সবাই মেনে নিতে বাধ্য হতো। একই সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলে সামরিক বাহিনীর পক্ষে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়াই সম্ভব হতো না। নিজের শক্তিকে সংহত করে তিনি তখন সাংবিধানিক ও আইনগতভাবেই পূর্বাঞ্চলকে পৃথক করতে পারতেন। ভুট্টোর মতে, দুই পর্বে স্বাধীনতা অর্জনের এই লক্ষ্য নিয়েই অগ্রসর হচ্ছিলেন শেখ মুজিব। তিনি স্পষ্ট বলেছেন, মুজিবের কৌশল ও সময়সীমা যা-ই হোক, তাঁর লক্ষ্যই ছিল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। পাকিস্তান সম্পর্কে মোহভঙ্গে এই নেতা শেষ পর্যন্ত অনড় ও অসমঝোতাযোগ্য হয়ে ওঠেন এবং অচলাবস্থা ভাঙার যেকোনো চেষ্টাকেই নস্যাৎ করে দিচ্ছিলেন। তিনি যতই পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণের কাছাকাছি যাচ্ছিলেন, ততই হয়ে উঠছিলেন অনমনীয়।

দ্য গ্রেট ট্র্যাজেডিভুক্ত জুলফিকার আলী ভুট্টোর এই সংক্ষিপ্ত বয়ান থেকে কয়েকটি বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়: প্রথমত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একমাত্র লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তাঁরা প্রাথমিক পর্যায়ে এটি ধাপে ধাপে এবং রক্তপাতহীন পথে অর্জনের চেষ্টা করছিলেন। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ বা আপস করার কোনো চেষ্টা এর মধ্যে ছিল না। তৃতীয়ত, প্রখর ব্যক্তিত্ব, সঠিক নেতৃত্ব ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত দিয়ে বঙ্গবন্ধুই বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতাসংগ্রামের পথে নিয়ে গেছেন। তাই তিনিই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপিতা।

সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১৭ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত