বিজ্ঞাপন
default-image

জুন মাসের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে যুদ্ধপরিস্থিতি নিয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এখানে সিদ্ধান্ত হয় যে প্রশাসনিক ও রণকৌশলের সুবিধার্থে রণাঙ্গনকে কয়েকটি অঞ্চল বা সেক্টরে ভাগ করা হবে। মন্ত্রিসভা প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেয়।

প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী ১১ থেকে ১৫ জুলাই সেক্টর কমান্ডারদের সভা আহ্বান করেন। সভা অনুষ্ঠিত হয় কলকাতার ৮, থিয়েটার রোডে। সভায় সেক্টর কমান্ডার ছাড়াও সদরদপ্তরের স্টাফ অফিসাররা এবং সেক্টরের বেসামরিক বিষয়ক উপদেষ্টারাও যোগ দেন। শেষ মুহূর্তে সংবাদ পেয়ে তড়িঘড়ি করে হলেও প্রায় সব সেক্টর কমান্ডার ও বেসামরিক বিষয়ক উপদেষ্টা যথা সময়ে কলকাতায় এসে পৌঁছেন। তবে ৫ ও ১০ নম্বর সেক্টরে কমান্ডার এবং ১, ৫ ও ৭ নম্বর সেক্টরের বেসামরিক বিষয়ক উপদেষ্টারা প্রথম দিন অনুপস্থিত ছিলেন। সভা শুরুর আগে ২৮-৩০ জুনের মধ্যে বাংলাদেশ বাহিনীর সদরদপ্তর থেকে বেশ কয়েকটি নীতিনির্ধারণী চিঠি প্রচারিত হয়। এই চিঠিগুলোই সভার আলোচ্যসূচিতে প্রাধান্য পায়।

default-image

সভায় আগত সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যে কয়েকজন স্বাধীনতাযুদ্ধকে গতি দান এবং যুদ্ধে একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটি যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবে কর্নেল ওসমানীকে দেশরক্ষামন্ত্রী পদে উন্নীত করে যুদ্ধ কাউন্সিলের প্রধান নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়া কাউন্সিলে সাতজন সামরিক সদস্য প্রস্তাব করা হয়। সেক্টর কমান্ডারদের অধিকাংশ এই প্রস্তাবের পক্ষে মত পোষণ করেন। মেজর জিয়াউর রহমান এই প্রস্তাবের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিলেও মেজর খালেদ মোশাররফ এর বিরোধিতা করেন। কর্নেল ওসমানী যুদ্ধ কাউন্সিলকে তাঁর একক নেতৃত্বের জন্য হুমকি মনে করে সভার শুরুতেই প্রধান সেনাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন। ফলে শুরুর দিন প্রধান সেনাপতি সভায় অনুপস্থিত থাকেন। দেশরক্ষামন্ত্রী তথা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রথম দিনে সভাপতিত্ব করলেও শুরুতেই ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনার কারণে ওই দিন আলোচনা দীর্ঘায়িত হয়নি এবং প্রধানমন্ত্রীর বড় সময় ব্যয় হয় কর্নেল ওসমানীকে মানিয়ে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করাতে। সভার শুরুতে বেশ কয়েকজন সেক্টর কমান্ডার উল্লেখ করেন যে ২৮ জুন থেকে প্রচারিত পত্রগুলো তাঁরা পাননি।

default-image

সূচনার বিব্রতকর পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠে ১২ তারিখ থেকে সভা যথাযথভাবে শুরু হয়। সেক্টর কমান্ডাররা সভায় তাঁদের নিজ নিজ এলাকার বিভিন্ন সাফল্য, সমস্যা ও পরিকল্পনার কথা আলোচনা করেন। একনাগাড়ে পাঁচ দিন সভা চলার পর ১৫ জুলাই সভার সমাপ্তি ঘটে। ১৫ জুলাই রাতে সেক্টর কমান্ডাররা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে শপথ নেন। ১৭ জুলাইয়ের মন্ত্রিসভায় প্রধান সেনাপতি সেক্টর কমান্ডারদের সভার প্রতিবেদন পেশ করেন। ৬ আগস্ট সভার কার্যবিবরণী প্রচার করা হয়, তবে সভায় গৃহীত অনেক সিদ্ধান্তই বিশেষ করে সেক্টর সীমানা, গণবাহিনীর সংগঠন ও অস্ত্রশস্ত্র, গেরিলাযুদ্ধের রণকৌশল ইত্যাদি কার্যবিবরণী প্রকাশের আগেই জুলাই মাসের মধ্যে পৃথক পত্র দ্বারা প্রচারিত হয়।

যুদ্ধকালে এটিই সর্বোচ্চ পর্যায়ের একমাত্র সামরিক সভা, পরবর্তী সময়ে সেক্টর কমান্ডারদের সভা অনুষ্ঠিত হয় দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১১ জানুয়ারি ১৯৭২, ঢাকায়।

সূত্র: লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, রফিকুল ইসলাম

বীর উত্তম, (২০০৬)।

মূলধারা’ ৭১, মঈদুল হাসান, (২০০৮)।

সভার সিদ্ধান্ত

সেক্টর কন্ডারদের সভায় যা আলোচনা হয়েছিল, তা পরবর্তীতে সভার কার্যবিবরণী এবং একাধিক নীতিমালার সাহাঘ্যে প্রচার করা হয়। সভায় অনেক বিষয় আলোচনা হলেও সবগুলোকে কার্যবিবরণীতে অন্তভু‌র্ক্ত করা হয়নি। গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় ২৭টি বিষয় কার্যবিবরণীতে অন্তভু‌র্ক্ত করা হয়। এই ২৭টির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিচে দেওয়া হলো:

  • অনেকগুলি কোম্পানি নিয়ে একটি সেক্টর গঠিত হবে। সেক্টরের এলাকা ও দায়িত্বের ভিত্তিতে সেক্টরের কোম্পানি সংখ্যা নির্ধারণ করা হবে। সেক্টরের দায়িত্ব ও অপারেশন পদ্ধতিসমূহ সভায় নির্ধারণ করা হয়।

  • সেক্টরসমূহের সীমানা নির্ধারণ করা হয় এবং ১৮ জুলাই অতি গোপনীয় পত্রের মারফত তা সংশ্লিষ্ট সকলকে জ্ঞাত করানো হয়। নির্দেশ দেওয়া হয় যে এক সেক্টর অপর সেক্টর এলাকায় অপারেশন করবে না।

  • সৈনিকদের মধ্যে যে সমস্ত সৈনিক বিমান, নৌ, গোলন্দাজ, সিগন্যাল বিষয়ে পারদর্শী তাদের তালিকা তৈরি করতে হবে, যাতে এদের দ্বারা ঐ সমস্ত বাহিনী গঠন করা যায়।

  • ইয়ূথ ক্যাম্পের সঙ্গে বাংলাদেশ বাহিনীর কোনো সম্পৃক্ততা থাকবে না। ইয়ূথ ক্যাম্প সরকারের ভিন্ন সংস্থা পরিচালনা করবে।

  • গণবাহিনীর গঠন, কর্মপন্থা, প্রসাশন ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ২৫ জুলাই গণবাহিনীর সংগঠন, অস্ত্রশস্ত্র, পোষাক, রণকৌশল, আত্মীকরণ সম্বন্ধীয় ১০ পৃষ্ঠার পত্র জারি হয়। এই পত্রে প্রেরিত সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনাবালীর অতিরিক্ত আরও কিছু সিদ্ধান্ত ২৭ ও ৩১ জুলাই সকল সেক্টরে প্রেরণ করা হয়।

  • সদরদপ্তর ও সেক্টরের মধ্যে বেতার যোগাযোগ ভারতীয় সেক্টরের মাধ্যমে রক্ষা করা হবে। ভারতীয় সেক্টর সদরদপ্তর ও বাংলাদেশী সেক্টর সদরদপ্তর এক স্থানে না থাকলে তাদের মধ্যে বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকবে।

  • লজিস্টিকস ও প্রশাসনিক বিষয়গুলোর মধ্যে মুক্তিবাহিনীর বেতন, পোষাক, রেশন, চিকিৎসা বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

default-image

অংশগ্রহণকারীদের নাম

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ

কর্নেল এম এ জি ওসমানী

লে. কর্নেল এম এ রব

গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার

মেজর কাজী নূরুজ্জামান

মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত

মেজর জিয়াউর রহমান

মেজর কে এম সফিউল্লাহ

মেজর খালেদ মোশাররফ

মেজর মীর শওকত আলী

উইং কমান্ডার এম কে বাশার

মেজর আবু ওসমান চৌধুরী

মেজর রফিকুল ইসলাম

মেজর নাজমুল হক

মেজর এম এ জলিল

মেজর এ আর চৌধুরী

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস , মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, (২০০৪)। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড , তথ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, (১৯৮২)। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ , সেনাসদর, শিক্ষা পরিদপ্তর, (২০০৭)। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে , রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম, (২০০৬)।

মূলধারা ’৭১ , মঈদুল হাসান, (২০০৮)।

বাংলাদেশ বাহিনীর জনবল

‘জেড’ ফোর্স

১ম, ৩য় ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং রওশন আরা ব্যাটারি।

‘এস’ ফোর্স

২য় ও ১১তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট।

‘কে’ ফোর্স

৪র্থ, ৯ম ও ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং মুজিব ব্যাটারি।

১নং সেক্টর

ক. নিয়মিত বাহিনী: ২,১০০ খ. গণবাহিনী: ২০,০০০

২নং সেক্টর

ক. নিয়মিত বাহিনী: ৪,০০০ খ. গণবাহিনী: ৩০,০০০

৩নং সেক্টর

ক. নিয়মিত বাহিনী: ৬,৬৯৩ খ. গণবাহিনী:২৫,০০০

৪নং সেক্টর

ক. নিয়মিত বাহিনী: ৯৭৫ খ. গণবাহিনী: ৯,০০০

৫নং সেক্টর

ক. নিয়মিত বাহিনী: ১,৯৩৬ খ. গণবাহিনী: ৯,০০০

৬নং সেক্টর

ক. নিয়মিত বাহিনী: ২,৩১০ খ. গণবাহিনী: ১১,০০০

৭নং সেক্টর

ক. নিয়মিত বাহিনী: ২,৩১০ খ. গণবাহিনী: ১২,৫০০

৮নং সেক্টর

ক. নিয়মিত বাহিনী: ৩,৩১১ খ. গণবাহিনী: ৮,০০০

৯নং সেক্টর

ক. নিয়মিত বাহিনী: ৩,৩১১ খ. গণবাহিনী: ৮,০০০

১০নং সেক্টর

এই সেক্টরের কোনো ভৌগোলিক সীমানা ছিল না। বিভিন্ন নদীবন্দর ও শত্রুপক্ষের নৌ-যানগুলোতে অভিযান চালানোর জন্য নৌ-কমান্ডোদের নিয়ে সেক্টরটি গঠিত হয়েছিল। নৌ-কমান্ডোর সংখ্যা ৫১৫ জন।

১১নং সেক্টর

ক. নিয়মিত বাহিনী: ২,৩১০ খ. গণবাহিনী: ২৫, ০০০

কমান্ডারদের নাম

দেশরক্ষা মন্ত্রী : তাজউদ্দীন আহমদ

প্রধান সেনাপতি : কর্নেল এম এ জি ওসমানী

চিফ অব স্টাফ : লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ রব

ডেপুটি চিফ অব স্টাফ : গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার

‘জেড’ ফোর্স কমান্ডার : মেজর জিয়াউর রহমান

‘এস’ ফোর্স কমান্ডার : মেজর কে এম সফিউল্লাহ

‘কে’ ফোর্স কমান্ডার : মেজর খালেদ মোশাররফ

সেক্টর নং ১

মেজর জিয়াউর রহমান (এপ্রিল-১০ জুন ’৭১)

মেজর রফিকুল ইসলাম (১১ জুন-১৬ ডিসেম্বর ’৭১)

সেক্টর নং ২

মেজর খালেদ মোশাররফ (এপ্রিল-অক্টোবর ’৭১)

ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দার (অক্টোবর-১৬ ডিসেম্বর ’৭১)

সেক্টর নং ৩

মেজর কে এম সফিউল্লাহ (এপ্রিল-৩০ সেপ্টেম্বর ’৭১)

মেজর এ এন এম নূরুজ্জামান (১ অক্টোবর-১৬ ডিসেম্বর ’৭১)

সেক্টর নং ৪

মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত (মে-১৬ ডিসেম্বর ’৭১)

সেক্টর নং ৫

মেজর মীর শওকত আলী (আগস্ট-১৬ ডিসেম্বর ’৭১)

সেক্টর নং ৬

উইং কমান্ডার এম কে বাশার (জুন-১৬ ডিসেম্বর ’৭১)

সেক্টর নং ৭

মেজর খন্দকার নাজমুল হক (এপ্রিল-আগস্ট ’৭১)

মেজর কাজী নূরুজ্জামান (আগস্ট-১৬ ডিসেম্বর ’৭১)

সেক্টর নং ৮

মেজর আবু ওসমান চৌধুরী (এপ্রিল-১৫ আগস্ট ’৭১)

মেজর এম আবুল মঞ্জুর (১৮ আগস্ট-১৬ ডিসেম্বর ’৭১)

সেক্টর নং ৯

মেজর এম এ জলিল (এপ্রিল-১৬ ডিসেম্বর ’৭১)

সেক্টর নং ১০

কোনো সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়নি। প্রধান সেনাপতি তাঁর নিয়ন্ত্রণে এই বাহিনীকে রেখেছিলেন।

সেক্টর নং ১১

মেজর জিয়াউর রহমান (১০ জুন-১২ আগস্ট ’৭১)

মেজর আবু তাহের (১২ আগস্ট-১৪ নভেম্বর ’৭১)

ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম হামিদুল্লাহ খান (১৫ নভেম্বর-১৬ ডিসেম্বর ’৭১)

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, (২০০৪)।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১১ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত