বঙ্গবন্ধু কী বলবেন ৭ মার্চে, এ নিয়ে সর্বত্র ছিল উৎকণ্ঠা, জিজ্ঞাসা। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত, সৈন্যরা মিছিলে গুলি করে মানুষ মারছে। পরিস্থিতি এমন জায়গায় চলে গেছে, পেছনে ফেরার আর উপায় নেই। আমরা, আর্ট কলেজের শিক্ষক আর ছাত্ররা তো সেই ষাটের দশক থেকেই স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছি। আমরা ছিলাম সংস্কৃতি সংসদের কর্মী। ঊনসত্তরের গণ–আন্দোলনে ছিলাম সরাসরি যুক্ত। এখন সারা দেশের সমস্ত মানুষের সঙ্গে শিল্পী-সাহিত্যিক-শিক্ষকেরাও সরাসরি মিশে গেছেন। আমরা সেই মিছিলটা বের করি, যেটার সম্মুখভাগে অঙ্কিত ছিল বাংলাদেশের মানুষের চাওয়া—স্বাধিকার নয়, স্বাধীনতা। চারটা কুলায় স্বা-ধী-ন-তা কথাটা লেখা ছিল। আর রেসকোর্স ময়দান তো আমাদের আর্ট কলেজেরই সামনে।
আমরা অনেক কাটুর্ন এঁকেছিলাম, আমি তো তখন তরুণ কাটুর্নিস্ট, অনেক কার্টুন এঁকে হাত রপ্ত করছি, সেই সব কার্টুনও ছিল আমাদের মিছিলের হাতে হাতে, মিছিল শেষে সেসব আর্ট কলেজে টাঙানো রইল। সাতই মার্চ আমরা কলেজ থেকেই দেখছি সকাল থেকে লোক আসছে। মিছিলের পর মিছিল। লাঠি হাতে মানুষ আসছে। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের দিক থেকে লগি হাতে আসছে মিছিল। সব জায়গা থেকে সব ধরনের মানুষ। যত জায়গা থেকে যত ধরনের মানুষ আসতে পারে, সব বয়সের, সব স্তরের নারী-পুরুষ।
আমি, বুলবন ওসমান, হাশেম খান আর শাহাদত চৌধুরী তিনটার মধ্যে জনসমুদ্রে ঢুকে গেলাম লাইব্রেরির উল্টো দিক দিয়ে। রেসকোর্সের ময়দানের চারদিকে তখন কাঠের বেড়া ছিল। শিশুপার্কের ওই পাহাড়টা ছিল, পাহাড়ের কাছাকাছি জিমখানা, আর একটা বটগাছ। মঞ্চের বেশি কাছে যেতে পারিনি। মানুষ আর মানুষ। লাখ লাখ মানুষ। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। সেই দৃশ্য তো ভোলার নয়। আর কী ভাষণটাই না দিলেন বঙ্গবন্ধু! সিরাজউদ্দৌলা পালায় যেমন কণ্ঠ ধীরে ধীরে উঁচু লয়ে ওঠে, শচীনবাবুর কণ্ঠের মতো তার ওঠানামা। আস্তে আস্তে তিনি পুরো আবহটা তৈরি করলেন। সমস্ত মানুষকে আপ্লুত করলেন। সমস্ত ইন্দ্রিয় যখন একটা বাক্য শোনার জন্যে আকুল—তিনি ঘোষণা করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
ভাষণ শেষ হলে আমরা চলে এলাম শরিফের ক্যানটিনে। ওখানে সব তরুণ লেখক-শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীদের আড্ডা জমে। তখন আড্ডার বিষয় ছিল একটাই—রাজনীতি। ওই ভাষণের পরে সব এক হয়ে গেল, কে রুশপন্থী, কে চীনপন্থী, কে আওয়ামী লীগ কিংবা কে নীরব মুসলিম লীগ—সব একাকার। আমরা জানলাম, আমাদের সামনে একটাই গন্তব্য—স্বাধীনতা। (প্রথম আলো, ২৬ মার্চ ২০১১)
রফিকুন নবী: চিত্রশিল্পী