বিজ্ঞাপন
default-image

স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারি কর্মচারী হিসেবে আমি কাজ শুরু করি ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে। ওই দিন বঙ্গবন্ধু ঢাকা রেসকোর্সে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সরকারি কর্মচারীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন তাঁরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুসারে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃত্বের সঙ্গে সহযোগিতা করে প্রশাসন পরিচালনা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই আদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রশাসনব্যবস্থা থেকে আমরা মুক্তি লাভ করি এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে হবিগঞ্জ মহকুমায় যেখানে আমি মহকুমা প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত ছিলাম, সেখানে কাজ শুরু হয়। তারপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন অতর্কিতভাবে বাংলার নিরীহ–নিষ্পাপ মানুষের ওপর আঘাত হানে, তখন পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থা থেকে আমরা সম্পুর্ণ বিযুক্ত হয়ে যাই।

শাসনব্যবস্থা কখনো থেমে থাকে না, যেখানে পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থা অচল হয়ে যায় সেখানেই বাংলাদেশি শাসনব্যবস্থা চালু করার প্রয়োজন দেখা দেয়। অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের বিতরণ করার জন্য মহকুমা প্রশাসকের আদেশ ছাড়া পুলিশ কোনোমতেই দিতে রাজি নয়। মহকুমা প্রশাসক হিসেবে সে আদেশ আমাকে জারি করতে হলো। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি বড় অংশ তেলিয়াপাড়াকে কেন্দ্র করে তখন হবিগঞ্জ মহকুমায় অবস্থান করছে। তাদের খাদ্যের দরকার। সরকারের গুদামে চাল, চিনি, গম ইত্যাদি মজুত ছিল। এগুলো মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের দেওয়ার জন্য মহকুমা প্রশাসকের আদেশ প্রয়োজন। সেই আদেশও আমি নির্দ্বিধায় দিয়ে দিলাম। সারা দেশে তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাড়ি যেতে চান, কিন্তু বাড়ি গেলে কবে ফিরতে পারবেন জানেন না এবং আরও জানেন না কোথা থেকে তাঁরা টাকা পাবেন। তাঁদের আবদার, তাঁদেরকে তিন মাসের অগ্রিম বেতন দেওয়া হোক। অগ্রিম বেতনের অধিকার ছিল প্রাদেশিক সরকারের কিন্তু এখন তো হবিগঞ্জে সরকার কাজ করছে না। সুতরাং মহকুমা প্রশাসকেরই এই আদেশ দিতে হবে। আমি ট্রেজারি কর্মকর্তাকে আদেশ দিলাম যাতে সব কর্মকর্তা-কর্মচারী তিন মাসের অগ্রিম বেতন নিতে পারেন।

ইতিমধ্যে যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যেসব স্থান থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিল, সেসব স্থান পুনঃদখল করা শুরু করে দিয়েছে। হবিগঞ্জে ন্যাশনাল ব্যাংকে তখন তিন কোটি রুপি মজুত ছিল। এ রুপি পাকিস্তানি বাহিনীর খপ্পর থেকে রক্ষা করতে হলে আগরতলায় নিয়ে যেতে হবে। ন্যাশনাল ব্যাংকের কর্মকর্তারা মহকুমা প্রশাসকের আদেশ ছাড়া এ অর্থ হস্তান্তর করতে রাজি নন। সুতরাং সেখানেও মহকুমা প্রশাসক হিসেবে আমার আদেশ দিতে হলো। কিন্তু তখনো বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়নি। সরকারের ঘোষণা হয় ১০ এপ্রিল। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিসহ সরকারের মন্ত্রিসভা শপথ নেয় ১৭ এপ্রিল ১৯৭১। এর আগেই হবিগঞ্জে বাংলাদেশ সরকার কাজ করছিল। আমাদের পক্ষে ধারণা করা অসম্ভব ছিল যে দেশে সরকার নেই। বস্তুত ২৬ মার্চ থেকে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১—এই তিন সপ্তাহ আইনত সরকার ছিল না কিন্তু আমাদের মতো সরকারি কর্মচারীদের কাছে সরকার ছিল।

এ সময়ে আমার ব্যক্তিগত জীবনে আরেকটি ঘটনা ঘটে। ২৬ মার্চের আগে আমি ইংরেজিতে নাম স্বাক্ষর করতাম। আমি স্বাধীন বাংলাদেশের সব কাগজপত্রে বাংলায় নাম স্বাক্ষর করি। অনেকেই সে সময়ে আলী শব্দটি ‘ী’ দিয়ে লিখত। আমি ‘ি’ দিয়ে আলির বানানটি পরিবর্তন করে আকবর আলি খান নামে স্বাক্ষর মকশ করলাম। সে সময় থেকে শুরু করে এই স্বাক্ষর আমি আজ পর্যন্ত ব্যবহার করছি। এর মধ্যে আমি কানাডা এবং আমেরিকাতে প্রায় সাড়ে ১২ বছর ছিলাম। কানাডা ও আমেরিকার ব্যাংকেও আমি বাংলায় চেক স্বাক্ষর করতাম, কখনো ইংরেজিতে স্বাক্ষর করিনি।

বাংলাদেশ থেকে ভারতে

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমাদের প্রতিবেশী মহকুমার প্রশাসকদের সঙ্গে যোগাযোগ দৃঢ়তর হয়। আমার পার্শ্ববর্তী মহকুমা ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে তখন এসডিও ছিলেন আমার ব্যাচমেট কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ। কিশোরগঞ্জে মহকুমা প্রশাসক ছিলেন স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা খসরুজ্জামান চৌধুরী। আমাদের তিনজনের মধ্যে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে আমি একবার ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে গিয়েছিলাম। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সহায়তা নিয়ে পাকিস্তানি নৌবাহিনী এবং স্থলবাহিনী ভৈরব সেতু দখল করে নেয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া তখন একটি অনিরাপদ স্থান বলে বিবেচিত হয়। তাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ হবিগঞ্জে আমার কাছে চলে আসেন। তখন দিনের বেলায় আমরা হবিগঞ্জে অফিস করতাম। কিন্তু রাতের বেলা হবিগঞ্জে থাকতাম না। বেশির ভাগ সময় চলে যেতাম চুনারুঘাট থানার আমু চা-বাগানে, কখনো থাকতাম মাধবপুর থানার সড়ক বিভাগের রেস্টহাউসে। এই বাগানের ব্রিটিশ ম্যানেজার এবং তার সহকারীরা বাগান ছেড়ে বিলেতে পালিয়ে গিয়েছিল। এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত আমরা সেখানে টিকে ছিলাম। ২৮ কি ২৯ এপ্রিল তারিখে রাত ১২টার দিকে চুনারুঘাট থানার আওয়ামী লীগের সাংসদ মুস্তফা শহীদ (যিনি সম্প্রতি মারা গেছেন এবং বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী ছিলেন) আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তিনি জানান, মৌলভীবাজারের দিক থেকে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিক থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হবিগঞ্জের দিকে আসছে। তাই হবিগঞ্জে আমাদের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হবে না। তাঁর পরামর্শে আমরা তৎক্ষণাৎ আমু চা-বাগান থেকে বের হয়ে তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ভেতর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করি। তখন রাত প্রায় তিনটা বাজে। ভারতে প্রবেশ করার পর প্রথম যে চা-বাগান ছিল, সে চা-বাগানে গিয়ে আমরা ঢুকলাম। সে চা-বাগানের ম্যানেজার ছিলেন মুস্তফা শহীদের পরিচিত। মুস্তফা শহীদ বললেন যে এত রাতে আগরতলায় গিয়ে থাকার জায়গা বের করা শক্ত হবে। সুতরাং তিনি বললেন, ‘রাতটা কষ্ট করে এ চা-বাগানে কাটান।’ চা-বাগান তখন বাংলাদেশি রিফিউজিতে ভর্তি হয়ে আছে। থাকার কোনো জায়গা নেই। ম্যানেজার অনেক খুঁজে চা-বাগানের নৈশপ্রহরীরা গেটের সামনে যে কক্ষে রাতে ঘুমাত, সেই কক্ষের একটি চৌকি আমাদের বের করে দেন। এই চৌকিতে আমি আর রকীব দুজন রাত কাটাই। ঘুম হয়নি। তখনো দেশের কথা মনে করে দুজনেই কাঁদছিলাম।

default-image

পরদিন সকালে আমরা আগরতলার সার্কিট হাউসে যাই। সার্কিট হাউস থেকে বলা হলো এক দিন বা দুদিনের জন্য আমাদের জায়গা দেওয়া সম্ভব হবে, কিন্তু ত্রিপুরা রাজ্যের বাইরে থেকে এত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সরকারি কাজে আগরতলায় আসছেন যে আমাদের বেশি দিন সেখানে থাকতে দেওয়া যাবে না। এমন সময় আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন ত্রিপুরা রাজ্যের শিক্ষা বিভাগের একজন কর্মকর্তা, যিনি মুক্তিযোদ্ধাদের দেখাশোনা করছিলেন। তিনি আমাদের দুপুরবেলা তাঁর বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেন। তাঁর বাড়িতে তখন বাংলাদেশি চলচ্চিত্রাভিনেত্রী কবরী থাকতেন। দুপুরে কবরী আমাদের সবার খাওয়া পরিবেশন করেন। খাওয়ার পর শিক্ষা বিভাগের সেই কর্মকর্তা আমাদের একটি বাগানবাড়ির চাবি দেন। বাগানবাড়িটির মালিক ছিলেন প্রিয়দাস চক্রবর্তী। তিনি একজন ব্যবসায়ী এবং কংগ্রেসের একজন বড় নেতা ছিলেন। তাঁর স্ত্রী একজন মহিলা সাংসদ এবং কিছুদিন পর তিনি ত্রিপুরা রাজ্যের মন্ত্রীও হয়েছিলেন। বাগানবাড়িটি ছিল আগরতলা বিমানবন্দরের মাইল দুয়েকের মধ্যে। আগরতলা বিমানবন্দর ছিল সিঙ্গাইর বিল নামে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের একটি জলাভূমির প্রান্তে। বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রায়ই এ অঞ্চলে কামান দাগত। বেশির ভাগ সময় কামানের আওয়াজে রাতে ঘুমানো যেত না। সেই বাগানবাড়িতে প্রথমে আশ্রয় নিই আমি এবং রকিবউদ্দীন আহমদ। তারপর আমাদের সঙ্গে যোগ দেন শ্রীমঙ্গলের চা-গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. হাসান। হবিগঞ্জে আমার যে বাবু‌র্চি সে তখনো আমার সঙ্গে ছিল এবং সে–ই রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করে। এর দু-তিন দিনের মধ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার হোসেন তৌফিক (এইচটি) ইমাম তাঁর পরিবারসহ একই বাড়িতে এসে ওঠেন। তাঁর পরিবারের জন্য আমরা দেড়টি কামরা বরাদ্দ করি। ওই বাড়িতে আরেকটি কামরা ছিল, সেটি খসরুজ্জামান চৌধুরীর জন্য রাখা হয়। পরবর্তীকালে খসরুজ্জামান চৌধুরী তাঁর পরিবারসহ আগরতলায় এসে কিছুদিন ছিলেন। তারপর তিনি কলকাতায় মুজিবনগর সরকারে বদলি হয়ে যান।

আগরতলায় সরকারের উপকেন্দ্র

যদিও ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, তবু তখন পর্যন্ত মুজিবনগর সরকার একটি কেন্দ্রীভূত সরকার হিসেবে গড়ে ওঠেনি। ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশ সরকারের অফিস গড়ে ওঠে, যাদের সঙ্গে তখনো কলকাতার মুজিবনগর সরকারের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মুজিবনগর সরকার আগরতলা সরকারকে একটি উপকেন্দ্র হিসেবে মেনে নেয়। এই উপকেন্দ্রের দায়িত্বে ছিলেন সাংসদ এম আর সিদ্দিকী ও সাংসদ জহুর হোসেন চৌধুরী। এই সরকারের একটি অংশ আগরতলার কর্নেল চৌমুহনীতে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের একটি অফিস স্থাপন করে। এই অফিসের কাজ ছিল বাংলাদেশ থেকে আগত সাংসদ এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের থাকার ব্যবস্থা করা। এ ছাড়া যাঁরা বাংলাদেশ থেকে বাধ্য হয়ে আগরতলায় আসছিলেন, তাঁদের অনেক ক্ষেত্রে পরিচয়পত্রের প্রয়োজন পড়ত। এই অফিস থেকে পরিচয়পত্র দেওয়া হতো। আগরতলায় এইচ টি ইমামের নেতৃত্বে আরেকটি অফিস ছিল, এই অফিসই ছিল ভারত সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান যোগসূত্র। এইচ টি ইমাম সরাসরি ত্রিপুরা রাজ্যের চিফ সেক্রেটারির সঙ্গে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য যোগাযোগ করতেন। তাঁর অধীন কর্মকর্তারা ত্রিপুরা রাজ্যের সচিব এবং অন্য কর্মকর্তাদের কাছে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দেনদরবার করতেন। এই সরকারের প্রশাসনের উপসচিব ছিলেন কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ। তথ্য বিভাগের উপসচিব ছিলাম আমি এবং অর্থ বিভাগের উপসচিব ছিলেন খসরুজ্জামান চৌধুরী। বাংলাদেশ থেকে যে পাকিস্তানি মুদ্রা আমরা নিয়ে গিয়েছিলাম, তা ভারতীয় মুদ্রায় ভাঙিয়ে সরকারের খরচ মেটানো হতো। আমরা আগরতলায় যাওয়ার পরে সমস্যা দেখা দিল মৌলভীবাজারে ন্যাশনাল ব্যাংকে, সেখানে দুই কোটি রুপির বেশি মজুত ছিল। ওই অর্থ কোনোমতেই আগরতলায় আনা সম্ভব হচ্ছিল না। এর কারণ হলো সব সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মচারী ও ব্যাংক কর্মচারীরা পালিয়ে গেছেন। তখন মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে কর্নেল রব আমাকে ও কাজী রকিবউদ্দীনকে মৌলভীবাজার যাওয়ার আদেশ দেন। আমরা সেখানে যাই কিন্তু যখন আমরা পৌঁছাই, তখন দেখতে পাই যে মুক্তিবাহিনী গ্রেনেড চার্জ করে ট্রেজারি ভেঙে রুপি আনার চেষ্টা করছিল। কিন্তু সে সময় কতিপয় দুষ্কৃতকারী সেখান থেকে অর্থ লুট করে পালিয়ে যায়। অতি সামান্য অর্থই সরকারের তহবিলে জমা হয়।

ওই সময় আরেকটি সমস্যা আমাদের নজরে আসে। মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের চা–বাগানগুলোতে অনেক চা মজুত ছিল। এগুলো পাকিস্তান বাহিনীর পক্ষে চট্টগ্রাম বন্দরে নেওয়া কোনোমতেই সম্ভব ছিল না। এই চা যদি আমরা ভারতে নিয়ে আসতে পারি তাহলে এগুলো বিক্রি করে কিছু অর্থ সংগ্রহ করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে আমরা চা–গবেষক ড. হাসানের সহযোগিতা নিয়ে কয়েকটি বাগানের চা ভারতে নিয়ে আসি। কিন্তু এগুলো ঠিকমতো বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। এর ফলে খুব একটা অর্থ পাওয়া যায়নি।

এ সময়ে আগরতলায় সফরে আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী। তিনি বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আগরতলায় সাক্ষাৎ করতে চান। তত দিনে বাংলাদেশের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা আগরতলা থেকে কলকাতায় চলে গেছেন। আগরতলায় শুধু সৈয়দ আলী আহসান সাহেব ছিলেন। এ অবস্থায় বুদ্ধিজীবী হিসেবে আমাদের মতো আমলাদের নেওয়া হয়। এর মধ্যে ছিলেন তৌফিক ইমাম, কাজী রকীব, খসরুজ্জামান এবং আমি। মিসেস গান্ধী স্পষ্টভাবে বলেন যে ভারত কোনোমতেই পাকিস্তানের ফাঁদে পা দেবে না এবং পাকিস্তান থেকে আসা রিফিউজিদের কখনো গ্রহণ করবে না। তিনি মুক্তিযুদ্ধকে সহায়তা করার সুস্পষ্ট আশ্বাস দেন।

এ সময় পাকিস্তান থেকে আসা রিফিউজিদের যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, সে ব্যাপারে সরজমিনে দেখার জন্য ভারতের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও রাজ্যসভার সদস্য ত্রিগুনা সেন আগরতলা এবং শিলচর সফরে আসেন। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে মাহবুবুল আলম চাষী ও আমাকে ড. ত্রিগুনা সেনের সঙ্গে থাকার আদেশ দেওয়া হয়। সরকারের বোধ হয় উদ্দেশ্য ছিল যদি এ ধরনের কোনো যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে হয়, তাহলে বাংলাদেশ সরকারের একজন কর্মকর্তাকেও নিয়োগ দিতে হবে। আমাকে সম্ভবত সে কারণে এ কাজে সংশ্লিষ্ট করা হয়। ড. ত্রিগুনা সেনের সঙ্গে আগরতলা থেকে শিলচর পর্যন্ত আমরা গাড়িতে ভ্রমণ করি। অসাধারণ মার্জিত এবং পণ্ডিত ত্রিগুনা সেন সিলেটের আদি বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর সঙ্গে সফর করতে গিয়ে দেখতে পেরেছি ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা রাজ্যসভার সদস্যদের কত সম্মান করে থাকেন। যেখানেই আমরা গিয়েছি, সেখানেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়াররা ত্রিগুনা সেনকে স্যালুট করেছেন এবং সব সময় স্যার বলে সম্বোধন করেছেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়াররা পাকিস্তানের সাংসদদের কখনো সম্মান করত না।

কলকাতায় মুজিবনগর সরকারের কার্যালয়ে

এই সফর শেষ করে আগরতলায় যখন ফিরে আসি, তখন মুজিবনগর সরকারের অনেকটা রূপ ধারণ করেছে। মূল সচিবালয় কলকাতায় থাকবে। মূল সচিবালয়ের নিচে ৯টি জোনাল কর্তৃপক্ষ স্থাপন করা হয়। প্রতিটি জোনাল কর্তৃপক্ষে একজন সংসদ সদস্যকে সভাপতি, একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কাজী রকিবউদ্দীন আহমদকে আগরতলার জোনাল কাউন্সিলের সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়। হোসেন তৌফিক ইমামকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে আগরতলায় বদলি করা হয়। হোসেন তৌফিক ইমাম মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে আমাকে উপসচিব হিসেবে বদলির ব্যবস্থা করেন। এর ফলে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে আমি কলকাতা চলে যাই।

কলকাতায় গিয়ে দেখি, সিভিল সার্ভিসের আমার অন্য সহকর্মীরা বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। নুরুল কাদের তখন জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগের সচিব, সিভিল সার্ভিসের খন্দকার আসাদুজ্জামান অর্থসচিব, পুলিশের ডিআইজি আবদুল খালেক স্বরাষ্ট্রসচিব, আনোয়ারুল ইসলাম তথ্যসচিব, ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, ড. খান খান সারওয়ার মুরশিদ, ড. মুশাররফ হোসেন এবং ড. আনিসুজ্জামান পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য। সিএসপি কর্মকর্তা ওয়ালিউল ইসলাম, কামাল সিদ্দিকী, সা’দত হোসেন ও মামুনুর রশীদ প্রমুখ উপসচিব। এ ছাড়া ড. সৈয়দ আবদুস সামাদ জোনাল প্রশাসন–১ এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন।

আমি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে দীর্ঘদিন কাজ করতে পারিনি। তার কারণ ছিল মন্ত্রিসভায় সাধারণত বেশির ভাগ রাজনৈতিক আলোচনা হতো। মন্ত্রিসভার সদস্যরা এসব রাজনৈতিক আলোচনার কোনো কার্যবিবরণী রাখতে চাইতেন না। তার ফলে কর্মকর্তাদের উপস্থিতি তাঁরা পছন্দ করতেন না। বেশির ভাগ সময়ই কর্মকর্তাকে সভার বাইরে বসে থাকতে হতো। অবশ্য এইচ টি ইমাম এর ব্যতিক্রম ছিলেন। তাঁর উপস্থিতি মন্ত্রিসভার সদস্যরা মেনে নিয়েছিলেন।

আমি কলকাতায় আসার মাসখানেক পর সিলেটে আমার সাবেক ডেপুটি কমিশনার আবদুস সামাদ কলকাতায় আসেন। তখন পর্যন্ত সরকারের কোনো প্রতিরক্ষা বিভাগ ছিল না। প্রতিরক্ষা বিভাগের সব কাজ করা হতো মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক কর্নেল ওসমানীর অফিস থেকে। তবে কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে তখন মাঠপর্যায়ের সামরিক কর্মকর্তাদের সম্পর্ক ভালো ছিল না। উপরন্তু সেনাবাহিনীর ওপর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্তের ফলে সামাদ সাহেবকে প্রতিরক্ষাসচিব করা হয় এবং তাঁকে সহায়তা করার জন্য আমাকে উপসচিব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. বেলায়েত হোসেন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক জাহিদকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। এ ছাড়া শাহ আলী ইমাম নামে বন বিভাগের একজন কর্মকর্তাকে উপসচিব নিয়োগ দেওয়া হয়।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে পুরোপুরি কাজ শুরু করে এবং ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুজিবনগরে কাজ করে। প্রায় সাড়ে তিন মাস আমি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছি। এই সময়ে আমি মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা বিভাগ যেসব উল্লেখযোগ্য কাজ করেছে, সে সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। ভারতে যেসব নিয়মিত বাহিনী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে যুদ্ধ করছিল তাদের খাওয়াদাওয়া, অস্ত্রশস্ত্র এবং অন্য সব সুযোগ-সুবিধা ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে দেওয়া হতো। কিন্তু বাংলাদেশের নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে প্রায় সর্বত্রই অনেক মুক্তিযোদ্ধা দায়িত্ব পালন করতেন। তাঁদের খাওয়াদাওয়া, অস্ত্রশস্ত্র এগুলো ভারতীয় সরকার সব সময় দিত না। তাঁদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দেওয়া ছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি দায়িত্ব। এখানে দুটি ঘটনা উল্লেখ করি। একটি ঘটনা হলো অক্টোবর মাসে মাঠপর্যায় থেকে খবর আসে, বিভিন্ন স্থানে অনিয়মিত বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা সদস্যদের রাতে ঘুমানোর জন্য প্রয়োজনীয় কম্বল নেই। মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো পাঁচ হাজার কম্বল এসব বাহিনীর কাছে পাঠানো হবে। এ নির্দেশ যখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে আসে, তখন প্রতিরক্ষাসচিব আমাকে ডেকে বললেন, ‘পাঁচ হাজার কম্বল কিনে মেঘালয়ের তুরাতে পাঠিয়ে দাও’। আমি বললাম, ‘কোনো টেন্ডার নেই, কোনো এস্টিমেট নেই, কীভাবে আমি পাঁচ হাজার কম্বল কিনব?’ প্রতিরক্ষাসচিব বললেন, ‘এটা যুদ্ধাবস্থা। এখানে কোনো টেন্ডার লাগে না। তুমি লোকজনকে জিজ্ঞেস করে হিসাব করো পাঁচ হাজার কম্বলের দাম কত হতে পারে। সে টাকার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে হাতে হাতে রিকুইজিশন নিয়ে যাও।’ রিকুইজিশন নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে গেলে আমাকে টাকা দিয়ে দেওয়া হয়। সেই টাকা নিয়ে কয়েকজন বন্ধুবান্ধবসহ বড় বাজারে যাই এবং কম্বল দেখে পছন্দ হলে কোথাও পাঁচ শ কম্বল, কোথাও সাত শ কম্বল এ রকম করে কম্বল কিনতে কিনতে পাঁচ হাজার কম্বল কিনে এগুলোকে থিয়েটার রোডের অফিসে আনার ব্যবস্থা করি। অন্যদিকে ফোর্ট উইলিয়ামে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ছিলেন। আমি তাঁকে বলি যে কম্বলগুলো মেঘালয়ের তুরাতে পাঠাতে হবে। তিনি বললেন, ‘তুমি কম্বলগুলো গাড়িতে ভরে সরাসরি ফোর্ট উইলিয়ামে নিয়ে আসো।’ সেখানে আমি তাঁর কাছে কম্বল হস্তান্তর করি। কম্বলগুলো সঠিক সময়ে পৌঁছেছিল কি না এবং পৌঁছে থাকলে কতগুলো অনিয়মিত বাহিনীর কাজে লেগেছে, সেটা সম্বন্ধে আমি আর কিছু জানি না।

তেমনি আরেকটি ঘটনা ঘটে প্রতিরক্ষাসচিব যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে এসে আমাকে একটি আদেশ দেন। সেই আদেশে তিনি লেখেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মাঠে অনেক ভালো যুদ্ধ করছে। কিন্তু এই যুদ্ধ সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ বেতারে প্রচার করা সম্ভব হচ্ছে না। যদি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে উঁচু মানের টেপরেকর্ডার পাঠানো যায়, তাহলে সেনাবাহিনীর যুদ্ধের অনেক বাস্তব বিবরণ তুলে ধরা সম্ভব হবে।’ আমাকে অবিলম্বে ২০টি টেপরেকর্ডার কিনে শিলিগুড়িতে পাঠানোর আদেশ দেওয়া হয়। আমি কম্বলের পদ্ধতি অনুসরণ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করি। চৌরঙ্গীতে গিয়ে টেপরেকর্ডারের দোকান থেকে উন্নত মানের টেপরেকর্ডার কিনে থিয়েটার রোডে নিয়ে আসি। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে সেই টেপরেকর্ডারগুলো শিলিগুলিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই টেপরেকর্ডারগুলোও কতটুকু কাজে লেগেছে তা জানি না। তবে আমরা আমাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছি।

প্রায় ৫০ বছর পর সেই স্মৃতি রোমন্থন করলে আমাদের মনে অনেক প্রশ্ন জাগে। ৫০ বছর আগে বিনা টেন্ডারে অনেক কারিগরি তথ্য না জেনেও যে সিদ্ধান্ত দ্রুততার সঙ্গে নিতে পেরেছি, আজকে ৫০ বছর পরে আমরা কি একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারব? অবিশ্বাস, হিংসা-বিদ্বেষ আজকের আমলাতন্ত্রকে অনেক খাটো ও খর্ব করে দিয়েছে।

এ সময়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আরও দুটি কাজ করে। প্রথমত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে প্রথম ব্যাচে ১০০ জন অফিসার প্রশিক্ষণের জন্য নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই শিক্ষানবিশ অফিসারদের বাছাই করার দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রতিরক্ষাসচিব আবদুস সামাদকে। তিনি বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত জোনাল অফিসগুলোতে যান এবং সেখানে সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রার্থী নির্বাচন করেন। বিভিন্ন সময়ে তিনি তাঁর কনিষ্ঠ সহকর্মীদের তাঁর বোর্ডের সদস্য মনোনয়ন দেন। আমি দুটি বোর্ডের সদস্য হিসেবে কাজ করেছি। দুই মাসের মধ্যে এই নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়। তাই প্রতিরক্ষাসচিব অনেক সময়ই কলকাতায় থাকতে পারতেন না।

আরেকটি বিষয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়। পাকিস্তান সমর্থকদের ভয় পাওয়ানোর জন্য এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়। এ বিষয়টির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ড. বেলায়েত হোসেন ও জাহিদকে। তবে দুই তিন মাস সময়ে এ ক্ষেত্রে খুব একটা অগ্রগতি হয়নি।

সরকারের দায়িত্বের পরিধি

১৯৭১ সালের আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বের পরিধি বাড়তে থাকে। ২০ অক্টোবর ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকারে ১২টি মন্ত্রণালয় ছিল।

১. প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, ২. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ৩. অর্থ ও শিল্প বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ৪. মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়, ৫. সাধারণ প্রশাসন বিভাগ, ৬. স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়, ৭. তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, ৮. স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ৯. ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়, ১০. সংসদবিষয়ক বিভাগ, ১১. কৃষি বিভাগ ও ১২. প্রকৌশল বিভাগ।

মন্ত্রণালয়ের বাইরে আরও কয়েকটি সংস্থা ছিল, যারা সরাসরি মন্ত্রিপরিষদের কর্তৃত্বাধীনে কাজ করত যেমন:

১. পরিকল্পনা কমিশন, ২. শিল্প ও বাণিজ্য বোর্ড, ৩. নিয়ন্ত্রণ বোর্ড, যুব ও অভ্যর্থনা শিবির, ৪. ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি ও ৫. শরণার্থী কল্যাণ বোর্ড।

এ ছাড়া ১৫টি সংগঠন বাংলাদেশ সরকারের সমর্থনে কাজ করছিল। এই সংগঠনগুলো নিম্নরূপ:

১. যুব নিয়ন্ত্রণ পরিষদ ও প্রশিক্ষণ বোর্ড, ২. বাংলাদেশ হাসপাতাল, ৩. স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, ৪. জয় বাংলা পত্রিকা, ৫. বাংলাদেশ বুলেটিন, ৬. বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী সংগঠন, ৭. বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি, ৮. স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল, ৯. বঙ্গবন্ধু শিল্পীগোষ্ঠী, ১০. বাংলাদেশ তরুণ শিল্পীগোষ্ঠী, ১১. বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সমিতি, ১২. বাংলাদেশ সংগ্রামী বুদ্ধিজীবী পরিষদ, ১৩. নিউইয়র্ক বাংলাদেশ লীগ, ১৪. বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি, লন্ডন ও ১৫. লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেন্টসিয়া।

সরকারের সব পর্যায়ে অনেক নতুন নিয়োগ দেওয়া হয়। রুহুল কুদ্দুসকে সেক্রেটারি জেনারেল পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে নিয়োগ করা হয় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী, এম হুসেন আলী, এ ফতেহ এবং মাহবুবুল আলম চাষীকে। নুরউদ্দিন আহমদ, ড. টি হোসেন এঁদের সচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। মাঠপর্যায়ে যুব ক্যাম্পে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা যুবকদের মনোবল দৃঢ় করার জন্য তাঁদের মনস্তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণের এবং শারীরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। কোনো কোনো দুর্গম অঞ্চলে পাকিস্তান বাহিনী যেতে ভয় পেত। এসব দুর্গম স্থানে বাংলাদেশ সরকারের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। এসব অঞ্চলে (বিশেষ করে কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী ও রৌমারী থানায়) যাতে ফসল উৎপাদন ব্যাহত না হয়, সে জন্য সার, উন্নত মানের বীজ ও কীটনাশক সরবরাহ করতে হয়েছে।

স্বাধীন বাংলা সরকারের ডাক বিভাগও চালু ছিল। অর্থ সংগ্রহের জন্য স্মারক ডাকটিকিট বিক্রি করা হতো। স্মারক ডাকটিকিট শুধু ভারতেই বিক্রি করা হতো না, এসব টিকিট নিউইয়র্ক, লন্ডন এ ধরনের বড় বড় শহরে বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করা হতো।

সরকারের কাজ বেড়ে যাওয়ায় সরকারের অফিসের সংখ্যাও বাড়াতে হয়। বাংলাদেশ সরকারের শুরু হয়েছিল প্রথমে সার্কাস অ্যাভিনিউতে। ভবনটি পাকিস্তান সরকারের কেনা সম্পত্তি ছিল। যেহেতু এই মিশনের বেশির ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী বাঙালি ছিলেন এবং তাঁরা সবাই স্বাধীন বাংলা সরকারে আস্থা স্থাপন করেছেন, সেহেতু এই বাড়ি বাংলাদেশ সরকারের দখলে চলে আসে। এখনো কলকাতায় বাংলাদেশের উপ-দূতাবাস সার্কাস অ্যাভিনিউর বাড়িতেই অবস্থিত। বাংলাদেশ সরকারের দ্বিতীয় অফিস স্থাপন করা হয় থিয়েটার রোডে। ব্রিটিশ শাসনামলে ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে বাংলা প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ছিল। সোহরাওয়ার্দী সাহেব যখন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি এই বাড়িতেই থাকতেন। ভারত বিভাগের পর এই বাড়ি ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সকে দেওয়া হয়। তারা এই বাড়ি অতিথিশালা হিসেবে ব্যবহার করত। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এই বাড়িতেই বাংলাদেশ সরকারের প্রধান কার্যালয়ের কাজ শুরু হয়। প্রায় আট মাস এখানেই সরকারের অধিকাংশ কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে। নভেম্বর মাসে দত্তশ্রী সিনেমা হল নামে একটি পরিত্যক্ত সিনেমা হল ভাড়া নেওয়া হয়। প্রতিরক্ষা এবং মন্ত্রিপরিষদ–সংক্রান্ত বিভাগগুলো ছাড়া বাকি বিভাগের অফিস দত্তশ্রী সিনেমা হলে স্থানান্তর করা হয়। অবশ্য সেখানে বেশির ভাগ বিভাগই মাসখানেকও অফিস চালাতে পারেনি।

মুজিবনগর সরকার বলতে যে ছবি মুজিবনগরের অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীর মনে ভেসে ওঠে, সেটি হলো থিয়েটার রোডের বাড়ি। যদি কলকাতায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের স্মৃতি রক্ষার্থে কোনো জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করতে হয়, তাহলে তার উপযুক্ত স্থান হবে থিয়েটার রোডে বিএসএফের বাড়ি। বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারের কাছে অনেক কিছু চেয়েছে এবং পেয়েছেও। কিন্তু কখনো এই বাড়ি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ভারত সরকারের কাছে চাওয়া হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে রামকৃষ্ণ মিশন এই বাড়ি বরাদ্দ করার জন্য ভারত সরকারের কাছে প্রার্থনা করে এবং বাড়িটি বরাদ্দ নিয়ে তারা সেখানে একটি সেবা কেন্দ্র স্থাপন করেছে। এখন যদি এই বাড়ি কিনতে হয়, তাহলে রামকৃষ্ণ মিশনের সম্মতির প্রয়োজন হবে। রামকৃষ্ণ মিশন একটি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান এবং তাদের সম্পত্তি তারা বিক্রয় করতে রাজি হবে কি না তাতে সন্দেহ রয়েছে। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান স্মরণ করে ঢাকায় রেসকোর্সে ইন্দিরা মঞ্চ স্থাপন করেছে এবং ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনী গঠিত যৌথবাহিনীর কাছে যে স্থানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল, সেখানেও একটি মঞ্চ নির্মাণ করেছে। বিশ্বভারতীতে বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে বাংলাদেশ হাউস প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অথচ কলকাতায় মুজিবনগর সরকার বলতে যে স্থানটিকে বোঝানো হয়, সে স্থানটি সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। বাংলাদেশের প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার জন্যই এটি একটি দুঃসংবাদ।

মুজিবনগর সরকারের ঔতিহাসিক ভূমিকা

আমরা এখন মুজিবনগর সরকারের ঐতিহাসিক ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করতে পারি। মুজিবনগর সরকার দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে। প্রথমটি হলো কম বেতনে হলেও যেসব সরকারি কর্মচারী পাকিস্তানে নিযুক্ত ছিলেন, তাঁদের চাকরির ব্যবস্থা করা হয়। এতে কর্মচারীদের মনোবল বেড়ে যায়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে মুজিবনগরে কর্মচারীদের যে বেতন দেওয়া হতো, তার অর্থ ভারত সরকার দেয়নি। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে যে অর্থ ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেই অর্থের একটি অংশ ভারতীয় মুদ্রায় রূপান্তরিত করে সরকারের খরচ চালানো হচ্ছিল। অবশ্য ভারতের অনেক প্রাদেশিক সরকার এক কোটি থেকে দশ কোটি রুপি অনুদান বাংলাদেশ সরকারকে দেবে বলে ঘোষণা করে। তবে সে অর্থ আসার আগেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়।

বাংলাদেশ সরকার আরেকটি বড় কাজ করে ইয়ুথ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভয়ে এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য লক্ষাধিক যুবক ভারতে আশ্রয় নেন। তাঁদের সবাইকে একসঙ্গে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধে নামানো সম্ভব ছিল না। তাই তাঁদের মধ্যে হতাশার কারণ ছিল। এই হতাশা দূর করার জন্য ইয়ুথ ক্যাম্পগুলোতে সরকার মনস্তাত্ত্বিক এবং শারীরিক শিক্ষার ব্যবস্থা করে। যেসব সরকারি কর্মচারীর কোনো প্রত্যক্ষ কাজ ছিল না, তাঁদের এ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ইয়ুথ ক্যাম্প কর্মসূচি সাফল্যের সঙ্গে পরিচালিত না হলে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের আশঙ্কা ছিল। ইয়ুথ ক্যাম্প পরিচালনা করে মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশের যুবকদের একটি সুসংহত বাহিনীতে পরিণত করে।

ভারতের জনগণের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি গড়ে তোলার জন্য একটি সরকারের প্রয়োজন ছিল। এই সরকার তার নিজস্ব পতাকা ব্যবহার করত। বাংলাদেশ সরকারের চিঠিপত্র যেখানেই দেখানো হতো, সেখানে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মর্যাদা দিত। সরকারের পাশাপাশি বাংলাদেশের তরুণেরা, সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, বঙ্গবন্ধু শিল্পীগোষ্ঠী, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করে এবং ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জনসমর্থন সৃষ্টি করে।

মুজিবনগর সরকারে অতি অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদদের নিয়ে পরিকল্পনা কমিশন গঠন করা হয়। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে কীভাবে অর্থনীতি পুনর্গঠন করতে হবে, সেটিই ছিল পরিকল্পনা কমিশনের প্রধান কাজ। তারা এক বছরের জন্য বিভিন্ন পণ্য ও সেবার চাহিদা নির্ণয় করে, অন্যদিকে অর্থনীতির পুনর্গঠনের জন্য কর্মসূচি প্রণয়ন করে। নভেম্বর মাসে যখন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ প্রায় নিশ্চিত হয়ে দাঁড়ায়, তখন পরিকল্পনা কমিশন ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে। যৌথ আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের অর্থনীতির অনেক সমস্যা এড়ানো সম্ভব হয়েছে।

মুজিবনগর সরকার একটি বড় সরকার ছিল। সরকারের প্রায় প্রতিটি অঙ্গই হয় বড় আকারে, না হয় ছোট আকারে কাজ করছিল। এর ফলে ভারত সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে যখনই কোনো বিষয়ে আলোচনা করতে চেয়েছে, তখনই বাংলাদেশের প্রশাসক ও বিশেষজ্ঞদের পাঠানো সম্ভব হয়েছে।

ভারতের প্রশাসকদের মনে বাংলাদেশের প্রশাসনের দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন ছিল। মুক্তিযুদ্ধে অনেক প্রশাসক মারা যাওয়ায় তারা ধরে নেয় যে ভারতীয় বাহিনী যখন বাংলাদেশে যাবে, তখন সেই বাহিনীর সমর্থনে বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনার ক্ষমতা বাংলাদেশ সরকারের নেই। তাই তারা পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের আগে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে বাঙালি আইএএস এবং আইপিএস কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে বাংলাদেশের ১৯টি জেলার জন্য ডেপুটি কমিশনার এবং এসপি পদে মনোনয়ন দেয়। তারা বাংলাদেশ সরকারকে এ সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি জারি করতে অনুরোধ করে। বাংলাদেশ সরকার স্পষ্ট বুঝতে পারে, এটি একটি মারাত্মক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। ভারতীয় অফিসারদের ডিসি, এসপির অফিসে বসতে দেখা গেলে বাংলাদেশের মানুষের কাছে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যাবে। তাই বাংলাদেশ সরকার এ ব্যবস্থায় রাজি হয়নি। বাংলাদেশের যেসব প্রশাসনিক ও পুলিশের কর্মকর্তা তখন মুজিবনগর সরকারের অধীনে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে যথেষ্ট ভালো কর্মকর্তা ছিলেন, তবে তাঁদের অনেকের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ছিল না। তাঁদের দেশপ্রেম, তাঁদের অভিজ্ঞতা ঘাটতি মোকাবিলা করতে সহায়তা করবে, এই বিশ্বাসে বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিস এবং পুলিশ সার্ভিস থেকে ১৯টি জেলায় ডিসি এবং এসপি নিয়োগ দেওয়া হয়। এই ডিসি ও এসপিরা প্রশাসনের অন্যান্য বিভাগের কর্মকর্তাদের তাঁদের জেলায় পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন।

যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা ছিল একটি জটিল ও দুরূহ কাজ। আমলাতন্ত্র তখন দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। এক ভাগে ছিলেন যাঁরা মুজিবনগর সরকারের কাছে আনুগত্য প্রকাশ করে স্বাধীন বাংলা সরকারে কাজ করছিলেন, অন্যদিকে ছিলেন পাকিস্তানের তাঁবেদার সরকারের কাজে নিযুক্ত আমলারা। দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাদের মধ্যে খুব বেশি হলে শতকরা ২০ ভাগ গেরিলা বাহিনীকে সুযোগ-সুবিধা করে দেওয়ার জন্য দেশের ভেতরে কাজ করছিলেন। কিন্তু যখনই তাঁরা ধরা পড়ার মতো অবস্থার সম্মুখীন হতেন, তখন তাঁরা পালিয়ে যেতেন। এ ছাড়া যাঁরা পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছেন, তাঁদের ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে কাজ করতে হয়েছে। যুদ্ধের পরিবেশে তাঁদের মধ্যে বাছাই করা সম্ভব ছিল না। যুদ্ধের শেষে মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তাদের অনেক উঁচু পদে নিয়োগ দিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে কর্মরত কর্মচারীদের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রোধ থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছেন, এ রকম অনেক কর্মকর্তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন মুজিবনগরের কর্মকর্তারা। তবে সবাই এ উপকার মনে রাখেননি। অনেক পাকিস্তানি কর্মকর্তার ওই সময়ে কনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের অধীনে কাজ করতে হয়েছে। তাঁরা এটাকে ব্যক্তিগত অপমান হিসেবে ধরে নেন এবং পরবর্তীকালে প্রতিবিপ্লবের সময় অনেক মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তার ক্ষতি করেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতৃত্ব। আমলাতন্ত্র এ রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সহায়তা করেছে কিন্তু আমলাতন্ত্রের কোনো নিজস্ব অস্তিত্ব ছিল না। এর ফলে পাকিস্তান কিংবা ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে।

মুজিবনগর সরকারের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আজ বারবার তিনটি বিষয় মনে পড়ছে। প্রথম বিষয়টি হলো মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মুজিবনগর সরকার যে কাজ করেছে, তা বাঙালি জাতির জন্য চিরদিন গর্বের কারণ হয়ে থাকবে। দ্বিতীয়ত, মুজিবনগর সরকারের প্রশাসনে রাজনীতিবিদ, আমলা এবং জনগণের মধ্যে ব্যবধান তত বড় ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সমাজে ব্যবধান অনেক বেড়ে গেছে। তৃতীয়ত, স্বাধীন বাংলাদেশে ঐক্যের রাজনীতির বদলে সংঘাতের রাজনীতি শুরু হয়। রাজনীতিবিদেরা অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়েন। এর প্রভাব আমলাতন্ত্রের ওপরও পড়ে। বাংলাদেশের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যখন জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকে, তখনই বাঙালিদের পক্ষে বড় অর্জন সম্ভব হয়, অন্যথায় নয়। আমরা প্রার্থনা করি যেন আগামী দিনে বাঙালি জাতি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে দৃপ্ত পদক্ষেপে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।

আকবর আলি খান: মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তা; সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা