বিজ্ঞাপন

গণহত্যা ও আন্তর্জাতিক আইন

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হিটলারের নেতৃত্বে ইহুদি হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় বিশ্ব শিউরে উঠেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৪৬ সালে জাতিসংঘ এক প্রস্তাবে গণহত্যাকে আন্তর্জাতিক আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ বলে ঘোষণা করে। ১৯৪৮ সালে প্রণীত এবং ১৯৫১ সালে কার্যকর এ আইনে গণহত্যার সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়। সে সংজ্ঞার সাতটি শর্তে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনা যায়:

১. ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর সুপরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ; ২. বাঙালি সামরিক, বেসামরিক, আধা সামরিক, পুলিশ ও বৈমানিকদের সন্দেহবশত হত্যা; ৩. সেপ্টেম্বর ১৯৭১–এ ইয়াহিয়ার তথাকথিত সাধারণ ক্ষমার বিস্তৃত জালে আত্মসমর্পণকারী বাঙালিদের হত্যা; ৪. হাজার হাজার বাঙালিকে বন্দিশিবিরে রেখে নারকীয় নির্যাতন এবং হত্যা; ৫. নারী ধর্ষণ ও হত্যা; ৬. নিষ্পাপ শিশুহত্যা; এবং ৭. বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড।

অপারেশন সার্চলাইট

পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত বাঙালিদের কঠোর হাতে দমন করার জন্য ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সামরিক বাহিনী তাদের সশস্ত্র অভিযান ‘অপারেশন সার্চলাইট’ পরিচালনা করে। উদ্দেশ্য ছিল ঢাকাসহ পূর্ব বাংলার প্রধান শহরগুলোতে আওয়ামী লীগ নেতা, ছাত্রনেতা এবং বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের গ্রেপ্তার ও প্রয়োজনে হত্যা; সামরিক, আধা–সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের নিরস্ত্রীকরণ; অস্ত্রাগার এবং রেডিও ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ দখল করাসহ প্রদেশের পুরো কর্তৃত্ব গ্রহণ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করে এ অঞ্চলে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।

অপারেশনের প্রস্তুতি চলে মার্চের প্রথম থেকে। গুরুত্বপূর্ণ সেনানিবাস ও ছাউনিগুলোতে সেনাসমাবেশ ঘটানো হয়। ঢাকায় গণহত্যার মূল দায়িত্ব দেওয়া হয় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে। আরও ছিলেন মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা, জেনারেল হামিদ, জেনারেল এ ও মিঠঠা, মেজর জেনারেল ইফতেখার জানজুয়া, কর্নেল সাদউল্লাহ। সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান।

অপারেশন সার্চলাইটের আওতায় পরিকল্পনা নেওয়া হয়: ১. একযোগে পুরো পূর্ব পাকিস্তানে অভিযান শুরু হবে; ২. সর্বোচ্চ সংখ্যায় রাজনীতিক, ছাত্রনেতা, শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মীদের গ্রেপ্তার করতে হবে; ৩. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখলে নিতে হবে; ৪. সেনানিবাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে; ৫. অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ছিন্ন করে দিতে হবে; ৬. ইপিআরের সেনাদের জায়গায় পাকিস্তানি সেনাদের অস্ত্রাগারের কর্তৃত্ব দিতে হবে: ৭. অপারেশন প্রথম পর্যায়ে হবে ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, রংপুর, সৈয়দপুর ও সিলেটে। চট্টগ্রাম, সিলেট, যশোর, রংপুর ও কুমিল্লায় প্রয়োজনে বিমানযোগে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে।

অভিযানের আওতায় ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১১টা থেকে মধ্য মে পর্যন্ত বড় বড় শহরে অভিযান পরিচালিত হয়। এর মধ্যে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী প্রভৃতির সহায়তায় গ্রামেগঞ্জে হত্যাযজ্ঞ চলে। দেশব্যাপী সর্বাত্মক গণহত্যা চলে স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত।

অপারেশন সার্চলাইট বাস্তবায়ন

ঢাকা বিভাগ: মূল পরিকল্পনায় ছিল রাত একটায় অভিযান শুরু হবে। পথে বিলম্বের আশঙ্কায় অভিযান শুরু হয় সাড়ে ১১টায়। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। অন্যদিকে চলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ। রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, বিভিন্ন থানা, ফাঁড়ি, পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তর দখল করতে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়।

সাংবাদিকদের ভাষ্যে জানা যায়, ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় ৭ হাজারের মতো বাঙালি হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ৯ মাসে শহীদ হন ১৯৪ জন শিক্ষক, কর্মচারী, ছাত্র ও তাঁদের পরিবারের সদস্য।

ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জে বক্তাবলী ইউনিয়ন ও আলীগঞ্জ বধ্যভূমিতে বহু লোককে হত্যা করা হয়। ঢাকা–সংলগ্ন কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় ২ এপ্রিল গানপাউডার দিয়ে গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। মারা হয় শত শত লোক। ঢাকা বিভাগের মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় সেনারা এক দিনে ৩৬০ জনকে হত্যা করে। কিশোরগঞ্জ জেলার বরইতলা, বাজিতপুর, কটিয়াদী, ভৈরবে নির্বিচারে হত্যা করে শত শত মানুষ। জামালপুরে ১০ হাজার লোক হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়। ফরিদপুরে ছিল অনেকগুলো নির্যাতনকেন্দ্র ও বধ্যভূমি। গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া থানার কালীবাড়িতে ১২ অক্টোবর শুধু এক দিনে ২০০ নিরীহ গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদী, জামালপুর, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর ও মাদারীপুরে বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হয়। ময়মনসিংহ জেলায় পাওয়া যায় ১২টি বড় বধ্যভূমির সন্ধান।

চট্টগ্রাম বিভাগ: চট্টগ্রামে বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক গণহত্যা চলে। দৈনিক বাংলার ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানি বাহিনী চট্টগ্রামে প্রায় ৪০ হাজার লোককে হত্যা করে। চট্টগ্রামের ৭৩ জন পুলিশ হত্যার শিকার হন। চট্টগ্রাম শহরে ছিল ২০টি বধ্যভূমি। বড় বধ্যভূমিগুলো ছিল পাহাড়তলী, ওয়্যারলেস কলোনি, শেরশাহ কলোনি ও ফয়’স লেকে।

চট্টগ্রাম বিভাগের কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও বহু লোককে হত্যা করা হয়। কুমিল্লা সেনানিবাসে ৭০০ নরকঙ্কাল পাওয়া যায়। স্বাধীনতার পরে পত্রিকা থেকে জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২৫ হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধকালে সিলেট ছিল চট্টগ্রাম বিভাগের অধীনে। বৃহত্তর সিলেট জেলার সালুটিকর, বালাগঞ্জ, বুরঙ্গা, মৌলভীবাজার, খাদিমনগর ও শমশেরনগরে ছিল বড় বড় বধ্যভূমি। বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন চা–বাগানের বহু শ্রমিককে হত্যা ও নির্যাতন করা হয়।

default-image

রাজশাহী বিভাগ: রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল গণহত্যার অন্যতম জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষকসহ বহু কর্মচারী ও ছাত্র শহীদ হন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বধ্যভূমিতে বাইরের বহু লোককে এনে হত্যা করা হয়।

এ বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, পাবনা, বগুড়ায় বহু লোক হত্যার শিকার হয়। নাটোরের ছাতনী, গোপালপুর সুগার মিল ছিল বড় বধ্যভূমি। গোপালপুর সুগার মিলের ৩০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর রক্তে রঞ্জিত হয়েছে মিলের পুকুর। স্বাধীনতার পর পূর্বদেশ পত্রিকার প্রতিবেদনে বগুড়া জেলার ২৫ হাজার লোককে হত্যার সংবাদ প্রকাশ করে।

বৃহত্তর রংপুর বিহারি–অধ্যুষিত হওয়ায় হত্যাকাণ্ডের মাত্রা ছিল বেশি। রংপুর জেলার সেনানিবাস, সৈয়দপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী, কুড়িগ্রামে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চলে। ১৯৭২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি দৈনিক বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু রংপুরে ৬০ হাজার লোককে পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করে।

পাবনা ওয়াপদা পাওয়ার হাউস ছিল জেলার প্রধান বধ্যভূমি। এখানে প্রায় তিন হাজার লোককে হত্যা করা হয়। ঈশ্বরদী ছিল আরেকটি বিহারি–অধ্যুষিত এলাকা। এখানে প্রায় ৫০০ লোককে হত্যা করা হয়। সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীতে মুক্তিযুদ্ধকালে বহু লোককে হত্যা করে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে।

খুলনা বিভাগ: খুলনা বিভাগে খালিশপুর, গোয়ালপাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র, পিপলস জুট মিল, খুলনা রেলওয়ে স্টেশন, রূপসা কাস্টমস ঘাট, প্লাটিনাম জুট মিল ও গল্লামারী ছিল বধ্যভূমি। খালিশপুরে বৃহৎ শিল্পগুলোর বাঙালি শ্রমিকদের পাকিস্তানি বাহিনী গণহারে হত্যা করে। বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি অঞ্চলেও তারা ব্যাপক গণহত্যা চালায়। স্বাধীনতার পর পূর্বদেশ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, বরিশালে পাকিস্তানি বাহিনী ৫০ হাজার লোককে হত্যা করে। পিরোজপুরে এ সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০ হাজার। এই মহকুমায় প্রায় ১০ হাজার নারী-পুরুষ-শিশুকে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা হত্যা করে।

পাকিস্তান সরকারের দায়

স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারি বাংলাদেশে তাদের সংঘটিত গণহত্যাকে অস্বীকার করে আসছে। অথচ ১৯৭১-৭৪ পর্যন্ত পাকিস্তানের বিভিন্ন নথিতেও গণহত্যায় তাদের সংশ্লিষ্টতার স্বীকৃতি মেলে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে পাকিস্তানের পরাজয়ের কারণ নির্ণয়ের জন্য গঠিত হয় বিচারপতি হামুদুর রহমান কমিশন ও জেনারেল আফতাব কমিশন। উভয় কমিশনের প্রতিবেদনেই পাকিস্তানিদের জবানবন্দিতে গণহত্যায় তাদের সংশ্লিষ্টতার উল্লেখ আছে।

বঙ্গবন্ধুর আমলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাংলাদেশ উদ্যোগ নিলে পাকিস্তান সরকার বিরোধিতা করে। পাকিস্তানের গণহত্যায় সংশ্লিষ্টতার বড় প্রমাণ ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ–ভারত–পাকিস্তান স্বাক্ষরিত ত্রিপক্ষীয় চুক্তি। এর ১৩, ১৪, ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনী যে বর্বরতা চালিয়েছে, তা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী এবং গণহত্যার শামিল। ১৫ নম্বর ধারায় বলা হয়, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে বাংলাদেশ ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীর বিচার বাতিল করে তাদের ক্ষমা করে পাকিস্তানে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে। চুক্তির এ ধারার ভিত্তিতে তারা মুক্তি পায়। চুক্তির স্বাক্ষরদাতা পাকিস্তানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমেদ গণহত্যার জন্য গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন।

১৯৭৪ সালের ১১ এপ্রিল পাকিস্তানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীকে বাংলাদেশ ক্ষমা করলেও পাকিস্তান সরকার দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। তবে পরবর্তী সময়ে এ ব্যাপারে তারা মৌন থেকেছে।

৩০ লাখ বাঙালি হত্যাযজ্ঞের শিকার হলেও আজও এই হত্যাযজ্ঞ আন্তর্জাতিকভাবে ‘গণহত্যা’ হিসেবে স্বীকৃত হয়নি। বর্তমান সরকার আরও তৎপর হলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মতো আগামীতে আমরা হয়তো একাত্তরের গণহত্যারও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাব।


ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসেন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক এবং কলা অনুষদের ডিন