স্বাধীন বাংলাদেশের সূতিকাগার হচ্ছে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল এই জায়গার নামকরণ করা হয় ‘মুজিবনগর’। বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ গর্বের সঙ্গে এই নামকরণ করেছিলেন। তখন সরকারি নথিতে লেটার হেডে লেখা থাকত ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, মুজিবনগর’। সরকারের ঠিকানা ছিল মুজিবনগর।
প্রতিবছরের ১৭ এপ্রিল, মুজিবনগরে সরকারিভাবে বিশেষ অনুষ্ঠান হওয়া উচিত বলে মনে করি। আমার ধারণা, এটি জনগণেরও প্রত্যাশা। মুজিবনগর দিবসে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশেষ অনুষ্ঠানের অনুপস্থিতি আমাকে পীড়া দেয়।
বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে মুজিবনগর রাষ্ট্রীয়ভাবে চিহ্নিত হওয়া প্রয়োজন। নতুন প্রজন্ম যাতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারে, সচেতন হতে পারে এবং গর্ববোধ করতে পারে, সে জন্য প্রতিবছরের ১৭ এপ্রিল সেখানে জাতীয়ভাবে উৎসবসহ নানা উপযুক্ত
অনুষ্ঠান রাষ্ট্রীয়ভাবে করা প্রয়োজন।
মুজিবনগর শুধু ঐতিহাসিক স্থানই নয়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং রাষ্ট্র গঠনের ভূমিও। যুদ্ধ করে বিজয়ী হওয়া প্রতিটি দেশের এমন একটা জায়গা থাকে, যেটি মানুষের আবেগের সঙ্গে যুক্ত। যেমন আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে চিহ্নিত। ঠিক সেভাবে মুজিবনগরে উপযুক্ত স্থাপনা তৈরি করা এবং বড় উৎসবের জায়গা হতে পারে।
মুজিবনগর জাদুঘর আরও সমৃদ্ধ করা প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধকালীন পুরোনো অস্ত্র সংগ্রহ করে সংরক্ষণসহ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক ধরনের পেইন্টিংও থাকতে পারে সেখানে। ঐতিহাসিক ও স্মরণীয় সব ঘটনাকে জাদুঘরে তুলে ধরার ব্যবস্থা রাখা দরকার, যাতে এটি স্বাধীনতার জাদুঘর হিসেবে পূর্ণতা পায়। ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক নিদর্শন বিবেচনায় এটি হোক আন্তর্জাতিক মানের জাদুঘর। যাতে এখানে এসে মানুষ বুঝতে পারে মুজিবনগর হলো বাংলাদেশের উৎপত্তিস্থল। মুজিবনগর থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের কথা কার্যত সারা বিশ্ব আনুষ্ঠানিকভাবে জানল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই গঠিত হয়েছিল মুজিবনগর সরকার। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের দিন। ভোরের দিকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও ওসমানী গাড়িতে কলকাতা থেকে মেহেরপুরের উদ্দেশে রওনা হন।
১৭ এপ্রিল শপথ অনুষ্ঠানে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের হাজির করার ভার ছিল আমার ও আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের তৎকালীন হুইপ আবদুল মান্নানের ওপর। ১৬ এপ্রিল আমরা দুজনে মিলে কলকাতা প্রেসক্লাবে যাই। এই প্রথম বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দুজন প্রতিনিধি বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে মিলিত হলেন। পুরো প্রেসক্লাব লোকে লোকারণ্য। সার্চলাইটের মতো অসংখ্য চোখ আমাদের দিকে নিবদ্ধ। ক্লাবের সেক্রেটারি উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
সমবেত সাংবাদিকদের পরদিন ১৭ এপ্রিল কাকডাকা ভোরে প্রেসক্লাবে হাজির হতে অনুরোধ জানানো হলো। তাঁদের বলা হলো, আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একটি বিশেষ বার্তা তখন জানানো হবে। তাঁদের কেউ কেউ আরও কিছু প্রশ্ন করতে চাইলেন। আমরা কোনো উত্তর দিতে অপারগতা প্রকাশ করলাম। সাংবাদিকদের নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের গাড়ি তৈরি থাকবে বলে জানালাম।
এদিকে শপথ অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি তৈরি করা হচ্ছে। জানা গেল প্রধান সেনাপতি ওসমানীর সামরিক পোশাক নেই। কিন্তু শপথ অনুষ্ঠানের জন্য তাঁর সামরিক পোশাক প্রয়োজন। বিএসএফকে ওসমানীর জন্য এক সেট সামরিক পোশাক দিতে বললাম। তাদের স্টকে ওসমানীর গায়ের মাপে কোনো পোশাক পাওয়া গেল না। সেই রাতে (১৬ এপ্রিল) কাপড় কিনে দরজি ডেকে তাঁর জন্য পোশাক তৈরি করা হলো।
আর আমি ও আবদুল মান্নান ভোরের দিকে কর্মসূচি অনুযায়ী কলকাতা প্রেসক্লাবে গেলাম। সেই ভোরেও ক্লাবে লোকধারণের জায়গা নেই। ক্লাবের বাইরেও অনেকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি সাংবাদিকদের লক্ষ করে বিনীতভাবে বললাম, আমি বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আপনাদের জন্য একটা বার্তা নিয়ে এসেছি। তাঁদের জানালাম স্বাধীন বাংলার মাটিতে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করবে। আপনারা সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত। এ সময় কেউ কেউ জানতে চাইলেন, কোথায় যাবেন, কীভাবে যাবেন? আমি আবার বললাম, ‘আমরা আপনাদের সঙ্গে রয়েছি। পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব।’ আমাদের গাড়িগুলো তখন প্রেসক্লাবের সামনে। উৎসাহী সাংবাদিকেরা গাড়িতে উঠলেন। অনেকের কাঁধে ক্যামেরা। ৫০-৬০টি গাড়ি নিয়ে আমরা রওনা দিলাম গন্তব্যস্থলের দিকে। আমি ও আবদুল মান্নান দুজন দুই গাড়িতে। আমার গাড়িতে কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিক ছিলেন। পথে তাঁদের সঙ্গে অনেক কথা হলো।
শপথ অনুষ্ঠানের নির্ধারিত স্থানে, অর্থাৎ বৃহত্তর কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে পৌঁছাতে বেলা ১১টা বেজে গেল। আমরা পৌঁছার পরপরই অনুষ্ঠান শুরু হয়। ঝিনাইদহ মহকুমার পুলিশ প্রধান মাহবুব উদ্দিন আহমদ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার দেন। মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-ইলাহী শপথ অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন। আগেই ঠিক করা হয়েছিল, আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী শপথ অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করবেন।
অনুষ্ঠানের জন্য ছোট্ট একটি মঞ্চ তৈরি করা হয়। মঞ্চে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্যরা, এম এ জি ওসমানী, আবদুল মান্নান ও আমি। আবদুল মান্নান অনুষ্ঠান পরিচালনা করলেন। ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করলেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিলেন। এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এই স্থানের নাম ‘মুজিবনগর’ নামকরণ করেন। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত মুজিবনগর ছিল সরকারের রাজধানী।
সাংবাদিকদের প্রধান প্রশ্ন ছিল সরকারের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোথায়? জবাবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই মন্ত্রিসভা গঠন করেছি। তাঁর সঙ্গে আমাদের চিন্তার (বিস্তর) যোগাযোগ রয়েছে।’
আমবাগানের অনুষ্ঠানে ভরদুপুরে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ছাড়াও পার্শ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার লোক জমায়েত হয়। হাজারো কণ্ঠে তখন উচ্চারিত হচ্ছিল ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ ইত্যাদি স্লোগান।
আমার কাজ ছিল দ্রুত অনুষ্ঠান শেষ করে সাংবাদিকদের কলকাতা ফেরত পাঠানো। দুপুরের মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল। সাংবাদিকদের গাড়িতে করে ফেরত পাঠানো হলো। মন্ত্রিসভার সদস্যরা ফিরলেন সন্ধ্যায়। অনুষ্ঠানের পর কলকাতায় ফিরে গিয়ে সাংবাদিকেরা বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে সরকার গঠন সম্পর্কে সংবাদ পাঠাতে শুরু করলেন।
মুজিবনগর সরকার নিয়ে এমন একটা সময়ে আমরা আলোচনা করছি, যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপিত হচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাস জানতে হলে মুজিবনগর সরকার এবং এই সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে হবে, বুঝতে হবে। আমি মনে করি মুজিবনগর সরকারের ইতিহাস ও তাৎপর্য পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। পাঠ্যপুস্তকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রও অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। মুজিবনগর সরকার নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। বিশেষ করে শিক্ষার্থী এবং নতুন প্রজন্ম মুজিবনগর সরকার বিষয়ে আগ্রহ নিয়ে গবেষণা করবে, এটিই প্রত্যাশা।
স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা, এই সরকারের বিচক্ষণতা ও কৌশল সম্পর্কে বর্তমান সময়ের তরুণ রাজনীতিবিদদেরও জানা থাকা দরকার। যে ত্যাগ, সাহস ও দূরদর্শিতার মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীনতা অর্জনের পথে নিয়ে যায় মুজিবনগর সরকার, সেই গৌরবের ইতিহাস কখনো ভুলে যাওয়ার নয়। বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে নিতে এবং রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত ওই সময়ের নেতাদের জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
১৭ এপ্রিল, ১৯৭১ মুজিবনগর সরকার গঠনের দিবস, দেশের নতুন প্রজন্ম ও ভবিষ্যতের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। আমরা আগামীতেও দিনটি যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করব।
ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম: জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, সাবেক সাংসদ ও প্রতিমন্ত্রী, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের রচয়িতা।