বিজ্ঞাপন
default-image

সিদ্দিক মোল্লা আমার মামা। সংগ্রামের সময় তাঁর বয়স ছিল ১৫ বছর। তাঁর মেজ ভাই সোলায়মান মোল্লা আইএসসি পাস করেন গৌরনদী কলেজ থেকে। ১৯৭১ সালে তিনি বিএসসি পরীক্ষা দিচ্ছিলেন গোপালগঞ্জ কলেজ থেকে। ছয়টি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর দেশের পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। সোলায়মান মোল্লা গোপালগঞ্জ থেকে তাঁর বাড়িতে চলে আসেন।

পাকিস্তানিরা আস্তে আস্তে কোটালীপাড়া এলাকায় ঢুকে পড়ে। একদিন পাকিস্তানি সেনারা সোলায়মান মোল্লাকে বাড়ি থেকে গামছা দিয়ে পিছমোড়া করে বেঁধে নিয়ে গিয়ে বেদম মার দেয়। তাঁর সামনে বহু লোক মারা যায়। তারা হানিফ চেয়ারম্যানের বাড়িতে নিয়ে হত্যা করে ফারুক, জব্বার, আজিজ, ইংগুলসহ অনেককে। সোলায়মান মোল্লা শহীদ হন সবার শেষে।

তাঁকে ও হরি মিত্রকে হানিফ চেয়ারম্যানের বাড়ির উত্তর-পূর্ব পাশে পুকুরে নামিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। সোলায়মান মোল্লার মা এখনো জীবিত। তাঁর পরিবার মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করেছিল।

একদিন আমার মামা দেখতে পেলেন কিছু পাকিস্তানি সেনা কয়েকজনকে হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে রেখেছে। ঘটনাটি দেখে মামা অনেক ভয় পেয়ে যান। তিনি হঠাৎ চিৎকার করে ওঠেন। সে চিৎকার শুনে পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে ধরারও চেষ্টা করে, কিন্তু তাঁকে ধরতে পারেনি। তারা তাঁকে গুলি করারও চেষ্টা করে। কিন্তু ভাগ্যজোরে তিনি বেঁচে যান।

একদিন তিনি সিকির বাজার হাইস্কুলের উত্তর পাশে বুকে দুটি গুলি করে শশী বাড়ৈকে মাঠের ধানের মধ্যে ফেলে দিতে দেখেন। রুহুল ঘরামীকে তারা চার-পাঁচটি গুলি করে। বাচ্চা বলে একজন বাঙালি ক্যাপ্টেন রুহুলকে গুলি করতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু নিষ্ঠুর পাকিস্তানি সেনারা রুহুলকে ছাড়েনি। তাকে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। রুহুল ওদের কাছে একটু পানি খেতে চাইলে ওরা পানির বদলে প্রস্রাব খেতে দেয়। রুহুল অবশেষে মারা যায়।

বাংলাদেশের অনেক মানুষ পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দেশ ত্যাগ করছিল। সোহাগ নামে একটা ছেলেও তার মামা-মামির সঙ্গে যাচ্ছিল। মামি তাকে মুড়ির টিন নিয়ে আসতে বলেন। মুড়ির টিন আনতে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে সোহাগ ধরা পড়ে যায়। সোহাগেরও মৃত্যু হয়। মামা এ ঘটনা দেখতে পেয়েছিলেন।

একদিন মামা বসে ভাত খাচ্ছেন আর নানা বসে কোরআন শরিফ পড়ছেন। এমন সময় পাকিস্তানি বাহিনী এসে পড়ল। সবাই ভয় পেল। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে কিছু বাঙালিও ছিল। তারা ওদের বলল, পবিত্র কোরআন পড়ছে, মারার দরকার নেই। ওরা কাউকে কিছু বলল না। কিন্তু মামার ফুফাতো বোন রহিমাকে ধরে নিয়ে গেল পাকিস্তানি সেনারা। এরপর তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

একদিন মাছ ধরতে গিয়ে মামা তাঁর জালে একটি চুড়ি পান। চুড়িটি তাঁর খুব চেনা মনে হওয়ায় তিনি আবার জাল ফেলেন, কিন্তু কিছুই পান না। মাছ ধরা শেষে তিনি গোসল করতে নামেন। তাঁর পায়ের নিচে কী যেন আছে বলে মনে হয়। তিনি সবাইকে ডেকে ব্যাপারটি বলেন। পুকুরে নেমে সবাই রহিমার লাশ দেখতে পায়। এ খবর শুনে রহিমার মা বেগম ছবুরুনও অজ্ঞান হয়ে মারা যান।

(বর্ণনাকারী সিদ্দিক মোল্লা, গ্রাম: সিকির বাজার, গোপালগঞ্জ, সম্পর্কে সংগ্রহকারীর মামা)

সূত্র: ছাত্রছাত্রীদের সংগৃহীত মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী-ভাষ্য, ষষ্ঠ পর্ব, সম্পাদনা: মফিদুল হক, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, জুন ২০১২