বিজ্ঞাপন
default-image

৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে বাংলাদেশের ২০২১ সালে, সেই সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনীতিরও। কূটনীতির বিবর্তনের ইতিহাস দীর্ঘ। ট্রয় অভিযানের আগে গ্রিক রাজ্যগুলোর পক্ষ থেকে দূত গিয়েছিল ট্রয়ে, হেলেনকে ফেরত দেওয়া এবং অপহরণকারী প্যারিসের শাস্তিবিধানের প্রস্তাব নিয়ে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র-এও বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে দূত প্রেরণের কথা আছে, আর আছে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রতি তাঁর সেই আপ্তবাক্য, ‘আপনার প্রতিবেশী আপনার শত্রু, আপনার প্রতিবেশীর প্রতিবেশী আপনার বন্ধু।’

এককথায় বলতে গেলে যেকোনো দেশের কূটনীতির লক্ষ্য হচ্ছে দেশের স্বার্থ রক্ষা। সে স্বার্থ হতে পারে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অথবা নিরাপত্তাসংক্রান্ত। এ কূটনীতি কেমন হবে, কী লক্ষ্যে পরিচালিত হবে, তা অনেকাংশে নির্ভর করে পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর। দেশটির ভৌগোলিক ও ভূরাজনৈতিক অবস্থান, আর্থিক ও সামরিক শক্তি, মানবসম্পদ ইত্যাদি সবকিছুই প্রভাব ফেলে দেশটির কূটনীতিতে। এর অনেকটাই আপেক্ষিক। এক পাশে তিন দিক দিয়ে ঘিরে রাখা ভারত, অন্যদিকে মহাচীন বাংলাদেশকে একটি তুলনামূলক ছোট রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। এমনকি প্রতিবেশী মিয়ানমার, জনসংখ্যায় আমাদের এক-তৃতীয়াংশ হলেও আকারে পাঁচ গুণ। বাংলাদেশের কূটনীতি এসব বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই পরিচালিত করতে হয়েছে। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়—এই মূলনীতি দিয়েছে আমাদের সংবিধান। তবে বাস্তব দুনিয়া এত সরল পথে চলে না।

৫০ বছরে বিপুল সাফল্য আছে বাংলাদেশের, আছে কিছু ব্যর্থতাও। তেমনি বাংলাদেশের কূটনীতিতেও আছে সাফল্য আর ব্যর্থতা। মোটাদাগে বাংলাদেশের কূটনীতিকে আমি সাতটি পর্বে ভাগ করতে চাই। ভাগটি আমি করেছি বিভিন্ন সময়ের বাস্তবতা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, সুবিধা, সীমাবদ্ধতা ইত্যাদির নিরিখে। এর অনেকাংশই চাকরিসূত্রে আমার নিজের দেখা, বাকিটুকু প্রাপ্ত তথ্যের বিশ্লেষণ।

প্রথম পর্ব: মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১, মুজিবনগর সরকার: ১০ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে মুজিবনগরে শপথ নেওয়া বাংলাদেশের প্রথম সরকার কাজ শুরু করে ১৭ এপ্রিল কলকাতায়। বাংলাদেশের কূটনীতির প্রথম পর্যায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে পরদিন ১৮ এপ্রিল। এদিন কলকাতায় পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার এম হোসেন আলী মিশনের সব বাঙালি কর্মকর্তা, কর্মচারীসহ বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি যদিও মেলেনি, এটি বাংলাদেশের প্রথম কূটনৈতিক মিশন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত অনেক বাঙালি কূটনীতিক এরপর বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে থাকেন। লন্ডনে অবস্থানরত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে চিফ ওভারসিজ রিপ্রেজেনটেটিভ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কূটনীতির মূল লক্ষ্যগুলো ছিল দেশে যে গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে, তা বিশ্বের কাছে তুলে ধরে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা, ভারতে বাংলাদেশি শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা অর্জন করা এবং বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রাখা। এই প্রচেষ্টার ফলে অল্প কিছু দেশ ও সরকার বাদ দিলে সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের পক্ষে বিপুল জনসমর্থন গড়ে ওঠে।

তবে নানা কারণে এই কর্মকাণ্ডে যথাযথ সমন্বয় সাধন সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল, প্রবাসী মুজিবনগর সরকারে বিদ্যমান অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। ভারতীয় গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে তরুণ নেতৃত্বের একাংশ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কর্তৃত্বকে উপেক্ষা করেন। অন্যদিকে প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদকে তাজউদ্দীন বা ভারতীয়রা কেউই বিশ্বাস করতেন না। ফলে এ ধরনের কর্মযজ্ঞে যে কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল দরকার, তার অভাব ছিল।

দ্বিতীয় পর্ব: মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী পর্যায়, ১৯৭২-৭৫ : সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বসম্প্রদায়ের স্বীকৃতি আদায়। চীন, সৌদি আরবের মতো কয়েকটি দেশ বাদ দিলে বিশ্বের সব দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এ ছাড়া যুদ্ধবিধ্বস্ত যোগাযোগব্যবস্থা এবং অর্থনীতির পুনর্গঠনে বাংলাদেশ বিপুল সহানুভূতি এবং সমর্থন লাভ করে। ফলে খুব অল্প সময়ে সড়ক এবং রেল যোগাযোগ চালু হয়ে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারিত হয়।

এই সময়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল দেশের ভেতরে অবস্থানরত ভারতীয় সেনাসদস্যদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো। বঙ্গবন্ধুর এক সূক্ষ্ম চালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সেনা প্রত্যাহারে সম্মতি জ্ঞাপন করেন এবং তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনী স্বদেশে ফেরত যায়। বঙ্গবন্ধুর আরেকটি দূরদর্শী পদক্ষেপ ছিল ভারতের সঙ্গে পরামর্শ না করে, কুয়েতের দৌত্যে এবং পাকিস্তানের আমন্ত্রণে ইসলামি সম্মেলন সংস্থার লাহোর শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়া। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে যে একটি অস্বস্তিকর সম্পর্ক ছিল পাকিস্তান ভেঙে তৈরি হওয়া সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের, এই ঘটনায় তা সহজ হয়ে আসে। জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের বাধাও দূর হয় এবং ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করে।

ভুল, ব্যর্থতাও যে ছিল না এ সময়ে, তা নয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয় তদানীন্তন মার্কিন প্রশাসনের জন্য পরাজয়তুল্য ছিল। কিউবার সঙ্গে করা বাংলাদেশের এক বাণিজ্যিক লেনদেনে মার্কিন প্রশাসন রুষ্ট হয়। এ সময়ে বাংলাদেশের কূটনীতির আরেকটি ব্যর্থতা ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় পর্যাপ্ত আন্তর্জাতিক সহায়তা লাভে সফল না হওয়া, যার ফলে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগ এবং বিজয়ের ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে গৌরব অর্জন করেছিল বাংলাদেশ, অভ্যন্তরীণ গোলযোগ এবং সুশাসনের অভাবে তার অনেকখানিই হারিয়ে বসে দেশটি।

তৃতীয় পর্ব: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড থেকে ১৯৮২-র সামরিক অভ্যুত্থান: স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার অব্যবহিত পরই বাংলাদেশ জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে (ন্যাম) যোগ দেয়। তবে ন্যামভুক্ত অনেক দেশের মতোই, শীতল যুদ্ধের বিশ্বব্যাপী বিভাজনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল সোভিয়েত প্রভাববলয়ের প্রান্তে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এই অবস্থানের আমূল পরিবর্তন ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অস্বস্তিকর সম্পর্ক অনেকটা সহজ হয়ে আসে। চীন ও সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং দুই দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পক্ষান্তরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই পরিবর্তনে রুষ্ট হন এবং দেশটির সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে।

অভ্যুত্থান ও হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। প্রায় তিন মাসব্যাপী অস্থিতিশীলতা, অভ্যুত্থান, পাল্টা-অভ্যুত্থানের পর নভেম্বর মাসে অনেকটা স্থিতিশীল একটি সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। উচ্চ আদালতের রায়ে এই সরকারকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়েছে। তবে তৎকালীন বিশ্ব বাস্তবতার নিরিখে এই সরকারকে বহির্বিশ্বে তেমন বৈধতার সংকটে পড়তে হয়নি। বিগত শতকের ষাট, সত্তর ও আশির দশকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ১৪০টির মতো সফল সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে এবং বিশ্বব্যবস্থার নিয়ন্তারা এগুলোকে অনেকটাই সেসব দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবেই দেখেছে।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক কূটনৈতিক কার্যক্রম চালাতে তাই এ সরকার কোনো সমস্যায় পড়েনি। ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধী সরকারের পতনের পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্কও অনেকটা সহনশীল পর্যায়ে উন্নীত হয়। ফারাক্কা বাঁধে গঙ্গা নদীর পানিবণ্টনের একটি সাময়িক চুক্তিও এ সময় স্বাক্ষরিত হয় দুই দেশের মধ্যে। ১৯৭৯ সালে জাপানকে পরাজিত করে বাংলাদেশ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়। মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষত সৌদি আরবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের কর্মসংস্থান শুরু হয়।

চতুর্থ পর্ব এরশাদের শাসনামল, ১৯৮২-৯০: ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন অসামরিক সরকার বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ১৯৮২ সালের মার্চে এক রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানে সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন। এ অভ্যুত্থান কেন হলো, এর কোনো গ্রহণযোগ্য জবাব এরশাদ তাঁর ৯ বছরের শাসনামলে দিতে পারেননি। দেশের ভেতরে তাঁর এই গ্রহণযোগ্যতার সংকটে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাঁর অবস্থান ছিল বেশ দুর্বল।

এরশাদ সরকারের আইনি সিদ্ধতা প্রতিষ্ঠা করা এ সময়ে কূটনীতিকদের অন্যতম প্রধান কাজে পরিণত হয়। ভারত ও পশ্চিমের দেশগুলোর প্রতি সরকারের অতি আপসকামী নীতির পরিপ্রেক্ষিতে দেশের স্বার্থে কোনো দৃঢ় অবস্থান নেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে জিডিপিতে বৈদেশিক সাহায্যের অংশ দাঁড়ায় ৭ শতাংশ। এই নির্ভরশীলতার ফলে দাতাদেশগুলোর চাপিয়ে দেওয়া শর্তাবলি মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। ভারতকে খুশি রাখার জন্য গঙ্গার পানি চুক্তি নবায়ন করা হয় গ্যারান্টি ক্লজ বাদ দিয়ে।

পঞ্চম পর্ব: গণতন্ত্রের ক্লেশকর পরীক্ষা, ১৯৯১-২০০৬: এ ছিল সেই সময়, যখন কিসিঞ্জার আর তাঁর উত্তরসূরিদের ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণ করে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ তকমা থেকে বেরিয়ে আসে বাংলাদেশ। গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে সামরিক স্বৈরাচার হটিয়ে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক পরিসরে সম্মান বাড়ে বাংলাদেশের। ধারাবাহিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি দেশকে উচ্চতর অবস্থানে নিয়ে যায়।

বহির্বাণিজ্য ও অভিবাসন বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বৃদ্ধি পায় কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড। আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহেও বাংলাদেশ সক্রিয় ভূমিকা রাখে এবং বিভিন্ন নির্বাচনে জয়লাভ করে। জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশ পরিণত হয় প্রথম বা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী সরবরাহকারী। তাঁদের পেশাদারি এবং আন্তরিক সেবা দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ভারতের সঙ্গে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারতের সাহায্যপুষ্ট যে বিদ্রোহী গ্রুপ সক্রিয় ছিল, তাদের সঙ্গে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

এত সব সাফল্য অনেকটাই ম্লান হয়ে যায় অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভেদ ও সংঘাতের কারণে। বিদেশিদের উপর্যুপরি হস্তক্ষেপ আহ্বানে একদিকে যেমন দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অন্যদিকে বাংলাদেশের কূটনীতিকদের কার্যকারিতা হ্রাস পায়।

ষষ্ঠ পর্ব: তত্ত্বাবধায়ক আমল, ২০০৭-০৮: বাংলাদেশের ৫০ বছরের জীবনে সবচেয়ে অস্বাভাবিক বা বলা যায় সবচেয়ে অদ্ভুত সরকার ছিল এই দুই বছর। একে বলা হতো সামরিক বাহিনী-সমর্থিত অসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বাহ্যত যাঁরা এ সরকারের কার্যক্রম চালাচ্ছিলেন, তাঁদের হাতে কোনো ক্ষমতা ছিল না, আর প্রকৃত ক্ষমতার মালিক ছিলেন যাঁরা, তাঁরা ছিলেন অনেকটাই অদৃশ্য। এ সরকার প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পূর্বেকার রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে প্রাথমিকভাবে জনসাধারণ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল। কিন্তু শিগগিরই, ক্ষমতার কুশীলবেরা দৃশ্যমান সরকারের ওপর নানান অযৌক্তিক এবং অদ্ভুত সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে থাকলেন। এ সময় কূটনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা প্রকৃতই কঠিন হয়ে ওঠে।

এই সরকারের সৃষ্টি, কর্মপরিচালনা এবং অবসায়নে ধাত্রীর ভূমিকা পালন করেন ঢাকার জাতিসংঘ প্রতিনিধি এবং কয়েকটি শক্তিমান দেশের রাষ্ট্রদূতেরা। দৃশ্যমান সরকারকে এড়িয়ে, প্রকৃত ক্ষমতাকেন্দ্রের সঙ্গে তাঁরা সরাসরি এবং ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। কোনো বিষয়ে খানিকটা দৃঢ়তা যদিও-বা কখনো দেখাত পররাষ্ট্র দপ্তর, পরমুহূর্তেই ভারসাম্য রক্ষায় নমনীয়তার প্রয়োজন হয়ে পড়ত। পুরো ব্যাপারই ছিল একটা জগাখিচুড়ি। অবশেষে পুনর্গঠিত নির্বাচন কমিশনের অধীনে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ২০০৯ সালের শুরুতে এই সরকার বিদায় নেয়।

সপ্তম পর্ব: বর্তমান পর্যায়, ২০০৯ থেকে অদ্যাবধি: এই নির্বাচিত সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ দেশের জন্য যেমন, কূটনীতিকদের জন্যও একটা স্বস্তির বাতাবরণ সৃষ্টি করে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একে স্বাগত জানায় এবং কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সঞ্চার হয়। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় উপনীত হয়, দুই দেশের উচ্চ নেতৃত্বের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একই সঙ্গে চীনের সঙ্গে গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্কের কারণে একধরনের ভারসাম্য রক্ষিত হয়। দীর্ঘ সময় ঝুলে থাকা ভারত-বাংলাদেশ স্থলসীমা চুক্তি অবশেষে কার্যকর হয় এবং ছিটমহল বিনিময় সম্পন্ন হয়। বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয় বিদ্রোহী গ্রুপগুলোকে বিতাড়ন করা হয় এবং তাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়। দুই দেশের মধ্যে বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ খাতে সহযোগিতা বেড়েছে। ভারতকে তার উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া হয়েছে। গত সপ্তাহে খুলে দেওয়া ফেনী নদীর ওপর মৈত্রী সেতু এ ক্ষেত্রে আরেকটি সংযোজন।

সাফল্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের কূটনীতি বেশ কিছু হতাশা আর সমস্যারও সম্মুখীন হয়েছে এ সময়ে। প্রথমত, উচ্চপর্যায়ের সুসম্পর্ক সত্ত্বেও বাংলাদেশের এত সব ইতিবাচক পদক্ষেপের কোনো দৃশ্যমান প্রতিদান দেয়নি ভারত। সীমান্তে হত্যা বন্ধ করেনি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী, পানিবণ্টনের কোনো সুরাহা হয়নি। উপরন্তু ভারতীয় শীর্ষ পর্যায়ের রাজনীতিকদের কিছু অসম্মানজনক কথাবার্তা বাংলাদেশের মানুষের ক্ষোভই শুধু বাড়িয়েছে। সেই সঙ্গে উদ্বেগ বাড়িয়েছে আসামের নাগরিক পঞ্জি আর ভারতের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন।

অন্যদিকে সুশাসন, মানবাধিকার, বাক্‌স্বাধীনতা, দুর্নীতি, আইনের শাসন ইত্যাদি সূচকে হতাশাব্যঞ্জক অবস্থান কূটনীতিকদের কাজকে সহজ করেনি। ২০১৪ আর ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত যে নির্বাচনগুলোকে ঠিক মানসম্মত বলা যায় না, সেগুলোর সাফাই গাইতে গিয়েও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিব্রত হতে হয়েছে তাদের। সর্বোপরি, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কর্তৃক বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশ এবং অবস্থান এক দীর্ঘমেয়াদি উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। আসছে বছরগুলোতে শক্ত চ্যালেঞ্জ রয়েছে বাংলাদেশের কূটনীতিকদের সামনে।

৩ মার্চ ২০২১