বিজ্ঞাপন
default-image

অস্ট্রেলিয়ার এক নাগরিক এ দেশে এসেছিলেন বিদেশি এক কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হয়ে। কিন্তু ১৯৭১ সালে জড়িয়ে গেলেন মুক্তিযুদ্ধে। যেনতেনভাবে নয়; সরাসরি রণাঙ্গনে, অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে। গেরিলা বীর প্রতীক খেতাবও পেয়েছিলেন। বহু বিদেশি বন্ধুই মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছেন। কিন্তু রণাঙ্গনে লড়াই করার ঘটনা কেবল তাঁরই।

এই বীরের পুরো নাম উইলিয়াম আব্রাহাম সাইমন উডারল্যান্ড। পিতৃসূত্রে অস্ট্রেলীয় নাগরিক। তবে জন্ম নেদারল্যান্ডসে, ১৯১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর। ১৯৭০-এর শেষ দিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিলেন বাটা শু কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হয়ে। উডারল্যান্ডের কর্মস্থল ছিল টঙ্গী। একাত্তরের ৫ মার্চ টঙ্গীতে ইপিআর আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর গুলি চালালে তিনি আক্রান্ত বাঙালিদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছিলেন। সে–ই ছিল সূচনা।

২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নির্বিচার গণহত্যা চালালে শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। উডারল্যান্ড প্রথমে মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থ সহায়তা দেন। বিদেশি কোম্পানির সিইও হিসেবে ঊর্ধ্বতন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর ছিল সখ্য। অনায়াসে যেতে পারতেন সেনানিবাসে।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গতিবিধি ও পরিকল্পনার কথা তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়ে দিতে থাকেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর অতীত অভিজ্ঞতা কাজে লেগেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির নাৎসি বাহিনীর কাছে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি। কৌশলে পালিয়েছিলেন বন্দিশিবির থেকে। বন্দিশিবিরে থাকার সময় উডারল্যান্ড জার্মান ভাষা আয়ত্ত করেন। এটি তাঁকে সৈনিকদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ করে দেয়। নেদারল্যান্ডসের প্রতিরোধ বাহিনীকে নিয়মিত তিনি নাৎসিদের খবরাখবর পৌঁছাতেন।

উডারল্যান্ড লিখেছেন, ‘যখন মার্চের ঘটনাবলি শুরু হলো এবং পাকিস্তানি সেনারা ঢাকায় হত্যাযজ্ঞ শুরু করল, আমি তরুণ বয়সে ইউরোপে আমার অভিজ্ঞতা কাজে লাগালাম। আমি পুরোপুরি বাঙালি জনগণের অবস্থা উপলব্ধি করলাম, যা আমাকে তাঁদের পক্ষে যুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করল।’

অল্প দিনেই উডারল্যান্ড হয়ে উঠলেন বাঙালির বিশ্বস্ত বন্ধু। প্রথমে টঙ্গীর বাটা শু কোম্পানির সদর দপ্তরের আঙিনায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলেন। পরে নিজেই ২ নম্বর সেক্টরের উপপ্রধান এ টি এম হায়দারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঢাকা ও টঙ্গী এলাকায় গেরিলাযুদ্ধ শুরু করেন। পাকিস্তানিদের চলাচলের পথ বন্ধ করতে সহযোদ্ধাদের নিয়ে তিনি ব্রিজ-কালভার্ট ধ্বংস করেছিলেন। ১ জানুয়ারি ১৯৭২ বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী সদর দপ্তরের ২ নম্বর সেক্টর থেকে হায়দার উডারল্যান্ডকে যে শংসাপত্রটি দিয়েছিলেন, সেটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। হায়দার লিখেছেন, ‘বাটা শু কোম্পানির ম্যানেজার মি. উডারল্যান্ড পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে আমার পরিচিত। তিনি গেরিলা ইউনিটগুলোর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। সাবেক সেনা কর্মকর্তা হিসেবে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিয়েছেন, অর্থ ও ওষুধ দিয়েছেন, গরম পোশাকাদি দিয়েছেন। দিয়েছেন কারিগরি সহায়তা ও যুদ্ধের সরঞ্জাম।’

১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকারের পদকপ্রাপ্ত সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় উডারল্যান্ডের নাম ছিল। তাঁকে বীর প্রতীক সম্মাননা দেওয়া হয়। ১৯৯৭ সালে শেখ হাসিনার সরকারের আমলে পদকপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা অনুষ্ঠানেও তিনি আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। আসার সম্মতি জানিয়েও অসুস্থতার কারণে আসতে পারেননি। তাঁকে দেওয়া সরকারের আর্থিক সম্মানী তিনি বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টকে দান করেন। পরে অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর হাতে পদকটি তুলে দেয়।

যুদ্ধের পর উডারল্যান্ড আবার বাটা শু কোম্পানিতে ফিরে আসেন। ১৯৭৮ সালে অবসর নেওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশেই ছিলেন। এরপর ফিরে যান অস্ট্রেলিয়ায়। নিজের নামের সঙ্গে আমৃত্যু ব্যবহার করেন বীর প্রতীক উপাধি।

মহান এই বিদেশি মুক্তিযোদ্ধা মারা যান ২০০১ সালের ১৮ মে।

সূত্র: ১ ডিসেম্বর ২০১৮, শনিবার , প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।