আমি ৭ নম্বর সেক্টরের ৩ নম্বর সাব-সেক্টরে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের (পরে বীরশ্রেষ্ঠ) অধীন ৮১ মিমি মর্টার প্লাটুনের অধিনায়ক ছিলাম। যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে আমাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল সোনামসজিদ এলাকার বালিয়দীঘির পশ্চিম পাড়ে আর পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল কানসাটের ধোবড়ায় এক বিশাল আমবাগানের মধ্যে। এই দুই অবস্থানের মধ্যে দূরত্ব ছিল আনুমানিক ৫–৬ কিমি। মাঝেমধ্যে পাকিস্তানি ফাইটিং প্যাট্রল এসে আমাদের ওপর গুলি চালাত, কখনও আমরাও ওদের অবস্থানে গিয়ে গুলিবর্ষণ করতাম। প্রায়ই আমাদের মধ্যে আর্টিলারি আর মর্টার শেল বিনিময় হতো। আমরা ওদের ধোবড়ার অবস্থানে অনেকবার আক্রমণ চালিয়ে সফল হতে পারিনি, তারাও কখনো সোনামসজিদ এলাকা দখল করতে পারেনি।
অক্টোবর মাসে রোজা শুরু হয়। প্রতিরক্ষা অবস্থানে সেহরি খাওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও ইফতারের ব্যবস্থা ছিল বেশ অনিয়মিত। অনেক সময় সেহরি খাওয়ারও সময় হতো না। তারপরও মুক্তিযোদ্ধারা রোজা রাখতেন। রোজার শেষ দিনে অর্থাৎ ঈদের আগের দিন ইফতারের পর ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর আমাদের একত্র করে যুদ্ধপরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার পর মোনাজাত করলেন। মোনাজাতের সময় বাবা-মা, ভাই-বোন ও পরিবারের কথা খুব মনে পড়ছিল।
ঈদের দিন সকালে কোয়ার্টার মাস্টার খুব ব্যস্ত। দুপুরে গরু-খাসি ও পোলাও রান্না হবে। পশু জবাই শেষে আমরা পাশের পুকুরে গোসলের জন্য নেমে পড়ি। এর মধ্যে একজন খবর দিলেন, ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর আমাকে ডেকেছেন। গিয়ে দেখি, তিনি লেফটেন্যান্ট কাইউম খানের (পরে মেজর) সঙ্গে কথা বলছেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘তোমার মর্টার প্লাটুনকে প্রস্তুত করো। আমাদের কাছে খবর আছে যে পাকিস্তানিরা সোনামসজিদ দখল করে ঈদের নামাজ পড়তে চায়।’ আমাদের যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল।
আমাদের অবস্থান থেকে কিছু এগিয়ে শত্রুর সম্ভাব্য আগমন পথগুলোকে কভার করে আমরা অবস্থান নিই। কিছুক্ষণ পরে ঈদের নামাজ হয়ে গেলে আমাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে ফিরে আসার হুকুম হলো। সেখানে ফিরে গিয়ে জানতে পারলাম, পাকিস্তানিরা সন্ধ্যায় আক্রমণ করবে। ইতিমধ্যে সেক্টর অধিনায়ক লে. কর্নেল নুরুজ্জামান (পরে বীর উত্তম) সপরিবারে আমাদের সদর দপ্তরে উপস্থিত হলেন। কিছুক্ষণ পর লালগোলা থেকে ৪ নম্বর সাব-সেক্টর অধিনায়ক মেজর গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী (পরে ব্রিগেডিয়ার ও বীর বিক্রম) এলেন। সবার সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় হলো।
দুপুরে ঈদ উপলক্ষে উন্নত মানের খাওয়া-দাওয়ার পর সিদ্ধান্ত হলো, সন্ধ্যায় পাকিস্তানিদের আক্রমণের আগে আমরাই ধোবড়া আক্রমণ করব। অভিযানে নেতৃত্ব দিবেন মেজর গিয়াস। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর সোনামসজিদ-কানসাট রাস্তার পশ্চিম দিক দিয়ে, আর লেফটেন্যান্ট কাইউম পূর্ব দিক দিয়ে পাকিস্তানিদের আক্রমণ করবেন। আর মূল রাস্তা ধরে মেজর গিয়াস অগ্রসর হয়ে উত্তর দিক থেকে আক্রমণ করবেন। আমার মর্টার সেকশন শত্রুর অবস্থান থেকে মোটামুটি এক হাজার গজের মধ্যে অবস্থান করবে।
বিকেলে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। মূল রাস্তা ধরে কিছুদূর সবাই চলার পর ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর ও লেফটেন্যান্ট কাইউম তাদের বাহিনী নিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম দিকে চলে গেলেন। আমি মর্টার ফায়ার কনট্রোলার হিসেবে মেজর গিয়াসের সঙ্গে মূল রাস্তা ধরে এগোচ্ছি। সন্ধ্যায় আমরা পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানের কাছাকাছি পৌঁছে যাই, সামনেই তাদের বাংকারগুলো দেখা যাচ্ছে। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর ও লেফটেন্যান্ট কাইউমও আক্রমণ–পূর্ব অবস্থানে পৌঁছে গেছেন।
মেজর গিয়াস প্রথমে লেফটেন্যান্ট কাইউমকে, এরপর ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরকে ফায়ার ওপেন করার নির্দেশ দিলেন। উভয় দিক থেকে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হলে মেজর গিয়াসের আদেশে মর্টার ফায়ার শুরু করলাম। মেজর গিয়াসের সঙ্গে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা তখনও ফায়ার ওপেন না করে ক্রলিং করে সামনে অগ্রসর হতে থাকেন। হঠাৎ শত্রুপক্ষ আমাদের ওপর ব্যাপক গুলিবর্ষণ শুরু করল, সঙ্গে আর্টিলারির গোলাও পড়তে লাগল। শত্রুর গুলিগোলার মধ্যে আমরা আর সামনে এগোতে পারছিলাম না।
সন্ধ্যা পেরিয়ে অন্ধকার হয়ে গেছে। এর মধ্যে একটি গরু বাঁধার খুঁটির সঙ্গে মেজর গিয়াসের পা আচমকা জড়িয়ে গেলে তিনি গর্তে পড়ে যান। এতে তিনি চলনশক্তি হারিয়ে ফেলেন। আমি মেজর গিয়াসের নির্দেশ মতো পাকিস্তানিদের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষে৵ অবিরাম শেল বর্ষণ করে চলেছি। এমন সময় আমাদের ওয়্যারলেসের প্রেশার সুইচ জ্যাম হয়ে যায়। এতে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর, লেফটেন্যান্ট কাইউমসহ মর্টার পজিশনের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। অধিনায়ক আহত, বেতার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, শত্রুর অবিরাম গোলাগুলিতে আমাদের অগ্রাভিযান বিপর্যস্ত। অন্যদিকে শত্রু সুদৃঢ় বাংকারে অবস্থানের কারণে আমাদের গোলাগুলি কার্যকর হচ্ছে না। এ রকম প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে মেজর গিয়াস আমাদের পেছনে সরে আসার নির্দেশ দিলেন।
ইতিমধ্যে পাকিস্তানিদের গোলাগুলি আরও অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মেজর গিয়াস ক্রলিং করে অনেক কষ্টে পেছনে কিছুদূর এসে আর কোনোভাবেই চলতে পারছিলেন না। তিনি বললেন, ‘আমি এখানে কোথাও লুকিয়ে থাকি। তোমরা দ্রুত পেছনে চলে যাও। পরে এসে আমাকে নিয়ে যেয়ো।’ আমি তাঁর প্রস্তাবে রাজি হলাম না। আমি তাকে কাঁধে করে নেওয়ার কথা বললে তিনি নাকচ করে দিলেন। বললেন, ‘এভাবে চললে সবাই মারা যাবে।’ আমি অনেকটা জোর করেই তাকে কাঁধে তুলে চলতে শুরু করলাম। কিছুদূর চলার পর আমরা শত্রুর গুলির রেঞ্জ থেকে বেরিয়ে এলেও আর্টিলারি গোলা তখনো আমাদের ওপর পড়ছিল। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে আমি গোলার শব্দ শুনে বুঝতে পারতাম, এটা কত দূরে পড়তে পারে।
তাই কোনো গোলা আমাদের কাছাকাছি পড়বে মনে হলে মেজর গিয়াসকে কাঁধ থেকে নিচে নামিয়ে ভূমির সঙ্গে মিশে যেতাম। গোলা ফাটলে আবার কাঁধে নিয়ে চলা শুরু করতাম। এভাবে আমরা আমাদের মূল অবস্থানের কাছে চলে আসি।
লেফটেন্যান্ট কাইউমও তাঁর দল নিয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থানে ফিরে এলেন। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের তখনো কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। মেজর গিয়াস আমাকে মর্টার পজিশনে গিয়ে শত্রুর টাগে৴টে আঘাত হানার নির্দেশ দিলেন। আমি মর্টার পজিশনে গিয়ে দেখি প্রত্যেক মর্টারের ব্যারেলের অগ্রভাগ বা মুখ ঘন ঘন ফায়ারের ফলে লাল হয়ে গেছে, ব্যারেল ফেটে যেতে পারে, কিন্তু উপায় নেই। সর্ব্বোচ্চ দূরত্বে ৭ বা ৮ নম্বর চার্জ দিয়ে দীর্ঘক্ষণ ফায়ার করার ফলে এমন হয়েছে। খুবই জরুরি প্রয়োজনে ৭ বা ৮ নম্বর চার্জ ব্যবহার করা হয়, তা–ও অল্প সময়ের জন্য। কিন্তু আমাদের অতিরিক্ত কোনো মর্টার নেই যে রেস্ট দিয়ে ব্যবহার করব।
আমরা ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। অনেক পরে কাদামাটি গায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তিনি ফিরে এলেন। তাঁর কাছ থেকে জানা গেল, তিনি পাকিস্তানিদের অবস্থানের পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ করে ধীরে ধীরে দক্ষিণ দিকে অর্থাৎ পেছনের দিকে চলে যান। এদিকে ধোবড়ার শক্তি বাড়ানোর জন্য পাকিস্তানিদের একটি বড় দল দক্ষিণ দিক থেকে সেদিকে আসছিল। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের সঙ্গে সেই দলের যুদ্ধ বেধে যায়। ধোবড়ায় অবস্থিত পাকিস্তানিরাও তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। তার দল অনেকটা ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে যায়। অসীম সাহস ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে গুলি করতে করতে তারা শত্রুর বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে পশ্চিম দিকের কচুরিপানাপূর্ণ জলাধারের মধ্য দিয়ে পাশের গ্রামে ঢুকে পড়েন। এরপর ধীরে ধীরে নিজের অবস্থানে ফিরে আসেন।
ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের জন্য অজানা আশঙ্কায় সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা দারুণ উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। তাঁর ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে পুরো সাব-সেক্টরে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। ঈদের দিনে এটা এমন এক আনন্দ যা হয়তো আর কোনো দিন পাওয়া যাবে না।
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা।