বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৪৯ সালের ২৬ এপ্রিল জগৎজ্যোতি দাসের জন্ম হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জের জলসুখা গ্রামে। সুনামগঞ্জ কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) কর্মী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি তাতে যোগ দেন এবং ২৮ মাচ৴ সুনামগঞ্জের অস্ত্রাগার ভেঙে রাইফেল লুট করে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন।

জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ৩৬ জন মুক্তিযোদ্ধা বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরে যুক্ত হন। এই গেরিলা দলের অধিনায়ক ছিলেন জগৎজ্যোতি দাস। ভাটি অঞ্চল মুক্ত রাখার পাশাপাশি তাঁদের বিশেষ দায়িত্ব ছিল ভৈরব-আজমিরীগঞ্জ-শেরপুর এলাকায় নদীপথ পাকিস্তানি সেনাদের জন্য বিপদসংকুল করে তোলা।

সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের জয়কলস ব্রিজ পাকিস্তানি বাহিনীর লাইফলাইন হিসেবে পরিচিত ছিল। সেই পথে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের অস্ত্র ও রসদ পরিবহন করত। রাজাকাররা সব সময়ই এই ব্রিজটির পাহারায় থাকত। জগৎজ্যোতি দাসকে ব্রিজটি ধ্বংস করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। জুলাইয়ের শেষের দিকে জগৎজ্যোতি তাঁর গেরিলা বাহিনী নিয়ে ব্রিজটি উড়িয়ে দেওয়ার জন্য রওনা দেন। পথে তিনি একদল রাজাকারের মুখোমুখি হন। রাজাকারদের এই অবস্থানের তথ্য জগৎজ্যোতির জানা ছিল না। রাজাকার দলের সঙ্গে যুদ্ধ বেধে গেলে ব্রিজে অবস্থানরত রাজাকাররা সতর্ক হয়ে যায়। জগৎজ্যোতি তাঁর পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনেন এবং জয়কলস ব্রিজের বদলে সদরপুর ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়ার জন্য রওনা হন। তাঁর বাহিনী কোনো গুলি ব্যয় না করেই সদরপুর ব্রিজে পাহারারত রাজাকারদের বন্দি করে এবং বিস্ফোরক দিয়ে সদরপুর ব্রিজ উড়িয়ে দেয়।

৭ আগস্ট জগৎজ্যোতির দল জামালগঞ্জ থানা আক্রমণ করে। থানায় অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনী দক্ষিণ দিকে পালিয়ে যায়। এরপর সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত অন্যান্য দলের সঙ্গে জগৎজ্যোতির দল তাহিরপুর এলাকায় যুদ্ধ করতে থাকে।

সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে জগৎজ্যোতি তাঁর দল নিয়ে সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই থানার কুঁড়িতে ফিরে আসেন।

সেখান থেকে তাঁরা আজমিরীগঞ্জ থানা আক্রমণ করেন। তাঁরা ভেড়ামোহনায় শত্রুর কার্গো কনভয় ডোবান। জগন্নাথপুরের রানীগঞ্জ বাজারে রাজাকারদের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেন। মাঁকুলীতে দুই শতাধিক রাজাকারের আস্তানা দখল করেন। ১৮ অক্টোবর রাতে রমেশ পান্ডের দল আর জগৎজ্যোতির দল মিলে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি বানিয়াচং থানা আক্রমণ করে। সেই যুদ্ধে জগৎজ্যোতি তাঁর প্রিয় এলএমজি হাতে পাকিস্তানি বাহিনীর বূ৵হের মধ্যে ঢুকে ৩৫ জন সৈনিককে হত্যা করেন এবং বানিয়াচং থানা দখলমুক্ত করেন। এরপর তিনি মার্কুলির কাছে একটি বার্জ দখল করে গচিয়া গ্রামে এনে ডুবিয়ে দেন।

জগৎজ্যোতি ও তাঁর দলের উপর্যুপরি অভিযানে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান সরবরাহ পথ অর্থাৎ ভৈরব-শেরপুর নদীপথ বিপদসংকুল হয়ে পড়ে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী জীবিত অথবা মৃত জগৎজ্যোতিকে ধরে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে।

বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের প্রধান বিদ্যুৎ লাইনটি এসেছে আশুগঞ্জ থেকে শাহজীবাজার হয়ে বাহুবলের ওপর দিয়ে। জগৎজ্যোতির দলের নৌযান ডোবানো, ব্রিজ-কালভার্ট ধ্বংসের পাশাপাশি বিদ্যুৎ লাইন ধ্বংস করার বিশেষ প্রশিক্ষণ ছিল। সাব-সেক্টর থেকে জগৎজ্যোতিকে বাহুবল গিয়ে বিদ্যুৎ লাইন ধ্বংসের দায়িত্ব দেয়। ১৬ নভেম্বর ভোরবেলা তাঁরা বাহুবলের দিকে রওনা দেন।

পরিকল্পনা ছিল আজমিরীগঞ্জ হয়ে যাবেন। আজমিরীগঞ্জ যাওয়ার আগেই বদলপুরের কাছে রাজাকারের দল দেখে জগৎজ্যোতি ৩০ জনকে বদলপুরে রেখে বারোজনকে সঙ্গে নিয়ে রাজাকারদের ধাওয়া করেন। এটা ছিল শত্রুর পাতানো ফাঁদ। রাজাকারের দল কিছুদূর গিয়ে পালিয়ে যায় জগৎজ্যোতির নিজ গ্রাম জলসুখার দিকে। আর জগৎজ্যোতি আটকে যান খৈয়াগোপির বিলে পাকিস্তানি বাহিনীর ত্রিমুখী আক্রমণের ফাঁদে। ১৬ নভেম্বরের এই যুদ্ধেই শহীদ হন জগৎজ্যোতি দাস। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের আনন্দ-উল্লাস আর ধরে রাখতে পারেনি। তারা আজমিরীগঞ্জ বাজারে জগৎজ্যোতির ক্ষতবিক্ষত লাশ বেঁধে রাখে প্রদর্শনীর জন্য। ফটোগ্রাফার দিয়ে সেই লাশের ছবিও তুলে রাখে পাকিস্তানি মেজর। জগৎজ্যোতির মা ও বাবাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আসে রাজাকাররা। জগৎজ্যোতির অসহায় মা পাথরের মতো শক্ত হয়ে বললেন, ‘এ লাশ আমার ছেলে জ্যোতির নয়।’ তিনি সম্ভবত তাঁর বেঁচে থাকা অপর সন্তান ও স্বামীর কথা ভেবেছিলেন।

অসম সাহসী জগৎজ্যোতির মৃত্যুসংবাদ স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে খুব গুরুত্বসহ প্রচার করা হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য শহীদ জগৎজ্যোতি দাসকে বীর বিক্রম উপাধিতে ভূষিত করে।

সূত্র: দাস পার্টির খোঁজে, হাসান মোর্শেদ, ঐতিহ্য

লেখক: প্রথম আলোর গ্রন্থাগারকর্মী