বিজ্ঞাপন
default-image

চাঁদপুরে বধ্যভূমি রয়েছে অন্তত ১৯টি। বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিকামী সাধারণ মানুষজনের রক্তমাখা স্মৃতিবহ এসব স্থান। কিন্তু শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এসব স্থান সংরক্ষণের উদ্যোগ আছে সীমিতই। স্থানীয় উদ্যোগে জেলায় তৈরি হয়েছে ৮টি স্মৃতিস্তম্ভ। এর বাইরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বেশির ভাগ স্থান রয়ে গেছে অবহেলায়।

চাঁদপুর শহরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সড়কের লেকের পাড় এলাকায় ১৯৮৯ সালে স্থাপিত হয় মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য ‘অঙ্গীকার’। জেলার প্রথম এই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের কাজ। তিনি অপরাজেয় বাংলার স্থপতি। একটি হাতে অস্ত্র ধরে রাখা এই ভাস্কর্য দেশ স্বাধীন করার লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের অঙ্গীকারের প্রতীক। স্মৃতিস্তম্ভটি করার উদ্যোগ নেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক এস এম শামছুল আলম। পরে এটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

চাঁদপুর শহরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে নির্মিত হয়েছে আরও তিনটি স্মৃতিস্তম্ভ। জেলা শহরের বড় স্টেশনে ডাকাতিয়া ও মেঘনা নদীর মিলনস্থলসংলগ্ন স্থানে ‘বধ্যভূমি রক্তধারা’, শহরের ট্রাক রোডে ‘কালাম-খালেক-সুশীল-শংকর স্মৃতিসৌধ’ এবং চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে শহীদ মুক্তিযুদ্ধের তালিকাসংবলিত ‘স্মৃতিসৌধ’। এগুলোসহ জেলার মুক্তিযুদ্ধের সব স্মৃতিস্তম্ভের বিস্তারিত তথ্য লিপিবদ্ধ আছে জেলা প্রশাসনের ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর নামের বইয়ে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী বীর প্রতীক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাশার বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী সাধারণ লোকজনকে ধরে এনে প্রকাশ্যে গণহত্যার পর মেঘনায় লাশ ভাসিয়ে দিত। এ ছাড়া তারা চাঁদপুর শহরের পুরান বাজার এবং বড় স্টেশনে নির্যাতন কেন্দ্র বানিয়েছিল। এসব শহীদের স্মরণে ২০১১ সালে নির্মিত হয় ‘বধ্যভূমি রক্তধারা’। স্মৃতিসৌধটির স্থপতি চঞ্চল কর্মকার। এটি উদ্বোধন বর্তমান করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল একসঙ্গে শহীদ হন কালাম-খালেক-সুশীল-শংকর নামের চার বীর সন্তান। তাঁরা হানাদার বাহিনীকে চাঁদপুরে প্রবেশে বাধা দিতে স্থানীয় ট্রাক রোডসংলগ্ন পোদ্দার বাড়িতে বোমা বানাচ্ছিলেন। এ সময় বোমার বিস্ফোরণে চারজনই নিহত হন। তাঁরাই ছিলেন চাঁদপুরের প্রথম শহীদ। ১৯৯৭ সালে তাঁদের স্মরণে নির্মিত হয় ‘কালাম-খালেক-সুশীল-শংকর স্মৃতিসৌধ’।

এ ছাড়া হাজীগঞ্জ উপজেলার নাসিরকোর্ট গ্রামের বধ্যভূমিতে ‘নাসিরকোর্ট শহীদ স্মৃতিসৌধ’, মতলব দক্ষিণ পৌরসভার মতলব জেবি পাইলট হাইস্কুল মাঠে ‘দীপ্ত বাংলা’, মতলব উত্তর উপজেলা পরিষদ চত্বরে ‘চান্দ্রাকান্দি স্মৃতিসৌধ’ এবং ফরিদগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সামনে রয়েছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাসংবলিত ‘স্মৃতিসৌধ ১৯৭১’। এর বাইরে জেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও স্মৃতিবাহী স্থানগুলো সংরক্ষণের জন্য যথেষ্ট উদ্যোগ নেই। অথচ, জেলায় বধ্যভূমিসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান রয়েছে অসংখ্য।

শুধু চাঁদপুর পরিক্রমা: ইতিহাস ঐতিহ্য বইয়েই মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় চাঁদপুরে অন্তত ১৯টি স্থানে হানাদার বাহিনীর গণহত্যার তথ্য রয়েছে। বিভিন্ন লেখকের বই থেকে নতুন করে এটির সংকলন করেছেন চাঁদপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক প্রিয়তোষ সাহা। বইটিতে তিনি চাঁদপুরের ওই ১৯টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করেছেন।

সরকারি উদ্যোগে বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই। এর মধ্যে রয়েছে চাঁদপুর সদর উপজেলার বাগাদী গ্রামে ২৪ সেপ্টেম্বরের গণহত্যা, দাসাদী ও শিলন্দিয়া গ্রামে ৬ ডিসেম্বরের গণহত্যা ও ১০ আগস্টের ছোটসুন্দর গণহত্যা, বিভিন্ন সময়ে ফরিদগঞ্জ উপজেলার গৃদকালিন্দিয়া গণহত্যা, দত্রা গণহত্যা ও চরভাগল গণহত্যা, হাজীগঞ্জের লাওকরা গণহত্যা, বড়কুল গণহত্যা ও রঘুনাথপুর গণহত্যা, শাহরাস্তি উপজেলার আহমদনগর গণহত্যা ও রায়শ্রী গণহত্যা, কচুয়ার রহিমানগর গণহত্যা, কাদলা গণহত্যা ও সাচার গণহত্যা, মতলব দক্ষিণ উপজেলার কাসিমপুর গণহত্যা এবং মতলব উত্তর উপজেলার রসুলপুর ও এনায়েতনগর গণহত্যা। এর বাইরে বিভিন্ন সময়ে জেলার বিভিন্ন গ্রামে হানাদার বাহিনী আক্রমণ চালিয়ে বহু মানুষকে হত্যা করে, যা বইপত্র এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় লোকজনের বরাতে জানা যায়।

বীর মুক্তিযোদ্ধা জীবন কানাই চক্রবর্তী বলেন, মুক্তিযুদ্ধে উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা এমদাদুল হক, জাহাঙ্গীর আলম, আবদুর রশিদ, মো. জয়নাল আবেদীন, মো. জয়নাল আবেদীন-২, মো. আবু তাহের, মো. জহিরুল ইসলাম ও মো. ইলিয়াস শহীদ হন। তাঁদের লাশ নাসিরকোর্ট গ্রামে পাশাপাশি সমাহিত করা হয়। তাঁরাসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্য শহীদদের স্মরণে হাজীগঞ্জের রাজারগাঁও ইউনিয়নের নাসিরকোর্ট গ্রামে ১৯৮১ সালে শহীদ স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়। কিন্তু বাস্তবে বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণে নেই কোনো তদারিক।

মতলব দক্ষিণ উপজেলার ‘দীপ্ত বাংলা’ স্মৃতিসৌধটি নির্মাণের প্রস্তাব দেন যোদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ ওয়াদুদ। পরে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেন মতলবের তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অপূর্ব কুমার বিশ্বাস। স্থানীয় জনসাধারণের আর্থিক সহযোগিতায় ১৯৯৭ সালের ৪ ডিসেম্বর মতলব জেবি পাইলট হাইস্কুল মাঠে স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। দীপ্ত বাংলার স্থপতি রবিউল হোসাইন। শিল্পকর্ম ও পরিকল্পনায় ছিলেন শিল্পী হাশেম খান। সমন্বয়ক ছিলেন ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন।

মতলব উত্তর উপজেলার সাদুল্লাপুর ইউনিয়নের চান্দ্রাকান্দি গ্রামের একই বাড়ির চার সদস্য সিরাজুল ইসলাম, আবদুল আউয়াল, দুধ মিয়া ও শাহাজ উদ্দিন শহীদ হন। তাঁদের স্মৃতি রক্ষায় ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর মতলব উত্তর উপজেলা পরিষদ চত্বরে চান্দ্রাকান্দি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়। আর ফরিদগঞ্জ উপজেলার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে মুক্তিযুদ্ধের ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরীর নিজস্ব অর্থায়নে ‘স্মৃতিসৌধ ১৯৭১’ নির্মিত হয়। সেখানে শহীদদের নামের তালিকা পাথরে খোদাই করে লেখা আছে।

সার্বিক বিষয়ে চাঁদপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার যোদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ ওয়াদুদ বলেন, জেলার বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণে সরকারিভাবে এখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বধ্যভূমি সংরক্ষণে বা মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মাণে এ পর্যন্ত যতটুকু উদ্যোগ, তার সবই স্থানীয়ভাবে। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এসব স্মৃতিবাহী স্থান ক্রমেই বিস্মৃত হয়ে উঠছে। তাই সরকারি উদ্যোগ অতিজরুরি হয়ে পড়েছে।

চাঁদপুরের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জামান বলেন, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) মাধ্যমে চাঁদপুরের বধ্যভূমিগুলোর একটি তালিকা করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটা বধ্যভূমি সংস্কার ও সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাকিগুলো আস্তে আস্তে এলজিইডির মাধ্যমেই সংস্কার ও সরক্ষণের পরিকল্পনা রয়েছে।