বিজ্ঞাপন
default-image

মুক্তিযুদ্ধের সময় খুলনা নগরের পাশের গল্লামারী এলাকায় কেউ যেতে সাহস করত না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরদিন ওই এলাকায় যাঁরা যান, তাঁদের একজন মনিরুল হুদা। দেখলেন, সেখানে লাশ আর লাশ। এখনো ওই এলাকায় মাটি খুঁড়লে মানুষের কঙ্কাল বেরিয়ে আসে। গল্লামারীতে কতশত মানুষ শহীদ হয়েছেন, তা মনিরুল হুদা যেমন জানেন না, তেমনি অন্য কারও কাছেও সঠিক হিসাব নেই।

সেদিনের গল্লামারী পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা বলছিলেন মনিরুল হুদা, ‘রাস্তার ধারে, বিলের মধ্যে, নদীতে শুধু গলিত, অর্ধগলিত লাশের স্তূপ। কোথাও লাশ টানাটানি করছে শুকুন আর কুকুর। এই অবস্থা দেখে আমি সেখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারিনি। তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসি।’

১৯৭১ সালে দৈনিক বাংলা পত্রিকার খুলনা প্রতিনিধি ছিলেন মনিরুল। প্রথম আলোকে দেওয়া তাঁর সাক্ষাৎকারে গল্লামারীসহ মুক্তিযুদ্ধে খুলনার নানা ঘটনা উঠে আসে।

তৎকালীন খুলনা বেতারকেন্দ্র ছিল বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে। সেখানেই আস্তানা তৈরি করে পাকিস্তানি সেনারা। এ ছাড়া সার্কিট হাউস ও রেলস্টেশনে ছিল তাদের আস্তানা। আর ভূতের বাড়ি আনসার ক্যাম্প ছিল আলবদরের ঘাঁটি। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষজনকে ধরে আনা হতো এসব আস্তানায়। সেখানে নির্যাতন চলত কয়েক দিন ধরে। এরপর তাঁদের নিয়ে যাওয়া হতো গল্লামারী ও খুলনা সার্কিট হাউসের উত্তরে ফরেস্ট ঘাট এলাকায়। সেখানে তাঁদের গুলি করে বা গলা কেটে হত্যা করা হতো। স্বাধীনতার পর শুধু গল্লামারী এলাকা থেকেই আটটি ট্রাক নরকঙ্কাল সরিয়ে নেওয়া হয়।

১৯৭২ সালের প্রথম দিকে গল্লামারী এলাকায় একাধিকবার গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখক সুকুমার বিশ্বাস। তিনি তাঁর একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর বইতে গল্লামারীর কথা তুলে ধরেছেন। লিখেছেন, ‘আমি ও আমার তিন সহকর্মী গিয়েছিলাম জাতীয় স্বাধীনতার ইতিহাস পরিষদের পক্ষ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে। সেদিন গল্লামারীর বিস্তীর্ণ এলাকার যে বীভৎস রূপ দেখেছিলাম, তা আজ আর আমার পক্ষে বর্ণনা করা সম্ভব নয়।’

দেশ স্বাধীনের পরপরই গল্লামারী এলাকায় গিয়েছিলেন ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। শাহরিয়ার কবির সম্পাদিত একাত্তরের দুঃসহ স্মৃতি গ্রন্থে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার আছে। তাতে তিনি গল্লামারীতে তাঁর দেখা ভয়াবহ চিত্রগুলো তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বিশাল প্রান্তর জুড়ে ছড়িয়ে আছে হাজার হাজার মানুষের

লাশ। শুধু প্রান্তরে নয়, আশপাশে ধানখেত ও পাটখেতেও ছড়িয়ে ছিল লাশ। বাতাসে পাটগাছ যখন এলোমেলো হচ্ছে, ফাঁক দিয়ে দেখি লাশের স্তূপ। কোনো লাশই তিন-চার দিনের পুরোনো নয়।’

ঠিক কতজনকে গল্লামারীতে হত্যা করা হয়েছিল, তা কেউ বলতে পারে না। বৃহত্তর খুলনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বইয়ে গৌরাঙ্গ নন্দী লিখেছেন, ‘গল্লামারী বধ্যভূমিতে কতজনকে হত্যা করা হয়েছিল, তা যেমন নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি, তেমনি এখানে কাদের হত্যা করা হয়েছিল, তার বেশির ভাগ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। কারণ, সেই সময়ের খুলনা শহর থেকে দূরের অপেক্ষাকৃত নির্জন এই জায়গায় মুক্তিযুদ্ধকালের শুরু থেকে একেবারে শেষ পর্যন্ত মুক্তিকামী মানুষকে ধরে এনে হত্যা করা হয়েছে। যুদ্ধকালে কেউই যেতে সাহস দেখাননি। যুদ্ধ শেষে যাঁরা গেছেন, তাঁরা দেখেছেন নরকঙ্কালের স্তূপ।’

অবহেলায় গল্লামারী স্বাধীনতা স্মৃতিসৌধ

পাশাপাশি দুটি সুউচ্চ সাদা রঙের স্তম্ভ। মাঝে লাল রক্তিম সূর্য। স্তম্ভ থেকে সাতটি দণ্ড মিশেছে লাল সূর্যে। দণ্ডগুলো সাত বীরশ্রেষ্ঠর প্রতীক। তাঁদের ধারণ করে আছে লাল রক্তিম সূর্য। সামনে প্রশস্ত সিঁড়ি। খুলনা-সাতক্ষীরা সড়কের দক্ষিণ পাশে এই ‘খুলনা গল্লামারী স্বাধীনতা স্মৃতিসৌধ’। মুক্তিযুদ্ধে বড় এক গণহত্যার নিদর্শন এটি।

খুলনার বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে খুলনা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উদ্যোগে ১৯৯০ সালে গল্লামারী বধ্যভূমিতে ছোট

পরিসরে স্মৃতিসৌধটি তৈরি হয়। ওই বছরের ২৬ মার্চ সেটি উদ্বোধন করেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সন্তানের বাবা আলতাউদ্দিন আহম্মদ। ১৯৯৫ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক কাজী রিয়াজুল হক ও পুলিশ সুপার আওলাদ হোসেনের উদ্যোগে অস্থায়ীভাবে এবং পরে স্থানীয়

সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) নকশা অনুযায়ী ছোট পরিসরে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়। পাশেই তৈরি হয় বিজয় মঞ্চ।

এরপরও আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দাবি অব্যাহত ছিল। ২০০৭ সালে জেলা পরিষদ সেই উদ্যোগ নেয়। আধুনিক স্মৃতিসৌধ নির্মাণ প্রকল্পের জন্য ৩ একর খাসজমি অধিগ্রহণ করা হয়। মূল স্তম্ভ, সংযোগ সড়ক ও পার্কিংয়ের জায়গা, সীমানাপ্রাচীরসহ ফটক নির্মাণ, পানির ফোয়ারাসহ বিভিন্ন কাজের জন্য মোট ব্যয় ধরা হয় ১০ কোটি টাকা। ২০০৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা (স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং শ্রম মন্ত্রণালয়) আনোয়ারুল ইকবাল।

২ কোটি টাকা খরচ করে মূল স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজ শেষ হয়। ২০১১ সালে সেটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক। এরপর আর বরাদ্দ না পাওয়ায় থমকে আছে প্রকল্পের অন্যান্য কাজ।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, গল্লামারী স্মৃতিসৌধের মূল স্তম্ভের পাদদেশ সংস্কার করে নান্দনিক করা হয়েছে। ছেলেমেয়েরা জুতা পায়ে স্মৃতিসৌধের ওপর উঠছে। জুতা পরে না ওঠার নির্দেশনা সাঁটানো হয়নি। কেন এই স্মৃতিসৌধ, সেই তথ্যও নেই কোথাও। অবশ্য ভিত্তিপ্রস্তর ও উদ্বোধনের তিনটি স্মারক আছে এক পাশে।

ভিত্তিপ্রস্তরের এক পাশে অবহেলায় পড়ে আছে পুরোনো স্মৃতিসৌধটি। তার সাতটি স্তম্ভের মধ্যে দুটি ভেঙে পড়েছে। বিজয় মঞ্চের অবস্থা আরও করুণ। মঞ্চস্থলে বড় বড় ফাটল ধরেছে। দেবে গিয়ে বড় গর্ত হয়ে গেছে কয়েক জায়গায়। ইটগুলোও খুলে পড়ছে।

মোট তিন একর জায়গা নিয়ে এই স্মৃতিসৌধ

কমপ্লেক্স। পশ্চিম পাশ ছাড়া পুরো এলাকার কোথাও কোনো সীমানাপ্রাচীর নেই। মূল সড়ক থেকে স্মৃতিসৌধে প্রবেশের পথটি বাঁশ দিয়ে আটকে দেওয়ার বৃথা চেষ্টা

করা হয়েছে। পুরো সীমানার মধ্যে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় গরু ও ছাগল।

স্মৃতিসৌধের তত্ত্বাবধায়ক হায়দার শিকদার বলেন, সীমানাপ্রাচীর ও ফটক না থাকায় ছাগল-গরু ঢুকে পড়ে যখন–তখন। পুরো এলাকাই অরক্ষিত। ফলে এখানে মাদকসেবীদের আড্ডা বসে। কিছু বলতে গেলেই বিপাক। মাদকসেবীদের সঙ্গে কয়েকবার মারামারিও হয়েছে।

স্মৃতিসৌধটি দেখভালের জন্য কোনো পারিশ্রমিক পান না হায়দার শিকদার। এর আগে তাঁর বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা সাত্তার শিকদার স্থানটা দেখাশোনা করতেন। তিনি ছিলেন বটিয়াঘাটা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের একজন কমান্ডার। ২০১১ সালে তিনি মারা যাওয়ার পর থেকে স্থানটা দেখাশোনা করেন ছেলে হায়দার শিকদার। প্রতিদিন পতাকা উত্তোলন ও নামানোর কাজ করেন।

হায়দারের কাছ থেকেই জানা গেল, ওই এলাকায় মাটি খুঁড়লে এখনো মেলে মানুষের কঙ্কাল। ২০১১ সালের দিকে স্মৃতিসৌধের সামনে দুটি বড় পুকুর খনন করা হয়। ওই সময় একটি পুকুরে কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিল। হাড়গোড়গুলো একটি গাছের কাছে রেখে দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সেগুলোর কী হয়েছে, তা বলতে পারেন না হায়দার শিকদার।

খুলনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ হারুনুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রয়োজনীয় টাকার অভাবে পুরো এলাকা সংরক্ষণ করা হয়ে উঠছে না। যে টাকা বরাদ্দ পাওয়া গিয়েছিল, তা দিয়ে শুধু মূল স্তম্ভের কাজ হয়েছে। এরপর বরাদ্দ না পাওয়ায় কাজ বন্ধ রয়েছে। এ জন্য মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চিঠি দিয়েও কোনো সাড়া মেলেনি। সর্বশেষ দুই বছর আগে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র দেওয়া হয়েছে। তাতে পুরো কমপ্লেক্সের কাজ শেষ করতে ৩০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। এই বরাদ্দ পাওয়া যাবে বলে তিনি আশাবাদী।