বিজ্ঞাপন
default-image

দুর্গম দ্বীপজেলা ভোলায় সুবিধা করতে পারেনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এমনকি কোনো কোনো এলাকায় পৌঁছাতেই পারেনি তারা। এর মধ্যে অন্যতম মনপুরা। এখানে আশ্রয় নেয় বিভিন্ন এলাকার হাজারো মানুষ। ফলে এলাকাটি পরিচিতি পায় ‘দ্বিতীয় কলকাতা’ হিসেবে। বিষয়টি জানতে পেরে মনপুরা অভিমুখে রওনা হয়েও ফিরে আসতে বাধ্য হয় হানাদারেরা।

জানতে চাইলে ভোলা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার সফিকুল ইসলাম বলেন, দ্বীপজেলা হওয়ায় ভোলা প্রাকৃতিকভাবেই অনেকটা সুরক্ষিত ছিল। অনেক উপজেলাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পৌঁছাতেই পারেনি। এর মধ্যে ছিল তজুমদ্দিন ও মনপুরা। মনপুরায় আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েও পাকিস্তানি বাহিনী ফিরে আসে বলে তিনি শুনেছেন।

মুক্তিযুদ্ধে মনপুরার কাহিনি কোনো বইয়ে উল্লেখ নেই। ফলে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের বিবরণই ভরসা। অবশ্য, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাস চারেক আগের এক শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় এবং এতে বিধ্বস্ত মনপুরায় ‘ফাদার টিম’–এর টানা ত্রাণ কার্যক্রম ও মুক্তিযুদ্ধ–সংশ্লিষ্ট নানা তথ্য দেশ–বিদেশের পত্রপত্রিকা ও সাময়িকীতে বিভিন্ন লেখায় পাওয়া যায়। তিনি ও তাঁর স্বেচ্ছাসেবী দলের সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও নির্বিঘ্নে মনপুরায় কার্যক্রম চালিয়েছিলেন।

১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে ওই শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়। এতে ভোলায় কমপক্ষে দেড় লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। মনপুরা দ্বীপের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তায় গঠিত হয় ‘সাইক্লোন রিহ্যাবিলিটেশন প্রজেক্ট’। ওই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন নটর ডেম কলেজের অধ্যক্ষ ফাদার রিচার্ড উইলিয়াম টিম। মনপুরার মানুষ তাঁকে ‘ফাদার টিম’ নামে চেনেন। তিনি ওই প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন।

ফাদার টিমের সঙ্গে মনপুরায় যায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীদের একটি দল। এই স্বেচ্ছাসেবীরা ত্রাণ কার্যক্রমের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের সময় মনপুরায় আশ্রয় নেওয়া ব্যক্তিদের থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থাও করেন।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সামসুদ্দিন বাচ্চু চৌধুরী বলেন, মনপুরায় যারা আশ্রয় নিয়েছিল, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাদের সেবা করেন নটর ডেম কলেজের অধ্যক্ষ ফাদার রিচার্ড উইলিয়াম টিম। মনপুরার মানুষ তাঁকে ফাদার টিম নামেই চেনেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি বাঙালিদের পক্ষে অবস্থান নেন। ঘূর্ণিঝড়ে দুর্গতদের সহায়তার পাশাপাশি বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

মনপুরা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার আবুল কাশেম মাতব্বর বলেন, মনপুরাকে বলা হতো দ্বিতীয় কলকাতা। কারণ, নিরাপদ মনে করে বিভিন্ন এলাকার লোকজন এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ভোলার অন্যান্য এলাকার লোকজন যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন নোয়াখালীর হাতিয়া, সন্দ্বীপ ও রামগতি এবং পটুয়াখালীর বাউফল ও গলাচিপার বহু মানুষ। সব মিলিয়ে ১০ হাজারের বেশি মানুষ মানুষ পালিয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের বহু মানুষ মনপুরায় আশ্রয় নেন। ঘুর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় লোকজনের পাশাপাশি ওই আশ্রিত লোকজনকেও সেবা দেয় বিদেশি স্বেচ্ছাসেবী দলটি।

মনপুরার যাঁরা মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের জন্যও পথটা কঠিন ছিল। তাঁরা নৌকায় চড়ে প্রথমে হাতিয়ায় যান। পরে আবার নৌকায় চড়ে পৌঁছান নোয়াখালীতে । সেখান থেকে পায়ে হেঁটে যান ভারতে। সেখানে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

হানাদার বাহিনী যেহেতু মনপুরা ও তজুমদ্দিনে পৌঁছাতে পারেনি, তাই সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কোনো সম্মুখযুদ্ধ হয়নি। অবশ্য, স্থানীয় রাজাকার বাহিনী সাধারণ মানুষের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে। একটি ভাষ্য হচ্ছে, পাকিস্তানি বাহিনী গানবোট নিয়ে মনপুরার উদ্দেশে রওনা হয়েছিল। কিন্তু পথ হারিয়ে সেটি ডুবোচরে আটকে যায়। পরে তারা ভোলায় ফিরে যায়।

ঘটনাটি নিয়ে নানা ধরনের বর্ণনা রয়েছে। ডেপুটি কমান্ডার আবুল কাশেম মাতব্বর বলেন, মনপুরায় অন্যান্য এলাকার লোকজনের আশ্রয় নেওয়ার খবর শুনেই হানাদার বাহিনী সেখানে অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু উত্তাল ঢেউয়ে পড়ে ডুবে যাওয়ার ভয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয় তারা। সেদিন তারা মনপুরায় পৌঁছাতে পারলে কয়েক হাজার মানুষের প্রাণ যেত। কারণ, মনপুরায় তখন কোনো মুক্তিযোদ্ধা বা অস্ত্র—কিছুই ছিল না।

মনপুরা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আ. লতিফ ভুইয়া বলেন, হানাদার বাহিনীর গানবোটের নাবিক ছিলেন বাঙালি। তিনি গানবোটটি চরে আটকে দেন। পথ না চেনায় মনপুরা আসার পথে কয়েকবার সেটি ডুবোচরে আটকা পড়ে।

দুর্গম ভোলার অন্যান্য এলাকাতেও সুবিধা করে উঠতে পারেনি হানাদার বাহিনী। বাস্তবে তারা এখানকার সব কটি যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বিভিন্ন বইয়ে এর প্রমাণ মেলে।

ভোলা জেলার ইতিহাস বইয়ের মুহাম্মদ শওকাত হোসেন লিখেছেন, বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ভোলা রাজধানী থেকে দূরে সমুদ্র অববাহিকায় অবস্থিত। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে অন্যান্য স্থানে যেভাবে যুদ্ধ হয়েছে, ভোলার প্রেক্ষাপট ছিল তার থেকে কিছুটা আলাদা।

মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মাহফুজুর রহমান তাঁর ভোলা দ্বীপের অনন্য মুক্তিযুদ্ধ বইয়ে লিখেছেন, সব গুজবের অবসান ঘটিয়ে ৬ মে খেয়াঘাট দিয়ে লঞ্চে করে পাকিস্তানি বাহিনী ভোলায় পৌঁছায়। তারা ভোলায় এসে প্রথমে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে।

বইটিতে মে থেকে নভেম্বর—এই সাত মাসে ভোলায় মুক্তিযুদ্ধের ১০টি উল্লেখযোগ্য ঘটনার বর্ণনা আছে। এগুলো হচ্ছে চরফ্যাশন উপজেলার ওসমানগঞ্জের অপারেশন (৯ আগস্ট), দৌলতখানের গুপ্তগঞ্জের যুদ্ধ (১০ অক্টোবর), বোরহানউদ্দিনের দেউলার যুদ্ধ (১৫ অক্টোবর), বোরহানউদ্দিন থানা দখল (১৮ অক্টোবর), লালমোহন থানা দখল (২১ অক্টোবর), দৌলতখান থানা দখল (২৩ অক্টোবর), বাংলাবাজার যুদ্ধ (২৮ অক্টোবর), ঘুইংগারহাটের যুদ্ধ (২৮ অক্টোবর), চালতাতলার যুদ্ধ (২৯ অক্টোবর) এবং গরুচোখা খালের যুদ্ধ (২৯ অক্টোবর)।

ভোলা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার মাহাবুব আলম বলেন, ‘হানাদার বাহিনী এলোপাতাড়ি মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছে, এটা সত্য। কিন্তু দুর্গম এলাকা হওয়ায় মুখোমুখি যুদ্ধে তারা টিকতে পারেনি। সব যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে হানাদারেরা। তা ছাড়া ভোলায় মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগ সেনাবাহিনীর সদস্য। ফলে প্রশিক্ষিত মুক্তিবাহিনীর সামনে টিকতে পারেনি হানাদারেরা।

পাকিস্তানি বাহিনী নভেম্বরের প্রথম দিকেই চরফ্যাশন, লালমোহন, দৌলতখান ও বোরহানউদ্দিন ছেড়ে চলে যায়। পরে ভোলা শহরের ওয়াপদার মধ্যে ঘাপটি মেরে ছিল। ১০ জানুয়ারি ভোররাতে লঞ্চে চড়ে ঢাকার উদ্দেশে পালিয়ে যায় হানাদারেরা।