বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭১ সালের ৩ অক্টোবর। গরুর গাড়িতে করে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট ক্যাম্প থেকে বিরামপুরে যাচ্ছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাত সদস্য। খবর পৌঁছে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। বিরামপুরের আলতাদীঘি–সংলগ্ন বিজুল বাজার এলাকায় সঙ্গীদের নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালান বীর মুক্তিযোদ্ধা আবতাব উদ্দিন। ঘটনাস্থলেই মারা যান ওই সাতজন। তবে ঘটনাক্রমে বেঁচে যান পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে থাকা হাকিমপুর উপজেলার গাড়োয়ান গ্রামের আবদুস সাত্তার।

সপ্তাহ না পেরোতেই এই প্রতিরোধের ‘চড়া মূল্য’ দিতে হয় নবাবগঞ্জ উপজেলার চড়ারহাটের লোকজনকে। মুক্তিযোদ্ধাদের এই প্রতিরোধের খবর হাকিমপুর উপজেলার ছাতনী ক্যাম্পে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে পৌঁছে দেন তাদের দোসর আবদুস সাত্তার। বাঙালি নিধনে হিংস্র হয়ে ওঠে সেনারা। পরিকল্পনা হয় বিজুল বাজার এলাকায় আক্রমণের। তবে ১০ অক্টোবর বিজুল বাজার–সংলগ্ন আলতাদীঘি এলাকায় না গিয়ে পাকিস্তানি সেনারা চার কিলোমিটার দূরের চড়ারহাট এলাকায় আক্রমণ করে নারকীয় গণহত্যা চালায়। জ্বালিয়ে দেয় ঘরবাড়ি, ফসলের খেত। নির্যাতনের মুখে পড়ে অসংখ্য মা-বোন।

চড়ারহাটের সেই নির্মম গণহত্যার অনেক প্রত্যক্ষদর্শীই এখনো বেঁচে আছেন। তবে দুঃসহ সেই স্মৃতির কথা মনে হতেই চোখের কোণে জমে অশ্রু। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে চড়ারহাট গণহত্যার একটি বর্ণনা পাওয়া যায়।

নবাবগঞ্জ উপজেলার পুঁটিমারা ইউনিয়নের চড়ারহাট বাজার। বাজারের দক্ষিণে প্রাণকৃষ্ণপুর আর উত্তরে আন্দোল গ্রামের সারাইপাড়া, নয়াপাড়া এবং আহম্মদনগর এলাকা। কিছুটা ভীতি আর শঙ্কা নিয়ে ঘুমন্ত গ্রামের মানুষ। মধ্যরাত থেকে অনেকটা চুপিসারে প্রাণকৃষ্ণপুর গ্রাম ঘিরে ফেলে পাকিস্তানি বাহিনী।

১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর সবে পুবের আকাশে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। পাখির ডাকে জাগতে শুরু করেছে মানুষ। গ্রামের গোদা মিয়া নামের একজনকে পাঠানো হয় সবার বাড়িতে বাড়িতে। সেতু সংস্কার করা হবে জানিয়ে গ্রামের তরুণ ও মধ্যবয়সীদের উত্তর–পূর্ব দিকে একটি ফাঁকা মাঠে জড়ো করা হয়। ওই মাঠে নিরুপায় হয়ে ঢাকি–কোদালসহ সমবেত হয় শতাধিক মানুষ। এরপর উপস্থিত সবাইকে কালেমা পড়তে বলা হয়। কালেমা পড়া শেষ হতে না হতেই শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর ব্রাশ ফায়ার। মুহূর্তে সবুজ ঘাস সকালের সূর্যের মতো লাল হয়ে ওঠে। ঝরে যায় ৯৮টি তাজা প্রাণ। গণহত্যার ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়েও বেঁচে যান ১১ জন। বর্তমানে সেই ঘটনার সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছেন পাঁচজন।

ঘটনার দিন চোখের সামনে ছটফট করতে করতে বাবা ও ভাইয়ের মৃত্যু দেখেছেন মোজাম্মেল হক (৭৬)। নিজের হাতে ও পায়ে গুলির ক্ষত নিয়ে আজও বেঁচে আছেন তিনি। ১০ অক্টোবরের কথা উঠতেই বলেন, ‘রাত থেকেই টের পাইছিলাম যে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রাম ঘিরে ফেলেছে। ভয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে পালানোর সাহস হয়নি। সকালে যখন মাঠের মধ্যে

গিয়েছি, তখনো মনে হয়েছে আজকেই শেষ দিন। ব্রাশ ফায়ার করলে হাতে ও পায়ে আহত হয়ে মাটিতে পড়ে যাই। কৌশল করে উপুড় হয়ে লাশের মতো শুয়েছিলাম। বুটের লাথি খেয়েছি, কিন্তু চিৎকার করিনি। বুঝতে পারছিলাম, সবার মৃত্যু নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে তারা। একটা সময় অজ্ঞান হই। আর কিছু মনে করতে পারি না।’

প্রায় ঘণ্টাব্যাপী প্রাণকৃষ্ণপুর ও আন্দোল গ্রামে তাণ্ডব চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। মৃত্যুপুরী হয় চড়ারহাট। ফেরার পথে খড়ের গাদা ও বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয় ওরা। পুড়তে থাকে সকালের উষ্ণ বিছানা। মানুষসহ গরু–ছাগলের আর্তনাদ মিলিয়ে যায় আগুনের লেলিহান শিখায়। গ্রামের মেয়েদের ওপরও চলে অমানুষিক নির্যাতন।

ওই ঘটনায় বেঁচে যাওয়া চিকিৎসক এহিয়া মণ্ডল বলেন, ‘সকাল ৮টার সময় ওরা চলে গেলে আমরা যারা বেঁচে ছিলাম, তারা উঠে দাঁড়াই। ইতিমধ্যে পার্শ্ববর্তী গ্রামের লোকজন জড়ো হয়েছে। শিশু ও বৃদ্ধদের ওরা ছেড়ে দিয়েছিল। আমরা লাশ দাফনের ব্যবস্থা করি। কবর খুঁড়ছি। কেউ হয়তো এসে বলছে, ‘পাকিস্তানি বাহিনী আসছে’। আবার পালিয়ে গেছি। মানুষের কাফনের কাপড় নেই। বাড়ির মশারি, পুরোনো কাপড়, লেপের কাভার পরিয়ে কোনোমতে একসঙ্গে গ্রামের পশ্চিম দিকে গণকবর দেওয়া হয়। মাগরিবের মধ্যে কবর দেওয়া শেষ হয়। আমার পায়েও গুলি লেগেছিল।’

সেই ঘটনার দুই মাস পর বিজয় অর্জন। পরবর্তী সময়ে হাকিমপুর উপজেলার গোহারা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা অজিত রায় চড়ারহাটে স্মৃতিমিনার নির্মাণের জন্য জনসংযোগ শুরু করেন। স্বাধীনতার ৪০তম বছরে তৎকালীন দিনাজপুর সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-৭১–এর সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, অজিত রায়সহ কয়েকজনের উদ্যোগে চড়ারহাটে নির্মিত হয় শহীদদের নামের ফলক। ২০১১ সালের ১০ অক্টোবর সেই নামফলক উন্মোচন করেন তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকী। অন্যদিকে শহীদদের স্মৃতিকে ধরে রাখতে স্থানীয় ব্যক্তিরা প্রতিষ্ঠা করেছেন শহীদ স্মৃতি মহাবিদ্যালয় ও শহীদ স্মৃতি বালিকা বিদ্যালয়।

দিনাজপুর সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-৭১–এর সাবেক সভাপতি ও নাগরিক উদ্যোগ দিনাজপুরের আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, চড়ারহাটের মানুষ চায়, সেদিনের ঘটনায় শহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করে যেন গবেষণা করা হয়। শহীদদের স্মরণে স্মৃতির মিনার নির্মাণ, সর্বোপরি শহীদদের রাষ্ট্রীয় সম্মানসহ নির্যাতিত নারীদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া হোক।