বিজ্ঞাপন
default-image

একাত্তরের ১৭ এপ্রিল গাইবান্ধা শহরে প্রথম পাকিস্তানি সেনারা প্রবেশ করে। ঘাঁটি গড়ে স্টেডিয়ামে। সেখান থেকে তারা জেলার বিভিন্ন এলাকায় হত্যা আর নির্যাতন চালায়। কোথাও নিরীহ মানুষদের দল বেঁধে ধরে এনে হত্যা করা হয়, কোথাও হত্যার পর দেওয়া হয় গণকবর।

বাঙালির ইতিহাসের নির্মম এই অধ্যায়ের সাক্ষী জেলায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন গণকবর ও বধ্যভূমি। গাইবান্ধা জেলায় এমন ৯টি বধ্যভূমি ও ৮টি গণকবর চিহ্নিত করা হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় শহীদদের স্মরণে ফলক, স্তম্ভ নির্মাণ করা হলেও কিছু জায়গা সংরক্ষণই করা হয়নি। যেসব বধ্যভূমিতে স্মৃতিফলক হয়েছে, সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা নেই।

গাইবান্ধা জেলা একাত্তরের বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক জি এম চৌধুরীর মতে, বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো সংরক্ষণ করা দরকার, না হলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে যাবে। তিনি বলেন, ‘এ জন্য দীর্ঘদিন ধরে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। আমাদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক স্থানে সংরক্ষণ করে সেখানে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে।’

গাইবান্ধা জেলা একাত্তরের বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও বাস্তবায়ন কমিটি এবং জহুরুল কাইয়ুম সম্পাদিত গণহত্যা—বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ গ্রন্থ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বধ্যভূমিগুলো হচ্ছে জেলা শহরের তৎকালীন হেলাল পার্ক বর্তমানে শাহ আবদুল হামিদ স্টেডিয়াম মাঠ, সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের গোঘাট, সুন্দরগঞ্জ উপজেলা শহরের শহীদ মিনারসংলগ্ন গোয়ালের ঘাট, একই উপজেলার কাপাসিয়া ইউনিয়নের লালচামার, পলাশবাড়ী উপজেলা শহরের ডাকবাংলো, কিশোরগাড়ী ইউনিয়নের কাশিয়াবাড়ি, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কাটাখালী সেতুসংলগ্ন, সাঘাটা উপজেলার সাঘাটা স্কুলসংলগ্ন ও ফুলছড়ি উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের বাউসি এলাকায় ফুলছড়ি বধ্যভূমি।

গণকবরগুলো হচ্ছে সদর উপজেলার বোয়ালি ইউনিয়নের ত্রিমোহিনী, পলাশবাড়ী উপজেলার পলাশবাড়ী পৌরসভার বৈরি হরিণামারি, একই ইউনিয়নের পলাশবাড়ী-ঘোড়াঘাট সড়কসংলগ্ন কলাগাছি ও মুংলিশপুর জাফর, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার হরিরামপুর ইউনিয়নের পাখেড়া, সাঘাটা উপজেলার বোনারপাড়া ইউনিয়নের বোনারপাড়া বিএডিসি তেলের ট্যাংকসংলগ্ন, বোনারপাড়া কেজি স্কুলসংলগ্ন এবং বোনারপাড়া কলেজসংলগ্ন। দুটি বধ্যভূমি ও তিনটি গণকবর এখনো সংরক্ষণ করা হয়নি। অবশিষ্টগুলো সংরক্ষণ করা না হলেও ছোট–বড় স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে।

একাত্তরে পাকিস্তানি সেনারা বিভিন্ন এলাকা ও বাড়ি থেকে নারীদের ধরে আনত শাহ আবদুল হামিদ স্টেডিয়ামে। সেখানে ধর্ষণ ও নির্যাতনের পর পাশে পুঁতে রাখা হতো। পাশাপাশি পুরুষদেরও ধরে এনে হত্যার পর মাটিচাপা দেওয়া হতো। এভাবে কয়েক মাসে সহস্রাধিক নারী-পুরুষকে হত্যার পর এই মাঠে পুঁতে রাখা হয়।

কিন্তু এখন পর্যন্ত জায়গাটি বধ্যভূমি হিসেবে গড়ে তোলা হয়নি। প্রতিবছর ২৫ মার্চ এখানে কিছু সংগঠন মোমবাতি প্রজ্বালন করে। সরেজমিন দেখা যায়, জেলা শহরের মাঠসংলগ্ন বধ্যভূমির ভেতরের কিছু জায়গা আগাছায় ভরে গেছে। কিছু জায়গায় সবজি চাষ করা হচ্ছে।

স্টেডিয়ামসংলগ্ন মাস্টারপাড়া এলাকার প্রবীণ ব্যবসায়ী শরিফ মিয়া বলেন, ‘একাত্তরের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনারা চলে যাওয়ার পর স্টেডিয়াম মাঠে নারীদের রক্তমাখা শাড়ি, ব্লাউজ, মাথার চুল ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকতে দেখেছি। এখানে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা না হলে আগামী প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার ইতিহাস মুছে যাবে।’

গাইবান্ধা যুব নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক জিয়াউল হক বলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় জেলায় সবচেয়ে বেশি নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ হয় স্টেডিয়াম মাঠে। কিন্তু এটি সংরক্ষণ করা হয়নি।

গাইবান্ধা পৌরসভার মেয়র মতলুবর রহমান বলেন, তিনি সদ্য দায়িত্ব নিয়েছেন। শহরের স্টেডিয়ামসংলগ্ন বধ্যভূমি সংরক্ষণ করে সেখানে স্মৃতিফলক নির্মাণ করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।

গাইবান্ধা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে কামারজানি ইউনিয়নের গোঘাট বধ্যভূমি। এখানকার বধ্যভূমি রক্ষণাবেক্ষণ তো দূরের কথা, পুরোটা দখল হয়ে গেছে। কামারজানি বাজারের গাইবান্ধা-কামারজানি সড়ক ঘেঁষে এই বধ্যভূমির ওপর দোকানপাট গড়ে উঠেছে। একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা গোঘাট গ্রামে ঢুকে এলাকার অসংখ্য লোককে ধরে এনে হত্যা করে। নারীদের নির্যাতন করে হত্যার পর গোঘাট গ্রামের এই জায়গায় গণকবর দেয়।

বধ্যভূমিটি পরিত্যক্ত থাকায় গোঘাট গ্রামের কয়েকজন মিলে দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়ি গড়ে তুলেছেন। তাঁদের মধ্যে জহুরুল হক ও আবু মিয়ার ভাষ্য, বধ্যভূমির এই জায়গাটি তাঁদের পৈতৃক সম্পত্তি। জায়গাটি পরিত্যক্ত ছিল। তাই কিছুদিন আগে তাঁরা এখানে দোকানপাট ও ঘরবাড়ি নির্মাণ করেন। কখনো কোনো সময় সরকার অধিগ্রহণ করলে তাঁরা ছেড়ে দেবেন।

কামারজানি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুস ছালাম জানান, বধ্যভূমির এই জায়গা সংরক্ষণ করে এখানে স্মৃতিফলক নির্মাণের জন্য বহুবার প্রশাসনকে বলা হয়েছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। কামারজানি এলাকার সংস্কৃতিকর্মী সাদ্দাম হোসেন বলেন, এই বধ্যভূমির জায়গা সংরক্ষণ করে এখানে স্মৃতিফলক নির্মাণ সময়ের দাবি।

গাইবান্ধার গণকবরগুলো সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে অযত্ন আর অবহেলা। পাকিস্তানি সেনারা স্থানীয় ১০ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে পলাশবাড়ীর বৈরি হরিণামারি গ্রামে মাটি চাপা দেয়। কিন্তু এখানে অদ্যাবধি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়নি। বৈরি হরিণামারি গ্রামের প্রবীণ কৃষক বাদল মিয়া বলেন, প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়েও গ্রামের গণকবরটি সংরক্ষণ করানো যায়নি। পলাশবাড়ী পৌরসভার মেয়র গোলাম সারওয়ার বলেন, ‘আমি সদ্য দায়িত্ব পেলাম। গণকবরটি সংরক্ষণ করে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হবে।’

গোবিন্দগঞ্জের পাখেড়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, গ্রামের গণকবরটি অযত্নে পড়ে আছে। গণকবরের জায়গায় স্থানীয় লোকজন একটি ছোট শহীদ মিনার নির্মাণ করেন। সেটি ময়লা-আবর্জনায় জমে আছে। এখানে সাতজন হিন্দু গ্রামবাসীকে লাইন করে হত্যার পর মাটিতে পুঁতে রাখা হয়। পাখেড়া গ্রামের কলেজছাত্র শাহ আলম বলেন, আগামী প্রজন্ম যাতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানে, সে জন্য এখানে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা দরকার।

পাকিস্তানি সেনারা পলাশবাড়ীর মুংলিশপুর জাফর গ্রামে ১১ জন মানুষকে হত্যা করে গ্রামেই তাঁদের পুঁতে রাখে। কিন্তু এই গণকবর সংরক্ষণ করে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়নি।

পলাশবাড়ীর কাশিয়াবাড়ি বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা হলেও সেটির অবস্থা করুণ। কাশিয়াবাড়ি স্কুল মাঠে একসঙ্গে শতাধিক (কারও মতে ৬১ জন) নিরীহ মানুষকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাঁদের লাশগুলো স্কুলের অদূরে রামচন্দ্রপুর নামক জায়গায় পুঁতে রাখা হয়। রামচন্দ্রপুর এলাকার ওই স্থানের চারদিকে প্রচীর দেওয়া হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু স্মৃতিফলকটি অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে।

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, যেসব বধ্যভূমি ও গণকবর সংরক্ষণ করা হয়নি, সেগুলো দ্রুত করা হবে।