নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় যুক্ত করার জন্য এখন পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ সুপারিশ পেয়েছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। অনেক স্থানে নিয়মনীতি অনুসরণ না করায় এই বিপুলসংখ্যক সুপারিশ যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়েছে।
গত ২১ জানুয়ারি মহানগর, জেলা ও উপজেলা পর্যায় থেকে প্রাথমিক যাচাই-বাছাই শুরু হয়। গত সোমবার পর্যন্ত ৩৪১টি কমিটি থেকে ওই সুপারিশ এসেছে। এখনো ১৪৭টি কমিটির সুপারিশ বাকি রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্তির জন্য কোনো কোনো এলাকায় স্থানীয় মন্ত্রী-সাংসদের প্রভাব রয়েছে। তালিকাভুক্তির জন্য আর্থিক লেনদেনেরও অভিযোগ রয়েছে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অভিযোগ এনে কারও কারও ভাতা বন্ধের সুপারিশ এসেছে। তা ছাড়া সব কমিটির সুপারিশের সংখ্যা দেড় লাখে পৌঁছাতে পারে। এত সুপারিশ যাচাই-বাছাই করতে কমপক্ষে দুই বছর সময় লাগতে পারে, যা জামুকার পক্ষে অসম্ভব। এ কারণে ‘সঠিক’ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়নের পুরো প্রক্রিয়াটি বর্তমান সরকারের আমলে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন মন্ত্রণালয় ও জামুকার কর্মকর্তারা।
এবার নিয়ে সপ্তমবারের মতো তালিকা পরিবর্তন এবং নতুন করে আরও মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকাভুক্ত করতে যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া চলছে দেশে। গত ৪৬ বছরে ছয়বার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পরিবর্তন করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও মানদণ্ড পাল্টেছে ১০ বার।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এবার সাংসদের নেতৃত্বে উপজেলা, জেলা ও মহানগর পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাই কমিটির শুধু সম্মানী ও খরচ বাবদ প্রায় ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। সরকার রাষ্ট্রীয় অর্থ ও প্রচুর সময় ব্যয়ের পরও প্রকৃত ও নির্ভুল মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়ন করতে পারেনি বলে সমালোচনা রয়েছে।
জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক মন্ত্রণালয়ে এসব অভিযোগের কথা স্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ সুপারিশ এসেছে। অনেক কমিটিই আমাদের বেঁধে দেওয়া নিয়মনীতি অনুসরণ করেনি, এটা ঠিক। কমিটি ইচ্ছামতো কাজ করেছে। অনেক স্থানে টাকা দিয়ে কমিটির সদস্যদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে, স্থানীয় সাংসদের প্রভাব খাটানোর অভিযোগও এসেছে। এ ছাড়া যেখানে মুক্তিযোদ্ধা উপস্থিত ছিলেন না, সেখানকার সুপারিশ আমলে নেব না। আমরা কী করব তা জামুকার বৈঠকে বসেই সিদ্ধান্ত নেব।’
বর্তমানে ২ লাখ ৩১ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকাভুক্ত রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার পুরোনো তালিকায় যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, যাঁরা নতুন করে সনদ পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন এবং গেজেটে যাঁদের নাম রয়েছে, তাঁদের ব্যাপারে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য মহানগর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি করতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় গত ১২ জানুয়ারি গেজেট প্রকাশ করে। যাচাই-বাছাই কমিটিতে স্থানীয় সাংসদ অথবা তাঁর মনোনীত একজন মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধি, মন্ত্রণালয়ের মনোনীত একজন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের সদস্য মনোনীত একজন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের মনোনীত একজন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, জেলা ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের প্রতিনিধি, সংশ্লিষ্ট জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক অথবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) রয়েছেন।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শতাধিক জেলায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই করার ক্ষেত্রে ইউএনও কোনো ধরনের নিয়মকানুন মানেননি বলে অভিযোগ এসেছে। অনলাইনে পাওয়া আবেদন নিয়ে যাচাই-বাছাই করার কথা। কিন্তু স্থানীয় সাংসদ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চাপে তাৎক্ষণিক আবেদন জমা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন অনেকে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতিতে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার কথা থাকলেও অনেক ইউএনও আবেদনকারীদের একজন একজন করে ডেকে যাচাই-বাছাই করেছেন।
মন্ত্রী ও সাংসদের শতাধিক ডিও লেটার
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শুরু থেকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তি এবং কমিটিতে পছন্দের লোক রাখার জন্য মন্ত্রণালয়ে সাংসদদের শতাধিক আধা সরকারি পত্র (ডিও লেটার) এসেছে।
সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর এলাকায় যাচাই-বাছাই কমিটিতে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধার নাম দেওয়া হয়েছিল। এই নাম বাদ দিয়ে তিনি নিজের নাম রাখতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীকে ডিও লেটার দিয়েছেন।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ গাজীপুর-৫ এর সাংসদ। তিনি নিজের আত্মীয় ঢাকায় বসবাসরত ইমতিয়াজ আহমেদকে তালিকাভুক্ত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।
শরীয়তপুরের সাংসদ বি এম মোজাম্মেল হক কমিটিই বদলে দিতে বলেছেন। তাঁর মতে, ওই কমিটির অধীনে উপজেলার অধিকাংশ আবেদনকারী যাচাই-বাছাই করতে চাইছেন না। তিনি জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এম এ সাত্তার খানকে কমিটির সভাপতি করতে বলেছেন।
শেখ ফজলে নূর তাপস ঢাকার সাংসদ। তিনি লক্ষ্মীপুরের লোকমান হায়দারকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা উল্লেখ করে বলেছেন, তিনি ১৯৭১ সালে তাঁর ব্যবহৃত অস্ত্র খুলনা সদর থানায় জমা দেন। তাঁর নাম গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হোক।
মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কয়েকটি জেলায় যেখানে আগে ৪০০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, সেখানে আরও ২০০ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম সুপারিশ করে পাঠানো হয়েছে। অন্যদিকে ভুয়া নাম বাদ দেওয়া হয়নি। সাংসদেরা নিজেদের ভোটব্যাংক বাড়াতে কিছু কিছু এলাকায় ইচ্ছামতো নাম ঢুকিয়েছেন।
আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ
কোনো কোনো উপজেলায় আর্থিক লেনদেনও হয়েছে। নড়াইলের সাংসদ কবিরুল হকের অভিযোগ, কালিয়া উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি দরখাস্ত আহ্বান করে সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা করে ঘুষ নিয়ে ১৯৭১ সালে যাঁদের বয়স মাত্র ৯ বা ১০ বছর ছিল, তাঁদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে জামুকায় সুপারিশ পাঠিয়েছে। কবিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার এলাকায় যা হয়েছে, তা বোধ হয় আর কোথাও হয়নি। কমিটির সভাপতি এমদাদুল হকসহ সদস্যরা লাখ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন। কোনো রাখঢাক করে নয়, সকলের সামনে। এখন তাঁরা ওই টাকা দিয়ে জমি কিনছেন, বাড়ি বানাচ্ছেন। এই কমিটির কার্যকলাপে এলাকায় সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।’
জানতে চাইলে এমদাদুল হক বলেন, এসব অভিযোগ ঠিক নয়। বিরোধিতার কারণে মিথ্যা বলা হচ্ছে।
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বলায় হুমকি
কুমিল্লার মুরাদনগরের স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর আলম মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেছেন, তিনি মুরাদনগরের ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার কারণে হুমকির মুখে রয়েছেন। তিনি স্থানীয় ১৬ জনের বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি করে বলেছেন, যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে তাঁরা দায়ী থাকবেন। প্রথম আলোকে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, তাঁদের এলাকায় অধিকাংশই ভুয়া লোকের নাম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুপারিশ করা হয়েছে। দুর্নীতি ও অর্থ বিনিময়ের মাধ্যমে তাঁদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
সূত্র: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ৫ আশ্বিন ১৪২৪, বুধবার, প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।