সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই নিয়ে বিতর্ক চলছেই। একদিকে অভিযোগ উঠেছে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম রাখার জন্য অর্থ লেনদেনের, অন্যদিকে আপত্তি উঠেছে কমিটির সদস্যরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে কিছু ক্ষেত্রে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলে কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নতুন আবেদন করা ৯০ ভাগের দেওয়া তথ্যই ভুল। পাশাপাশি যাঁরা যাচাই-বাছাই করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও উঠেছে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অভিযোগ। এসব কারণে নির্ধারিত সময়ে যাচাই-বাছাই সম্পন্ন হয়নি। মাঠপর্যায় থেকে ২০ মের মধ্যে যাচাই-বাছাই করা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা) না পৌঁছালে আগামী অর্থবছর থেকে সম্মানী ভাতা বা উৎসব ভাতা দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দেওয়া হলেও অর্ধেক আবেদনও পৌঁছায়নি। নিয়ম ভঙ্গ করে এখনো চলছে যাচাই-বাছাই।
মুক্তিযোদ্ধার পুরোনো তালিকায় যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে এবং যাঁরা নতুন করে সনদ পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন, তাঁদের ব্যাপারে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য মহানগর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি করতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় গত ১২ জানুয়ারি একটি গেজেট প্রকাশ করে। সারা দেশে আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ৪৮৮টি উপজেলা ও ৮টি মহানগর কমিটি কাজ শুরু করে ২১ জানুয়ারি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য অনলাইনে জমা পড়ে প্রায় দেড় লাখ আবেদন।
এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কাছে এ পর্যন্ত জেলা পর্যায় থেকে যে তালিকা এসেছে, তাতে ৫ শতাংশও মুক্তিযোদ্ধা নন। আমাদের কাছে যেসব অভিযোগ এসেছে, তা খতিয়ে দেখছি। টাকা লেনদেনের বিষয়ে আমাদের কাছেও অভিযোগ এসেছে।’
অভিযোগের পর অভিযোগ
গত বুধবারও মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে গোপালগঞ্জের ভাতাপ্রাপ্ত ২৪৭ জন বাদ পড়ায় এলাকায় মানববন্ধন করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মো. মজিবর রহমান অভিযোগ করেছেন, মুক্তিযোদ্ধার গেজেট, মুক্তিবার্তা, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের সনদে নাম থাকার পরও যাচাই-বাছাই কমিটি ‘দুর্নীতির মাধ্যমে’ ২৪৭ জনকে তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। অন্যদিকে কাগজপত্র নেই এমন ৫৫২ জনকে যাচাই-বাছাই কমিটি সদর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।
তবে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য গোপালগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বদরুদ্দোজা বদর দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সরকার একটি নীতিমালা করেছে এবং সে অনুযায়ী যাচাই-বাছাইয়ের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে।’
এর আগে রাজবাড়ী সদর ও গোয়ালন্দ উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কার্যক্রম নিয়ে কমিটির দুই সদস্যের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি অভিযোগ দিয়েছেন স্থানীয় ৮৯ জন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রাজবাড়ী সদর উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই নিয়ে কমিটির সদস্য মহসীন উদ্দিন এবং আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়েছে, তাঁরা যাচাই-বাছাইয়ের
নামে ভয়ভীতি দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন।
মহসীন উদ্দিন অভিযোগ অস্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, যাচাই-বাছাইতে কিছু অমুক্তিযোদ্ধা ও ভুয়া ব্যক্তি তালিকাভুক্ত হওয়ার চেষ্টায় মিথ্যা অভিযোগ করেছে।
আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা না হওয়ার অভিযোগ ওঠায় তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বয়স নিয়ে আইনের ব্যত্যয় হলে বিষয়টি মন্ত্রণালয় দেখবে।’
বরিশালে সনদ সংগ্রহ এবং তালিকায় নাম রাখা নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ উঠেছে বাবুগঞ্জ উপজেলায়। বরিশাল জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার মহিউদ্দিন মানিক প্রথম আলোকে বলেন, যাচাই-বাছাই কমিটিতে যাঁদের রাখা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে অনেকেই বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন।
বাবুগঞ্জ উপজেলার মহিষাদী গ্রামের আলেয়া বেগম মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেন, তাঁর স্বামী মোসলেম আলী হাওলাদার মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু তাঁকে বাদ দেওয়া হয়েছে। মো. কাঞ্চন মৃধা প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধার সনদ থাকা সত্ত্বেও তাঁকে বাদ দেওয়া হয়েছে। একই অভিযোগ করেন মো. হাকিম আলী।
বরিশাল জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক এনায়েত হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বাবুগঞ্জ উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটা অংশ অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত ছিল। আবার যাচাই-বাছাই কমিটিও অনেক স্থানে রাজনৈতিকভাবে করা হয়েছে। তবে জাল সনদ নিয়েও অনেকে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য এসেছিলেন। তাঁরা বাদ পড়েছেন।
বাবুগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. আনিচুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্থ লেনদেন হয়েছে এটা দ্বিমত করি না। শুনেছি লোকে গরু, জমি বেচে এবং সুদে ঋণ নিয়েও নাকি টাকা দিয়েছে।’
যাচাই-বাছাই শেষে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বগুড়ার শেরপুরে বেশির ভাগের নাম বাদ দেওয়ার সুপারিশ করায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের সন্তানেরা বিক্ষোভ করেছেন।
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বাদ পড়া তালিকায় বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মজিবর রহমান ও বাংলাদেশ ব্যাংক বগুড়ার সহকারী পরিচালক আবদুর রউফ খানও রয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে মজিবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পাকিস্তান আমলে তিনি শেরপুর থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৭০ সালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক বগুড়ার সহকারী পরিচালক আবদুর রউফ খান বলেন, তিনি ছিলেন ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। সরকারি গেজেটভুক্ত এবং মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সনদপ্রাপ্ত ছিলেন। তাঁকে অন্যায়ভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয় তিন দফা কমিটিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
সূত্র: ২৩ জুন ২০১৭, ৯ আষাঢ় ১৪২৪, শুক্রবার, প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।