বিজ্ঞাপন
default-image

‘তখন আমি দিদির বাড়িতে থাকতাম। দিদির বাড়ি ছিল কাজদিয়া গ্রামে।... প্রতিদিনের মতো আমরা কাজকর্ম করছিলাম। হঠাৎ শোনা গেল জিপের শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে শোনা যায় বুলেট আর মানুষের চিৎকার। আমরা ভয়ে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে পড়ি। জামাইবাবু আমাদের রান্নাঘরে যেতে বলে। আমরা রান্নাঘর থেকে শুনতে পাই দরজায় লাথি মারার শব্দ।’

সাতক্ষীরার নিহারবালা রায় মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের চোখে দেখা এ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। এই বর্ণনায় উঠে এসেছে তাঁর জামাইবাবু ও ভাগনে হত্যাকাণ্ডের কাহিনি। তিনি এই বর্ণনা দিয়েছেন সাতক্ষীরা সরকারি গার্লস স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী বৈশাখী চ্যাটার্জির কাছে। গত বছরের এপ্রিলে। বৈশাখী তা লিখে পাঠিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীর এই ভাষ্য যুদ্ধের কথ্য ইতিহাসের অংশ হিসেবে সংরক্ষিত থাকবে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আর্কাইভে। বহু বছর পর বৈশাখী অথবা নিহারবালার পরিবারের কেউ বা কোনো গবেষক যদি এসে খোঁজ করেন, তবে এটিসহ এমন অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য পাবেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এখন পর্যন্ত সারা দেশের ৪০ হাজার প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য সংগ্রহ করেছে। প্রতিটিই আলাদা ঘটনা। এই বিবরণগুলো লিখে পাঠিয়েছে নিজ নিজ এলাকার স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা। এই কথ্য ইতিহাস সংগ্রহ শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালে। চলতি বছর পর্যন্ত ৬৪ জেলার ১৫ হাজার স্কুলের লক্ষাধিক শিক্ষার্থী এতে অংশ নিয়েছে।

বাঙালির চিরগৌরবের মহান মুক্তিযুদ্ধ সফল হয়েছিল অনেক মানুষের মিলিত চেষ্টা ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে। সময়ের প্রবাহে ক্রমেই দূর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে সেই গৌরবদীপ্ত ঘটনার দিনগুলো। সেই সময়ের মানুষও বিদায় নিচ্ছেন একে একে। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার তাগিদ থেকেই প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য সংগ্রহের এই উদ্যোগ শুরু হয়েছিল।

এই প্রকল্পের পরিচালক জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এর ভেতর দিয়ে হাজারো মানুষের প্রাণের কথা তুলে ধরা হচ্ছে। মুছে যাওয়া, ভুলে যাওয়া, আড়ালে চাপা পড়া—কত স্মৃতি এভাবে আবার সরব হয়ে উঠছে। অন্য মানুষের অন্তরে স্থান পাচ্ছে। আর যারা এ কাজ করছে, তারা মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরের প্রজন্ম। ছোটরাও যে অনেক বড় কাজ করতে পারে, এটি তার এক উজ্জ্বল নিদর্শন। দেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এমন প্রামাণ্য বিবরণের এটিই সবচেয়ে বড় সংগ্রহ।

এসব ভাষ্যের তথ্যের নিশ্চয়তা সম্পর্কে ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, ‘এগুলো ইতিহাসের দলিল নয়, আমরা দেখছি ইতিহাসের উপকরণ হিসেবে। একজন মানুষ ঘটনাগুলো কীভাবে দেখে, তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়েছে। খুঁটিনাটি তথ্যে হয়তো একটু এদিক-ওদিক হতে পারে, তবে মূল সারবস্তু ঠিক আছে কি না, সে বিষয়টিতে আমরা গুরুত্ব দিয়েছি।’

ট্রাস্টি মফিদুল হক এবং এই প্রকল্পের সঙ্গে বিভিন্নভাবে জড়িত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অনুষ্ঠান সমন্বয়কারী রফিকুল আলম, লিয়াজোঁ কর্মকর্তা কামাল উদ্দিন তথ্য-উপাত্ত দিলেন। বললেন, সারা দেশে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের নিয়ে জাদুঘরের ব্যাপক কর্মসূচি চলছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য সংগ্রহ তার একটি। এই প্রকল্পে দুটি ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর দেশের প্রতিটি জেলায় গিয়ে এক মাস থাকে। এই সময়ে জেলার বিভিন্ন উপজেলার স্কুলে যায়। শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শনগুলো দেখে। তাদের মুক্তিযুদ্ধের একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। তাদের বলা হয় পরিবার, প্রতিবেশী বা পাড়া-মহল্লার পরিচিতজন যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন বা দেখেছেন, নারী-পুরুষ যে কেউ হতে পারেন, তাঁদের কাছ থেকে তাঁদের অভিজ্ঞতা শুনতে। এরপর সেই অভিজ্ঞতা লিখে স্কুলে জমা দিতে বলা হয়। স্কুল থেকে সেই লেখাগুলো জাদুঘরে পাঠানো হয়। জাদুঘর এসব ভাষ্য কম্পোজ করে বইয়ের আকারে বাঁধাই করে সংশ্লিষ্ট স্কুলগুলোতে পাঠায় এবং মূল কপি আর্কাইভে সংরক্ষণ করে। আর তিন মাস অন্তর একটি ছোট পুস্তিকা প্রকাশ করে। তাতে যেসব শিক্ষার্থী লিখিত ভাষ্য পাঠিয়েছে, তাদের ও যাঁদের ভাষ্য নেওয়া হয়েছে তাঁদের নাম, ঠিকানা ও প্রয়োজনীয় তথ্য উল্লেখ থাকে। বাছাই করা কিছু ভাষ্যও প্রকাশিত হয়। ভাষ্য পাঠানো শিক্ষার্থীদের জাদুঘরের পক্ষ থেকে একটি স্বীকৃতিপত্রও দেওয়া হয়। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম ও নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগসূত্র সৃষ্টি হয়।

এসব ভাষ্য অঞ্চলভিত্তিক বাছাই করে বই আকারেও ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ছাত্র-ছাত্রীর সংগৃহীত মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য নামে পাঁচটি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। এতে প্রায় দেড় হাজারের মতো ভাষ্য ও বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। এসব ভাষ্য থেকে দুটি ঘটনা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে প্রামাণ্যচিত্র।

মফিদুল হক বললেন, এই ভাষ্যগুলোর একটি বিশেষত্ব হলো, যত ভাষ্য এসেছে, তার প্রায় অর্ধেকে আছে নারীর কথা। সংগ্রহও করেছে নারীরা। মুক্তিযুদ্ধে নারীদের কথা এত ব্যাপক ও বিস্তারিতভাবে আগে জানা যায়নি। তা ছাড়া এগুলো ছিল অনানুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার। ফলে যাঁরা বলেছেন তাঁরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলেছেন। কাচা হাতের লেখা হলেও সেখানে আছে স্বতঃস্ফূর্ততা। এই ভাষ্যগুলো অনলাইনে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য সংগ্রহে অংশ নিয়েছিলেন চট্টগ্রামের পাঁচলাইশের শিক্ষার্থী নিহার দাস ও দিনাজপুর সদরের বাঁধন রায়। তারা প্রথম আলোকে জানাল, এটি তাদের জীবনের একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তারা অনেক কিছু জেনেছে।

আরও কর্মসূচি

প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য সংগ্রহ ছাড়াও তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আরও বেশ কিছু প্রকল্প রয়েছে। এর একটি হলো ‘আউটরিচ’ কর্মসূচি। এতে জাদুঘর নিজ ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের জাদুঘরে নিয়ে আসে। তারা জাদুঘর ও প্রামাণ্যচিত্র দেখা, কুইজে অংশ নেওয়াসহ কিছু কর্মসূচিতে অংশ নেয়। বিজয়ীদের পুরস্কার দেওয়া হয়। এটি চালু হয়েছে ১৯৯৭ সালে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এতে ৭৯৮টি স্কুলের ১ লাখ ৯২ হাজার ৭৬১ জন অংশ নিয়েছে।

এ ছাড়া প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় মুক্তির উৎসব। আগের বছর আউটরিচে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা দিনভর এই উৎসবে অংশ নেয়। জাদুঘর মনে করে, একুশ শতকের শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংগ্রহের ভেতর দিয়ে একটি করে ফুল সংগ্রহ করছে। সেই ফুল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এক বিশাল মালা গাঁথার কাজটি করে চলেছে।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১৭, ১২ চৈত্র ১৪২৩, রবিবার, প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।