বিজ্ঞাপন
default-image

হেরেম্ব্রনাথ রায় ছিলেন টাঙ্গাইলের সন্তোষ জাহ্নবী উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক। এই স্কুলে যোগদানের আগে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন শহরের শিবনাথ উচ্চবিদ্যালয়ে। টাঙ্গাইল অঞ্চলে শিক্ষক হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন তিনি।

সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন না। তবে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন সোচ্চার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে গ্রামের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। নানাভাবে তাঁদের সহায়তা করতেন।

এ কারণে পাকিস্তানি সেনারা তাদের অনুগত ভৃত্য রাজাকারদের সহায়তায় প্রবীণ শিক্ষক হেরেম্ব্রনাথ রায় ও তাঁর ছেলেকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে।

হেরেম্ব্রনাথ রায়ের জন্মসাল সঠিক জানা যায়নি। পরিবার সূত্রে জানা গেছে, গত শতাব্দীর বিশের দশকে টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী উপজেলার সহদেবপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। বাবা হেমন্তনাথ রায় ছিলেন হোমিও চিকিৎসক, মা সরোজিনী রায় গৃহিণী।

হেরেম্ব্রনাথ ছিলেন তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবার বড়। গ্রামের পাঠশালায় লেখাপড়া শুরু। পরে ময়মনসিংহের গৌরীপুর স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন।

বিজ্ঞানে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পাস করেন রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোলে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন।

হেরেম্ব্রনাথ চেয়েছিলেন এলাকার নতুন প্রজন্মের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে। সে কারণে অন্য কোনো চাকরির চেষ্টা না করে পাঠপর্ব শেষে তিনি কলকাতা থেকে ফিরে এসে টাঙ্গাইল শহরের শিবনাথ উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। দীর্ঘদিন তিনি এই স্কুলে সহকারী শিক্ষক ছিলেন।

১৯৬৯ সালে সন্তোষ জাহ্নবী হাইস্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্য ও পাঠসহায়ক বই রচনা করতেন।

স্বাধিকার আন্দোলন দানা বেঁধে উঠলে হেরেম্ব্রনাথ রায় তাতে একাত্ম হন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে টাঙ্গাইল শহরের বাসা ছেড়ে তিনি পরিবার নিয়ে গ্রামের বাড়ি সহদেবপুর চলে আসেন।

একাত্তরের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী টাঙ্গাইল শহরে প্রবেশ করে। হানাদারদের প্রতিরোধ করতে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন মির্জাপুর উপজেলার সাটিয়াচড়ায়।

ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হানাদার বাহিনীর আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ভেঙে যায়। অনেক মুক্তিযোদ্ধা হেরেম্ব্রনাথ রায়ের গ্রামের বাড়ি সহদেবপুর চলে আসেন। হেরেম্ব্রনাথ তাঁদের আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করেন।

এতে রাজাকাররা তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে তিনি সহদেবপুর ছেড়ে অন্য গ্রামে আত্মগোপন করেন।

মাঝেমধ্যে গোপনে সহদেবপুর এসে পরিবারের সঙ্গে দেখা করে যেতেন। এভাবেই জুলাই মাসের ৭ তারিখে পরিবারের সঙ্গে দেখা করে ছেলে অমিয় ভূষণ রায়কে নিয়ে আত্মগোপন করতে যাচ্ছিলেন।

টাঙ্গাইল শহরের কাছে পথিমধ্যে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের সামনে পড়েন। রাজাকাররা তাঁদের চিনে ফেলে আটক করে ময়মনসিংহ সড়কের পাশে পলাশতলী এলাকায় সেনাক্যাম্পে নিয়ে যায়।

স্থানীয় এক রিকশাচালক ঘটনাটি দেখে হেরেম্ব্রনাথ রায়ের বড় ছেলে হিমাদ্রী ভূষণ রায়কে এই খবর দেন।

হিমাদ্রী ভূষণ রায় প্রথম আলোকে জানান, খবর পেয়ে বাবা-ভাইকে ছাড়িয়ে আনার জন্য স্থানীয় শান্তি কমিটির নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

মায়ের ও স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে হিমাদ্রী ভূষণ সেই নেতাকে টাকা দেন। কিন্তু ওই নেতা হেরেম্ব্রনাথ ও অমিয় ভূষণকে ছাড়িয়ে আনতে পারেননি।

হানাদার সেনারা তাঁদের নির্যাতন করে হত্যা করে।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমবেদনা জানিয়ে হেরেম্ব্রনাথ রায়ের স্ত্রী জ্যোতির্ময়ী রায়কে চিঠি ও দুই হাজার টাকা অনুদান পাঠিয়েছিলেন। হেরেম্ব্রনাথের সাত ছেলে ও চার মেয়ে।

হেরেম্ব্রনাথ রায় ও তাঁর ছেলে মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিলেও তাঁরা শহীদের স্বীকৃতি পাননি। টাঙ্গাইল জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার আবুল কালাম আজাদ বীর বিক্রম জানান, হেরেম্ব্রনাথ রায় তাঁরও শিক্ষক ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁকে ছেলেসহ ধরে নিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি তাঁর প্রাপ্য।

গ্রন্থনা: কামনাশীষ শেখর, টাঙ্গাইল