বিজ্ঞাপন
default-image

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানিকগঞ্জ মহকুমায় শিক্ষক স্বদেশ প্রসাদ বসু মজুমদার ছিলেন পরিচিত মুখ। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন শুরু থেকেই। মানিকগঞ্জে একাত্তরের মার্চে বাংলাদেশের পতাকার সঙ্গে কালো পতাকা ওড়ানো এবং পাকিস্তানি পতাকা পোড়ানোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। এতে ক্ষিপ্ত হয় রাজাকার ও হানাদার সেনারা। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাও করা হয়। হানাদার সেনারা তাঁকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।

শহীদ স্বদেশ প্রসাদ বসুর জন্ম ১৯১৪ সালে ঘিওর উপজেলার বড়টিয়া ইউনিয়নের শ্রীবাড়ির জমিদার পরিবারে। তাঁর বাবা কামাখ্যাপ্রসাদ বসু মজুমদার ছিলেন জমিদার। মা জ্যোতির্ময়ী মজুমদার গৃহিণী। তাঁরা ছিলেন দুই ভাইবোন। স্বদেশ বসু ১৯৩৬ সালে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন। এলাকায় সাংস্কৃতিক চর্চা ও বিকাশে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থ দিয়ে সহায়তা করেন।

একাত্তরের ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস। এ উপলক্ষে সারা বাংলাদেশের মতো মানিকগঞ্জেও পাকিস্তানি পতাকার পরিবর্তে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলনের জোর তৎপরতা চালানো হয়। স্বদেশ বসু মানিকগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। শিবালয় সিও (সার্কেল অফিসার) অফিসে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনে তিনি সাহসী ভূমিকা রাখেন। দৌলতপুরের খলসি ইউনিয়ন পরিষদের পতাকা উত্তোলনের সময়ও স্বদেশ বসু উপস্থিত ছিলেন।

একাত্তরের ৮ এপ্রিল মানিকগঞ্জে হানাদার বাহিনী প্রবেশ করলে স্বদেশ বসু আত্মগোপন করেন। জুন মাসের শেষের দিকে তিনি তাঁর গ্রামের ক্ষীতিশ বসুর বাড়িতে আশ্রয় নেন। স্থানীয় রাজাকাররা বিষয়টি জেনে যায়। তারা ক্ষীতিশ বসু ও স্বদেশ বসুকে আটক করে হানাদার সেনাদের হাতে তুলে দেয়। ঘাতক সেনারা ১ জুলাই রাতে হাত বেঁধে তাঁদের ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বারবাড়িয়া সেতুর কাছে এনে বেয়নেট দিয়ে নির্মমভাবে খুঁচিয়ে আহত করে ফেলে রেখে যায়। স্বদেশ বসু মজুমদার সেখানেই শহীদ হন। ক্ষীতিশ বসু গুরুতর আহত হলেও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তথ্য চেয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে মানিকগঞ্জ সদরের খাবাশপুর আদর্শ ডিগ্রি কলেজের বাংলার প্রভাষক মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর স্বদেশ প্রসাদ বসুর ছবি ও তথ্য পাঠান। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের নিয়ে তাঁর মাঠপর্যায়ে গবেষণার তথ্য নিয়ে প্রকাশিত স্মৃতি ও শ্রুতিতে মানিকগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধ বইতে এবং আশির দশকে মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক সাইফ উদ্দিন আহমদ সম্পাদিত মানিকগঞ্জ জেলার ইতিহাস বইতে স্বদেশ বসুর জীবন ও কর্ম স্থান পেয়েছে। এ ছাড়া অধ্যক্ষ মুহম্মদ সায়ীদুল হক সম্পাদিত সরকারি দেবেন্দ্র কলেজের ইতিহাস বইতেও তাঁর জীবনকর্ম রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানকে সম্মান জানাতে ২০১৩ সালে ঘিওর-শ্রীবাড়ির সড়কের নামকরণ করা হয় ‘শহীদ স্বদেশ বসু সড়ক’।

স্বদেশ বসুর একমাত্র সন্তান শংকর প্রসাদ বসু মজুমদার অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা। তিনি জানান, দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর মা বিভাবতী বসুকে সমবেদনা জানিয়ে চিঠি ও নগদ দুই হাজার টাকা অনুদান পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু এখনো তাঁর বাবার নাম বুদ্ধিজীবী হিসেবে সরকারি তালিকাভুক্ত হয়নি। মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালাম বলেন, স্বদেশ বসুকে শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।

গ্রন্থনা: আবদুল মোমিন, মানিকগঞ্জ