বিজ্ঞাপন

শহীদবুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়

default-image

টেবিলে ভাত রাখা। সবে গোসল সেরে বেরিয়েছেন যশোর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ প্রকৌশলী সুলতানউদ্দিন আহমদ। এ সময় দরজায় লাথি। দরজা খুলতেই সশস্ত্র পাঁচ ঘাতক সেনা টেনেহিঁচড়ে তাঁকে নিয়ে যায় নিচের তলায়। গোলাপঝাড়ের সামনে দাঁড় করিয়ে ওরা জিজ্ঞাস করে, ‘তুম বাঙালি আউর বিহারি?’ দীপ্তকণ্ঠে তিনি আত্মপরিচয় দিলেন বাঙালি বলে। অমনি গর্জে উঠল ঘাতকের বন্দুক। গুলিতে গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গেল তাঁর বুক।


এ ঘটনা একাত্তরের ৫ এপ্রিলের। শহীদ সুলতানউদ্দিন আহমদের বাসভবনে সেদিন ছিলেন তাঁর ছোট ভাই বশিরউদ্দিন আহমদ, শ্যালক নাজমুল হক খোকন ও যশোর শহরের খ্যাতনামা চিকিৎসক ওবায়দুল হক। সুলতানউদ্দিনকে হত্যা করে ঘাতক সেনারা আবার ওপরে গিয়ে বশির, খোকন ও ওবায়দুল হককে নিচে নামিয়ে লাইন করে গুলি করে।

সুলতানউদ্দিনের স্ত্রী শামসুন নাহার আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘাতক আর্মিরা আমাদের দোতলার বারান্দার ওপর দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। নিচে ওদের গুলি করার পর আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে। ছোট ছেলেমেয়েরা ভীষণ কান্নাকাটি শুরু করলে আমাদের গুলি না করে চলে যায়।’


শামসুন নাহারের বয়স এখন প্রায় ৭৫, থাকেন চট্টগ্রামে। সুলতানউদ্দিনের ছয় ভাইবোনের মধ্যে শুধু এক বোন মনোয়ারা মণি বেঁচে আছেন। থাকেন ঢাকার উত্তরায়। ফোনে তাঁরা শহীদ সুলতানউদ্দিন সম্পর্কে বিস্তারিত বলেছেন।
মাত্র দেড় বছরের মতো সংসারজীবন ছিল সুলতানউদ্দিন আহমদের। স্ত্রী শামসুন নাহার সেই দিনগুলো আর পরের দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের স্মৃতিচারণা করলেন। সুলতানউদ্দিন প্রকৌশলী হলেও সাহিত্যের প্রতি ছিল প্রবল ঝোঁক। দরিদ্র অসহায় মানুষকে সাহায্য করতেন। দেশের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ছিল। বিশ্বাস করতেন, দেশ স্বাধীন হবেই।

সুলতানউদ্দিনের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বাবা মহিউদ্দিন ছিলেন রেলের কর্মকর্তা। যশোরে গণহত্যা শুরু হলে অনেকেই শহর ছেড়ে পালাতে শুরু করেন। কিন্তু সুলতানউদ্দিন পালাতে রাজি হননি।


শামসুন নাহার জানান, সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁরা ওই বাড়িতেই ছিলেন। নিচে পড়ে ছিল প্রকৌশলী সুলতানউদ্দিন আহমদ, তাঁর শ্যালক নাজমুল হক ও চিকিৎসক ওবায়দুল হকের লাশ। সন্ধ্যার পর পলিটেকনিকের এক কর্মচারী এসে বাসা থেকে শামসুন নাহারদের নিয়ে যান। স্বজনের মৃতদেহ ফেলে রেখে প্রাণ বাঁচাতে তাঁরা অনেক বাধা পেরিয়ে নড়াইলে নূরুল ইসলাম নামের এক সহৃদয় ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। নড়াইলে গিয়ে তাঁরা জানতে পারেন লাশগুলো বাড়ির লনেই পড়ে ছিল। পরদিন পাকিস্তানি সেনারা ঠেলাগাড়ি এনে তুলে নিয়ে গেছে।


সংগ্রামী জীবন শুরু হয় শামসুন নাহারের। একটি পুত্রসন্তানের জন্ম হয় তাঁর। বিয়ের আগেই স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছিলেন শামসুন নাহার। পরে ইতিহাস ও ইসলামের ইতিহাসে দুটো স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন সাতকানিয়া কলেজে। এরপর চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ ও সিটি কলেজে অধ্যাপনা করে অবসরে গেছেন ২০০৫ সালে। একমাত্র ছেলে সালাহ উদ্দিন আহমদ গত জানুয়ারিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
শামসুন নাহার বলেন, কোনো সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা তিনি নেননি। এমনকি তাঁর স্বামী ও ভাই শহীদ হয়েছেন, শহীদ পরিবার হিসেবে কোনো সদনও তাঁদের নেই।