বিজ্ঞাপন
default-image

মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেননি সাধু ভূঞা। তবে ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার রাজাগাঁতী ইউনিয়নের কাশিনগর গ্রামের বাসিন্দা সংস্কৃতিসেবী ও শিক্ষানুরাগী সাধু ভূঞা সোচ্চার ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। এলাকার তরুণদের তিনি যুদ্ধে যেতে সংগঠিত করেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চলাচল বাধাগ্রস্ত করতে এলাকায় একটি সড়ক ও রেলসেতু উড়িয়ে দেন। এতে তিনি সহায়তা করেছিলেন। এ কারণে ক্ষিপ্ত হানাদার সেনারা ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল সাধু ভূঞাকে গুলি করে হত্যা করে। গানপাউডার দিয়ে পুড়িয়ে দেয় তাঁর বাড়ি।

সাধু ভূঞা ছিলেন সংস্কৃতিসেবী, শিক্ষানুরাগী, দানশীল ব্যক্তি। এলাকার সব সাংস্কৃতিক আয়োজনে তিনি নেতৃত্ব দিতেন। গড়ে তুলেছিলেন একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নান্দাইলের কাশিনগর গ্রামে ১৮৯৬ সালে তাঁর জন্ম। বাবার নাম দোহাই ভূঞা। তিনি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী পালন, ঋতুভিত্তিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও গ্রামীণ মেলার আয়োজন, নাটক মঞ্চায়নে আর্থিকভাবে সহায়তাসহ সব আয়োজনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখতেন। বিদ্যোৎসাহী সাধু ভূঞা ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও অর্থসহায়তায় এলাকায় ১৯৬০ সালে কাশিনগর জুনিয়র হাইস্কুল (বর্তমানে উচ্চবিদ্যালয়) ও কাশিনগর প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়া একাধিক সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজে সহায়তা করেছেন। গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দারা বলেন, সাধু ভূঞা ইচ্ছে করলে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজ নামে করতে পারতেন। কিন্তু খ্যাতির জন্য তিনি লালায়িত ছিলেন না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন ক্রমেই স্বাধীনতার পক্ষে রূপ নিতে থাকলে সাধু ভূঞা এলাকার তরুণ ও যুবকদের সংগঠিত করতে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জনতার প্রতিরোধ ও সশস্ত্র সংগ্রাম গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য তৎকালীন কিশোরগঞ্জ মহকুমা শহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঘাঁটি স্থাপন করে। ওই ঘাঁটি থেকে হানাদাররা নানা দলে বিভক্ত হয়ে নান্দাইলের প্রত্যন্ত গ্রামে ঢুকে নারকীয় অত্যাচার শুরু করে।

হানাদার সেনাদের যাতায়াতে বাধা সৃষ্টির জন্য সে সময় ঢাকা থেকে আসা কিছু বাঙালি ইপিআর ও সেনাসদস্য মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল নান্দাইলের তারঘাট সড়কসেতু ও কালীগঞ্জ বাজারের কাছে অবস্থিত শুভখিলা রেলসেতু উড়িয়ে দেন। এতে সাধু ভূঞারও যুক্ততা ছিল।

এই ঘটনায় হানাদাররা প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তিন দিন পর ২১ এপ্রিল হানাদার বাহিনীর একটি দল পুরো কাশিনগর গ্রামে হামলা চালায়। তারা গ্রামে ঢুকেই সাধু ভূঞার খোঁজ করতে থাকে। সাধু ভূঞা পরিস্থিতি আগাম অনুমান করে বাড়ির নারীসহ সব সদস্যকে আত্মগোপন করতে পাঠিয়ে দেন। তিনি নিজেও বাড়ির পাশের জঙ্গলে লুকিয়ে থাকেন। একপর্যায়ে হানাদার সেনারা তাকে খুঁজে পেয়ে গুলি করে হত্যা করে। তারা গানপাউডার দিয়ে তাঁর বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়। এরপর ঘাতক সেনার দল পুরো কাশিনগর গ্রামে নারকীয় তাণ্ডব চালায়।

নান্দাইল মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মাজহারুল হক ফকির প্রথম আলোকে বলেন, নান্দাইলের শহীদদের তালিকায় সাধু ভূঞার নাম রয়েছে। উপজেলা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে নির্মিত সৌধে শহীদদের তালিকায় সাধু ভূঞার নাম রয়েছে। এ ছাড়া আগামী প্রকাশনীর শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থে সংস্কৃতিসেবী ও বিদ্যোৎসাহী সাধু ভূঞার সংক্ষিপ্ত জীবনী রয়েছে।

সাধু ভূঞার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে ছিল, তাঁরা কেই জীবিত নেই। সাধু ভূঞার নাতি আবুল কালাম ভূঞা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের পরিবারের সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক হিসেবে পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ তাঁর দাদা এলাকায় দানবীর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তবে সরকারিভাবে তিনি শহীদের স্বীকৃতি পাননি।

গ্রন্থনা: রমেশ কুমার, নান্দাইল, ময়মনসিংহ