বিজ্ঞাপন
default-image

একাত্তরে শাহ আবদুল মজিদ ছিলেন রাজশাহীর পুলিশ সুপার। ৩১ মার্চ সন্ধ্যায় পাকিস্তানি সেনারা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিসির বাসভবন থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তাঁর আর সন্ধান পাওয়া যায়নি।

শোনা যায়, পাকিস্তানি সেনারা কয়েক দিন পর তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। হত্যার সঠিক তারিখ ও তাঁর মরদেহের কোনো সন্ধান আর মেলেনি।

এ ঘটনার বিবরণ জানা যায় আবদুল মজিদের বড় মেয়ে ফারজানা শাহনাজ মজিদের কাছ থেকে।

এই প্রতিবেদককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে (২৯ ডিসেম্বর ২০১৪, সোমবার) শাহনাজ মজিদ বলেন, ‘২৫ মার্চ রাত ১১টার পর আমাদের বাসার টেলিফোন, বিদ্যুৎ-লাইন কেটে দেওয়া হয়।

বাসা পাকিস্তানি সেনারা ঘিরে ফেলে। সেই রাতে সমগ্র রাজশাহী শহর পাকিস্তানি সেনাদের প্রায় দখলে চলে যায়।

রাজশাহীর ডিসি রাশিদুল হাসানের (পরে বাংলাদেশ সরকারের সচিব) আহ্বানে বাবা আমাদের নিয়ে তাঁর বাসায় আশ্রয় নেন।

‘৩১ মার্চ ডিসির বাংলো থেকে পাকিস্তানি সেনারা বাবাকে গ্রেপ্তার করে। তখন মাগরিবের সময়, আমার মা নামাজে বসেছিলেন।

এমন সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সোলেমান মাহমুদ নামের এক ক্যাপ্টেন একদল সেনাসহ ডিসির বাসায় জিপ নিয়ে আসে।

মা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাবাকে জোরপূর্বক জিপে তোলা হয়। সেনারা বাবার চারদিকে অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে ছিল। ক্যাপ্টেন সোলেমান মাহমুদকে ২৬ থেকে ৩১ মার্চ প্রতিদিনই ডিসির বাংলোতে দেখা যেত।’

শাহ আবদুল মজিদ ছিলেন আধুনিক মনের মানুষ। ইতিহাস ও সংগীতের প্রতি ছিল তাঁর গভীর আগ্রহ।

উনসত্তর ও সত্তরের গণ-আন্দোলন চলাকালে তিনি আন্দোলনরত সবার নিরাপত্তার জন্য উদ্‌গ্রীব থাকতেন।

মিছিল-সমাবেশে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে, সে জন্য অধীনস্থদের না পাঠিয়ে তিনি নিজেই এসব স্থানে দায়িত্ব পালন করতেন।

অসহযোগ আন্দোলনকালে সরকারি কর্মকর্তা হয়েও তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

২৯ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাজশাহী পুলিশ লাইনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করলে তিনি চেষ্টা করেন পুলিশ লাইন রক্ষার। এ জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরাগভাজন হন।

১৯৩৫ সালের ১ জানুয়ারি গাইবান্ধায় শাহ আবদুল মজিদের জন্ম। বাবা শাহ ইউনুস আলী, মা মেহের আফজুন বেগম।

বাবা-মায়ের একমাত্র পুত্রসন্তান। ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করে সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।

পরে ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত ঢাকার জগন্নাথ কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যাপনা করেন।

১৯৬১ সালে পাকিস্তান পুলিশ সার্ভিসে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৬৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নারায়ণগঞ্জের এসডিপিও (মহকুমা পুলিশ প্রশাসক) নিযুক্ত হন।

পরবর্তীকালে বগুড়া ও ফরিদপুর জেলার এসপি, সারদা পুলিশ একাডেমির উপাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বরে রাজশাহী জেলার এসপি হন।

শাহ আবদুল মজিদের স্ত্রী নাজমা মজিদ। স্বাধীনতার পর সরকারের আহ্বানে তিনি নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে যোগ দেন।

মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক হিসেবে অবসর নেন। তাঁর দুই ছেলে, দুই মেয়ে। বড় ছেলে মামুন মাহমুদ শাহ ব্যাংকার। ছোট ছেলে বখতিয়ার রসুল শাহ অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।

বড় মেয়ে ফারজানা শাহ্‌নাজ মজিদ জেন্ডার বিশেষজ্ঞ। বতমানে আইসিডিডিআরবিতে কর্মরত।

ছোট মেয়ে সাগুফতা ফারাহ্‌ মজিদ অর্থনীতিতে মাস্টার্স। একাত্তরে তাঁর বয়স ছিল মাত্র নয় মাস। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী।

স্বাধীনতার পর রাজশাহী শহরের গির্জার পশ্চিমে ও পার্কের পূর্ব দিকের রাস্তা যেটি টেনিস কমপ্লেক্স হয়ে পদ্মার পাড় দিয়ে গেছে, সেই সড়ক শাহ আবদুল মজিদ সড়ক নামে নামকরণ করা হয়।

এ ছাড়া রাজশাহী পুলিশ লাইন স্কুলের একাডেমিক ভবন তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছে।

স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (তৃতীয় পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৪) থেকে।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান

সূত্র: ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত