বিজ্ঞাপন
default-image

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের প্রভাষক ও ঢাকা হলের (বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল) সহকারী আবাসিক শিক্ষক ছিলেন শরাফত আলী।

১৯৭০ সালের ১ জুলাই থেকে ঢাকা হলে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন শুরু করেন তিনি। তখন থেকে এই হলের শিক্ষক আবাসে থাকতেন।

সে সময় দেশের গণ-আন্দোলনের প্রতিটি কর্মকাণ্ডে অন্যান্য শিক্ষকের সঙ্গে তাঁকেও অংশগ্রহণ করতে দেখা যেত।

একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকা হলে আক্রমণ করে। রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হলেও ২৬ মার্চ সকালে নৃশংসভাবে নিহত হন তিনি।

২৫ মার্চ রাতে বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী তঁাদের আবাসে কামানের গোলা ছুড়েছিল।

তাতে নিহত হন শরাফত আলীর পাশের কামরায় পদার্থবিদ্যার শিক্ষক আতাউর রহমান খান খাদেম। তাঁর বাসায় আগুন ধরে যায়।

ভোররাতে শরাফত আলী চুপিচুপি সেই আগুন নেভাতে গেলে সেনারা তাঁকে দেখতে পায়। তখন সেনারা গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে তাঁকে হত্যা করে।

এ ঘটনার বিবরণ জানা যায় তাঁর সহকর্মী আ ন ম শহীদুল্লার ‘আমার সহকর্মী’ রচনায়। তিনি লিখেছেন, ‘১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়।

দেশজোড়া ছয় দফা আন্দোলন চলছে। সাইন্স এনেক্স ভবনের তিন তলার একটি কক্ষে তৃতীয় বর্ষের ক্লাস নিচ্ছি।

বারান্দায় ছেলেমেয়েদের উচ্চস্বরে তর্কাতর্কির শব্দে অসুবিধা হচ্ছিল। ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে দেখি থুতনীতে স্বল্প দাড়ি মন্ডিত মোংগলীয় আদলের এক ছেলেকে ঘিরে ভীষণ বাকবিতন্ডা।

ছেলের একই কথা “ছয় দফাও চাই পূর্ববাংলাও চাই”। উত্তেজিত ছেলেমেয়েরা বলে “বেটা ছয় দফা বানচাল করার জন্যই এই কথা বলছে।” মোংগলীয় আদলের এই মোল্লা মার্কা ছেলে আমারই শেষ পর্ব এম. এসসি. ক্লাসের ছাত্র শরাফত আলী।

‘১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের সেই ভয়াল রাতে বর্বর পাকবাহিনীর হাতে শরাফত আলী তার আবাসে নৃশংসভাবে নিহত হয়।

সেই রাতে পাকবাহিনী তাদের আবাসে কামানের গোলা ছোঁড়ে। এবং তাতে সরাসরি নিহত হন শরাফত আলীর পাশের কামরার পদার্থবিদ্যার শিক্ষক আতাউর রহমান খান খাদেম। তাঁর আবাসে আগুন ধরে যায়।

ভোর রাতে শরাফত চুপি চুপি আগুন নেবাতে গেলে পাকবাহিনী তাকে দেখতে পায় এবং গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে বলে শোনা যায়।

শরাফত আলীর সহপাঠী বন্ধু বুয়েটের শিক্ষক মোঃ ঈসা আমাকে ফোনে ধরা গলায় বলল, “স্যার, শরাফত আলী একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিল।

সে রোজ এশার নামাজের পর কিছুক্ষণ কোরআন পাঠ করত। সে তার ভাইবোনদের প্রতি দায়িত্বশীল ছিল।

তার ছোট ভাই শহীদুল্লাকে ঢাকা রেসিডেন্সিয়েলে রেখে পড়িয়েছে।...শরাফত আলী পরোপকারী লোক ছিল স্যার।

তার মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে বাড়ি চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দেশের এক দুস্থ রোগী তার বাসায় আশ্রয় নিলে তাকে থেকে যেতে হল।”’ (স্মৃতি: ১৯৭১, ষষ্ঠ খণ্ড, প্রকাশ ১৯৯৩, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।

শরাফত আলীর জন্ম ১৯৪৩ সালের ১ জুলাই। কুমিল্লা জেলার সদর উপজেলার দক্ষিণ রামপুরা গ্রামে। বাবা আলী আজম।

১৯৬০ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়াশোনা করেন। এখান থেকে ১৯৬৪ সালে বিএসসি পাস করেন।

এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৬৪-৬৫ শিক্ষাবর্ষে গণিত বিভাগে ভর্তি হন। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী।

১৯৬৫ সালের প্রথম পর্ব পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন।

কিন্তু আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে ১৯৬৬ সালে শেষ পর্ব পরীক্ষা দিতে পারেননি। ১৯৬৭ সালে বিশুদ্ধ গণিতে এমএসসি শেষ পর্বে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন।

শরাফত আলী অবিবাহিত ছিলেন। তাঁর মরদেহ পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয় আরও অনেকের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তাঁকে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে।

স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (ষষ্ঠ পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৩) থেকে।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান