একাত্তরের ৫ মে একদল পাকিস্তানি সেনা নাটোরের নর্থ বেঙ্গল (গোপালপুর) সুগার মিলে প্রবেশ করে।
তারা মিলের ভেতরে পুকুরপাড়ে শতাধিক বাঙালিকে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন।
এ ঘটনার বিবরণ জানা যায় তাঁর ছেলে মোহাম্মদ হাসানউল্লাহর কাছ থেকে। এ প্রতিবেদককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে (৮ জানুয়ারি ২০১৪) তিনি বলেন, ‘আমার বাবা তখন মিলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (বর্তমানে মহাব্যবস্থাপক, প্রশাসন) ছিলেন।
বাবা এখানে চাকরি করলেও মা ও আমরা তিন ভাই ঢাকায় থাকতাম। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে আমরা বাবার কাছে যাই।
‘মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মিলের প্রধান মো. আনোয়ারুল আজিম ও আমার বাবা স্থানীয় প্রতিরোধ যোদ্ধাদের হাতে মিলের কিছু অস্ত্র তুলে দেন।
ই এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে তাঁদের প্রতিরোধযুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকিস্তানিরা পরাজিত হয়।
তাদের কয়েকজন নিহত ও কয়েকজন ধরা পড়ে। ধরা পড়াদের মধ্যে ছিল মেজর আসলাম। জনতা তাদের হত্যা করে।
‘কিছুদিন পর ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এই এলাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।
এই সময় আনোয়ারুল আজিম ও আমার বাবাসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিরাপত্তার স্বার্থে পরিবার নিয়ে মিলের তৃতীয় শ্রেণির কোয়ার্টারে আশ্রয় নেন।
‘৫ মে সকাল ছিল শান্ত। সেদিন আমার বড় ভাই আমাদের বাসায় গিয়েছিল কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনতে।
নটার পর আমার বড় ভাই ফিরে এসে জানাল, মিলের মেইন গেটের কাছে মিলিটারিরা ঘোরাফেরা করছে।
এ খবর শুনে সেখানে উপস্থিত সকলে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। এদিকে তখন বাবা আমাদের কাছে ছিলেন না।
তিনি আনোয়ারুল আজিমের সঙ্গে গিয়েছিলেন পাশের গ্রামে। সেখানে মিলের ওয়েলফেয়ার অফিসার পরিবারসহ আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি ডাকাতের ছুরিকাঘাতে আহত হয়েছিলেন, তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন।
‘তাঁরা জানতেন না মিলে মিলিটারি এসেছে। তাই ওয়েলফেয়ার অফিসারকে দেখে মিলের ভেতরে প্রবেশ করেন।
মিলিটারিরা মিলের ভেতরে বিভিন্ন স্থানে পজিশন নিয়ে ছিল। অফিসে আসামাত্র কয়েকজন সেনা তাঁদের বলে গেটে মেজর শেরওয়ানী ও ক্যাপ্টেন মাহমুদ আছে। তারা মিলের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়ে মিটিং করবে।
বাবারা গেটের দিকে যাওয়ার পথে জোরপূর্বক তাঁদের বড় পুকুরের কাছে নেওয়া হয়। তখন এই পুকুরের নাম ছিল গোপাল সাগর।
‘পাকিস্তানিরা বাবাদের সেখানে জড়ো করে লাইনে দাঁড় করায়। এই সময় বাবাসহ অনেকে বুঝতে পেরেছিলেন তাঁদের হত্যা করা হবে।
কেউ কেউ শেষবারের মতো নামাজ পড়ার জন্য সময় চেয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তানি নরপশুরা সেই সুযোগ দেয়নি। গর্জে ওঠে তাদের অস্ত্র।
সবাইকে পাখির মতো গুলি করে তারা। বেঁচে যাওয়া একজনের কাছে পরে শুনেছি, বাবার শরীরে নাকি পাঁচটি গুলি লেগেছিল।
তিনি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর কিছুক্ষণ বেঁচে ছিলেন।
‘বাবার মরদেহ আমরা দেখতে পারিনি। সমাহিতও করতে পারিনি। পরে শুনেছি পাকিস্তানি দোসররা সবার মরদেহ দুটি বড় গর্তে মাটিচাপা দিয়েছে।’
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর জন্ম ১৯৩০ সালের ১ জানুয়ারি নরসিংদী জেলার বদরপুর গ্রামে। বাবা আবদুল হামিদ, মা গোলেজা বেগম।
ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি বিভিন্ন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনেও তাঁর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিল। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ পাস করেন।
ছাত্রজীবন শেষে তিনি সমাজকল্যাণ বিভাগে সংগঠক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ বিষয়ে এক বছর প্রশিক্ষণ নেন।
পরে ক্যাডার অফিসার হিসেবে যশোরের মোবারকগঞ্জ সুগার মিলস ও পরে ফরিদপুরের মধুখালী সুগার মিলসে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত হন।
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ তিন ছেলের জনক। বড় মোহাম্মদ শাহাদত হোসেইন, চাকরিজীবী। মেজো মোহাম্মদ হাসানউল্লাহ ব্যাংকার।
ছোট ছেলে মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। স্ত্রী কাজী লুৎফুননেছা বেগম।
স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (চতুর্থ পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৫) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
সূত্র: ১৮ জানুয়ারি, ২০১৫ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত