বিজ্ঞাপন
default-image

আয়কর আইনজীবী মো. তসলিম উদ্দিন প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু যুক্তিবাদী ও মুক্তচিন্তার মানুষ ছিলেন।

একাত্তরের ২৫ মার্চ রাত থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ তাঁকে বিচলিত করে। তিনি বিশ্বাস করতেন, পাকিস্তানিদের পরাজয় অনিবার্য।

এপ্রিলের মাঝামাঝি পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজশাহী শহরে প্রবেশ করলে মো. তসলিম উদ্দিন কিছুদিনের জন্য গ্রামে আশ্রয় নেন।

পরে ফিরে আসেন শহরে। খুব নিকটেই ভারতে আশ্রয় না নিয়ে দেশের মাটিতে থেকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তিনি পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েন।

একসময় বিষয়টি তাঁর এলাকার স্বাধীনতাবিরোধীদের কাছে ধরা পড়ে। ১৩ নভেম্বর স্থানীয় থানার ওসির নেতৃত্বে কয়েকজন পুলিশ ও ইপিকাফ (ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স) তাঁকে তাঁর কাজিহাটার বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়।

তারা মো. তসলিম উদ্দিনকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে অবস্থিত জোহা হলে অবস্থানরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়।

ধারণা করা হয়, ১৭ নভেম্বর পাকিস্তানিরা তাঁকে হত্যা করে। তাঁর মরদেহ পাওয়া যায়নি।

এ ঘটনার বিবরণ জানা যায় আইনজীবী ও সাংবাদিক সাঈদউদ্দিন আহমদের ‘আমার সতীর্থ’ রচনায়।

তিনি লিখেছেন, ‘শহীদ এডভোকেট মোঃ তসলিম উদ্দিনের চশমা, কলম ও অন্যান্য দু’একটি জিনিস উদ্ধার করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ড. শামসুজ্জোহা হলের পিছনের একটি গণকবর থেকে, দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েকদিন পরে।

তসলিম উদ্দিনের লাশটি কিন্তু সনাক্ত করা যায়নি। প্রায় পঞ্চাশটির মতো লাশ একটা দড়িতে বাঁধা ছিল।

এদের কাউকেই সনাক্ত করার অবস্থা ছিল না। এক মাস আগে পোঁতা লাশগুলি পচে গলে গিয়েছিল।

জোহা হলের জল্লাদখানা থেকে বরাত জোরে যারা বেঁচে গিয়েছিল, তাদের কাছ থেকে জানা যায় ১৯৭১ সালের ১৭ই নভেম্বর রাতে এডভোকেট তসলিম উদ্দিনকে সহবন্দীদের সাথে জোহা হলের বন্দীখানা থেকে বের করা হয় এবং সেই রাতেই তাদের হত্যা করা হয়। সেদিন ছিল পবিত্র ‘শবেকদরের’ রাত।...

‘১৩ নভেম্বর বিকেল চারটার সময় এডভোকেট তসলিম উদ্দিন তাঁর কাজিহাটা বাড়িতেই ছিলেন।

তাঁর ছোট ভাই এডভোকেট গোলাম রাব্বানীর কাছ থেকে জানা যায়, বিকেল ৪টার দিকে বোয়ালিয়া থানার তৎকালীন ও. সি. কয়েকজন সেপাই ও ইপিকাপের সদস্যদের নিয়ে একটি গাড়িতে করে তাদের বাড়িতে আসে এবং তসলিম সাহেবকে বলে কিছুক্ষণের জন্য তাঁকে থানায় যেতে হবে।

তারা জানায় তাঁকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে ইফতারের আগেই ছেড়ে দেবে। তসলিম সাহেব তাদের সঙ্গে থানায় যান।

না গিয়ে উপায়ও ছিলো না। তাঁর স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, ভাই, বোন সকলেরই মনে শঙ্কা ছিলো, ফিরে আসবে তো? না, তসলিম সাহেব আর ফিরে আসেননি।

তাঁর ছেলে মেয়েরা তাঁকে আর কোনোদিন আব্বা বলে ডাকতে পারেনি। ‘বোয়ালিয়া থানায় নিয়ে গিয়ে তাঁকে বলা হয়-“জোহা হলে যেতে হবে।”...তসলিম সাহেব রোজা ছিলেন। ইফতারের পর থানা থেকে তাঁকে জোহা হলে নিয়ে যাওয়া হয়।

তারপরের ৪ দিনের খবর তার সহবন্দীদের মধ্য থেকে, ভাগ্যগুণে যারা বেঁচে গেছেন, তাঁদের কাছ থেকে গোলাম রাব্বানী শুনেছেন।

সে খবর নিগ্রহের।’ (স্মৃতি: ১৯৭১, চতুর্থ খণ্ড, প্রথম প্রকাশ ১৯৯১, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।

মো. তসলিম উদ্দিনের জন্ম ১৯৩৬ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নামোশংকরবাটি গ্রামে।

বাবা মজিদুল্লাহ বিশ্বাস। মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত মো. তসলিম উদ্দিন চাঁপাইনবাবগঞ্জের রাজরারামপুর হামিদুল্লাহ উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে ম্যাট্রিক, রাজশাহী কলেজ থেকে আইএ ও বিএ এবং ১৯৬০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি পাস করেন।

১৯৬২ সাল থেকে তিনি রাজশাহীতে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে আয়কর উকিল হিসেবে রাজশাহী ইনকাম ট্যাক্স অ্যাডভোকেটস বারে যোগ দেন। শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত এ পেশাতেই যুক্ত ছিলেন।

মো. তসলিম উদ্দিন এক মেয়ে ও তিন ছেলের জনক। স্ত্রী সাঈদা বেগম। তিনি রাজশাহী টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শিক্ষিকা ছিলেন।

স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (সপ্তম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৮) থেকে।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান

সূত্র: ২১ জানুয়ারি, ২০১৫ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত