বিজ্ঞাপন
default-image

মুক্তবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধে বিশ্বাসী মানুষ ছিলেন শিক্ষাবিদ মুহাম্মদ হবিবুর রহমান।

তিনি একসময় এম এন রায়ের র‌্যাডিকেল হিউম্যানিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ভারত ভাগের পর ঢাকায় হাজী ওসমান গনি রোডে (তখন মনোয়ার খান বাজার রোড) তাঁর বাসায় ছিল এই দলের অফিস।

সেখানে নিয়মিত আসতেন অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অজিত গুহ, অশ্বিনী বাবু, সালাহ্‌উদ্দীন আহমদ, ডা. টি হোসেন, সাহিত্যিক আবদুল গনি হাজারী, বিভূতি সেন প্রমুখ।

পরে ষাটের দশকের বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-আন্দোলন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনেরও বলিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। প্রত্যক্ষভাবে এসব আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন তিনি।

একাত্তরে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের রিডার (বর্তমানে সহযোগী অধ্যাপক) ও বিভাগীয় প্রধান ছিলেন।

২৬ মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে তাঁর বাসায় উত্তোলিত কালো পতাকা নামিয়ে ফেলার নির্দেশ দিলে তিনি তাদের বলেন, ‘এ পতাকা নামানোর জন্য তোলা হয়নি।’

১৫ এপ্রিল বিকেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল সামরিক জিপে মুহাম্মদ হবিবুর রহমানের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাসায় এসে তাঁকে নিয়ে যায়।

তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। কবে, কোথায় কীভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়, তা পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেননি। তাঁর মরদেহও পাওয়া যায়নি।

তাঁর স্ত্রী ওয়াহিদা রহমানের ‘আমার স্বামী’ রচনা থেকে তখনকার ঘটনা সম্পর্কে তথ্য জানা যায়। তিনি লিখেছেন, ‘...বোধহয় এপ্রিলের ১৩ তারিখ হবে। ও সকালে আমাকে বললো, “গ্রামে যাওয়ার জন্য তৈরি থেকো।

আমাদের চলে যেতে হতে পারে।”...কিন্তু বিকেল নাগাদ পাকিস্তানি সৈন্যরা ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়েছে। আমাদের আর যাওয়া হলো না।...ক্যাম্পাসে ৬/৭টি মাত্র পরিবার।

কেউ নেই চারি-পাশে। ওর পক্ষে এরপর পালানো সম্ভব হবে কি? তবু আল্লাহ ভরসা করে ওর পকেটে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে ওকে প্রায় জোর করে বের করে দিলাম ঘর থেকে।...

‘পরের দিন আলো ফোটার আগেই পিছনের দরজা দিয়ে ও ঢুকলো। বললো পাশের পরিত্যক্ত ফ্লাটটিতে রাতে ছিল।

ওর পক্ষে আমাদের ফেলে রেখে যাওয়া সম্ভবপর নয়। ও এসে এক গ্লাস দুধ খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। সারা ক্যাম্পাস শুনশান।

দুপুরকে মধ্যরাতের মতন মনে হচ্ছে। দুপুরে উঠে খাওয়া দাওয়া করল। বিকেলে জনৈক প্রতিবেশীর ছেলেটি এসে ডাকতে থাকে। ওকে বেরুতে নিষেধ করলাম। কিছু শুনল না। বেরিয়ে গেল।...

খানিক পরে ফিরে এলো। চিন্তাক্লিষ্ট ও বিষণ্ন। আর্মির সঙ্গে দেখা করতে হবে। ভয়ের কিছু নেই।...পরের দিন, বিকেল হয়ে এসেছে।

আসরের নামাজ পড়ব।...নামাজে বসেছি এমন সময় একটি জিপ এসে থামল।...

‘স্যান্ডেল পরে ওর দোতলা থেকে নেমে যাওয়ার শব্দ পাচ্ছি।...সালাম ফিরিয়ে দেখি ও ঘরে নেই, জিপ নেই, দূরে জিপ যাচ্ছে।...

‘আমার স্বামী আর ফিরে আসেননি। যাঁরা তখন ক্যাম্পাসে ছিলেন বা পরে ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন, বাঙালি অবাঙালি প্রত্যেকের কাছে গিয়েছি।

আমার স্বামীকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সাহায্য চেয়েছি। উপাচার্য সাজ্জাদ হোসেনের কাছে গিয়েছি, তিনি বলেছেন, তাঁর কিছু করার নেই, তাঁকে যেন বিরক্ত না করি।’ (স্মৃতি: ১৯৭১, প্রথম খণ্ড, প্রকাশ ১৯৮৮, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।

মুহাম্মদ হবিবুর রহমানের জন্ম ১৯২১ সালের ১ জানুয়ারি নোয়াখালী জেলার বালিয়াধর গ্রামে।

বাবা কলিমউদ্দিন ভূইয়া, মা আছিয়া খাতুন। স্থানীয় দত্তপাড়া হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক (১৯৩৮), কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে আইএসসি (১৯৪০), কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএসসি, অনার্স (১৯৪৩), আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি (১৯৪৬) এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ (১৯৫৪) ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৫৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। কলেজ বীজগণিতযোগাশ্রয়ী বীজগণিত তাঁর দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ।

মুহাম্মদ হবিবুর রহমান দুই ছেলে ও চার মেয়ের জনক। বড় ছেলে খায়রুল আনাম বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন।

ছোট ছেলে আনিসুর রহমান বিদেশে থাকেন। মেয়ে রোকসানা রহমান, শারমিন রহমান, নাসরিন রহমান ও মোনালিসা রহমান। তাঁরা সবাই প্রবাসী।

স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৩) থেকে।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান

[email protected]

সূত্র: ৭ ফেব্রুয়ারি , ২০১৫ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত