বিজ্ঞাপন
default-image

একাত্তরে কুমিল্লার এসপি (পুলিশ সুপার) ছিলেন মুন্সী কবিরউদ্দিন আহমেদ। ২৬ মার্চ সকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল হানা দেয় তাঁর সরকারি বাসভবনে। তিনি তখন বাসাতেই ছিলেন। সেনারা তাঁকে ধরে নিয়ে যায়।

এরপর তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। সেদিন কুমিল্লার ডিসি এ কে এম শামসুল হককেও পাকিস্তানি সেনারা একই সময়ে ধরে নিয়ে যায়।

ধারণা করা হয়, ওই দিনই কুমিল্লা সেনানিবাসে নিয়ে গিয়ে মুন্সী কবিরউদ্দিন আহমেদ ও ডিসিকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। তাঁদের মরদেহ পাওয়া যায়নি।

সেদিনের এ ঘটনার বর্ণনা জানা যায় তাঁর স্ত্রী মাকছুদা কবিরের রচনায়। তিনি লিখেছেন,

‘...২৬ মার্চ সকাল সাতটায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাসা থেকে আমার স্বামীকে ধরে ডিসি সাহেবের সাথে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায় এবং সেখানেই তাঁদেরকে হত্যা করা হয়। এরপর আর তাঁর লাশ পাওয়া যায়নি।

‘তিনি যখন আমাদের ছেড়ে চলে যান, সেই মুহূর্তের স্মৃতি আজও আমার চোখের সামনে স্পষ্ট ভাসে।

যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তিনি যখন আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাবেন, সেই মুহূর্তে আমার মনে পড়ে আমার বৃদ্ধা শাশুড়ির কথা।

সারা রাত গোলাগুলির শব্দে তিনি ঘুমাতে পারেন নাই, তাই ভোরের দিকে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।

আমি তাড়াতাড়ি যেয়ে তাঁকে ঘুম থেকে জাগিয়ে আমার স্বামীর কাছে নিয়ে যেতে যেতে বলি, আম্মা, আপনার ছেলে আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

তখন তিনি সবকিছু বুঝতে পেরে তাঁর ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন আর বলতে থাকেন, তুমি আমাদের ছেড়ে কোথায় যাবে? তুমি আমাদের ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না।

আমার স্বামী তখন বললেন, মা, আমি এখনই চলে আসব। তখন আমি বুঝিনি যে এই যাওয়াই তাঁর শেষ যাওয়া।’ (আমার স্বামী, স্মৃতি: ১৯৭১, ষষ্ঠ খণ্ড, প্রথম প্রকাশ ১৯৯৩, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।

একাত্তরের ২৩ মার্চেই মুন্সী কবিরউদ্দিন খবর পেয়েছিলেন যে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি সেনারা এসে পুলিশ লাইন আক্রমণ করতে পারে। সেদিন তিনি নিজে পুলিশ লাইনে গিয়ে পুলিশ সদস্যদের উদ্বুদ্ধ করেন।

তিনি বলেছিলেন, পুলিশ লাইন আক্রান্ত হতে দেবেন না এবং অস্ত্রশস্ত্র পাকিস্তানি সেনাদের নিতে দেবেন না।

ওই রাতে তিনি নিজেও পুলিশ লাইনে ছিলেন। কিন্তু সেই রাতে পাকিস্তানি সেনারা পুলিশ লাইনে আসেনি।

২৪ মার্চ কুমিল্লার ডিসির সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি সার্কিট হাউসে একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করেন। পুলিশ লাইন, সার্কিট হাউসসহ সব জায়গাতেই তখন যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছিল।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী কুমিল্লা পুলিশ লাইন আক্রমণ করে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে। ওই রাতে তারা দেশের আরও অনেক স্থানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

কুমিল্লা পুলিশ লাইনে যে প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়, তা ছিল অনেক দুর্বল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের কাছে তা ভেঙে পড়ে।

পুলিশ বাহিনীর পক্ষে সম্ভব হয়নি পাকিস্তানিদের পুরোপুরি প্রতিরোধ করা। ভোরের দিকে পাকিস্তানি সেনারা পুলিশ লাইন দখল করে অসংখ্য পুলিশকে হত্যা করে।

এরপর তারা এসপি ও ডিসির বাসভবনে হামলা করে তাঁদের আটক করে। মুন্সী কবিরউদ্দিনের স্ত্রী ও সন্তানের কান্না এবং বৃদ্ধা মায়ের আহাজারি, কোনো কিছুই তাদের মন টলাতে পারেনি।

মুন্সী কবিরউদ্দিন পাঁচ ছেলেমেয়ের জনক। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন সৎ ও ধার্মিক একজন মানুষ।

স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (পঞ্চম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৫) থেকে।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান

সূত্র: ২০ জানুয়ারি, ২০১৫ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত