পাবনা জিলা স্কুলের উর্দু ও আরবি শিক্ষক ছিলেন মওলানা কসিমউদ্দিন আহমেদ। অসাম্প্রদায়িক মনের মানুষ ছিলেন তিনি।
১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বরে জিলা স্কুলে এক মুসলমান ছাত্রের প্রতি একজন হিন্দু শিক্ষকের আচরণে প্রথমে স্কুলে ও পরে শহরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল।
তখন যে কজন সমাজহিতৈষী তা প্রতিরোধ করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেন, তিনি তাঁদের একজন।
সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তিনি নিয়মিত অংশ নিতেন। স্কুলের তো বটেই, শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে এমনকি ধাঙড় পাড়ার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও তিনি উপস্থিত হতেন।
পাবনার কতিপয় ধর্মান্ধ তাঁকে ‘কাফের’ বলে আখ্যা দিয়েছিল। কারণ, একটি ওয়াজ মাহফিলে তিনি এক অর্ধশিক্ষিত মওলানার বক্তব্যের প্রতিবাদে কোরআন ও হাদিসের আলোকেই যুক্তিপূর্ণ ও বিজ্ঞানসম্মত বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
তাঁর এই বক্তব্য তাদের খেপিয়ে দিয়েছিল। একাত্তরে তাদের প্ররোচনাতেই একজন পাকিস্তান-সমর্থক (জামায়াতের কর্মী) স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় তাঁকে আটক করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়।
এ ঘটনা ঘটে একাত্তরের ১০ জুন। সেদিন তিনি পাবনা থেকে বাসে নিজের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়ায় যাচ্ছিলেন।
সাঁথিয়ার মাঠপুর থেকে তারা বাস থেকে নামিয়ে তাঁকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করে।
সেনারা তাঁকে চোখ বাঁধা অবস্থায় এক বাঁশঝাড়ে পুরোনো কবরে নামিয়ে গুলি করে চলে যায়। পরে স্থানীয় লোকজন তাঁর মরদেহ সেখানেই সমাহিত করেন।
শিক্ষক ও শিক্ষাদানে মওলানা অথচ এ রকম আধুনিক মানুষ সে সময়ে শুধু পাবনায় নয়, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানেও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ছিল।
তিনি পরতেন ফুলপ্যান্ট, শার্ট; মাথায় ব্যবহার করতেন ডোরাকাটা পশমি টুপি। পাবনা জিলা স্কুলের ক্রীড়া ক্ষেত্রে তাঁর অফুরন্ত উৎসাহ ও শ্রম স্কুলকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
ফুটবল, হকি, ক্রিকেট এমনকি দাঁড়িয়াবান্ধা খেলাতেও উৎসাহ দিতেন এবং অংশ নিতেন।
খেলাধুলার প্রতি প্রীতির কারণে তাঁকে জেলা স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনেরও দায়িত্ব নিতে হয়।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্কাউটিংয়ের ক্ষেত্রে তাঁর নাম বিশেষ মর্যাদায় উচ্চারিত হবে।
পাবনায় স্কাউটিংয়ের তিনিই ছিলেন প্রাণপুরুষ। ছাত্রদের সঙ্গে থেকে তিনিই উৎসাহ জোগাতেন, অনুপ্রেরণা দিতেন এবং স্কাউটের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতেন।
তাঁর সম্পর্কে এসব তথ্য জানা যায় জিয়া হায়দারের ‘আমার শিক্ষক’ রচনায়।
জিয়া হায়দার আরও লিখেছেন, ‘১৯৪৬ সালে আমি পাবনা জিলা স্কুলে ক্লাস সিক্স-এর ছাত্র। তখন “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান” ও “বন্দেমাতরমের” যুগ।
ঐ বছরেরই মাঝামাঝি জিলা স্কুলে এসে যোগ দিলেন, সম্ভবত জলপাইগুড়ি থেকে বদলি হয়ে, আমাদের নতুন হেড মওলানা, কসিমউদ্দিন আহমেদ।
আমাদের তো চোখ ছানাবড়া। মুখে দাড়ি নেই, পাতলা গোঁফও আছে, পরনে ফুলপ্যান্ট, গায়ে হাওয়াই শার্ট। মাথায় কেবল পশম দিয়ে তৈরি কিছুটা গোলাকৃতি শক্ত টুপি।...
‘৫২ সালে ২১ শে ফেব্রুয়ারির পরে পাবনাতে যে ছাত্র ধর্মঘট হয়, তাতে ছাত্রদের উৎসাহ দেবার অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত হয়েছিলেন।
কামাল লোহানী ১৯৫৪ সালে গ্রেফতার হওয়ার আগে তাঁর বাসাতেই লুকিয়ে ছিল বলে শুনেছি।
এবং ১৯৫৫ সালে আমি জেল থেকে বেরোনোর পরে (২১ শে ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার অপরাধে) তিনি আমাকে তাঁর বাসায় নিয়ে শরবৎ খাইয়েছিলেন।
শুনেছি, ৭১-এর মার্চ মাসে আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।’ (স্মৃতি: ১৯৭১, চতুর্থ খণ্ড, প্রকাশ ১৯৯১, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।
মওলানা কসিমউদ্দিন আহমেদের পৈতৃক বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার পুরান টেকি গ্রামে।
এখানেই তাঁর জন্ম। বাবা মহিউদ্দিন খান। চার ছেলে ও দুই মেয়ের জনক তিনি। বড় ছেলে চিশতি পাবনায় থাকেন।
শিবলি, উরফি ও তান্নি প্রবাসী। দুই মেয়ে নিনা ও দিনা গৃহিণী। স্ত্রী জাহানারা খানম।
স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (অষ্টম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৯) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
সূত্র: ২৯ জানুয়ারি, ২০১৫ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত