বাসের আলী ছিলেন নওগাঁর একজন বিশিষ্ট নাট্যশিল্পী। ফুটবল খেলাতেও ছিল তাঁর উৎসাহ। প্রাণবন্ত, রসিক আর হাসিখুশি মানুষ ছিলেন তিনি। মিশর কুমারী, শাহজাহান, সিরাজউদ্দৌলা ইত্যাদি নাটকে অভিনয় করে সুনাম ও সম্মান অর্জন করেছিলেন।
দেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি খুবই ব্যাকুল ছিলেন। তাঁর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা এলে তাঁদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। নিরাপত্তার কথা ভাবতেন। তিনি তাঁর চাচাতো এক ভাইকেও ভারতে পাঠিয়েছিলেন মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে। তাঁর এই ভাই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর এক যুদ্ধে শহীদ হন। এ সংবাদে তিনি কিছুটা ভেঙে পড়েন। তার পরও তিনি উৎসাহ হারাননি। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান অব্যাহত রাখেন।
বাসের আলীর ইচ্ছা ছিল দেশ স্বাধীন হলে তাঁর শহীদ চাচাতো ছোট ভাইকে যে এলাকায় সমাহিত করা হয়েছে, সেখানে গিয়ে কবর শনাক্ত করে মিলাদ পড়াবেন। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এ-দেশীয় দোসর রাজাকাররা তাঁর সে ইচ্ছা পূরণ হতে দেয়নি।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে একদিন (বুধবার) রাজাকাররা তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। রাজাকারদের ওই দলে ছিল মোসলেম উদ্দিন, তাঁর বাবা কছিমুদ্দিন ও সাজ্জাদ হোসেন নামে তিনজনসহ আরও কয়েকজন। পাঁচটি গুলি বাসের আলীর শরীর ভেদ করে বেরিয়ে যায়। একটা গুলি করা হয়েছিল তাঁর কানের কাছে রাইফেলের নল ঠেকিয়ে।
তাঁর সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল, ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসা মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের তিনি খাবার ও আশ্রয় দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা চাচাতো ভাইয়ের জন্যও তাঁকে রাজাকাররা দায়ী করে।
বাসের আলীকে নির্দয়ভাবে হত্যা করার বিবরণ জানা যায় তাঁর একমাত্র পুত্র এমদাদুল হকের বর্ণনায়। তিনি এ প্রতিবেদককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে (১৪ জানুয়ারি, ২০১৫) বলেন, ‘বাবা সেদিন তিন মাইল উত্তরে বালুভরা হাটে গিয়েছিলেন। রাজাকার মোসলেম উদ্দিনের নেতৃত্বে পাঁচ-ছয়জন সশস্ত্র রাজাকার ওত পেতে ছিল রাস্তার পাশে জঙ্গলে ও ফসলের খেতে। বাবা হাট থেকে ফেরার পথে দূর থেকে রাজাকার মোসলেম ও সাজ্জাদ বাবাকে শনাক্ত করে। রাজাকাররা বাবাকে ধরে। তখন বাবার সঙ্গে তাদের বেশ কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি হয়। এই সময় হাটফেরত কয়েকজন ঘটনাস্থলের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাঁদের বলা হয়, ওদিক গেলে গুলি করা হবে। তাঁরা মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে সেখানে আর যেতে সাহস করেননি।
‘শুনেছি, বাবা রাজাকারদেরকে বহু অনুরোধ করে বাঁচতে চেয়েছেন। তাঁর নিজের জন্য নয়। শহীদ ছোট চাচার কথা বলে বলেছেন, “তাঁর পরিবারও আমাকে দেখতে হবে। তোমরা যা চাও তাই দেব। বিনিময়ে আমাকে ছেড়ে দাও।”
‘অপরিচিত রাজাকাররা একটু নমনীয় হয়ে ছেড়ে দিলেও রাজাকার মোসলেম বলে, “তাঁকে ছাড়া যাবে না। আজ না মারলে আর মারা যাবে না।” সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে গুলি করা হয়। বুকে গুলি লাগার পরও কিছু দূর দৌড়ে যান বাবা। তখন তাঁকে ধরে মাটিতে ফেলে দেয় রাজাকাররা। বাবা শেষ শক্তি দিয়ে একজনের রাইফেল কেড়ে নিয়ে দৌড় দেন। এরপর রাজাকাররা চারদিক থেকে ঘেরাও করে, মাটিতে ফেলে বুকে নল ধরে পরপর কয়েকটি গুলি করে। একজন কানে লাগিয়ে মাথায় গুলি করে। সর্বমোট পাঁচটি গুলির চিহ্ন ছিল তাঁর দেহে। জনতাকে হটানোর জন্য তারা ফাঁকা গুলিও করেছে ১০-১২টি। বাবার লাশের ওপর লাথি দিয়ে নারকীয় উল্লাসও করে তারা।
‘আজও ভুলতে পারিনি বাবার মর্মান্তিক, নিষ্ঠুর হত্যার ঘটনা। আজও চোখে ভেসে ওঠে সেই সন্ধ্যা। হত্যাকারীদের বিচার হয়নি। পরে তারা বীরদর্পে ঘুরে বেরিয়েছে। এটা দেখে কষ্ট হয়েছে আরও বেশি।’
বাসের আলীর জন্ম নওগাঁ জেলার সদর উপজেলার বক্তারপুর গ্রামে। বাবা ফরতুল সরদার, মা আফরোজা বেওয়া। স্ত্রী জিন্নাতুন নেছা। তাঁর শিক্ষাগত বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়নি। তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। মেয়ের নাম সাহেরা বানু। ছেলে নিজ এলাকায় কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। শহীদ বাসের আলীর নামে নওগাঁয় কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই।
স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (পঞ্চম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৬) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
সূত্র: ১৫ জানুয়ারি, ২০১৫ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত