বিজ্ঞাপন
default-image

কুমিল্লা সেনানিবাসের সামরিক হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ডা. এন এ এম জাহাঙ্গীর।

একাত্তরের ৩০ মার্চ কনফারেন্সের কথা বলে পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে নিয়ে যায়। এরপর তাঁর খোঁজ পাওয়া যায়নি।

ধারণা করা হয়, পাকিস্তানি সেনারা সেদিনই অথবা দু-এক দিন পরে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। স্বাধীনতার পর গণকবর থেকে পোশাক দেখে তাঁর দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়।

এ ঘটনার বিবরণ জানা যায় তাঁর স্ত্রী জেবুননিছা জাহাঙ্গীরের আমার স্বামী রচনায়। তিনি লিখেছেন, ‘...৩০ মার্চ সকাল পৌনে ৭টা হবে, আমরা যে বাসায় আশ্রয় নিয়েছি, সেখানে এসে উপস্থিত হলো একটি জীপসহ পাক বাহিনীর দুজন সেপাই।

সেপাইরা জানালো, উর্দ্ধতন কর্মকর্তার নির্দেশে তারা আমার স্বামীকে এসকর্ট করে নিয়ে যেতে এসেছে।...

পাক সেনারা তাকে নিয়ে গেল।...

সকাল ন’টা সাড়ে ন’টা হবে, ...

হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠলো। আমি কাঁপতে কাঁপতে রিসিভার তুললাম, অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো আমার স্বামীর কণ্ঠস্বর।

তিনি জানালেন, ৫৩ আর্টিলারি রেজিমেন্টের অবাঙালি কর্নেল ইয়াকুব মালিক এক কনফারেন্সে তাকে নিয়ে যেতে এসেছে...।

এই তার শেষ কথা।...তারপর আমি তার আর কোনো খোঁজ পাইনি। এরপরই আমাকে বাচ্চাদেরসহ অন্যান্য বাঙালী পরিবারের সাথে ইস্পাহানী পাবলিক স্কুলে বন্দী করা হয়।...

একদিন পাক বাহিনীর কর্নেল ইয়াকুব মালিক এলেন পাবলিক স্কুলে বন্দীদশায় অবস্থানরত বাঙালী পরিবারবর্গকে দেখতে।

আমি সাহস করে এগিয়ে গেলাম তার কাছে, যদি তিনি আমার স্বামীর কোনো খবর দিতে পারেন।

কিন্তু আমার স্বামীর নাম শুনতেই চোখমুখ লাল হয়ে উঠলো কর্নেল ইয়াকুবের। পরে ঠান্ডা মাথায় হত্যাকারীরা যেসব কথা বলে থাকে সেভাবেই বললো, “জাহাঙ্গীর একজন বিদ্রোহী। সে পাকিস্তানীদের ধ্বংস কামনা করতো।

এমনকি ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও সে এই মনোভাব ব্যক্ত করেছে। মৃত্যুই এইসব বিদ্রোহীদের যোগ্যতম শাস্তি।”...

উপরের কথাগুলি আমার ডাইরীর পাতা থেকে নেয়া।’ (স্মৃতি: ১৯৭১, পঞ্চম খণ্ড, প্রকাশ ১৯৯২, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।

এন এ এম জাহাঙ্গীরের স্ত্রীর রচনা থেকে আরও জানা যায়, এন এ এম জাহাঙ্গীর ১৯৭০ সালে চট্টগ্রামের সামরিক আদালতের প্রধান ছিলেন।

তখন অনেক মামলাতেই তিনি দেখতে পান বাঙালিদের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বিদ্বেষপ্রসূত।

অমুসলিম ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো উদ্দেশ্যমূলকভাবে সাজানো।

এর মধ্যে বহুল আলোচিত পাকিস্তানের পতাকায় অগ্নিসংযোগ মামলায় আসামি ছিলেন এম এ আজিজ, অমূল্য বিকাশ সেন প্রমুখ।

তিনি তাঁদের বেকসুর খালাস মঞ্জুর করেন। এ ছাড়া ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর ত্রাণকাজে পশ্চিম পাকিস্তানিদের মনোভাব লক্ষ্য করে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।

এ কারণে তিনি তাদের বিরাগভাজন হন। ২৭ মার্চে ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্স ইউনিটের সকল অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ আসে। এই নির্দেশ তিনি পুরোপুরি পালন করেননি।

বাঙালি সবাইকে নির্দেশ দেন, ‘মৃত্যু যদি অনিবার্য হয় তবে তোমরা তোমাদের হাতের শেষ অস্ত্রগুলো ব্যবহার করে মৃত্যুবরণ করো।

কিন্তু আত্মসমর্পণ করে নিজেদের ও দেশকে কলঙ্কিত করো না।’

এন এ এম জাহাঙ্গীরের জন্ম ১৯৩১ সালের ১৩ মে রাজবাড়ী জেলার পাংশায়। বাবা আবদুল কাদেরও ছিলেন চিকিৎসক। মা জাহানারা বেগম।

পাংশার জর্জ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক (১৯৪৫) ও কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে আইএসসি (১৯৪৭) পাস করেন।

১৯৫৩ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে ওই বছরই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে যোগদান করেন।

১৯৬২ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্যাথলজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান।

চাকরিজীবনের দীর্ঘদিন এন এ এম জাহাঙ্গীর পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭০ সালে তিনি বাংলাদেশে বদলি হয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসে ৪০ ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সের অধিনায়ক (সিও) নিযুক্ত হন।

একই সঙ্গে চট্টগ্রাম বিভাগের বিশেষ সামরিক আদালতের প্রধান ছিলেন।

এন এ এম জাহাঙ্গীর দুই ছেলে ও এক কন্যাসন্তানের জনক। স্বাধীনতার পর তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে পুনঃসমাহিত করা হয় এবং কুমিল্লা সেনানিবাসের প্রধান সড়কের নাম তাঁর নামে রাখা হয়।

স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (তৃতীয় পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৪) থেকে।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান

[email protected]

সূত্র: ৪ ফেব্রুয়ারি , ২০১৫ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত