সমাজ ও রাজনীতিসচেতন ছিলেন গোলাম মোস্তফা। একাত্তরে ঠাকুরগাঁও জেলার (তখন মহকুমা) পীরগঞ্জ কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি সব সময় অস্থিরতায় ছটফট করতেন। স্বাধীনতা যে আসবেই, সে বিষয়ে ছিলেন নিশ্চিত।
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের স্থানীয় লোকজনদের সাহায্য-সহযোগিতা ও সমমনাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৭ এপ্রিলও তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন।
এদিকে এ সময়ই পীরগঞ্জ এলাকায় শুরু হয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আনাগোনা। গোলাম মোস্তফা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল ওই এলাকায় উপস্থিত হয়।
পাকিস্তানি সেনারা রাস্তা থেকে তাঁকে আটক করে। সেনারা সেদিন আরও কয়েকজনকে আটক করেছিল।
পরে তাঁদের সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। গোলাম মোস্তফার বুক গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায়। এর পরও তাঁকে বেয়নেট চার্জও করা হয়েছিল।
এ ঘটনা সম্পর্কে জানা যায় তাঁর মেজো ছেলে মো. আসাদুজ্জামানের কাছ থেকে। তিনি বলেন, ‘শুনেছি আমার বাবা ছোটবেলায় দুরন্ত ছিলেন।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন কাজের মধ্যে দিয়ে সাহসিকতার সাথে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতেন। শিক্ষাজীবনের বেশির ভাগ সময় তিনি দিনাজপুরে কাটান।
কর্মজীবনে তিনি নিজ এলাকায় পীরগঞ্জ কলেজে অধ্যাপনার কাজটি বেছে নেন।
‘শিক্ষক হিসেবে বাবা শিক্ষার্থীদের বেশ প্রিয় ছিলেন। ক্লাসে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি প্রায়ই বলতেন, বাংলাদেশ পাকিস্তানিদের হাতে শোষিত হচ্ছে।
তাঁর এ মনোভাবের কথা তিনি খোলামেলা জানিয়ে প্রকাশ্যেই তাদের বলতেন, শোষকদের বিরুদ্ধে আমাদের কিছু করা দরকার।
ওরা আমাদের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। তোমরা সোচ্চার হও, দেখবে আমরা একদিন স্বাধীন হবোই।
‘১৭ এপ্রিল বাবার কয়েকজন বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী আমাদের বাসায় এসেছিলেন। ওই সময় বাবা বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
তাঁরা বাবাকে বাইরে যেতে বারণ করেছিলেন। আম্মাও নিষেধ করেছিলেন। বাবা তাঁদের বলেছিলেন, কিছু হবে না, এক্ষুনি ফিরে আসব। এই ছিল তাঁর শেষ যাওয়া। বাবা আর ফিরে আসেননি।
‘তার পর থেকে মা বাবার অপেক্ষায় ছিলেন। অনেক সময় পেরিয়ে যাওয়ায় ছোটাছুটি করেছেন খোঁজ নেওয়ার জন্য।
সন্ধ্যা হয়ে গেলেও কোনো খবর না পেয়ে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। পরের দিন গ্রামবাসী খুঁজতে খুঁজতে ছয় মাইল দূরে বাবার বিকৃত মরদেহটি অনেক কষ্টে নিয়ে আসে।
আমরা তখন এতই ছোট যে কিছুই বুঝিনি। মৃত্যু কী তাও জানতাম না। মাকে বাবার মৃতদেহ দেখতে দেওয়া হয়নি।
‘শুনেছি, বাবা বাসা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এলে চৌরাস্তার হোটেল মালিক শহীদুল্লাহ চাচা তাঁকে বলেছিলেন সরে থাকার জন্য।
কিন্তু তিনি জবাব দিয়েছিলেন, কেন থাকব? আমি তো কোনো অন্যায় করিনি। নির্ভীক এই মানুষটি তখনো জানতেন না, পাকিস্তানি সেনারা কতটা নিষ্ঠুর।
তাঁর বুকটা ব্রাশফায়ারে ঝাঁঝরা এবং শরীরটা বেয়নেটের আঘাতে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে।’ (সাক্ষাৎকার ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)।
গোলাম মোস্তফার জন্ম ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ থানা সদরে। ১৯৩৯ সালের ২৩ নভেম্বর। বাবা ফজলুল করিম, মা রমিছা খাতুন।
তিন ভাই ও সাত বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। পড়াশোনার হাতেখড়ি স্থানীয় স্কুলে। পরে দিনাজপুরে মূল লেখাপড়া সম্পন্ন করেন।
১৯৫৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে (বর্তমানে সরকারি কলেজ)।
এখান থেকে ১৯৬০ সালে আইএ ও ১৯৬২ সালে কমার্সে ডিগ্রি পাস করেন। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাকাউন্টিংয়ে ১৯৬৪ সালে মাস্টার্স করে নিজ এলাকা দিনাজপুরের পীরগঞ্জ কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন।
পরে উপাধ্যক্ষ হন। একাত্তরে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন।
গোলাম মোস্তফা তিন ছেলেসন্তানের জনক। বড় ছেলে এস এম আনোয়ার আলী (চাকরিজীবী), মেজো ছেলে মো. আসাদুজ্জামান (শিক্ষক) ও ছোট ছেলে আবুল কালাম আজাদ (চাকরিজীবী)। স্ত্রী আনোয়ারা মোস্তফা।
স্বাধীনতার পর পীরগঞ্জের প্রধান সড়ক তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া পীরগঞ্জ উপজেলার জাবরহাট কলেজের লাইব্রেরি তাঁর নামে নামাঙ্কিত।
প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (সপ্তম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৮) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান।
সূত্র: ১ মার্চ , ২০১৫ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত