বিজ্ঞাপন
default-image

পাবনার এডওয়ার্ড কলেজের প্রভাষক ছিলেন খন্দকার আবুল কাশেম। ১৯৭০ সালে এই কলেজে যোগ দেন। অল্প দিনেই শিক্ষার্থীদের প্রিয় ওঠেন তিনি।

একাত্তরের ৯ সেপ্টেম্বর পাবনা শহরে স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে অসুস্থ মাকে দেখার জন্য বাসে গ্রামের বাড়ি সাঁথিয়া উপজেলার চোমরপুরের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন।

পথে ছোনদহ নামক স্থানে এক সেতুর ওপর বাস থামিয়ে রাজাকাররা তাঁকে নামিয়ে নিয়ে যায়। এরপর তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

এ ঘটনার বিবরণ জানা যায় খন্দকার আবুল কাশেমের স্ত্রী মৌলুদা বেগমের রচনায়। মৌলুদা বেগম লিখেছেন, ‘২৮ আগস্ট (১৯৭১), আমাকে গ্রাম থেকে পাবনাতে নিয়ে এলেন চিকিৎসার জন্য। আমি থাকলাম আমার মা, ভাইবোনদের কাছে...।

৮ সেপ্টেম্বর আমার সাথে দেখা করে বললেন, “আগামীকাল বাড়ি যাব। কলেজ থেকেই যাব, তাই আজই দেখা করে যাচ্ছি।”...পরদিন ৯ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টা।...আমার ছোট বোন হঠাৎ বলে উঠল, “দুলাভাই এতক্ষণ রওনা হয়ে গেছে মনে হয়।” মুখের কথা শেষ না হতেই দরজায় নক।

খুলে দেখি ও। ছোট বোন খুশিতে নেচে উঠল—এই মাত্র আপনার কথা বললাম। দুলাভাই আপনি অনেক দিন বাঁচবেন।

ও হেসে বলল, “দুদিন আগে আরেকজন আমাকে এ কথাই বলেছে। আরে আমি বাঁচব না কেন?”

বলে শ্যালিকার পিঠ চাপড়ে দিলেন। আমাকে বললেন, “হঠাৎ কি মনে হলো, ভাবলাম যাবার আগে আর একবার দেখা করে যাই।...কেন জানি আজ বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না।

তবু যাই, ১২ তারিখ পর্যন্ত ছুটি আছে। মাকেও দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। ১১ তারিখেই ফিরে আসব।”

‘সেই যে গেল, আর ফিরে এলো না। পরে জানা গেছে, বেলা চারটায় ছোনদহ ব্রিজের ওপর বাস থামিয়ে ওকে নিয়ে গেছে।

‘কোথায় নিয়ে গেছে কেউ ঠিক বলতে পারে না। কেউ বলে, নগরবাড়ি আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে গেছে। কেউ বলে, ঢাকায় নিয়ে যেতে দেখেছি, ফেরিতে দেখা হয়েছিল।’ (আমার স্বামী, স্মৃতি: ১৯৭১, ষষ্ঠ খণ্ড, প্রথম প্রকাশ ১৯৯৩, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।

খন্দকার আবুল কাশেমের জন্ম ১৯৪৪ সালের ৩ জানুয়ারি পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার চোমরপুর গ্রামে।

বাবা খন্দকার নবাব আলী স্কুলশিক্ষক ছিলেন। মা সাহেরা খাতুন। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন তিনি।

খন্দকার আবুল কাশেম ১৯৬০ সালে রংপুর জেলার রাজারহাট হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন পাবনার এডওয়ার্ড কলেজে।

এই কলেজ থেকে ১৯৬২ সালে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৬৪ সালে বিএ পাস করেন। ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিপিএড পাস করেন। ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জেনারেল হিস্ট্রিতে মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করেন।

খন্দকার আবুল কাশেমের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৬৬ সালে কাশীনাথপুর এএল হাইস্কুলে শিক্ষকতার মাধ্যমে।

এই স্কুলে তিনি ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। ১৯৭০ সালে পাবনার এডওয়ার্ড মহাবিদ্যালয়ের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।

১৯৬৬ সালে তিনি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অধীনে শর্ট কোর্স ট্রেনিং ইন বেঙ্গলি নামে একটি কোর্স করেন।

১৯৭০ সালের ২ জুন থেকে ১২ জুলাই পর্যন্ত পাকিস্তান ক্যাডেট কোরের ট্রেনিং নেন। ওই বছরের ২২ মে তাঁর বিয়ে হয়। এই বিয়ের ঘটকালি করেছিলেন ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন।

খন্দকার আবুল কাশেম নিখোঁজ হওয়ার এক মাস চার দিন পর (১৪ অক্টোবর ১৯৭১) তাঁর একমাত্র সন্তান খন্দকার সোহেল কাশেমের জন্ম হয়।

সোহেল কাশেম বর্তমানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। স্ত্রী মৌলুদা বেগম স্বাধীনতার পর থেকে শিক্ষকতা করতেন। ২০১২ সালে অবসর নিয়েছেন।

স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (অষ্টম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৯) থেকে।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান

সূত্র: ১৯ জানুয়ারি, ২০১৫ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত